Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,ভেসনা মেইন

অনুবাদ গল্প: একটি চুলের ক্লিপ। ভেসনা মেইন

Reading Time: 3 minutes

ভেসনা মেইনের জন্ম জাগ্রেবক্রোয়েশিয়ায়। তিনি তুলনামূলক সাহিত্যে স্নাতক এবং বার্মিংহামের শেক্সপিয়ার ইনস্টিটিউট থেকে পিএইচডি করেছেন। তিনি নাইজেরিয়া এবং যুক্তরাজ্যের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে কাজ করেছেন। এছাড়াও তিনি বিবিসিতে এবং কলেজে শিক্ষক হিসাবে কাজ করেছেন। তার নিজের পুস্তক আকৃতির প্রকাশনাগুলোর মধ্যে রয়েছেএকটি উপন্যাসএ ওমেন উইথ নো ক্লোথস অন (ডিল্যান্সি২০০৮), ছোট গল্পের সঙ্কলনটেম্পটেশনএ ইউসার`স গাইড (সল্ট২০১৮এবং একটি সংলাপ নির্ভর উপন্যাসগুড ডে? (সল্ট২০১৯)। তার অটোফিকশনঅনলি এ লজার… এন্ড হার্ডলি দেটসিগল বুক্স থেকে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি লন্ডনে থাকেন।


আমরা সাঁতার কাটতে গিয়েছিলাম। আমার মেয়ে এবং আমি। ওর বয়স ছিল বিশ বছর।সে খুব ভালো সাঁতারু ছিল। তাই সাঁতার কাটার সময় ওর দিকে নজর রাখার দরকার পড়তো না।
 
আমার মেয়ে যখন সাগরে নেমে সাঁতার কাটছিল, আমি তখন সৈকতে বসে বই পড়ছিলাম। মাঝে মধ্যে আমি বই থেকে চোখ তুলে ওর দিকে তাকাতাম। ওহাসতো আর একটি হাত উঁচু করতো আমার দিকে।যেন সে আমাকে অভিবাদন জানাচ্ছে, অথবা আমাকে বলতে চাইছে, “মা, আমাকে দেখো।“বাচ্চারা যেমন প্রায়ই শৈশবকাল পেরিয়ে যাবার পরেও অন্যের কাছে স্বীকৃতি পাবার আশায় তাকিয়ে থাকে, তেমন একটা ব্যাপার।
 
শেষবার যখন আমি ওকে দেখেছিলাম, তখন সাগরের উত্তাল তরঙ্গগুলি ওর চারপাশে খেলাচ্ছলে ফুলে ফুলেউঠেছিল।
 
এক মুহুর্তে সে উদ্ধত সাগর জলে ফেনার শুভ্র আড়ালে লুকিয়ে যাচ্ছিল, অন্য মুহুর্তে আবার জয় করে নিচ্ছিল দুরন্ত ঢেউয়ের সুউচ্চ চূড়া।উজ্জ্বল জলের চকচকে পিঠের বিপরীতে ঝকঝক করছিল আমার মেয়েটা।

ওর দিকে তাকিয়ে আমি হেসেছি আর মনে মনে ভেবেছি মেয়েটাকে আমি কী ভীষণ ভালোবাসিএই সুখী অল্প বয়সী মেয়েটাকে। একবার ইচ্ছে হলো চিৎকার করে জানাই ওকে দেখতে কী সুন্দর লাগছে। কিন্তু আমার কণ্ঠস্বর সমুদ্রের তীব্র গর্জনের সামনে নিষ্প্রভ শক্তির মতো নষ্ট হয়ে যেতে দেবার কোন মানে হয় না। তাই আমি বাতাসে হাত উঁচিয়ে মেয়েকে একবার শুভেচ্ছা জানিয়ে আবার হাতের বইয়ে মনোযোগী হয়েছিলাম।

পরেরবার যখন আমি বই থেকে মুখ তুলে তাকিয়েছিলামতখন আর ওকে দেখতে পেলাম না। আমি অন্যান্য অনেক সাঁতারুদের দেখতে পাচ্ছিলাম সাগরের বুকেকয়েক ডজন সাঁতারু হবে। তারা সাগরের জল ও ঢেউয়ের উচ্ছলতা উপভোগ করছে। আমি আমার মেয়ের হাসি মুখটি দেখতে চাইলাম সেখানে। ওর প্রসারিত হাত উঁচিয়ে আমাকে অভিবাদন জানানোর ভঙ্গিটি মিস করছিলাম খুব। তাই যেখানে ওরা সাঁতার কাটছিল তার পাশে একটি ব্রিজের উপর উঠে দাঁড়ালাম। কিন্তু আমার মেয়েটিকে কোথাও খুঁজে পেলাম না।

একটি ভয়ার্ত চিন্তা আমার মনে জেগে উঠেছিল যে মেয়েটি সম্ভবত সাগরের জলে ডুবে গিয়েছে। আমি সব সময়ই বেশি দুশ্চিন্তা করা মানুষ। তবে কখনও কখনও মানুষের সবচেয়ে খারাপ ভয়টিই সত্যি হয়ে যায়। আমি আরও ভালো করে খুঁজতে থাকি আমার মেয়েকে। ব্রিজের চারপাশে পুরোটা সৈকত হেঁটে কোথাও দেখতে পেলাম না ওকে।

ভয়ে আমার বুক শক্ত হয়ে যায় তখন। আসলেই কি তা ঘটেছেযা আমার মনে আতংকের ঘন্টা বাজাচ্ছেএরপর আমি লক্ষ করলাম বালি মাখা একটা চমৎকার চুলের ক্লিপ পড়ে আছে সামনে। নিখুঁত একটা এন্টিক পিস্। নিশ্চয়ই কেউ এটা ইচ্ছা করে রেখে গেছে এখানে। অথবাখুব সম্ভবত হারিয়ে ফেলেছে বেখেয়ালে। চুল বাঁধার ক্লিপটি ব্রিজের গোড়ায় একটি পাথরের স্তম্ভের উপর পড়েছিল।

ক্লিপটিকে হাতের তালুতে চেপে ধরে আমি এর সিলভার ফ্রেমের কাছে লাগানো মুক্তোর সারিগুলোকে দেখতে থাকি খুব মনোযোগের সাথে। ক্লিপের গায়ে পরিপক্ক শিল্পীর জটিল নৈপুণ্য দক্ষতা এবং নান্দনিকতার স্বাচ্ছন্দ্যতা আমাকে মুগ্ধ করে। আমি হাতের আঙুলে ক্লিপটিকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখার সময় রোদ্রের কণা এর গায়ের উপর ঢলে ঢলে লুকোচুরি খেলে যায়। আমার একদম ইচ্ছে না করলেও এমন মূল্যবান একটা চুলের ক্লিপ পাওয়া গিয়েছেএটা সাগর কর্তৃপক্ষকে জানানো জরুরি ছিল। কিন্তু আমার মনের ভেতর থেকে কেউ আমাকে জানিয়েছে যেএটি এখন নিজের কাছে রাখার অধিকার আমার আছে। তাই আমি চুলের ক্লিপটিকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বাড়ির দিকে চললামএকা। মূল্যবান এই ক্লিপটিকে আমি কিছুতেই হারাতে দেব না।

অনুবাদকের বিশ্লেষণ:গল্পে একজন মা তার প্রিয় কন্যাকে নিয়ে সাগরে বেড়াতে গিয়েছে। মেয়েটি ভালো সাঁতার কাটেআর মেয়ের সাঁতার দক্ষতার উপর মায়ের আস্থা আছে। সৈকতে বসে মা বই পড়েআর মেয়েটি সাঁতারের ফাঁকে মাকে দেখেহাসেহাত তুলে অভিবাদন জানায়। এভাবে কিছুক্ষণ চলার পর একসময় মেয়েটিকে আর কোথাও দেখা যায় না। মেয়েটি সাগরের জলে তলিয়ে গিয়েছে।

গল্পের শেষে মা একটি সুদৃশ্য চুলের ক্লিপ পায় যেটিকে তার কাছে খুব মূল্যবান বলে মনে হয়। চুলের ক্লিপটিকে হাতের মুঠোতে চেপে ধরে সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেএটিকে সে কিছুতেই হারাতে দেবে নাযেমন অমনোযোগের কারণে মেয়েটিকে সে হারিয়ে ফেলেছে জীবন থেকে।

আসলে লেখিকা ভেসনার এই অণুগল্পটি আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় মূল্যবান বস্তুকে ভালোবেসে আগলে রাখতে হয় সবসময়। যা কিছু খুব মূল্যবান আছে আমাদের জীবনেআমাদের সম্পর্কসন্তানপরিবারতাদের যত্ন প্রয়োজনতাদের সুরক্ষার দিকে মনোযোগ দেওয়া জরুরি প্রতিমুহূর্তে।

আবার এটাও বলা যায়একটা ক্লিপ যেমন মাথার অগোছালো চুলগুলোকে শক্ত করে বেঁধে গুছিয়ে রাখেঠিক তেমন করে একজন মা তার পরিবারের সবাইকে সুসম্পর্কের নিবিড় বন্ধনে ধরে রাখে। তাই মেয়েটি হারিয়ে যাবার পর চুলের ক্লিপটিকে দেখে মূল্যবান বস্তুকে যত্নে আগলে রাখার কথা মনে হয়েছে মায়ের কাছে।

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>