| 20 এপ্রিল 2024
Categories
শারদ সংখ্যা’২২

শারদ সংখ্যা ওডিআ অনুবাদ গল্প: মশা । অনীল পাটী

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

লেখক পরিচিতি :
অনীল কুমার পাঢী ওডিআ কথাসাহিত্যে বেশ খ্যাতিসম্পন্ন।তাঁর গল্পগুলি স্বতন্ত্র ও পরীক্ষাধর্মী।রয়েছে সতেরোটি গল্প গ্রন্থ,পাঁচটি উপন্যাস এবং ১২১টি অণুগল্পের একটি সংকলন।পেশায় ইংরেজির অধ্যাপক এই লেখক সম্মানিত হয়েছেন বিভিন্ন পুরস্কারে।


অনুবাদ : শ্যামলী সেনগুপ্ত

(১)

ওঃ!প্রায় তিনটি ঘন্টা পরিশ্রম করে মশাটাকে মারতে পারলাম।
আমি সতর্ক ছিলাম।বারবার আমাকে হারিয়ে দেওয়া মশাটার গুগলি,ক্যারেম্বল,স্যুইং সবকিছুর সামনাসামনি হতে আমি প্রস্তুত।শেষবারের মতো মশাটা আমার বাঁ হাতের কনুইয়ের উপরে বসতেই আমি জোরে একটা থাপ্পড় লাগালাম। মশাটা চেপ্টে লেগে গেলো আমার হাতে।তবুও শান্তি পেলাম না।ওটাকে দুই আঙ্গুলে ডলে নাকের কাছে নিয়ে শুঁকলাম।
নাস্তানাবুদ করে দিয়েছিল আমাকে।মশারি টাঙিয়ে শুলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে বলে আমি গুডনাইট জ্বালাই,হিট্ স্প্রে করি।ভূবনেশ্বরের মশাগুলো শুধু হাতীর মতো বড়ো নয়, এরা বড়ো রক্তপিপাসু।কোনও বিষ ওদের কাবু করতে পারে না।এদের বেশি বেশি দেখা যায় হাটেবাজারে,চায়ের গুমটিতে আর সাহিত্য উৎসবে।না পড়তে দেয়,না ভাষণ শুনতে দেয়।বিরক্তি প্রকাশ করলে বলে তোমরা লোকেদের মাথা খাচ্ছ, আমরা তোমাদের রক্ত খাচ্ছি।আরে!দু’জনেই তো খাওয়ার কাজটি করছি।
এই রে! আরেকটা মশার পিনপিন শব্দ শুনতে পাচ্ছি কানের কাছে।সতর্ক হতে হবে এবার।

(২)

ট্রেন প্রায় আঠঘন্টা লেট ছিলো।রাত দশটায় যে ট্রেনের আসার কথা,সেটি আসবে সকাল ছয়টায়।সেকেন্ড ক্লাস ওয়েটিংরুম নরকের খুব কাছের জায়গা।যে গন্ধ সেখান থেকে বেরোয় তার বর্ণনা কোনও পুঁথি বা পুরাণে নেই।এই গন্ধের ভিতরে এক অনন্য ভারতীয়তা লুকিয়ে আছে।তাই প্ল্যাটফর্মে একটা ভাঙা বেঞ্চ পেয়ে গেলেও ভালো।পেয়েও গেলাম।প্ল্যাটফর্মের শেষে ওই সেমি ডার্কনেসে।অন্ধকার আধুনিকমানুষের সবচেয়ে বড়ো পোশাক। অন্ধকার না থাকলে আমরা সকলের চোখে প্রকট হয়ে যেতাম। অন্ধকারের জন্যই পানের পিক,ছ্যাপ-থুথু এসব চোখে পড়লো না।আমি বেশ আয়েস করে বসলাম। একটু পরেই হালকা নাকডাকার শব্দ শুনতে পেলাম। তাকিয়ে দেখি লাইন করে মানুষ ঘুমোচ্ছে ; লাইন চলে গেছে বহুদূর।মানুষ! এরা!কে জানে যদি এরা মানুষ হয় তবে পুঁজিপতি,নেতা,ব্যুরোক্র্যাট,কবি-লেখকরা কী!কি করে সমান হবে!পাগল না কি!আচ্ছা মানুষের মতো দেখতে এই জীবগুলি ভিক্ষাবৃত্তি,চুরিচামারি এবং অন্যান্য কাজ সেরে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল।
ট্রেন আসছে যাচ্ছে।যাত্রীরা নামছে উঠছে।এদের কারও কারও চোখ ‘বিনা অপারেশনে অর্শ,ভগন্দর- এর চিকিৎসা’র কুখ্যাত হাকিমের বিজ্ঞাপনের উপর পড়লেও এইসব ঘুমন্ত জীবের উপরে পড়ছিলো না।তবে মশাদের নজর থেকে এরা বাঁচতে পারেনি।ভাঙা বেঞ্চের একদম কাছ ঘেঁষে যে শুয়েছিলো ওর চাদরটা একটু সরে গেছে।ওর ফর্সা পিঠের ওই অংশটুকু কালো হয়ে আছে।ভালোকরে লক্ষ্য করে দেখি ওগুলো মশা!লোকটার শরীর যেন পাঁচ টাকার সরকারী ভোজনালয়।মশারা লাইন দিয়ে আছে।আমার হাত আর পায়ের উপরে বসার চেষ্টা করছিলো কয়েকটা পেটুক মশা।তাদের তাড়াতে তাড়াতে ভাবলাম, এই লোকটা কি বুঝতে পারছে না! আহা! ভিখারিদের এই সমূহ রক্তদান বন্ধ হয়ে গেলে মশারাই বা বাঁচবে কী করে? মশা আর ভিখারিরাই তো আমাদের জাতীয় সম্পত্তি! যা ব্বে শ্ শালা!কে যেন গালাগালি দিলো অ-ওডিআ ভাষায়।
কৌন হ্যায় বে!আমি রীতিমতো চটে গিয়ে বললাম।মশারা ছাড়া আর কেউ অবশ্য জেগে ছিলো না। মনে হয় কোনও বিহারি কি ইউ-পির মশা আমাকে গালি দিলো!


আরো পড়ুন: আঠা (ক্রেইজি গ্লু) । এটগার কেরেট । অনুবাদক ফারহানা আনন্দময়ী


(৩)

উঃ! গ্রামের সেইসব দিন কেমন ছিলো!রাত আঠটা বাজতেই মা বাবা মিলে সব ঘরে মশারি টানাতে শুরু করতো।তখন গ্রামে বিদ্যুৎ আসেনি।গরম কালে গরম তার সঙ্গে মশারির মধ্যে বাতাস ঢোকার ঊপায় ছিলো না।আমাদের প্রায় সব মশারিই ছেঁড়া ছিলো আর সুতো লাগানো একটা ছুঁচ ঝুলতো মশারির ভিতর দিকে।ময়লা আলো ছড়ানো লণ্ঠনটা একটু বাড়িয়ে দিয়ে মা মশারি সেলাই করতো।সেলাই শেষ হতো যখন তখন মশারির ভিতরে কেরোসিনের গন্ধ ছড়াতো।মা মশারিটা চারদিকে গুঁজে দিতো।সারাদিনের ক্লান্ত শরীর নিয়ে সকলে ঘুমিয়ে পড়তো।ছোটবেলা থেকেই আমার দেরিতে ঘুম আসা অভ্যেস।ঘরের দরজার সামনে লণ্ঠন জ্বলতো।আমি মশাদের লক্ষ্য করতাম।মশারির এপিঠে যেই একটা বসতো,মশারিসুদ্ধ সেটাকে চিপে মারতাম।সকালে আমার হাতের পাতায় রক্ত লেগে থাকতো ।মশাদের বিপক্ষে বিজয়লাভের সেটা ছিলো আমার সুবর্ণযুগ।যখন থেকে মায়ের মশারি টানানো আর মশারি গুঁজে দেওয়ার দিন শেষ ,আমিও তখন থেকে তাদের শিকার।
এখনকার নবভারত মশাদের পেট রক্ত পান করেও লাল হয় না।আমাদের সময়ে মশাগুলো রক্ত খেয়ে উড়তে পারতো না।এখনকার মশাদের পেটের থেকে রক্ত যায় কোথায়?যদি বা একটা ধরা পড়লো টিপে দিলেও রক্ত বেরোয় না!হাতের পাতা লাল করার সুযোগ আর নেই।

(৪)

আমার স্বপ্নে মশাটি এসেছিলো।আগে তো জানতাম মশা কামড়ালে ম্যালেরিয়া হয়। এখন না কি ডেঙ্গু আর চিকেনগুনিয়া ওরাই বাধায়।মশাটি স্বপ্নে এসে হঠাৎ প্রেমিকা হয়ে গেলো!লোটাস,ল্যাকমে ব্র্যান্ডের লোশন,ক্রিম,নেলপলিশ।পকেট ঘেঁটে দেখি খালি! বদলে গেল নেতা আর বিধায়কে।প্রতিটি শরীর থেকে আমার শরীরের মতোই পাইপলাইন গেল তাঁর ঘর অব্দি।তাঁর পিপাসা পেলেই তিনি রক্ত পান করেন।
আবার দেখি এক বিদ্বজন!কবি লেখক গান্ধর্ব-কলা।গন্ধর্বরা বুড়ো হয় না।আমি বললাম, আজ্ঞে আমি পুরুষমানুষ।
তো ! তিনি বললেন,তোমার থেকে রক্ত না নিলে আমি রক্তগ্রীবা কী করে হব?রক্তগোলাপ কি করে ফোটাবো!প্রিয়তমাকে কী উপহার দেব!
মশাটি আবার স্বরূপ ধারণ করতে করতেই আমার ঘুম ভেঙে গেল।
আহা! সুভাষ চেয়ে ছিলেন রক্ত! ওইরকম যদি আসতো একজন! এসে রক্ত দিতে বলতো যদি! অন্ততঃ,অপাত্রে দান করতে হতো না।

(৫)

মশাদের নিয়ে রিসার্চ করছেন যে বিজ্ঞানি,উনি হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন! আনন্দে না দুঃখে বোঝা গেলো না।উনি চিৎকার করে বলছেন,দেখ দেখ,মশার পেটে একটি মানব-ভ্রূণ!
অসম্ভব!!!
অন্যরা চিৎকার করে বললো।
এস তবে।এস,দেখে যাও,বললেন বৈজ্ঞানিক।
কম্প্যুটার স্ক্রিনে দেখ যাচ্ছিলো একটি অর্ধ বিকশিত মানবশিশু!
মশা আর মানুষের সঙ্গম!!
গর্ভবতী মশা!!!
সবচেয়ে বড়ো প্রশ্ন সেই পুং-মানব কে? যে এমন জঘন্য কাজ করেছে?
ল্যাবোরেটরির পুরুষ বৈজ্ঞানিকরা পরস্পরের দিকে সন্দেসের দৃষ্টিতে তাকাতে লাগলো।সকলের মনে হচ্ছিলো ওই অর্ধ বিকশিত শিশুটির মুখ যেন নিজের মুখের মতোই!

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত