| 28 মার্চ 2024
Categories
ধারাবাহিক

ইরাবতী ধারাবাহিক: একাকিনী (পর্ব-৭) । রোহিণী ধর্মপাল

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

সভাগৃহে, সবার সামনে, কর্ণ যখন বলে উঠলেন, “তুমি তো পাঁচ জনের স্ত্রী। পাঁচ জন মিলে যাকে ভোগ করতে পারে, সে তো বেশ্যাই। দুঃশাসন, পাণ্ডবদের সঙ্গে এই বেশ্যাকেও বিবস্ত্র করতেই পারো”– তখন দ্রৌপদীর এক মুহূর্তের জন্য সেই প্রত্যাখ্যান মনে পড়েছিল। বনবাস পর্বে, এমন একটা রাত যায় নি, যে রাতে দ্রৌপদীর মনে নিজের দুঃসহ অপমান দুঃস্বপ্নের মতো ফিরে ফিরে আসে নি! সেই সময়েও দ্রৌপদী অনেক ভেবেছেন। কর্ণকে তিনি না বলেছিলেন। সেটা তো তাঁর অধিকার। আর অধিকারের সীমার মধ্যেই ছিলেন বলে, তাঁর সেই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ কেউ করতে পারেন নি। এমনকী কর্ণ নিজেও না। কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে, যে নিজের মনে সেই রাগ পুষে রেখেছিলেন! এতদিন ধরে! আর কীভাবে সেই রাগের প্রকাশ হল!! নাকি কর্ণ তাঁকে ভালো বেসে ফেলেছিলেন! তাই প্রত্যাখ্যান সহ্য করতে পারেন নি! কিন্তু ভালোবাসার প্রকাশ কখনো এমন ভয়ানক হতে পারে? প্রথম কথা ভালো বাসলেনই বা কখন? একমাত্র ওই স্বয়ংবর সভায় কিছুক্ষণের দেখাতেই যদি ভালোবাসা জন্মে থাকে! আর সেই ভালোবাসা এতখানি ঘৃণায় পরিণত হল যে সর্বসমক্ষে তাঁকে বেশ্যা বলতে বাধল না একটিবারও? এমনকী কর্ণই তো বললেন তাঁকে নগ্ন করতে! “দুঃশাসন! পাণ্ডবাণাঞ্চ বাসাংসি দ্রৌপদ্যাশ্চাপ্যুপাহর।। দুঃশাসন, পাণ্ডবদের সঙ্গে সঙ্গে ওই দ্রৌপদীর কাপড়ও কেড়ে নাও। বেশ্যা যখন, তখন একবস্ত্রাই হোক বা বিবস্ত্রা, কী এসে যায়”! দ্রৌপদীর সমস্ত শরীর রাগে, ক্ষোভে, ঘৃণায় কাঁপতে থাকে। এই যদি ভালোবাসা হয়, তবে ধিক্ সেই ভালোবাসাকে। এই লোক যদি বীর বলে খ্যাত হয়, তবে ধিক্ সেই বীরত্বকে। যে পুরুষ এক নারীকে সম্মান দিতে জানে না, তার মতো কাপুরুষ আর কোথায়!

আরেকজনের কথা ভেবেও পাঞ্চালীর একইরকম ক্ষোভ তৈরি হয়। কর্ণ দুর্যোধনের সরাসরি বন্ধু। স্বভাবতই সেই লোক দুর্যোধনের পক্ষেই কথা বলবে। যদিও নোংরামিতে সে সেদিন সবার উপরে ছিল। কিন্তু ভীষ্ম! পিতামহ ভীষ্ম! সকলের শ্রদ্ধার পিতামহ! যিনি পাণ্ডবদের অতিরিক্ত স্নেহ করতেন! যাঁর পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ দুর্যোধনের ঈর্ষাকেও বাড়িয়ে দিয়েছিল! তিনি কি করলেন সেই সভায় সেদিন?

কৃষ্ণার যে ঈষৎ কোঁকড়ানো সুরভিত নীলচে চুল দেখে মুগ্ধ হত সকলে, সেই বিশাল চুলের বোঝা টানতে টানতে দুঃশাসন সভায় নিয়ে এলো তাঁকে। শরীরের ঊর্ধাংশের বস্ত্র তখনই বিস্রস্ত হয়ে গেছে। তাঁর তখন মাসিক চলছিল। সেই রক্তাক্ত একবস্ত্রা অবস্থাতেই পাষণ্ডটা তাঁকে কয়েক হাজার জোড়া চোখের সামনে এনে ফেলল। সেই মুহূর্তেই তো ভীষ্মের উঠে দাঁড়িয়ে দুঃশাসনকে হত্যা করা উচিত ছিল। কিন্তু একটি প্রতিবাদের সুর পর্যন্ত তাঁর গলায় শোনা গেল না। তিনি কিছুতেই ভীষ্মকে এতটুকু শ্রদ্ধা করতে পারেন না। চিরকাল ভীষ্ম মিনমিন করে এসেছেন। বাবার কামবাসনা মেটাতে নিজে চিরকুমার থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন। যাঁর জন্য মূলত এই প্রতিজ্ঞা, সেই সত্যবতীর দুই ছেলেই যখন নিঃসন্তান অবস্থায় মারা গেল আর সত্যবতী নিজেই ভীষ্মকে প্রস্তাব দিলেন অম্বিকার সঙ্গে মিলিত হতে; সেদিন যদি ভীষ্ম এই প্রস্তাবে রাজি হতেন, তবে এই কুরুপাণ্ডব দ্বন্দ্ব তৈরিই হত না। কারণ অম্বিকাকে সত্যবতী বলেছিলেন তোমার কোনও এক দেবরস্থানীয় আজ রাতে আসবেন তোমার কাছে। প্রস্তুত থেকো। দীর্ঘদিন পুরুষের সঙ্গহীন অম্বিকা সেদিন সাজলেন সুন্দর করে। সুরভিত করলেন নিজের শরীর। বিছানাটি তৈরি করালেন আরও আরামদায়ক করে। ঘরে জ্বালাতে বললেন মৃদু বাতি। মনে উত্তেজনা। দ্রৌপদী অনুভব করতে পারেন অম্বিকার সেদিনের মনটাকে। অর্জুনের কথা ভাবলে পর্যন্ত তাঁর দেহে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে। বুকের ভেতর উথালপাথাল হতে থাকে। অম্বিকা মনে মনে যখন ভাবছিলেন কে আসতে পারেন, নিশ্চিত ভাবে ভীষ্মের কথা ভেবেছিলেন, কারণ দেবরস্থানীয় তো ভীষ্মই ছিলেন। ভীষ্মের বীর দেহটিও তাঁর চোখে ভাসছিল। আর মনে মনে মিলনের কথা ভেবে উদ্বেলিত হচ্ছিলেন। তিনি বেচারি কী করে জানবেন, সুপুরুষ সুদেহী ভীষ্মের বদলে কুৎসিত গন্ধযুক্ত রীতিমত কুদর্শন ব্যাস আসবেন তাঁর কোমল দেহটিকে কঠিন পীড়ণে নিষ্পেষিত করতে! ঘরের আধো আলো আধো অন্ধকারে হঠাৎ করে এমন একজন উপস্থিত হলে একটি মেয়ে, যে এতদিন পর্যন্ত রাণীর মতো জীবনযাপন করেছে, সে কী করে সহজভাবে নেবে? অথচ দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরের থেকে এও জেনেছেন যে ব্যাস এক বছর সময় চেয়েছিলেন সত্যবতীর কাছে। অন্তত তিনি নিজে জানতেন তাঁকে শয্যাতে সঙ্গী হিসেবে মেনে নেওয়া এক রাণীর পক্ষে সম্ভব নয়। আগে তাঁর সঙ্গে আলাপ করে সহজ করতে হবে। জানতে হবে তাঁর ভেতরের মনটাকে। তাঁর শিক্ষাদীক্ষাকে। তবেই বাইরের কুরূপকে অগ্রাহ্য করে ভেতরকে শ্রদ্ধা করা যাবে। কিন্তু না! সত্যবতীর বিষম তাড়া। তিনি নিজে মেয়ে হয়েও আরেকটি মেয়ের মন নিয়ে এতটুকু ভাবলেন না। এমনকী অম্বিকার পর অম্বালিকার ক্ষেত্রেও তাঁর বোধ কাজ করল না। দুই ক্ষেত্রেই দুটি ব্যর্থ মিলনে জন্ম হল এক অন্ধ আর এক রক্তশূন্য ফ্যাকাশে রাজপুত্রের। সমস্তটার জন্য দায়ী এক এবং একমাত্র ভীষ্ম। দ্রৌপদীর মাঝেমধ্যেই মনে হয় বীর হলে কী তার বুদ্ধি বা বোধ কমে যায়? অর্জুনকেও দেখেছেন নিজের প্রতিজ্ঞা নিয়ে অদ্ভুত গোঁয়ার্তুমি করতে। একই ব্যাপার ভীষ্মেরও। তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন কুরুরাজ্য, কুরুসিংহাসনকে তিনি রক্ষা করবেন। কিন্তু সিংহাসনে যদি এমন কেউ বসেন, যিনি সেই সিংহাসনে বসার যোগ্য নন, বা তিনি যদি এমন কোনও সিদ্ধান্ত নেন, যা রাজ্যের জন্য অমঙ্গলজনক, তাহলেও তাঁকে সমর্থন করে যেতে হবে? এ কেমন প্রতিজ্ঞা!!


আরো পড়ুন: একাকিনী (পর্ব-৬) । রোহিণী ধর্মপাল


চোখ বন্ধ করলেই দ্রৌপদী ছবির মতো সেদিনের প্রতিটি দৃশ্য, প্রতিটি কথা মনে করতে পারেন। আসলে তাঁর মস্তিষ্কে গেঁথে গেছে দিনটা। চরম প্রতিশোধ না নেওয়া পর্যন্ত এই ছবি এতটুকু আবছাও হবে না। দুঃশাসনটা যখন ওই অবস্থায় সভার মধ্যে এনে ফেলল, তিনি ভেতরে ভেতরে লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়েও বাইরে যথাসম্ভব তেজ বজায় রেখেছিলেন। বারবার বলছিলেন, “ধিক এই সভাকে, যেখানে এতবড় অন্যায় দেখেও সবাই চুপ করে বসে আছে। ধিক্কার এখানে বসে থাকা বড় বড় বীরপুঙ্গবদের। তাঁরা আসলে নিতান্তই কাপুরুষ। অধার্মিক। কোনও বীর এমন স্থবির হয়ে বসে থাকতে পারে না। ভীষ্ম দ্রোণ বিদুর ধৃতরাষ্ট্র সবাই তো মনে হচ্ছে মৃত। প্রাণ থাকলে ঝাঁপিয়ে পড়ে এই দুর্বত্তদের আটকাত”। তিনি এই কথাগুলি বলে যাচ্ছেন, আর ওই লোকগুলো, ঠিক শকুনের মতো তাঁর দিকে তাকিয়ে তাঁর চারপাশে ঘুরছে। দুঃশাসন তাঁকে ধাক্কা মারছে আর ‘দাসী’ ‘দাসী’ বলে চিৎকার করে হেসে উঠছে হায়নার মতো। কর্ণ আর শকুনি দুঃসাসনের সঙ্গে প্রবল হাসছে। তিনি এর মধ্যেই প্রশ্ন করছেন, “যিনি আগেই হেরে বসে আছেন, তিনি আর কাউকে পণ রাখেন কী করে”! বারবার এই একটাই প্রশ্ন করেই যাচ্ছেন তিনি। শেষমেষ ভীষ্ম নড়েচড়ে বসলেন। কিন্তু কী উত্তর দিলেন তিনি! নিজে চিরকাল বোধহয় দ্বন্দ্বে ভুগেছেন। সেই দ্বন্দ্ব তাঁর উত্তরেও ফুটে উঠল। যে বস্তিতে যাঁর স্বত্ত্ব থাকে না, তিনি সেই বস্তু পণ রাখতে পারেন না ঠিকই, কিন্তু আবার স্ত্রীর ওপর স্বামীর অধিকার থাকে, এও ঠিক। তাই তোমার প্রশ্নের যথার্থ উত্তর দিতে আমি পারছি না”।

কৃষ্ণের সখী ছিলেন কৃষ্ণা। দুজনে অনেক কথা বলতেন। নানা বিষয়ে আলোচনা করতেন। সেই সময়ে কোনও এক প্রসঙ্গে কৃষ্ণ বলেছিলেন তাঁকে, যে বিষয় কারুর মঙ্গল করতে পারে না, সেই বিষয় তখনই বর্জন করা উচিত। বরং বহুজনের সুখের জন্য প্রয়োজনে মিথ্যা বললেও তা সত্যির থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তাই ওই অবস্থায়, যেখানে নিজেদের ঘরের বধূকে সর্বসমক্ষে নগ্ন করে ফেলা হচ্ছে, তখন ভীষ্মের এমন দ্বিধাপূর্ণ উত্তরে তিনি বুঝেছিলেন ভীষ্ম যাই শিখে থাকুন না কেন, তার যথাযথ প্রয়োগ করতে শেখেন নি!

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত