[কথাসাহিত্যিক ইনতেজার হুসেইনকে তুলনা করা হয় প্রখ্যাত উর্দু ছোটগল্পকার সা’দত হাসান মান্টোর সঙ্গে। কেউ কেউ তাকে মান্টোর চেয়েও শক্তিশালী গল্পকার বলে দাবি করেন। মান্টোপরবর্তী উর্দু ছোটগল্পের সবচে’ শক্তিমান স্রষ্টা ইনতেজার হুসেইন প্রথম কোন পাকিস্তানি লেখক হিসেবে ম্যানবুকার পুরস্কারের হ্রস তালিকায় স্থান করে নিয়েছিলেন। বিখ্যাত উপন্যাস বাস্তি-এর জন্য ২০১৩ সালে ম্যানবুকার সংক্ষিপ্ত তালিকার চতুর্থ নামটি ছিল তার। পৌরাণিক আখ্যান, এরাবিয়ান নাইটস্ ও কাফকাকে ছেনে সৃষ্টি করেছেন ছোটগল্পের নিজস্ব স্টাইল। তার গল্পের প্লট, চরিত্র কিংবা ভাষা সবই প্রতীকি। এছাড়াও দেশভাগের সময় ভারত ছেড়ে আসা এই লেখকের লেখায় বারবার ঘুরেফিরে এসেছে নস্টালজিয়া।
ইনতেজার হুসেইন উর্দু ছাড়াও ইংরেজিতে লেখালেখি করেছেন। পেশাজীবনে পাকিস্তানের বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিক ডন-এ কাজ করেছেন। অনুবাদ করেছেন চেখভসহ বিশ্বসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ নানা লেখাজোখা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষের এই কথাসাহিত্যিক আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও লিখেছেন একাধিক অসাধারণ ছোটগল্প। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার বিখ্যাত ছোটগল্প হচ্ছে, নিঁদ, আসির এবং শেহরে আফসোস। এ ছাড়াও তার বিখ্যাত উপন্যাস বাস্তি-এর একটি বড় অংশ জুড়েই রয়েছে সাতচল্লিশ, উনসত্তর এবং একাত্তরের দিল্লি, ঢাকা এবং লাহোর। ২০১৬ সালের দুসরা ফেব্রুয়ারি উর্দু সাহিত্যের এই শক্তিমান লেখক মারা যান।
‘ভারত থেকে একটি চিঠি’ দেশভাগের প্রেক্ষাপটে লেখা ইনতেজার হুসেইনের বিখ্যাত ছোটগল্প ‘হিন্দুস্তান সে এক খত’এর অনুবাদ। গল্পটি সরাসরি উর্দু থেকে অনূদিত।]
অনুবাদক: সালেহ ফুয়াদ
প্রাণপ্রিয় কামরান মিয়া,
তোমার সাক্ষাৎ লাভ এবং দীঘার্য়ু কামনা করছি। পরকথা হলো, তোমার খোঁজখবর না পেয়ে বড় দুশ্চিন্তায় সময় কাটছে। নানা মাধ্যমে আমাদের খবরাখবর পাঠানোর এবং তোমার কুশল জানার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। একটা চিঠি লিখে ইব্রাহিমের ছেলে ইউসুফকে পাঠিয়ে তাকিদ দিয়ে বলেছিলাম, চিঠিটা তাড়াতাড়ি করাচির ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়ো। ওদিক থেকে যে চিঠি আসে তা-ও আমাকে ডাকযোগে পাঠিয়ে দিয়ো। তোমার জানার কথা, সে কুয়েতে আছে। ভালোই পয়সা কামাচ্ছে। হয়তো এসব কারণেই পত্রের কথা বেমালুম ভুলে গেছে। চিঠিটা পাঠাল কি পাঠাল না এবং ওদিক থেকে কোন উত্তর এলো কি এলো না কিছুই লিখে জানায় নি। শেখ সিদ্দিক হাসান খাঁর পুত্র লন্ডন যাচ্ছিল, করাচির ঠিকানায় লন্ডনের লেটারবক্সে ফেলার জন্য তাকেও একটা চিঠি ধরিয়ে দিই। কিন্তু সেই হারামখোরও চিঠিটা পাঠাল কিনা কিছুই জানায় নি।
