ধারাবাহিক: খোলা দরজা (পর্ব-৩৪) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
ভ্রমণের কথা লিখতে বসলেই একজনের মুখ মনে পড়ে। আমার পাড়াতুতো মীণা পিসি।ছোটবেলায় একবার রিক্সা গাড়ি থেকে পড়ে গিয়ে সে বেচারির এমন আতঙ্ক হয়, কোনদিন আর কোন গাড়িঘোড়ায় না চাপার ধনুর্ভঙ্গ পণ করে। দশ বছর বয়সে, সেই পড়ে যাওয়ার দায় নিয়ে,হাঁটা পথে ছাড়া সে কোথাও কোনদিন যায়নি। আমাদের শহরের যাবতীয় মেলায় সে পায়ে হেঁটে হাজির হত।বিয়ে করেনি, ভাইপো ভাইবৌদের অনেক অনুরোধেও তাকে টলানো যেত না।
আমাদের প্রতিটি বেড়ানোর গল্প সে হাঁ করে শুনত,আর তার মুখ হাসিতে ঝলমল করে উঠত।একবার তার ছোট ভাইবোনেরা তাকে জোর করে বাসে তুলে দিয়েছিল। ড্রাইভারের হাতে পায়ে ধরে সে নেমে আসে।তার মৃত্যুর পর আমার মনে হয়েছিল ছোট্ট একটা জিদ তার জীবনের পরিসরকে বাড়াতে দিলনা। এ জীবনে তার ভ্রমণ হল না।
মনে পড়ছে বাবার আসামের গৌহাটিতে বদলী হওয়ার কারণে আমাদের আসামে যাওয়ার কথা। প্রথমবার বদলীর জন্য ফার্স্টক্লাসের ভাড়া পাওয়ায় বাবা আরো কিছু ভর্তুকি দিয়ে আমাদের প্লেনে চাপিয়েছিলেন। তখন সবে এইটে উঠেছি , নতুন পোশাকে,নতুন অলেস্টারে, সেজেগুজে যাওয়ার আনন্দই আলাদা, সেসময় অলেস্টার বলা হত লেডিস গরম কোটকে।আমার সঙ্গে বাবা ,মা আর এক ভাই, দুইবোনও চলেছে। প্লেনের উড়ানের অনুভূতি অনেকটা মেলাতলার নাগরদোলার মত লেগেছিল। ভাসতে ভাসতে নীচে নামে যখন,বুক পেট হাল্কা হয়ে যায়।
সুবেশা সুন্দরী এয়ারহস্টেসদের হাতের বাড়ানো ট্রের লজেন্সের আহ্বান, পরে রকমারি আমিষপদের মধ্যাহ্ন ভোজ, জানলা দিয়ে মেঘ আর আকাশের হাতছানি, সবটাই অভিনব, সবটাই আশাতিরিক্ত।
পরে গৌহাটিতে থাকতে থাকতে শিলং গেছিলাম আমরা।শিলং এ যাওয়ার পথটা আজো মনে পড়ে।অফিসের কাজে বাবার যাওয়া,তাই অফিসের জীপেই পাহাড়ি রাস্তায় সেই প্রথম আরোহণ। চেরাপুঞ্জি যাওয়ার জন্য একদিন বেরিয়ে পথ খুঁজে না পেয়ে ফিরে আসাটাও মনে আছে । ভূগোল বইএর সেই চেরাপুঞ্জি, যেখানে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়।পথে খাসিয়া বৃদ্ধা মহিলার হাতের কালো কালো অর্দ্ধেক পোড়া গরম রুটি আর বাঁধাকপির তরকারি খেয়েছিলাম আমরা। সেই শিলং এর পথঘাট,বাগানে ফলে থাকা কমলালেবু, বড় বড় গোলাপের বাগান,পার্কের হ্রদে মাছের সাঁতার,কিছুই ভুলিনি।খাসিয়া মেয়েদের সাজগোজ, চিরুনী গোঁজা খোঁপার বাহার, আর উল বুনতে বুনতে বাজার বিক্রি করা, আজো চোখে লেগে আছে।ভুলিনি কিছুই, বেশি না থাকলে ঝুলির সবটুকুই স্মরণে থাকে । ওই পাহাড়ি পথের কুয়াশার কথাও মনে আছে, জীবনে দেখা প্রথম কুয়াশা তো।”
আরো পড়ুন: ধারাবাহিক: খোলা দরজা (পর্ব-৩৩) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
