Categories
ইরাবতী ধারাবাহিক: একাকিনী (পর্ব-১৩) । রোহিণী ধর্মপাল
আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট
দ্রুপদ ফিরে ফিরে যাচ্ছিলেন অতীতে। পাঞ্চালীর সঙ্গে আবার কবে দেখা হবে, জানেন না। শুধু এই কথাটুকু মনে মনে স্থির জানেন, যে দেখা হবেই। পরিস্থিতি প্রতিকূল হবেই। যে আগুনের শিখাটিকে তিনি বেছেছিলেন, সেই শিখাটি তো নেভার নয়! বরং প্রয়োজনে শত সহস্র শিখা হয়ে ছড়িয়ে পড়ার কথা!
এখনও স্পষ্ট মনে পড়ে সেই অপমানের কথা। মনে পড়ে তার পরের প্রতিটি ক্ষণ। কী অসম্ভব একটা সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল তাঁকে। রাজি করাতে হয়েছিল মহীষীকেও। তিনি বুঝেছিলেন যে স্বাভাবিক ভাবে পরবর্তী সন্তানের জন্মের জন্য অপেক্ষা করে থাকলে চলবে না। কারণ সে ছেলে হোক বা মেয়ে, দ্রুপদের চাহিদা পূরণে সক্ষম হবে, তার কোনও নিশ্চয়তাই নেই। তাছাড়াও, এত সময়ই বা কোথায়? যা করতে হবে, তা দ্রুত আর নিশ্চিত হতে হবে। তাই তিনি ডেকে পাঠিয়েছিলেন তাঁর চরপ্রধানকে।
“দেখো মহী, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজের দায়িত্ব দিতে চাই তোমাকে। তুমি ছাড়া এই মুহূর্তে আর কাউকে ভরসা করতে পারছি না। এই কাজটি আর কেউ পারবেও না। তুমি তোমার সবথেকে বিশ্বস্ত কয়েকজনকে নিয়ে ছড়িয়ে পড়ো চারপাশে। আমি এমন এক বালককে চাই, যে হবে দৈহিক বলসম্পন্ন, সৎ, নির্ভীক। অস্ত্র চালনায় যার সহজাত দক্ষতা থাকবে। এমন কাউকে খুঁজে পেলে তৎক্ষণাৎ আমাকে এসে খবর দেবে। যত শীঘ্র এই কাজটি সম্পন্ন করতে পারো, ততোই ভালো। আর সমস্ত বিষয়টি যেন সম্পূর্ণ গোপন থাকে। মূল কথাটি শুধু তুমি জানবে। কোনও খোঁজ পেলে তুমিই এসে জানাবে আমাকে”।
দ্রুপদ জানতেন তিনি কোনও সহজ কাজ দেননি। মুখে তাড়া দিলেও আসলে ধৈর্য্য ধরতে হবে। তাঁর প্রতিদিনের আচরণে, সাধারণ মানুষের কাছে ভেতরের অস্থিরতা যেন কোনও ভাবেই প্রকাশিত না হয়ে পড়ে।
বেশ কয়েক মাস কেটে গেল। একটি করে দিন কাটছে, দ্রুপদের চিন্তা বাড়ছে। আদৌ পারবেন তো তিনি দ্রোণের অপমানের প্রতিশোধ নিতে? দ্রোণ একইসঙ্গে ব্রাহ্মণ, আবার অস্ত্রশস্ত্রে নিপুণ। তার ওপর এখন যুক্ত হয়েছে কুরুবংশের সখ্য, অর্জুনের মতো শিষ্য! কী করে কী হবে!! ছটফটানি বেড়েই যাচ্ছিল।
উদ্বেগ আর উৎকন্ঠা রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল তখন। এমন সময় একদিন প্রতিহারী এসে খবর দিল চর প্রধান মহী তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য অপেক্ষায়। দ্রুপদের নির্দেশে প্রতিহারী তাকে নিয়ে গুপ্ত কক্ষে। যেখানে যুদ্ধের পরিকল্পনাগুলি তৈরি হয়। অন্য সময় সেখানে মন্ত্রীরাও থাকেন। আজ দ্রুপদ একা।
মহী গুপ্ত কক্ষে ঢুকে দেখল, মহারাজ দ্রুপদ পেছনে হাত মুঠো করে পায়চারী করছেন। কপালে গভীর চিন্তার কুঞ্চন। তিনি এতটাই মগ্ন যে তার আসার শব্দও খেয়াল করলেন না। মহী “প্রণাম মহারাজ” বলতে চমকে উঠলেন।
“এস এস মহী। তোমার জন্য আমি বসে আছি। কী খবর এনেছ বলো। পেয়েছ এমন কোনও বালকের খোঁজ? বিস্তারিত বলো আমাকে”।
“মহারাজ, আপনি অস্থির হবেন না। খোঁজ পেয়েছি আমি। বালকের, সঙ্গে তার থেকে সামান্য বড় এক বালিকার”।
“বালিকা?? বালিকাকে নিয়ে আমি কী করব? তুমি কি বলছ মহী? এমন গম্ভীর একটা বিষয়ে অযথা সময় নষ্ট করছ”?
“না মহারাজ। আমার ওপর ভরসা রাখুন। বিশ্বাস করুন। এই সদ্য কৈশোরে পা রাখা কন্যাটি বড় আশ্চর্যের! ঠিক যেন আগুন। কৃষ্ণা। কিন্তু কী রূপ! কী তীব্র চোখের দৃষ্টি! কী নির্ভীক আর অনায়াস তার গতি! প্রতিটি কথায় তেজ যেন চুঁইয়ে পড়ছে! কোমর ছাপানো ঈষৎ কুঞ্চিত চুলের বোঝাটি শক্ত করে বেঁধে ভাইয়ের হাতটি ধরে যখন নদীর ধারে গিয়ে নিপুণ হাতে তীর ছুঁড়ে মাছে বেঁধে, তখন তার দৃপ্ত রূপ তাকিয়ে দেখার মতো। মাছ শিকারে তার ভাইটিও একই রকম দক্ষ। তার চলাফেরাও তেমনই অনায়াস, মসৃণ। কিন্তু কন্যাটির দীপ্তি একেবারেই অন্যরকম! মহারাজ, আমি আরও খোঁজ নিয়েছি। আপনি চাইলে বলব”।
মহী-র কথা শুনতে শুনতে যেন ঘোর লেগেছিল দ্রুপদের। মহী থামতেই তিনি বলে উঠেছিলেন, “থেমো না। বলতে থাকো”।
মহী হাসিমুখে একটু ঝুঁকে “যথাজ্ঞা মহারাজ”, বলে আবার বলতে শুরু করল। বক্তা আর শ্রোতা, দুজনের চোখই তখন চকচক করছে। বক্তা বুঝেছে যে তাকে যে কাজের ভারটি দেওয়া হয়েছিল, সেটি সে পূরণ করতে পেরেছে। আর শ্রোতার মনে তখন আশার আলো একটু একটু করে দেখা দিচ্ছে।
“মহারাজ, রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় খুঁজতে পাঠিয়েছিলাম কয়েক জন অনুচরকে। আর আমি নিজে খুঁজছিলাম নদীর পাড় বরাবর জঙ্গলে। আমার মন বলছিল, আপনি যেমন চাইছেন, তেমন বালকের খোঁজ নগরের থেকেও এইসব শ্বাপদসঙ্কুল বনেই পাওয়ার কথা। এই পথ ধরে চলতে চলতেই একদিন দেখতে পেলাম এই দুই ভাই-বোনকে। নদীর ধারে ঝুঁকে পড়ে কী যেন করছে। আমি কাছে গিয়ে দেখলাম ওদের পায়ের কাছে বেশ কতগুলি মাছ পড়ে। সেগুলোই ওরা পরিষ্কার করে জলে ধুয়ে নিচ্ছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমরা তো ছোট। এত মাছ যে ধরল, সে কোথায়’? আমার প্রশ্ন শুনে ঝাঁঝিয়ে উঠল সেই মেয়ে, ‘ছোট!! কাদের ছোট বলছেন আপনি? এই মাছ আমরা ধরেছি’।
আমার চোখে অবিশ্বাস দেখে ভাইকে বলল, ‘একটা তীর দে তো আমার হাতে। দেখিয়ে দিই’। ভাইটি তক্ষুণি পাশে পড়ে থাকা একটা হাতে তুলে দিল দিদির। নিজেও নিলে একটা। খরস্রোতা নদীর দিকে দুজনেই তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপরেই প্রথমে মেয়েটি, পরক্ষণেই ভাইটি তীর ছুঁড়ল, যেন বর্শার মতো। তারপরেই হাসিমুখে তীর ধরে টান মারল। দেখলাম, দুটি তীরের ফলায় দুটি মাছ বিঁধে ছটফট করছে তখনও। আমার সামনেই সেই মাছগুলোও পরিষ্কার করে দুজনে মিলে শুকনো পাতা জড়ো করে চকমকি পাথর ঠুকে আগুন জ্বালালো। মেয়েটি কোঁচড় থেকে কীসব মশলার গুঁড়ো বার করে মাছে মাখিয়ে আগুনে ফেলল। চড়বড় শব্দে মাছ ঝলসাতে লাগল। ভাইটি বলল, ‘আপনি আমাদের সঙ্গে খাবেন’? আমি জানতে চাইলাম, ‘তোমাদের মা বাবা কোথায়’? মেয়েটি মাছ ওল্টাতে পাল্টাতে বলল ‘মা আছে। ওই জঙ্গলের ভেতরে আমাদের কুটির। মা সকালে বামুনপাড়ায় কাজে যায়। দুপুর গড়িয়ে ফেরে। আমাদের সকালে খিদে পেলে আমরা নদীতে এসে মাছ ধরি বা পাখি শিকার করি। আর পুড়িয়ে খাই’।
‘আর তোমাদের বাবা’?
এই প্রশ্নে দুই ভাইবোনই ঠোঁট উল্টে দিলো। মেয়েটি যেমন কালো, ভাইটি তার তেমনই ফর্সা।
আমার মনে সন্দেহ হল। এই ছেলেটি মেয়েটির বাবা কে? জঙ্গলের ভেতরে থাকা আর খাওয়ার অভ্যেস, অস্ত্র চালানোয় নিপুণতা আর সহজ নির্ভীক ব্যবহার দেখে মনেই হচ্ছে ওদের মা আদিবাসী রমণী। অথচ একাই থাকে। বাবা কি তবে মৃত? নাকি আদিবাসী কেউ বাবা নয়ই এদের। বাবা কি তবে……!!!” মহী থেমে গেল।
“ব্রাহ্মণ? মা যে ব্রাহ্মণপাড়ায় কাজ করে বলছ, তবে কি সেই রমণীর সঙ্গে সেখানকার কোন ব্রাহ্মণের সম্পর্ক আছে”? চরম উত্তেজনায় এই জিজ্ঞাসা বেরিয়ে এল দ্রুপদের মুখ থেকে।
অধ্যাপিকা, শিক্ষা বিজ্ঞান বিভাগ, রামকৃষ্ণ সারদা মিশন বিবেকানন্দ বিদ্যাভবন ।
প্রাচীন ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে আগ্রহী, লেখালেখি করার বদভ্যাস আছে। পৌরোহিত্য করেন, মূলত পুরোনতুন বৈদিক পদ্ধতিতে বিবাহ দেন এবং রবিগান কঠোপনিষদ ও ঋক্ মন্ত্রসহ অন্যরকমভাবে শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন।