| 29 মার্চ 2024
Categories
গীতরঙ্গ

বাংলা ব্যাকরণের প্রথম প্রণেতা ঢাকার পর্তুগিজ

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট
একজন বিদেশি প্রথম অনুধাবন করেন সুশৃঙ্খল, শুদ্ধ ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে বাংলা ভাষা চর্চার প্রয়োজনীয়তা। আদর্শ মানের ভাষা চর্চা ও ব্যবহারে জন্য যে ব্যাকরণ বা গ্রামারের প্রয়োজন, তা তিনি বুঝেছিলেন। বাংলা ভাষা-র ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন সেই বিদেশি বাংলা প্রেমিক, জাতিতে যিনি ছিলেন পর্তুগিজ। কাজটি তিনি করেছিলেন ঢাকার কাছেই ভাওয়াল অঞ্চলে, ১৭৩৪ সালে।
 
ভাষা চর্চার জন্য অভিধান আর ব্যাকরণের প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাকরণকে বলা হয়ে থাকে ভাষার হাতিয়ার। নিয়ম-রীতি জেনে সঠিকভাবে ভাষা চর্চা করতে হলে ব্যাকরণ জানতে হবেই। হাতিয়ার ছাড়া যেমন কোনো কাজ করা সম্ভব নয়, ব্যাকরণ ছাড়া তেমনি শুদ্ধভাবে ভাষা চর্চা করা অসম্ভব।
 
আসলে ব্যাকরণ হচ্ছে ভাষা ব্যবহার ও প্রয়োগের নিয়মবিধি। ভাষা ব্যবহারে শৃঙ্খলা ও নিয়ম বজায় রাখার কাজটি করে ব্যাকরণ। বাক্য, শব্দ, পদ, লিঙ্গ ইত্যাদি আরো নানা কিছুর সঠিক নির্দেশনা ব্যাকরণে পাওয়া যায়।
 
 
বিভিন্ন ভাষা যেমন পার্থক্য ও বৈচিত্র্যপূর্ণ, সেসব ভাষার ব্যাকরণও তেমনি আলাদা। বাংলা ভাষা যেসব নিয়ম-রীতি মান্য করে, স্প্যানিশ বা আরবি তেমন নয়। ভাষা ভেদে ব্যাকরণও পৃথক বা আলাদা হয়।
 
বাংলা ভাষার নিজস্ব ব্যাকরণের ইতিহাস খুব বেশি প্রাচীন নয়। মুঘল আমলের ক্ষয়িষ্ণু সময়ে বাংলায় বিদেশি বণিক ও ধর্মযাজকদের বিকাশের আমলেই প্রথাগত ব্যাকরণ রচনার সূত্রপাত ঘটে। বিদেশিরা এদেশে এসে ব্যবসা-বাণিজ্য, কাজ-কর্ম করার প্রয়োজনে ভাষা শেখার তাগিদ অনুভব করেন। তখন তারা স্বদেশিদের এদেশে কাজের উপযোগী করার প্রয়েোজনে বাংলা শেখানোর জন্য ম্যানুয়েল আকারে ব্যাকরণ প্রণয়ন শুরু করেন।
 
রাজনৈতিক দিক দিয়ে নাজুক ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে বহিরাগত ইউরোপীয় শক্তির মধ্যে ইংরেজরা ক্ষমতা কব্জা করে। ইংরেজরা বাংলা তথা ভারত দখল করে নানা কিছু করলেও ব্যাকরণ রচনায় প্রথমে আসে একজন পতুর্গিজের নাম।
 
পতুর্গিজ পাদ্রি মনোএল দ্য আসসুম্পসাউ ঢাকার দক্ষিণে ভাওয়াল এলাকার নাগরী নামক খ্রিস্টান পল্লীতে ১৭৩৪ সালে পতুর্গিজ ভাষায় রচনা করেন বাংলা ব্যাকরণ। তার গ্রন্থের দুটি অংশ ছিল। একটি ব্যাকরণ, অন্যটি পর্তুগিজ-বাংলা ও বাংলা-পতুর্গিজ অভিধান।
 
মনোএল-এর কাজটি এদেশে ছাপার সুযোগ সে আমলে ছিল না। তখন সবে মাত্র প্রেস আবিষ্কৃত হয়েছে এবং সামান্য কয়েকটি প্রেস আছে ইউরোপের কিছু দেশে। ফলে ঢাকায় বসে রচনা করা হলেও দশ বছর পর ১৭৪৩ সালে পতুর্গালের রাজধানী লিসবন থেকে সেটি রোমান হরফে ছাপা হয়। কারণ বাংলা হরফ বা টাইপ তখন ছিল কল্পনার বিষয়।
 
বাংলা ভাষার দ্বিতীয় ব্যাকরণ গ্রন্থের প্রণেতাও একজন বিদেশি। তার নাম নাথানিয়েল ব্র্যাসি হলহেড। পর্তুগিজ মনোএল-এর ৩৫ বছর পর ১৭৭৮ সালে হলহেড যে ব্যাকরণ গ্রন্থ প্রকাশ করেন, তা উপমহাদেশের মুদ্রণ ইতিহাসের স্মরণীয় অংশ। কারণ বইটি এদেশে ছাপা হয় এবং এটি মূলত ইংরেজি ভাষায় রচিত হলেও উদাহরণ স্বরূপ কিছু বাংলা হরফও এতে ছাপা হয়।
 
কোনো পুস্তকে প্রথম বারের মতো বাংলা হরফ ছাপানোর কৃতিত্বটিও এখানে দেখা যায়। হলহেডের বইয়ের হাত ধরে সর্বপ্রথম মুদ্রিত হয় বাংলা অক্ষর। এজন্য বাংলা হরফগুলো ছাপার উপযোগী কাঠের ব্লক বানিয়ে ছিলেন চার্লস উইলকিনসন ও পঞ্চানন কর্মকার।
 
পুরো আঠারো শতকে এই দুটি নমুনা ছাড়া ব্যাকরণ রচনার অগ্রগতির ক্ষেত্রে আর কোনো উদাহরণ দেখতে পাওয়া যায় না। পরের শতকে ব্যাকরণ চর্চার পরিস্থিতি বেশ অগ্রসর হয়। ফলে উনিশ শতকে বাংলা ব্যাকরণ লেখার অনেকগুলো নমুনা দেখা যায়। এর কিছু ব্যাকরণ বিদেশি লেখকদের দ্বারা ইংরেজি ভাষায় রচিত। বাকীগুলো স্থানীয় পণ্ডিতদের দ্বারা প্রণীত।
 
সে সময়ের শাসক ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। তাছাড়া কলকাতার অদূরে শ্রীরামপুরে প্রতিষ্ঠিত পাদ্রি উইলিয়ার কেরির ছাপাখানাও বাংলা মুদ্রণ এবং ব্যাকরণ চর্চায় ঐতিহাসিক অবদান রাখে।
 
অবশ্য এসব কাজে তাদের উৎসাহের অন্তর্নিহিত কারণ অকৃত্রিম বাংলা ভাষা প্রেম নয়, তা ছিল (১) রাজনৈতিক ও প্রশাসনের প্রয়োজনে, (২) ব্যবসা-বাণিজ্য-অর্থনৈতিক স্বার্তগত প্রয়োজনে, এবং (৩) খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারের প্রয়োজনে।
 
ইংরেজ আমলে বিদেশি লেখক ও সংস্কৃত পণ্ডিতদের দ্বারা প্রণীত ব্যাকরণ ল্যাটিন এবং সংস্কৃত ভাষার রীতি মেনে রচিত এবং বাংলাকে সে ধাঁচে ফেলে আলোচনা করা হয়। ফলে অনেক কঠিন নিয়ম তখন বাংলা ব্যবহারে চাপিয়ে দেওয়া হয়। শব্দ গঠন, বাক্য গঠনে বিদ্যমান থাকে অনেক প্রাচীন রীতি। ক্রমে ক্রমে ভাষা ব্যবহার বিধিতে জটিলতা এড়িয়ে অনেক নিয়ম সহজ করা হয়, যা এখনো হচ্ছে।
 
ব্যাকরণ যেমন ভাষা ব্যবহারের নিয়ম নির্ধারণ করে, তেমনি মানুষ ও সমাজ তাদের ভাষা চর্চায় দীর্ঘকাল যাবত অন্তর্ভুক্ত অনেক কিছুকেই ব্যাকরণ-সিদ্ধ করে নেয়। ফলে ব্যাকরণকে অনঢ় বা স্থবির হলে চলে না। কিংবা উপর থেকে চাপিয়ে দিলেও কাজ হয় না। ব্যাকরণকে মানুষ ও সমাজে প্রচলিত ভাষার গতি-প্রকৃতি ও মনোভাবটিকেও আত্মস্থ করতে হয়। এ কারণেই ব্যাকরণ একটি জীবন্ত ভাষার জন্য নিজেকে জীবন্ত রাখতে বাধ্য হয়। সময় সময় নানা পরিবর্তন ও অদল-বদল মেনে নিতেও হয় ব্যাকরণকে।
 
ঢাকায় ভাষা আন্দোলনের কারণে এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলা ভাষার যেমন অভূতপূর্ব বিকাশ সাধিত হয়েছে, তেমনি ব্যাকরণেও বিদেশি প্রভাব অনেকাংশে লুপ্ত হয়েছে। বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তরফে ভাষা চর্চার নির্দেশনামূলক সহজ ও বোধগম্য ব্যাকরণ প্রণীত হচ্ছে। এখন হাতের কাছে পাওয়া যাচ্ছে একাধিক ব্যাকরণ গ্রন্থ। ইচ্ছে করলেই যে কেউ ব্যাকরণ অনুসরণ করে পরিশীলিত ও শুদ্ধ বাংলা চর্চা করতে পারেন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত