Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,ভ্যাম্পায়ারের একাল সেকাল

ভ্যাম্পায়ারের একাল সেকাল । দেবলীনা রায়চৌধুরী ব্যানার্জি

Reading Time: 3 minutes
 
Bard of Avon সেই কোন কালে Hamletকে দিয়ে বলিয়েছিলেন, “There are more things in Heaven and Earth Horatio, that are dreamt of in your philosophy”। সত্যি কিন্তু আমরা কল্পনা করে যত বিভীষিকা আর বীভৎসতাই সৃষ্টি করি না কেন, জীবন কিন্তু দু’কদম এগিয়েই থাকে রক্তচোষা বা ভ্যাম্পায়ার নিয়ে পৃথিবী জুড়ে মানুষের মনে রয়েছে অনেক প্রশ্ন , ভয় এবং আকর্ষণ। ব্রাম স্টোকারের লেখা ড্রাকুলা উপন্যাস ১৮৯৭ সালে প্রকাশিত আলোড়ন সৃষ্টি হয় গোটা বিশ্বে।গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র কাউন্ট ড্রাকুলা, যিনি হলেন ভ্যাম্পায়ার, তাকে ঘিরে চলচ্চিত্র থেকে কিংবদন্তি কিছুই বাদ পড়েনি।কিন্তু কল্পনারও তো একটা ভিত্তি লাগে। তাই বিশ্ব কাঁপানো এই বিষয়টির শিকড় খুঁজে বেশ কয়েকটি তথ্য পাওয়া গেল; আর পাওয়া গেল কিছু বাস্তব ঘটনা।
 
প্রাণিবিদ্যার প্রাঙ্গনে যে তথ্য আমরা পাই তা হয়তো অনেকেরই জানা। দক্ষিণ আমেরিকা ও আমেরিকার আরও কিছু অঞ্চলে এক ধরনের বাদুড় পাওয়া যায় যাদের Vampire Bat বলা হয়।এদের বৈজ্ঞানিক নাম Desmodontine। মেক্সিকো, আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে প্রভৃতি অঞ্চলে এই ধরনের বাদুড় দেখতে পাওয়া যায়। পরিত্যক্ত, অন্ধকার , ভেঁজা স্যাঁতস্যাঁতে স্থানে এদের বাস। সাধারণত গৃহপালিত পশুর শরীরে দাঁত বসিয়ে রক্ত পান করে এরা। এই প্রাণীর প্রকৃতির এমন ক্ষতিকারক দিকটিতে কেন্দ্র করে রক্তচোষা বা ভ্যাম্পায়ার মিথের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গেছে।
 
এবার দেখা যাক লোকবিশ্বাস বা মাইথলজিতে এই ধারণার শিকড় কোথায়। ইয়োরোপের লোকবিশ্বাসে ভ্যাম্পায়ারের ধারণা বরাবরই ছিল।প্রাচীন তুরস্কেও সাধারণ মানুষ ভয় করত উবির নামের এক রক্তচোষা প্রেতাত্মাকে। পোল্যান্ড ও বাল্টিক তটভুমি সংলগ্ন স্থানের লোকবিশ্বাস উপীর নামক অপদেবতা ছিল। এই উপীর হলো ভ্যাম্পায়ার বা রক্তচোষা। উপীর হলো স্লাভদের লোকবিশ্বাসের অন্তর্গত এক ভয়ংকর এক অপদেবতা। আঞ্চলিক মানুষের বিশ্বাস, যে সব মানুষের মৃত্যুর আগে পাপ স্খালন হয় না তারা মৃত্যুর পর ভ্যাম্পায়ারে পরিণত হয়। কোন আকশ্মিক ও দুর্ঘটনা জনিত মৃত্যু অর্থাৎ অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে বা কোন ডাইনি জাতীয় কেউ মারা গেলে, তারা রক্তলিপ্সা নিয়ে ঘুরে বেড়াত বলেই সাধারন মানুষ বিশ্বাস করত। মৃত্যুর পর চল্লিশ দিনের মধ্যেই এই প্রেত বা অপদেবতা হানা দিত আত্মীয় পরিজন ও পড়শিদের উপর। পরবর্তীকালে অবশ্য এর সাথে খ্রিষ্ট ধর্মে দীক্ষিত না হয়ে মৃত্যু হলেই উপীরে পরিণত হওয়ার ভয় জাঁকিয়ে বসেছিল মানুষের মনে। স্লাভদের বিশ্বাস অনুযায়ী উপীর ছিল ভয়ঙ্কর রক্তলিপ্সু। রক্তের নেশায় বিভোর এই অপদেবতা কিন্তু সূর্যালোকেও নিরস্ত থাকে না। দিন বা রাত যে কোন সময় বেরিয়ে পড়ে শিকারের সন্ধানে।
 
ভ্যাম্পায়ারের অস্তিত্ব ইতিহাসের পাতাতেও জলজল করতে দেখা যায়। রোমানিয়ার রাজপুত্র তৃতীয় ভ্লাদের মধ্যে মতানৈক্য হয় অটোমান সাম্রাজ্যের সম্রাট সুলতান মেহমেদের। ১৪৪৮ সালে পিতা ভ্লাদ ড্রাকুলের অকস্মাৎ মৃত্যুর সাথে সাথে অটোমান সাম্রাজ্যের ও রোমানিয়ার চুক্তি ভেঙে দেন তৃতীয় ভ্লাদ। তিনি রোমানিয়ায় প্রত্যাবর্তন করেই হাতে তুলে নেন দেশের শাসনভার। অত্যন্ত অত্যাচারী রাজা ছিলেন বলে তার বদনাম। আশেপাশের রাজ্য দখল করে শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকেন তিনি। সাথে যথেচ্ছ হত্যালীলা চালান। লক্ষাধিক মানুষকে হত্যা করেন জীবন্ত অবস্থায় শুলে চড়িয়ে। তাকে ঘিরে গড়ে ওঠে কিংবদন্তি যে তিনি মানুষের রক্ত পান করতেন। ড্রাকুলের পুত্র বলেই তার নাম হয় ড্রাকুলা। তৃতীয় ভ্লাদের নৃশংসতা, হত্যাকান্ড এবং পনের’ শ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে তার ত্রাসের ফসল হিসেবে মানুষের সাথে রক্তচোষার যোগ তৈরী হয়। যার ফলস্বরূপ লেখা হয় কাউন্ট ড্রাকুলার আখ্যান “ড্রাকুলা”।
 
শুধু কি তাই? চেনা পৃথিবীর আনাচে কানাচে লুকিয়ে থাকে কত ভয়ংকর সত্য , যা কল্পনার রঙে আঁকা ভয়কেও হার মানায়। বাস্তব জগতেও ভ্যাম্পায়ারের অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায় না। অবাক লাগলেও, এ কথা সত্যি যে রক্তমাংসের দেহধারী ভ্যাম্পায়ার বা রক্তচোষা মানুষ কিন্তু জীবন যাপন করে আমাদেরই মতো করে। পেনসিলভেনিয়ার বাসিন্দা দুই সন্তানের মা জুলিয়া কেপলস প্রতি মাসে দুই লিটার রক্ত পান করেন। একটা সুদীর্ঘ প্রাচীন ছুরি দিয়ে রক্তদাতার শরীর কেটে পান করেন তাজা রক্ত। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলে সঞ্চালিত হয় লিয়া বেনিঙহফ আর আরো ড্রেভেন নামে এক দম্পতির সাক্ষাৎকার । তারা একে অপরের রক্ত পান করেন বলেই তারা জানিয়েছেন। আরো ড্ৰেভেনের রক্তলিপ্সা ছিল আগে থেকেই। তার চেয়ে পনেরো বছরের ছোট লিয়ার সাথে আলাপ হওয়ার পর তিনি নিজের রক্তলিপ্সার কথা স্বীকার করেন এবং তাতে আকৃষ্ট লইয়া উপলব্ধি করেন তার মধ্যেকার সুপ্ত রক্ততৃষ্ণা। তারা একে অপরের রক্ত পান করেন নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে, এবং এতে নাকি তারা সুগভীর তৃপ্তি পান। Occultist ডিওন ফরচুনার মতে ডাইনিবিদ্যা বা Occultismএ আছে যে সদ্য মৃত আত্মা মানব শরীর থেকে রক্তপান করে অশরীরি হয়েও পৃথিবীতে অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারে।
 
ভ্যাম্পায়ার হওয়া , রক্ত পানের নেশা এগুলি চিকিৎসা শাস্ত্রেও পরিচিত। এই মনোরোগটি কিছুটা বিরল বটে কিন্তু অস্বাভাবিক নয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এর নাম রেনফিল্ড সিনড্রোম বা ক্লিনিক্যাল ভ্যাম্পায়ারিজম। এই রজার সূত্রপাত হয় শৈশবে বা কৈশোরে নিজের দেহের কোথাও কেটে বা কষ্ট তৈরী করে, এবং তার থেকে কোন ভাবে পরিতৃপ্ত হয়ে। চরম মানসিক আঘাত, দুর্ঘটনা বা অত্যাচারের ফলে দেখা দেয় এই রোগ। তবে খুব কম ক্ষেত্রেই তা বাড়তে দেখা যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই রোগ তীব্র আকার ধারণ করে না।
 
বিচিত্র এই পৃথিবী। কল্পনার মোড়কে আমরা যতই বিস্ময় খুঁজি না কেন, বাস্তবের জমিতেই এমন অনেক কিছু থেকে যায় যা আমাদের জ্ঞান , চেতনা , ভাবনাচিন্তার চেনা জগৎকেই এলোমেলো করে সত্যের নিশান গেঁথে দিয়ে চলে যায়। ভ্যাম্পায়ার কাল্ট যথেষ্ট প্রাচীন আর বর্তমান কালেও ভ্যাম্পায়ারিজম আবছা অস্তিত্ব হয়ে চেনা জগতের পাশে পাশে চলে। তাই এ কথা বলা মুশকিল যে মানুষের কল্পনায় সৃষ্ট ভ্যাম্পায়ার থেকেই কী প্রভাবিত হয়ে মানব মনে এই রোগ এসেছ; বা এর থেকেই কল্পকাহিনীগুলির সূত্রপাত? নাকি মানুষের সত্ত্বায় রক্তপিপাসা অনামী অচেনা বিরল রোগ হিসেবে ছিল বলেই কাহিনী বা মিথের সৃষ্টি !
 
কিছু প্রশ্নের উত্তর মেলে না।
 
 
 
 
 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>