ছোটবেলায় স্কুলের সঙ্গে চিড়িয়াখানা বা মিউজিয়াম যেতে আমাদের ছাড়া হত না।বাবা নিয়ে যেতেন ,সঙ্গে আশপাশের আরো অনেকেও যেত।আমাদের কলকাতা ভ্রমণের উত্তেজনা ছিল ট্রাম চাপায়, দোতলা বাসের জানলা দিয়ে পথের দৃশ্য দেখায়।প্রথম লিফট চাপা বা চলন্ত সিঁড়িতে লাফিয়ে নামাকে কি ভ্রমণ বলব না? কলেজ পড়ুয়া কাকার কল্যাণে, আর্ট কলেজের গ্যালারিতে দেখা প্রদর্শনী, র্যালীর কুলপী বা ক্যাডবেরী আইসক্রিমের মধুর আস্বাদ তো তখন ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ভ্রমণপথের উত্তেজনা। তাকে ভ্রমণ তো বলাই যায়।
সেসময়ের আর একটি ভ্রমণ ঘটেছিল, আঁকার স্কুলের মাষ্টারমশায়ের সঙ্গে। কোন একটি পুরস্কারের জন্য আমি আর মাষ্টারমশায়ের আর এক ছাত্র গিয়েছিলাম দিল্লীতে।তখন পনেরো ষোল হবে বয়স। সে ভ্রমণের স্বাধীনতার স্বাদ এ জীবনে আর পাইনি।
কথাটা একটু ভুল হয়ে গেল বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ক্লাসের সবাইমিলে স্যারেদের সঙ্গে দিল্লী আগ্রা ভ্রমণ আরো মধুর হয়েছিল।রাতে চাঁদের আলোয় তাজমহলের স্বর্গীয় রূপ দেখার সৌভাগ্য, বন্ধুদের সঙ্গে কাটানো আনন্দের মুহূর্ত,হাসি ঠাট্টা ,ঝগড়া ,ভালোবাসায় মাখামাখি সেসব দিন, রয়ে গিয়েছে মনের অ্যালবামে।
অনেকগুলো ভ্রমণের কথা বলা হলেও আসল কথাটিই বলা হয়নি। সেকালের ভ্রমণ আর একালের ভ্রমণের তফাৎ এর কথাটা।তখন আমরা সবাই বেড়াতে যেতাম পকেটে খুব সামান্য পয়সাকড়ি নিয়ে।ট্রেনে থ্রী টায়ারের গদী দেওয়া বিছানা রিজার্ভ করা হত।বাথরুম যেমন হয় তেমনই আর কি।ওতেই চলে যেত। খুঁতখুঁতানির অবকাশ ছিলনা। ফার্স্টক্লাস তখন মহার্ঘ্য।বাবার চাকরির কল্যাণে দু একবার চড়া হয়েছে। এসি ক্লাসের নাম শুনিনি। শীততাপনিয়ন্ত্রিত কথাটা তখন একেবারেই চালু হয়নি, আমাদের মত মধ্যবিত্ত মহলে।
ঐতিহ্যময় শহর চন্দননগরের স্থায়ী বাসিন্দা সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায় বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির স্নাতক।১৯৯৬ সালে প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়’দিবারাত্রির কাব্য’ পত্রিকায়।২০০১ সালে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়।‘আনন্দবাজার’, ‘বর্তমান’, ‘আজকাল’, ‘প্রতিদিন’, ‘তথ্যকেন্দ্র’, ‘উত্তরবঙ্গ সংবাদ’ ছাড়াও, ‘অনুষ্টুপ’, ‘কুঠার’, ‘এবং মুশায়ারা’-র মতো বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনেও তার কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ প্রকাশের ধারা অব্যাহত। প্রকাশিত উপন্যাস পাঁচটি, গল্পগ্রন্থ চারটি, এবং কবিতার বই একটি।