অসমিয়া অনুবাদ উপন্যাস: অর্থ (পর্ব-৩৪) । ধ্রুবজ্যোতি বরা
ডক্টর ধ্রুবজ্যোতি বরা পেশায় চিকিৎসক,অসমিয়া সাহিত্যের একজন স্বনামধন্য লেখক ২৭ নভেম্বর ১৯৫৫ সনে শিলংয়ে জন্মগ্রহণ করেন ।শ্রীবরা ছাত্র জীবনে অসম্ভব মেধাবী ছাত্র ছিলেন ।’কালান্তরর গদ্য’ ,’তেজর এন্ধার‘আরু’অর্থ’এই ত্রয়ী উপন্যাসের লেখক হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত। ২০০৯ সনে ‘ কথা রত্নাকর’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য আকাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। বাকি উপন্যাসগুলি ‘ভোক’,’লোহা’,’যাত্রিক আরু অন্যান্য’ ইত্যাদি।ইতিহাস বিষয়ক মূল্যবান বই ‘রুশমহাবিপ্লব’দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ’,’ফরাসি বিপ্লব’,’মোয়ামরীয়া বিদ্রোহ’।শ্রীবরার গল্প উপন্যাস হিন্দি, ইংরেজি, বাংলা, মালয়ালাম এবং বড়ো ভাষায় অনূদিত হয়েছে।আকাডেমিক রিসার্চ জার্নাল’যাত্রা’র সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন ।’ কালান্তরর গদ্য’ উপন্যাসের জন্য ২০০১ সনে অসম সাহিত্য সভার ‘ আম্বিকাগিরি রায়চৌধুরি’ পুরস্কার লাভ করেন।শ্রীবরা অসম সাহিত্য সভার প্রাক্তন সভাপতি।
অনুবাদকের কথা
কালান্তর ট্রিলজির তৃতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস হল’অর্থ’। সশস্ত্র হিংসার পটভূমি এবং ফলশ্রুতিতে সমাজ জীবনের দ্রুত অবক্ষয়ের মধ্যে বেঁচে থাকার তাড়না এবং বেঁচে থাকার পথ অন্বেষণেই আলোচ্য উপন্যাসের কাহিনী ভাগ গড়ে তুলেছে। সম্পূর্ণ পৃথক একটি দৃষ্টিকোণ থেকে এখানে অসমের মানুষ কাটিয়ে আসা এক অস্থির সময়ের ছবি আঁকার চেষ্টা করা হয়েছে। মানুষের অন্বেষণ চিরন্তন এবং সেই জন্যই লেখক মানুষ– কেবল মানুষের উপর আস্থা স্থাপন করতে পারে।
এবার উপন্যাসটির বাংলা অনুবাদ নিয়ে এলাম।আশা করি ইরাবতীর পাঠকেরা এই ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত অসাধারণ উপন্যাসটিকে সাদরে বরণ করে নেবে। নমস্কার।
বাসুদেব দাস,কলকাতা।
‘হে তথাগত,’ মহাপ্রজাপতি গৌতমী বুদ্ধকে বলছিল, ’ পরম জ্ঞান লাভ করে আপনি যে নতুন ধর্মপ্রবর্তন করেছেন, সেই সত্য এবং আনন্দের পৃথিবীতে আপনি নারীদের প্রবেশাধিকার দেননি। মানবজাতির এক বৃহৎ অংশ এভাবে জ্ঞানের আলো প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়ে রয়েছে। তাই হে তথাগত, নারীদেরও প্রব্রাজিকা রূপে এই অনুশাসনে প্রবেশের অধিকার দেওয়া উচিত।’
গয়ায় জ্ঞান প্রাপ্তির পরে সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধ হয়ে সেই প্রথমবারের জন্য শাক্যদের মধ্যে এসেছিলেন । দলে দলে শাক্য পুরুষ তার কাছে গিয়ে শরণ নিয়ে ছিল। অনেকে সংসার ত্যাগী ভিক্ষু হয়ে সংঘে প্রবেশ করেছিল, অনেকে গৃহধর্ম বজায় রেখে হয়েছিল সাধারণ উপাসক।
আর সেই সময়েই বুদ্ধের নিজের মাসি গৌতমী তার সামনে এই অনুরোধ করেছিল। জন্মের সাত দিন পরেই মাতৃহারা হওয়া গৌতমকে নিজের মাসি গৌতমী লালন পালন করেছিল।
বুদ্ধ কিন্তু মহাপজাপতি গৌতমীীর অনুরোধ তখন মেনে নেন নি।
‘এই ধরনের চিন্তা তোমার মনে স্থান দেবে না গৌতমী।’তিনবার অনুরোধের উত্তরে বুদ্ধ তিনবার একই উত্তর দিয়েছিল।বিফল মনোরথ হয়ে গৌতমী সেবার ফিরে গিয়েছিল।
কিন্তু শাক্য মহিলারা বুদ্ধের বাধা মানতে প্রস্তুত ছিলেন না। বুদ্ধ নিগূঢ়ধর্মা নামের জায়গা ছেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের কয়েকজন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে তারা ভিক্ষুণী হবেই।বুদ্ধ যাতে তাদের বারণ করতে না পারে সেই জন্য তারা বুদ্ধের সম্মুখীন হওয়ার সময় এবার ভিক্ষুণীর রূপ ধরে যাওয়ার স্থির করলেন।মহাপ্রজাপতি গৌতমী এবার নিজের চুলের গোছা ছোটো করে কেটে ফেললেন, দেহের রাজকীয় বেশভূষা ত্যাগ করে তিনি পরে নিলেন ভিক্ষুণীর গেরুয়া বসন।তারপরে একইভাবে সজ্জিত অন্য কয়েকজন শাক্য নারীর সঙ্গে তিনি বুদ্ধের খুঁজে বের হলেন। যেতে যেতে তারা বৈশালীর মহা বনের মাঝখানে কুটাগরা সভাগৃহে গৌতম বুদ্ধকে তার ভিক্ষুদের সঙ্গে খুঁজে পেলেন।। গৌতমী পুনরায় বুদ্ধকে অনুরোধ করলেন ‘হে তথাগত আজ্ঞা দিন, আজ্ঞা দিন।’
বুদ্ধ পুনরায় আগের মতোই উত্তর দিলেন।
পুনরায় বিফল মনোরথ হয়ে মহাপ্রজাপতি, গৌতমী মহাবনের কুটাগরা সভাগৃহের সামনে দুঃখিত মনে অপেক্ষা করছিলেন। ঠিক তখনই বুদ্ধের একজন প্রধান শিষ্য আনন্দ প্রজাপতি গৌতমীকে দেখতে পেয়ে চিনতে পারলেন।
‘ আপনি এই বেশে, মহা প্রজাপতি গৌতমী? এই জীর্ণ বস্ত্র পরে, পথের ধুলিতে ধূসরিত হয়ে আপনি এখানে কি করছেন?’
‘ হে আনন্দ, দেখ তোমার তথাগতকে দেখ,’মহাপ্রজাপতি বললেন,’তিনি মহিলাদের গৃহত্যাগী হয়ে ভিক্ষুণী হওয়ার অনুমতি দিচ্ছেন না। তাই আমি কী করব বুঝতে না পেরে এখানে দুঃখিত মনে অপেক্ষা করছি। ‘
আনন্দ গৌতমীকে সেখানে অপেক্ষা করতে বলে সভাগৃহের ভেতরে গেলেন এবং বুদ্ধের চরণে প্রণাম জানিয়ে গৌতমীর কথা বললেন,’ মহা প্রজাপ্রতি গৌতমী মাথার চুলটুল কেটে জীর্ণ বস্ত্র পরিধান করে পথের ধুলায় এসে সভাগৃহের বাইরে অপেক্ষা করছেন ।দুঃখে তার চোখের জলের ধারা বয়ে যাচ্ছে,কেননা তথাগত মহিলাদের গৃহত্যাগ করে তার দ্বারা প্রবর্তিত ধর্মের অনুশাসনে ভিক্ষুণী হিসেবে যোগদান করার জন্য অনুমতি দিচ্ছেন না। হে তথাগত, নারীদেরও এই ধর্মের অনুশাসনের ভেতরে গৃহত্যাগ করে ভিক্ষুণী হওয়ার অনুমতি দেওয়া উচিত হবে।’
বুদ্ধ বললেন,’ আনন্দ এরকম চিন্তা মনের মধ্যে আনবে না।’
তিনবার আনন্দ অনুরোধ জানাল। তিনবারই বুদ্ধ একই উত্তর দিলেন।।
‘কিন্তু এর কারণ কি?’ আনন্দ ছেড়ে দিল না। ‘হে তথাগত, ব্রাহ্মণরা বলে যে শূদ্র এবং নারী পবিত্র নয়, তাই তারা মোক্ষলাভ করতে পারে না।তাই তাদের পরিব্রাজক হতেও দেওয়া হয় না। এই ধরনে তথাগত ভাবেন কি? শূদ্রকে তো ইতিমধ্যেই তো ভিক্ষুর সংঘে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তাহলে নারীকে কেন বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে? নারীরা নির্বাণ লাভের জন্য উপযুক্ত নয় কি?’
‘ আমাকে তুমি ভুল বোঝনা আনন্দ’ বুদ্ধ বললেন। নির্বাণ লাভের জন্য নারী পুরুষ দুজনই সক্ষম। দুজনের এই ক্ষেত্রে সমান অধিকারও আছে ।আমি বাধা দেওয়ার কারণটা সম্পূর্ণ ব্যবহারিক।
‘কিন্তু,হে তথাগত,কেবলমাত্র ব্যবহারিক কারণে নারীদের ভিক্ষু সংঘে প্রবেশাধিকার না দেওয়াটা উচিত হবে না। এরকম করলে এই ধর্ম নারীর ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক নীতি গ্রহণ করা বলে সমালোচিত হবে না কি? ব্যবহারিক কারণগুলি অতিক্রম করার জন্য তথাগত নিয়ম বেধে দিতে পারে নাকি?’
এইবার বুদ্ধ আনন্দের কথায় সম্মতি দিলেন।’ আমি মহাপ্রজাপতি গৌতমীকে আমার দ্বারা প্রবর্তিত ধর্মের অধীনে নারীদেরকেও গৃহত্যাগী হয়ে পরিব্রাজ্য গ্রহণ করার জন্য সম্মতি দিতে পারি, কিন্তু তারা আটটা শর্ত মেনে চলতে হবে এবং এই আটটি শর্ত তাদের ক্ষেত্রে প্রচলন করার জন্য মহাপ্রজাপতি গৌতমীকে দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে।
মহা প্রজাপতি এই আটটি শর্ত মেনে নিলেন।
আর তখন বৌদ্ধ ধর্মের সংঘে নারীকে প্রবেশাধিকার দেওয়া হল।
প্রজাপতি গৌতমী হলেন প্রথম ভিক্ষুণী।
আর এভাবেই বৌদ্ধ ভিক্ষুণী সংঘের জন্ম হল।
আমরা সকালবেলায় চা জল পান খেয়ে যাত্রা আরম্ভ করেছিলাম।
ভাঙ্গা জিপে উঠে আরম্ভ করা যাত্রা একপ্রকার অ্যাডভেঞ্চারের মতোই মনে হয়েছিল। ড্রাইভারকে যখন বলেছিলাম যে আমরা পথের বৌদ্ধবিহারটাতে ঢুকে যাব, সে বলল রাস্তায় তো কোনো বৌদ্ধবিহার নেই।
‘বৌদ্ধ বিহার নেই, আমরা নিজে দেখেছি।
‘কোথায়, কোথায় দেখেছেন?’
ওই যে নিচে’, তাকে যেদিকে বৌদ্ধ বিহারটা দেখেছিলাম সেদিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলাম।সে গাড়ি থামিয়ে দেখল।আমরাও নামলাম। কিন্তু সেদিকে তো আমরা কোনো বৌদ্ধ বিহার দেখতে পেলাম না। এদিকে ওদিকে তাকালাম, ও হো বহুদূরে ক্রমে নেমে যাওয়া পাহাড়গুলি দেখা যায়। কিন্তু চোখে দেখা কোনো দিকেই বৌদ্ধবিহার দেখতে পেলাম না। কী হল কোথায় গেল সেই বিহার? আমাদের নিজেদেরই দিক ভুল হয়েছে বলে মনে হল। ড্রাইভার এতদিন এই পথ দিয়ে যাওয়া আসা করছে সে তো কখনও কোথাও বিহার দেখেনি। আমরা ইতিমধ্যে বেশ ক্যাম্প থেকে কিছুটা দূরে নেমে এসেছিলাম।এবার আমরা জিপ ঘুরিয়ে পুনরায় উপর দিকে ফিরে গেলাম। উপরে জিপ রেখে দূরবীন বের করে গতকাল পায়ে হেঁটে বেড়ানো পথে বেরিয়ে গিয়ে পুনরায় দেখতে লাগলাম। অদৃশ্য হওয়া বিহারটা এবার পুনরায় চোখে পড়ল। হ্যাঁ হ্যাঁ, বৌদ্ধ বিহারই,দূরবীন দিয়ে আমরা পুনরায় লাল কাপড় পরা লামাদের দেখতে পেলাম। ড্রাইভারকে দেখানোর পরে অনেকক্ষণ মনোযোগের সঙ্গে সে দেখে বলল যে ওটা বৌদ্ধ বিহারই হবে কিন্তু আগে সে কখনও সেটা দেখেনি, কোন দিক দিয়ে সেখানে যেতে হয় সেটাও জানে না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সে বলল যে আমরা যাওয়া পথটা থেকে একটা পাথর দেওয়া রাস্তা বাঁক নিয়েছে— সেদিকে দুটি গ্রাম আছে বলে সে জানে। মূল রাস্তা থেকে কিছু দূরে, হয়তো সেই গ্রামের দিকে বিহারটা হবে।
আরো পড়ুন: অর্থ (পর্ব-৩৩) । ধ্রুবজ্যোতি বরা
দূরবীনের মধ্য দিয়ে পুনরায় দেখছিলাম। হ্যাঁ, দূরে গ্রামের মতো ছোটো ছোটো ঘর দেখা যাচ্ছে। টিনের চালে রোদ পড়ে গাছপালার মধ্য দিয়ে জ্বলজ্বল করছিল।
হ্যাঁ, সেই গ্রামের কাছে বিহার হবে। আমরা সেই পথে যাব।’ ড্রাইভারকে বললাম।
আমরা দ্রুত এসে পুনরায় জিপে উঠলাম।
‘ আসলে সেই জায়গাটা ম্যাকলর থেকে খুব বেশি দূর নয়,’, ড্রাইভার বলল। সেদিকেও তিব্বতি শরণার্থীর সেটেলমেন্ট আছে।’
‘চলো সেখানে যাই।’
আমরা এবার রাস্তাটা দিয়ে বেশ দ্রুত নেমে এলাম।
চারপাশের উঁচু উঁচু পর্বত, দেবদারু অরণ্য, প্রস্তর ভূমি পথের পাশে পর্বতের সুরঙ্গ দিয়ে আসা খরস্রোতা ঝর্ণার রূপ চোখের সামনে মুহূর্তে মুহূর্তে পরিবর্তন হতে শুরু করেছিল। মেয়েটি প্রায় পাশেই বসে ছিল জিপের কাছের সিটটাতে, তার চোখ পর্বতের বুকে নিবদ্ধ।
একটা সময়ে আমরা এসে মূল পথটা থেকে পৃথক হয়ে যাওয়া রাস্তাটা পেয়েছিলাম। পাথর বিছানো একটা পথ, কোনোমতে একটা গাড়ি যেতে পারে।
‘তোমার গাড়ি যাবে তো?’ ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম।
‘ যাবে স্যার,কেন যাবে না,’ সে চট করে উত্তর দিল।
‘এখান থেকে কতটা দূর হবে?’ মেয়েটি জিজ্ঞেস করেছিল।
‘ কতদূর হবে তা তো বলতে পারব না,’ ড্রাইভার বলল। গেলে তবেই বুঝতে পারা যাবে। খুব বেশি দূর হবে না বলে মনে হয়’
রাস্তাটা দিয়ে একজন মানুষ বেরিয়ে এসেছিল। আমরা তাকে জিজ্ঞেস করলাম।
এদিক দিয়ে বৌদ্ধ বিহারে যাওয়া যায় কি?’
‘ যায়।’ তিনি মাথা নেড়ে জানিয়েছিলেন।
‘ কতদূর?’
‘ বেশি দূর নয়। দুই তিন কিলোমিটার হবে।’
‘ গাড়ি যায়?’
‘ যায়। ভালোভাবে যায়। সাবধানে যাবেন কিন্তু,বৃষ্টির পরে কিছুটা পিছল হয়ে থাকতে পারে।’
‘ খুব বড়ো বিহার নাকি?’ মানুষটাকে এমনিতেই জিজ্ঞেস করলাম।
‘ বড় বিহার, তিনি বললেন।’ ভালো লাগবে। পাশের গ্রামে তিব্বতি হস্তশিল্পের একটা কেন্দ্র আছে। দেখতে পারেন। সেখানে অনেক জিনিসপত্র কিনতে পারেন।’
‘অনেক ভিক্ষু থাকে নাকি বিহারে?’
‘ভিক্ষু থাকে না।’
‘ ভিক্ষুক থাকে না?’
‘ ওহো, ওটা বৌদ্ধ ভিক্ষুণীদের বিহার। কিন্তু আপনারা সেখানে যেতে পারবেন। মানুষ সেখানে যায়।’
‘ সেখানে ভিক্ষুণীরা থাকে ?’মেয়েটি এবার বড়ো আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল। তার চোখ দুটি উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করে উঠল।
‘ হ্যাঁ ,সেটা ভিক্ষুণীদের বিহার,’লোকটি বলল। ‘আমিই আপনাদের নিয়ে যেতাম, কিন্তু আমার ম্যাকলোডগঞ্জে একটা জরুরী কাজ আছে। বাস এসে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে।’ মানুষটা ঘড়ির দিকে তাকাল।
আমরা তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে জিপ স্টার্ট দিয়েছিলাম। উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ দিয়ে আমাদের গাড়ি বিহার অভিমুখে এগিয়ে চলল।
হাত দুটি দিয়ে মুখটা ঢেকে মেয়েটি বলে উঠেছিল,
‘ এই ভিক্ষুণীদের বিষয়ে আমার জানতে এত ইচ্ছা করছিল।ইস এবার আমার ইচ্ছা পূরণ হল। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ, অনেক ধন্যবাদ। ইস আমার যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। আমরা সত্যিই ভিক্ষুণীদের বিহারে যাচ্ছি তাই না?’
মেয়েটির আনন্দ দেখে আমার মনটাও ভালো হয়ে গেল।
বৌদ্ধ ভিক্ষুণী সংঘের প্রতিষ্ঠার কাহিনিটা আমরা সেই বিহারে জানতে পেরেছিলাম। ভিক্ষুণীরা বেশ আগ্রহের সঙ্গে আমাদের আপ্যায়ন জানিয়েছিল।
বাইরের মানুষ বিশেষ করে পুরুষ কেউ গেলে বসানোর জন্য তাদের বিহারের বাইরে একটা ছোটো দুই রুমের ঘর ছিল। একটি ঘর কার্যালয়ের মতো, সেখানে একজন ভিক্ষুণী একটা বেটে টেবিল সামনে নিয়ে মাটিতে বসে বসে একটাতে কিছু লিখছিল। অন্য ঘরটিতে পীরের মতো গদি দেওয়া আসনের সামনে ছোট ছোট টেবিল দিয়ে অতিথির জন্য সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা ছিল। আমরা গিয়ে সেখানে বসে ছিলাম। কাপড়-চোপড় আসবাবপত্রগুলি পুরনো প্রায় খসে যাওয়া কিন্তু অত্যন্ত পরিষ্কার এবং পরিপাটি। দেওয়ালে কয়েকটি টংখা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল।
ভিক্ষুণীটির সঙ্গে কথা বলে মেয়েটি উৎফুল্ল হয়ে পড়েছিল।
আমি কিছুক্ষণ এটা ওটা দেখে বাইরে থেকে আসছি বলে বেরিয়ে এসেছিলাম। কেন্দ্রটাতে গিয়েছিলাম। সেখানে বিভিন্ন তিব্বতি জিনিস বানানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এবং বিক্রির জন্য তৈরি করা হয়। পাশেই টংখা বা তিব্বতি ধর্মীয় ফটোচিত্র আঁকা শেখানোর জন্য একটা প্রতিষ্ঠান ছিল। প্রতিষ্ঠানটা বন্ধ ছিল। হস্তশিল্প কেন্দ্রটিতে একটি খুব কোমল এবং পাতলা উলের গলা বন্ধ পেলাম। ছোটো একটি শালের মতো শক্ত লাল রঙের গলা বন্ধ একটা হাতে নিয়েই ভালো লাগল। দাম যথেষ্ট। তথাপি কেন জানি মেয়েটির জন্য নিতে ইচ্ছা হল। দামদর করে কিনে নিলাম। একটা কাগজের থলেতে গলা বন্ধটা নিয়ে বিহারের বাইরে আমি টহল দিতে শুরু করেছিলাম।
মেয়েটির কোনো দেখা-সাক্ষাৎ নেই।।সে যে বিহারের ভেতরে ঢুকলো তো ঢুকেছেই বের হওয়ার কোনো নাম গন্ধ নেই।। কোনো খবর নেই।। এদিকে ক্ষুধায় পেট জ্বলে যাচ্ছিল। একটু অধৈর্য হয়ে পড়েছিলাম, রাগ হচ্ছিল।গাড়ির কাছে গিয়ে দেখি নেই ড্রাইভার নেই। সেও বোধহয় গ্রামের দিকে চলে গিয়েছিল।। আমিও তার খোঁজে যাব কিনা ভাবছিলাম।। গ্রামে খাওয়ার জিনিস পাওয়া যেতে পারে। সে সম্ভবত সেদিকেই গেছে ।ঠিক তখনই মনে হল নানী দিয়ে পাঠানো পুঁটলিটির কথা।খুলে দেখি তার মধ্যে খাবার জিনিস তো আছেই সঙ্গে ছোটো ফ্লাক্স একটাও আছে।। হ্যাঁ, এই ফ্লাক্সটা আমাদের অফিসে ছিল–প্রায় বিবর্ণ হয়ে পড়া একটা ফ্লাক্স। গাড়িটা পথের পাশে দাঁড় করানো ছিল। আমি গাড়িটার আড়ালে খাবার জিনিস আর চায়ের ফ্লাক্স নিয়ে ঘাসের মধ্যে বসে পড়লাম।তারপরে নানী দিয়ে পাঠানো সুন্দর পরোটা আলু ভাজা ডিম সিদ্ধ এবং চা সহকারে খুব ভালো করে দুপুরের আহার করেছিলাম।আমার সামনে ছিল নিচে নেমে যাওয়া পর্বতমালার অপূর্ব নয়নাভিরাম দৃশ্য। সেই দৃশ্য দেখতে দেখতে নানী বেঁধে দেওয়া পাঠানো প্রচুর খাওয়ার জিনিসের অনেকটাই একা খেয়েছিলাম।। জিনিসগুলি সামলে সুমলে রেখে পুনরায় সেই পথের পাশে ঘাসে বসে পড়েছিলাম।। একটা সিগারেট জ্বালিয়ে নিয়ে আমেজ করে ঘাসে পিঠ রেখে দিয়ে পায়ের উপরে পা তুলে দিয়ে মৌজ করছিলাম। একা একা পিকনিকে এসেছিলাম বলে মনে হচ্ছিল।।
বিহারের ভেতরে মেয়েটি কি করছে? এত কী কথা বলছে?ভিক্ষুণীগুলিও খুব কথা বলে। এত সুন্দর করে বৌদ্ধ ভিক্ষুণী সংঘের প্রতিষ্ঠার কথা বলল– -একেবারে রূপকথার গল্পের মতো। কিন্তু বৌদ্ধ মহাপ্রজাপতি গৌতমীকে দেওয়া আটটা শর্ত কী ছিল সে কথা জিজ্ঞেস করা হল না ।।
মেয়েটি কী কথা বলছে? কী এত বলার মতো আছে? ভালো ভিক্ষুণী খুঁজে পেয়েছে !মেয়েটির উপরে আমার রাগ হচ্ছিল।
মনে পড়ল কোমল উলের স্কার্ফটার কথা —ইস গাঢ় লাল রঙটি মেয়েটিকে এত মানাবে।
কিন্তু তাকে কীভাবে দেব স্কার্ফটা?কী বলে দেব?কোনো কথায় খারাপ পায় যদি?
হয়তো, হয়তো মেয়েটি খারাপ পাবে না। খারাপ পাওয়ার কোনো কথাই তো নেই। কিছু আছে কি!
মেয়েটি আমার চেয়ে বয়সে বড়ো হতে পারে– ঘাসে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম। হয়তো এক দুই বছরের বড়ো হবে, বা একই বয়সেরও হতে পারে,বা এক বছরের ছোটোও হতে পারে ।আমার বয়সের হওয়া মানে আসলে বুড়ি, আমার তো বয়স কম নয়। হ্যাঁ। খুব একটা কম বয়স নয় আমর।সেই রমেনটা—তার তো চুল পেকেছেই।সে কলপ লাগাতে শুরু করেছে—শালা বুড়ো–এতদিন তার খবর নেই। আমার হঠাৎ রমেনের ওপর রাগ হয়েছিল।আচ্ছা এই মেয়েটির কথা জানতে পারলে রমেন কি বলবে? শালা, অসভ্য কোথাকার।ভালো কথা তো তার মুখ দিয়ে বের হয় না।
সত্যি গাঢ় লাল গলাবন্ধটায় মেয়েটিকে খুব সুন্দর দেখাবে।গলা বন্ধ নয়, আসলে একটি ছোটোখাটো আলোয়ানই।সেই জন্য আরও সুন্দর কাপড়টা। সেই লাল গলাবন্ধটা গলায় ঘিরে নিলে তার সাদা কোমল মুখটা, দুটো গভীর কুয়োর মতো বিষাদ ঘন চোখ জোড়া, কপাল পর্যন্ত উজিয়ে আসা রুপালি ফ্রেমের চশমার পেছনদিকে বাতাসে নাচতে থাকা অবিন্যস্ত চুলগুলি, আর আধপাকা ননীর মতো তার মিহি রসাল ঠোঁট জোড়া –এই সবগুলোই আরও মোহনীয় হয়ে পড়বে…
মেয়েটি সেই গাঢ় লাল রঙের গলাবন্ধটা পেয়ে খুশি হবে কি?নেবে কি? নিয়ে গলায় পড়বে কি? এই বিশাল ধোলাধার পর্বতমালার সামনে এই ঘন দেবদারু এবং অরণ্যের সামনে হিমালয়ের ফুরফুরে শীতল বাতাসে তার গলার ভারী লাল গলাবন্ধটার সামনেটা উড়তে থাকবে পতাকার মতো আর তার চোখ জোড়া আরও গভীর হয়ে পড়বে আর গভীর রহস্যঘন কুয়োর মতো…
জীবনের দুঃখ কষ্টই হল এই পৃথিবীর চরম সত্য— আর এই দুঃখ-কষ্টের অবসানের চেষ্টাই হল মানব জীবনের লক্ষ্য– জীবনের সৎ কাজের দ্বারা নিজের এবং অন্যের কষ্ট মোচন সম্ভবপর— বৌদ্ধ ধর্মের বিষয়ে শুনে শেখা এই কথাটা হঠাৎ আমার মনে পড়েছিল। আর ধীরে ধীরে আমার মনে মেয়েটির প্রতি এক গভীর অনুকম্পা, একটা করুণার ভাব জেগে উঠেছিল। কিন্তু আমি কিছুক্ষণ পরে এটা অনুভব করেছিলাম যে এই অনুকম্পা– করুণার সঙ্গে মেয়েটির প্রতি আমি একই সঙ্গে অনুভব করছিলাম এক সুতীব্র জৈবিক আকর্ষণ
গায়ে ধরে কেউ ধীরে ধীরে নাড়িয়ে দেওয়ায় আমি ধড়মড় করে উঠে বসে ছিলাম।মেয়েটি হাসতে হাসতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। প্রথমে আমি কী হল কোথায় আছি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।’
তোমার এত খোঁজ করছিলাম কোথায় গিয়েছিলে।? ভিক্ষুণীরা গ্রামের দিকেও খবর করিয়েছিল তারা তোমার খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল। তুমি চুপি চুপি এখানে এসে শুয়ে আছ।’
‘ড্রাইভারটা– সে কোথায় গেল?’
সে গ্রামের পরিচিত মানুষের বাড়িতে যাচ্ছে বলে খবর দিয়ে গিয়েছিল। এখন এসেছে। তুমি কিছু খেয়েছো কি?’
‘খেয়েছি,’এক বোতল খাওয়ার জল দিয়ে চোখমুখ ধুয়ে উত্তর দিয়েছিল।’ নানী পরোটা চা সব পাঠিয়ে দিয়েছিল। তোমাদের জন্য রাখা আছে।’
‘ আমি ডাল এবং লাই শাকের ভাজা দিয়ে ভাত খেলাম।’ মেয়েটি বলল।’ এত সুন্দর রেধেছিল ভিক্ষুণীরা। তোমারও খুব খোঁজ করেছিল। পেল .না। আমি বেরিয়ে এলাম না। বেরিয়ে এলে নিশ্চই পেয়ে যেতাম।
‘ এখন তো আমরা যেতে পারি?’ মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম।
‘চলো যাই। ড্রাইভারটা আসছে। সে গ্রামে গিয়ে খেয়ে দেয়ে তোমার মতোই এক ঘুম দিয়ে নিয়ে… চোখ মুখ ফুলিয়ে এসেছে। সে বোধহয় বিছানায় শুয়েছে আর তুমি মাটিতে শুলে।
মেয়েটি আমার সোয়েটারের পেছন দিকে লেগে থাকা ঘাস বনগুলি হাত দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছিল। তার হাতটা আমার গায়ে লাগায় আমার একটা অদ্ভুত শিহরণ হচ্ছিল, বড়ো আনন্দদায়ক ছিল সেই শিহরণের অনুভূতি। তাকে একবার কোমল ভাবে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করেছিল।কিন্তু তার চোখের দিকে তাকাতে আমার সংকোচ হচ্ছিল। লজ্জা লাগছিল– কে জানে আমার মুখে মনের ভাব যদি তার চোখে ধরা পড়ে যায়।
নেমে আসার সময় সারাটা রাস্তা মেয়েটি প্রায় নীরব হয়ে এসেছিল।
আমরা ক্রমে কাংরা উপত্যকায় নেমে এলাম।ধর্মশালা পেয়ে পুনরায় মেকলতে উঠে যেতে হবে।
পথে একটা ধাবায় চা খাবার জন্য ঢুকতেই নানী দিয়ে পাঠানো খাবার জিনিসগুলি বের করে তাকে দিলাম, ড্রাইভারকে দিয়েছিলাম। মেয়েটি প্রায় খেলই না।ইঁদুরের মতো খুঁটে খুঁটে ছিঁড়ে নিয়ে একটু একটু করে মুখে দিচ্ছিল মাত্র।
‘ খেতে ইচ্ছা করছে না?’ ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। ইচ্ছা না হলে শুধুমাত্র চা খাও।’
‘ আমার মনটা ভারী হয়ে এসেছে বুঝেছ,’ মেয়েটি ধীরে ধীরে বলতে শুরু করেছিল।’ এই ভিক্ষুণীদের সঙ্গে দেখা হয়ে আমার মন ভরে গেছে। জীবনটাকে মানুষ অনেক আলাদা আলাদা ভাবে অর্থবহ করে তুলতে পারে, নয় কি? অনেক আলাদা আলাদা ধরনে…
অনুবাদক