সবচে’ বেশি দুশ্চিন্তা হচ্ছে ইমরান মিয়াকে নিয়ে। সে ওখানে পৌঁছতে পারল কিনা কে জানে। পৌঁছে থাকলে যেভাবেই হোক খোঁজখবর পাঠনোর কথা। ঘটনা হচ্ছে, ইমরান মিয়া এদিক হয়ে গিয়েছিল। তা যুদ্ধের দুই সোয়া-দুই মাস পরের কথা। তখন হালকা শীত বইছে। আমি আমার বিছানা পাকাঘরে নিয়ে এসেছি। শেষরাতে দরজায় টোকা পড়লে দুশ্চিন্তায় পড়ে যাই। এমন অসময়ে কে এলো, কেন এলো। দরজা খুলে টোকামারা লোকটার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখি। বিস্মিত ও হতবাক হয়ে যাই, এটা কে এলো! রক্ত রক্তকে চিনে নেয়, নতুবা চেনার মতো আসলে আর কিছু বাকি ছিল না। বুকে টেনে নিয়ে বলি, বাবা তোমাকে তো পাকিস্তানে অমন চেহারাসুরতে পাঠাই নি। চেহারার এ কী দশা বানিয়েছ। তারপর নিজেই আবার নিজের কথায় লজ্জিত হই। আমাদের আমানত আমরা ফিরে পেয়েছি এটাই বা কম কিসে। বান্দার উচিত সর্বাবস্থায় খোদার শুকরিয়া জ্ঞাপন করা। অভিযোগের শব্দ মুখে আনা যাবে না, পাছে তা আবার কুফরি কালাম হয়ে আজাবের উপযুক্ত হতে হয়। মানুষের মতো দুর্বল জাত—এ দুনিয়ায় এসে যা করেছে এরপর যা-ই হোক না কেন কোনো অভিযোগের সুযোগ নাই। মানুষের কাজ খামোশ থাকা। জীবনদাতা ও মহাপরাক্রমশালীর পরাক্রমকে ভয় করা।
তোমার চাচি ইমরান মিয়াকে দেখে ভেঙে পড়েন। বুকে টেনে নিয়ে খুব কান্নাকাটি করেন। আমি তো চুপ মেরে ছিলাম, কিন্তু সে জিজ্ঞেস করে বসে বউমা কোথায়, বাচ্চাগুলোকে কোথায় রেখে এসেছে। এসব প্রশ্ন শুনে ইমরানের চেহারা বদলে যায়। তার অবস্থা দেখে আমি আর তোমার চাচি দু’জনই ঘাবড়ে যাই। এরপর সতর্ক থাকি এরকম পরিস্থিতি যেন আর না ঘটে।
ইমরান মিয়া এখানে তিন দিন ছিল। কিন্তু একে কি থাকা বলে? কথা নাই হাসি নাই, সব সময় বিষণœ, বিমর্ষ। তৃতীয় দিন ইমরান মিয়ার মাথায় চাপলো সে মিয়া জানির কবরে যাবে। মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, দেখ বাবা, পঁচিশ বছর পর দাদার কবরে ফাতেহা পাঠ করতে যাচ্ছ ঠিকাছে কিন্তু দিনের বেলায় ওদিকে যাওয়াটা তোমার ঠিক না। তুমি এ মাটিতেই জন্মেছ, সহজেই তোমাকে চিনে ফেলবে। এ কথা শুনে ছেলেটা বড্ড রেগে যায়। বলে, ঘরে আসার আগে আমি বসতিটা চক্কর দিয়ে দেখে এসেছি। এ মাটি আমাকে চিনতে পারে নি। আমি বললাম, বাবা এ মাটি এখন তোমাকে না চিনলেই মঙ্গল। যাই হোক, মাগরিব পড়ে আমি ইমরান মিয়াকে নিয়ে কবরস্থানে যাই। নতুন কবরগুলোর সঙ্গে তাকে পরিচয় করিয়ে দিই। পুরনোগুলো সে নিজেই চিনতে পারে। অন্ধকারের কারণে কিছু কবর ঠাওর করতে কিছুটা সময় লেগেছে। মিয়াজানির কবরের কাছে গিয়ে ইমরান মিয়ার হৃদয় দুঃখে ফেটে যায়। আমার চোখও ভিজে আসে। কবরটা অনেকটা জীর্ণ হয়ে গেছে। মাথার দিকে দাঁড়িয়ে থাকা শিউলি ফুলের চারা পড়ে আছে। তোমার মনে আছে নিশ্চয়, মিয়াজানির শিউলি ফুলের বড় শখ ছিল। শখ করে বাগানে কয়েকটা চারা লাগিয়েছিল। গাছগুলো থেকে এত ফুল আসতো যে, তা দিয়ে সারা বছরই ঘরের মেয়েছেলেরা তাদের ওড়না রঙিন করে রাখত। প্রতিটি নেমনতন্নেই বিরিয়ানিতে এ ফুল দেওয়া হতো। তারপরও ফুরোতো না। কিন্তু শিউলি যত্ন চায়। আমি একা কয়টা জিনিসের খেয়াল রাখব। মিয়াজানির সিথানে থাকা এটাই ছিল শিউলি ফুলের শেষ চারা। যুদ্ধের আগের বর্ষায় সেটাও পড়ে যায়। এখন আমাদের বাগান এবং গোরস্তান দুটোই শিউলিশূন্য। এক আল্লার নাম ছাড়া কিছুই থাকে না। বেচারা বাগান তা-ও ভালো যে, গোরস্তানের পাশাপাশি থাকায় গোরস্তান বলে গণ্য হয়ে বেঁচে গেছে। হাত ফস্কে যেতে যেতেও বেঁচে গেছে। কিন্তু এ সাতাশ বছরে এত চারা ঝরে গেছে এবং এর সঙ্গে এত স্মৃতি দাফন হয়ে গেছে যে, এখন এ বাগানটাকেও গোরস্তান মনে করাই উত্তম। যে চারাগুলো এখনো রয়ে গেছে তা দেখে শুধু অতীতের স্মৃতিই মনে জাগে। যাকগে, বাগানের কী অবস্থা তা তো ইমরান মিয়া নিজেই দেখে গেছে। যদি সে পৌঁছে গিয়ে থাকে তাহলে তো তোমাকে বলবেই। ছেলেটা সেদিন সকালেই এখান থেকে চলে গেল। সারাটা রাত মিয়াজানির কবরের সিথানে বসে কাটিয়ে দিলো। সঙ্গে আমিও ছিলাম। যখন ভোর হলো এবং পাখি ডাকতে শুরু করল তখনই গা ঝাড়া দিয়ে উঠে আমার কাছে বিদায় চায়। আমি উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করি, কেন যাচ্ছ বাপ? এসেই যখন পড়েছ তখন থেকে যাও। অভিমানী হয়ে বলে, আমাকে তো কেউই চেনে না। আমি বললাম, বাপ, এখন না চেনার মধ্যেই মঙ্গল। কিন্তু সে আমার কথা কানেই তুলল না। চলেই যাবে। জিজ্ঞেস করি, কিন্তু বাবা তুমি যাবেটা কোথায়? বলে কিনা পা যেখানে নিয়ে যাবে সেখানইে যাবে। তার কথাবার্তা থেকে আন্দাজ করি, কাঠমান্ডু যেয়ে সেখান থেকে করাচি যাওয়ার কোনো পথ বের করার নিয়ত করেছে। প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছিল তবু ওর জেদ, তাছাড়া আমারও ভয় কেউ না আবার জেনে ফেলে, সব ভেবে ধৈর্য ধরি। আমার বাহু থেকে ‘দুয়ায়ে নুর’ খুলে তার বাহুতে বেঁধে দিই। তারপর আল্লার উপর ভরসা করে তাকে বিদায় দিই। এগিয়ে দিতে দিতে জোর দিয়ে বলি, সীমান্ত পাড়ি দেওয়ামাত্র যেভাবেই হোক কুশল জানাবে। কিন্তু আজও অবধি কোন খবর পেলাম না।
ওদিককার খবরাখবর এদিকে খুব কমই আসে। আর এলেও এমন খবর আসে যা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না। একদিন সিদ্দিক হাসান এসে খবর দিলেন পাকিস্তানের সবাই নাকি সোস্যালিস্ট হয়ে গেছে। প্রতি সের পেঁয়াজ নাকি পাঁচ রুপি দরে বিক্রি হচ্ছে। এসব শুনে তো দমে যাই। পরে ভাবলাম, শেখ সাহেব তো আদি কংগ্রেসি, পাকিস্তানের কোনো খবর শোনালে তো তার এমন খবরাখবরই শোনানোর কথা। তার কথায় বিশ্বাস করা ঠিক হবে না। কয়েক দিন পরেই এমন একটা খবর পেলাম যে, সব গুজবের উত্তর পেয়ে যাই। খবর পেলাম মির্জাদের নাকি অমুসলিম বলে ঘোষণা করা হয়ে গেছে। শেখ সাহেবকে এ খবর শোনালে তিনি বিশ্বাসই করলেন না। আল্লাহ তায়ালা পাকিস্তানের উপর রহম করুন। তাদেরকে তাদের পুণ্যের পুরস্কার দিন। আমরা তো আছি কুফরিস্তানে। অনৈসলামিক রীতি-রেওয়াজ সহ্য করতে হয়, কিছু বলাও যায় না। এই আমাদের বড় ঘরের পাশেই গায়রে মুকাল্লিদরা তাদের মসজিদ বানিয়েছে। ওখানে ওরা জোরে আমিন বলে আর আমরা চুপ থাকি।
হ্যাঁ, শেখ সিদ্দিক হাসান তোমাদেরও একটা খবর দিয়েছেন। তুমি নাকি পাকা ঘর তুলেছ। ঘরে সোফা-টেলিভিশনও রেখেছ। খবরটা শুনে খুব আনন্দিত হয়েছি। এখানকার ক্ষতি ওখানে পুষিয়ে যাচ্ছে-আল্লার শুকরিয়া। এখানকার বড় ঘরটার অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। দেবে যাওয়া খুঁটিগুলো গত বর্ষায় আরো দেবে গেছে। মেহমানখানার যা অবস্থা! ছাদের দিকে তাকালে আসমান দেখা যায়। বেকারত্ব আর ঋণের কথা তো তোমার ভালোই জানা আছে। তুমি কিছু পয়সা পাঠালে মিয়াজানির কবরটা মেরামত করিয়ে দেওয়া যেত। মেহমানখানার ছাদেও কিছুটা মাটি দেওয়া যেত। এর চে’ বেশি কিছু এখন আর করতেও চাইছি না। বড় ঘরের মামলাটার এখনো রায় হয় নি। সেই সাত চল্লিশে যাওয়ার সময় মরহুম কেবলা ভাই মামলার কাগজ-পত্র আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। আলহামদুলিল্লাহ, তখন থেকে আজও প্রতিটি শুনানিই সফলতার সঙ্গে মোকাবেলা করেছি এবং উপযুক্ত উকিলই হাজির করেছি। খোদার ইচ্ছায় আশা করছি, মামলার রায় ঘোষণা খুব শিগগিরই হয়ে যাবে এবং তা আমাদের পক্ষেই হবে। কিন্তু এক মিনিটের ভরসা নাই, কখন মৃত্যুর খড়গ এসে মাথায় পড়ে। মাঝে মাঝে খুব দ্বিধাগ্রস্ত হই, আমার পর এ মামলা কে চালিয়ে যাবে।
যে দিকেই তাকাই অন্ধকার আর অন্ধকার। আমাদের সাহেবজাদা আখতার তো প্রেমের খাতায় নাম লিখিয়ে বসে আছেন। বেতারনাটকে অভিনয় করছেন। মরহুম ছোট ভাইয়ার মেয়ে খালিদা এক হিন্দু উকিলকে বিয়ে করে বসেছে। বেপর্দা হয়ে শাড়ি পরে মাথায় সিঁদুর দিয়ে ঘোরে। পাকিস্তানে আমাদের খান্দানের যে অবস্থা তা আমার চে’ তোমার বেশি জানার কথা। শুনলাম বড় আপুর মেয়ে নারগিস নিজের পছন্দে বিয়ে করেছে। যাকে বিয়ে করেছে সে নাকি ওহাবি। খোদ বড় আপুর মারফতেই শুনলাম, নারগিস নাকি ছেলেদের আড্ডায় মুখ না ঢেকেই কথাবার্তা বলে এবং বাজার থেকে দরাদরি করে কাপড়চোপড় কেনাকাটা করে।
এসব দেখার জন্য একা আমিই শুধু বেঁচে আছি। কেবলা ভাই মরহুম এবং ছোট ভাইয়া দু’জনই ভালো সময়ে চলে গেছেন। মিয়াজানি এবং ছোট ভাইয়ার কবরে যখন ফাতেহা পড়ি তখন কেবলা ভাইকে খুব মনে পড়ে। কী সময় এলো আমাদের কারো পক্ষে তার কবরটা পর্যন্ত জেয়ারত করার সুযোগ নাই। যে পরিবার এক সঙ্গে বেঁচেছে, এক সঙ্গে থেকেই মরেছে সেই তাদের কবর এখন তিন তিনটা গোরস্তানে ভাগ হয়ে গেছে। কেবলা ভাইকে শ্রদ্ধার সাথে বলেছিলাম, আমাদেরকে আপনি ছেড়ে গেলেও ভালো হয় অন্তত কামরান মিয়ার কাছে করাচি চলে গেলে। কিন্তু ছোট ছেলের ভালোবাসা তাকে ঢাকা নিয়ে গেল। তার অসময়ে মৃত্যু আমাদের সবার জন্য বড় আঘাত ছিল। এখন মনে হচ্ছে তার তাড়াতাড়ি চলে যাওয়াটাই বরং ভালো হয়েছে। তিনি পুণ্যবান মানুষ ছিলেন। খোদা চান নি তিনি এসব দুঃসময় দেখার জন্য বেঁচে থাকুন। এসব তো আমার মতো পাপীর জন্য।
যখন বড়দের ছায়া মাথার উপর থেকে সরে গেছে আর আমাদের আত্মীয়স্বজনরাও ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে ভাগ হয়ে গেছে তখন ভাবছি আমার কাছে থাকা গচ্ছিত আমানত তোমার কাছে পৌঁছে দেব। বংশের বড় ছেলে তো এখন তুমিই। হেফাজতের জন্যই এ আমানত তোমার কাছে পাঠানো দরকার। বংশলতিকাসহ সমস্ত স্মৃতিচিহ্ন কেবলা ভাই নিজের সঙ্গে ঢাকায় নিয়ে গিয়েছিলেন। যেখানে বংশের সদস্যরা হারিয়ে গেছেন সেখানে ওসব স্মৃতিচিহ্নও মুছে গেছে। ইমরান মিয়া এখানে একেবারে শূন্য হাতে এসেছিল। সবচে’ বড় দুর্ঘটনা হলো আমাদের বংশলতিকা হারিয়ে গেছে। আমাদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন মহান ফাতেমি বংশের নেতা। ইতিহাসে কত কত বিপদ-আপদ তারা দেখে গেছেন অথচ বংশলতিকা হারানোর আঘাত আমাদেরকেই সইতে হলো। এখন আমরা এমন এক বিপদগ্রস্ত বংশে পরিণত হয়েছি যে বংশ তার নিজস্ব ঠিকানা ও বংশলতিকা হারিয়ে ফেলেছে। যে বংশ উদ্বিগ্ন। কেউ ভারতে প্রাণ দিয়েছে, কেউ বাংলাদেশে হারিয়ে গেছে আর কেউ পাকিস্তানে উদ্ভ্রান্তের ন্যায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। বংশের ধর্ম-বিশ্বাসে বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে। অনৈসলামিক রীতিনীতিকে আপন করে নিয়েছে। ভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ে বিয়ে করছে। এ রকম চলতে থাকলে অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের বংশের প্রকৃত ধারা একেবারেই বিলীন হয়ে যাবে। আমরা কে এবং কী এ কথাটা বলারও কেউ বাকি থাকবে না।
শোন বাবা, আমরা হলাম দু’দিক থেকেই উচ্চবংশীয় সাইয়িদ। হজরত ইমাম মুসা কাজেমের সঙ্গে গিয়ে আমাদের বংশলতিকা মিলিত হয়। কিন্তু খোদার শুকরিয়া যে আমরা রাফেজি নই। বিশুদ্ধ আকিদার হানাফি মুসলমান। আমরা জ্যেষ্ঠ সাহাবিদের মানি এবং আহলে বায়তকেও ভালোবাসি। মিয়াজানি আশুরার দিন রোজা রাখতেন এবং সারাদিন জায়নামাজে বসে কাটাতেন। আমাদের ঘরে একটা তসবিহ ছিল। আশুরার দিন হিসারের সময় তসবিহটা লাল হয়ে যেত। মিয়াজানি বলতেন, এটি সেই বিশেষ মাটির দানা দিয়ে তৈরি যেখানে আমাদের দাদা সাইয়িদুনা হজরত ইমাম হুসাইন আ. ঘোড়া থেকে অবতরণ করেছিলেন। তসবিহর লাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাবাজানের খোদায় মত্ততা বেড়ে যেত। কিন্তু তিনি বুক রক্তাক্ত করা এবং মর্সিয়া করা থেকে বিরত থাকতেন। এসব বিদাত। তবে হ্যাঁ, গরিবগুর্বাদের মাঝে বন্টনের জন্য ডেগ ভরে ভরে খিচুড়ি পাকাতেন। দেশভাগের পর কমতে কমতে সেই ডেগের পরিমাণ একে নেমে এসেছে। গত বছর তো তা-ও হয় নি। শুধু এক ডেগ ছোলার খিচুড়ি রান্না করিয়ে গরীবদের মাঝে বন্টন করে দিয়েছিলাম। সামনের বছর কী হবে আল্লাই ভালো জানেন। দিনদিন জিনিসপত্রের দাম বেড়ে চলেছে আর আমাদের অবস্থা দিনকে দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। বাবা, পাকিস্তানে পেঁয়াজ কী পরিমাণ চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে তা তো আমরা জানি, তবে একটা কথা মনোযোগ দিয়ে শোনো—জিনিসপত্রের দাম উর্ধ্বমুখি হচ্ছে কিন্তু মানুষের চরিত্র দিন দিন নিম্নগামী হচ্ছে। এমন সময় এলে বান্দাদের উচিত তওবা-ইস্তেগফার করা, ‘আদ ও ছামুদ জাতির আলোচনায় বুদ্ধিমানদের জন্য রয়েছে বহু নিদর্শন’—কালামে পাকের এ আয়াত তেলাওয়াত করা।
যাকগে, আমি আমাদের বংশের কথা বলছিলাম, সেই বংশের কথা যাকে আমি একত্রিত দেখেছি কিন্তু তারচে’ বেশি দেখেছি বিচ্ছিন্ন হতে। আমাদের তিন ভাইকে সামনাসামনি বসিয়ে মিয়াজানি [আল্লাহ তাকে শিউলির সুঘ্রাণের মধ্যে রাখুন] বলেন, আমি তোমাদেরকে যা বলতে চাইছি তা আমার পিতা সাইয়িদ হাতিম আলি তার জীবনের শেষ সময়ে বলেছিলেন। তিনি বলেন, একসময় আমাদের বংশীয় গৌরব ছিল, তারপর সাতান্ন সালে বাইশ খাজার সীমানা ছেড়ে বছরের পর বছর ছেঁড়া ত্যানা পরে উদ্বাস্তুর মতো ঘুরে বেড়ানোর মধ্যদিয়ে এর বিলুপ্তি ঘটে। আমরা আসলে ইস্পাহানের মাটি। পরদেশি শাহানশাহ হুমায়ুন তার সালতানাতের জন্য এ অঞ্চলে নিজের বাহিনী প্রেরণ করলে ইস্পাহান অর্ধজাহান থেকে খেজুর ব্যবসায়ী ও হাদিস শাস্ত্রের বিখ্যাত পণ্ডিত আমাদের প্রধান পূর্বপুরুষ মীর মনসুর এর যাত্রাসঙ্গী হয় এবং অত্যাচারিত হিন্দে পৌঁছে বিশ্বাসের আলোকবর্তিকা হয়ে আবির্ভুত হয়। আকবরাবাদে তার মাজার আজো সকলের যাতায়াতকেন্দ্র হয়ে আছে। কাঁচা কবর। অবিবাহিতারা মাটি নিয়ে সিঁথিতে লাগায়। বছর ঘোরার আগেই সে মাটি সিঁদুরে পরিণত হয়। নিঃসন্তান নারীরা আঁচলে বেঁধে মাটি নিয়ে যাওয়ার বছরদিন পরেই ভরা কোল নিয়ে মাজারে এসে গিলাফ চড়ায়। শাহজাহানের সময় এই বুজুর্গের সন্তানেরা সফরের প্রস্তুতি নেয় এবং জাহানাবাদে গিয়ে থামে। তারপর ওখান থেকে সাতান্নর গ-গোলের সময় বেরিয়ে পড়ে। আমাদের দাদা মীর রুস্তম আলি কাঁচা পয়সা সঙ্গে নেন নি। শুধু বংশলতিকাটাকে পুটলিতে পুরে কোমরে মজবুত করে বেঁধে নেন। কাগজ-দস্তাবেজের গাট্টি বগলদাবা করে বেরিয়ে পড়েন। সে গাট্টিতেই বংশের আদ্যোপান্ত লেখা ছিল। পথে দস্যুদের সঙ্গে লড়াই বাঁধে। এইসব হুলুস্থুলের মাঝে গাট্টি খুলে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে পড়ে। কিছু কাগজ পড়ে যায়, কিছু থেকে যায়। পড়ে যাওয়া কাগজগুলোর মধ্যে বংশের আদ্যোপান্ত লেখা কাগজগুলোও ছিল। কিন্তু খোদার হাজারো কৃতজ্ঞতা যে বংশলতিকার একটি অক্ষরও সামান্য মলিন হয় নি। নানাদেশ ঘুরে এই জনপদের মাটিকে দয়ার্দ্র পেয়ে এখানে ডেরা ফেলেন। আজ যেখানে তোমার হতভাগা চাচা একা মাটি কামড়ে পড়ে আছেন। জানা থাকা ভালো, মাটি যখন দয়ার্দ্র হয় তখন প্রেমিকার আলিঙ্গনের মতো কোমল এবং মায়ের কোলের মতো প্রশস্ত হয়ে ওঠে। আর দয়াহীন হলে জালিম শাসকের মতো কঠিন এবং হিংসুকের অন্তরের মতো সংকীর্ণ হয়ে যায়। সত্য কথা হলো, এ মাটি একটা সময় পর্যন্ত আমাদের উপর দয়া করেছে। আমাদের বাড়ন্ত বংশকে দীর্ঘদিন পর্যন্ত নিজের কোলে এমনভাবে আগলে রেখেছে যেভাবে একজন অধিকার খাটাতে পছন্দ-করা মা আপন সন্তানদেরকে বুকে ধরে রাখে। কাউকেই চোখের আড়াল হতে দেয় না। দেশভাগের পূর্বে এ বংশের মাত্র তিনজন ব্যক্তি বাইরে গিয়েছিলেন। ভাই আশরাফ আলি, ফারুক ভাইয়া এবং পেয়ার মিয়া। ভাই আশরাফ আলি আমাদের চাচাজানের ছেলে। বয়সে কেবলা ভাই থেকে বছরদিনের বড় ছিলেন। তোমাদের এই জ্যাঠা মশাই ডেপুটি কালেক্টর ছিলেন। চাকরির সূত্রেই বাইরের জেলায় থাকতেন। কিন্তু সম্মানী-উপহার এখানেই আসত। আমার সমবয়সী ফারুক ভাইয়া তার ছোট ভাই ছিলেন। মহকুমা বন অফিসে ছিলেন। সারাজীবন সি.পি-তে কেটেছে। আমাদের বাড়িতে কাঠের যেসব আসবাব দেখেছ তার সবই তার বানানো বা পাঠানো। দুই ভাই-ই বংশের গৌরব ছিলেন। সারাজীবন বাইরে কাটিয়ে শেষে আপন ভূমিতে এসেই শান্তি করেছেন।
পেয়ার মিয়া ছিলেন ফুফু-আম্মার আদরের দুলাল। অতি আদরে বখে গিয়ে নানা অন্যায় কাজ করতে লাগলেন। আমাদের বংশে তিনিই প্রথম বায়োস্কোপ দেখা ব্যক্তি। তার জোরাজুরিতে একবার আমারও স্খলন ঘটে। মাধুরীকে দেখে আমার হৃদয় এলোমেলো হয়ে যায়। কিন্তু আমি খুব তাড়াতাড়িই নিজেকে সামলে নিই। তারপর আর ওমুখো হই নি। পেয়ার মিয়া আগে নাটকের পাগল ছিল। পরে শহরে বায়োস্কোপ এলে তার ভক্ত হয়ে যায়।
‘বোম্বাই কি বিল্লি’ দেখে সুলোচনার রূপে পাগল হয়ে যায়। একদিন ফুফু-আম্মার সোনার চুড়ি চুরি করে সোজা বোম্বেতে গিয়ে ওঠে। মিয়াজানি খবর পাঠান, প্রিয় পুত্র, আর এ মুখো হয়ো না কোনোদিন। বোম্বেতে এক বাটপার তাকে সুলোচনার সঙ্গে দেখা করাবে বলে ধোঁকা দেয়। সুলোচনার সঙ্গে সাক্ষাত তো দূর নিজেই ফাঁদে পড়ে যায়। সারাটা যৌবনকাল বোম্বেতেই কাটিয়ে দেয়। ফুফু-আম্মার মরার খবর পেয়ে বাড়ি আসে। ততদিনে বৃদ্ধাবস্থা তাকে কাবু করে ফেলেছে। লম্বা সাদা দাড়ি, হাতে তসবিহ। মায়ের জন্য খুব কান্নাকাটি করে। আমরা সবাই বললাম, এবার থেকে এখানেই থাক। বলে কি, মিয়াজানির অনুমতি ছাড়া কিভাবে থাকি। মিয়াজানি আরো আগেই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন। অনুমতি দেবে কে। আবারো বোম্বেতে ফিরে যায়। ৪৭’ শুরু হয়ে গিয়েছিল। বাসে-ট্রামে দুর্ঘটনা ঘটে যাচ্ছিল। সবাই কত করে বোঝাল, কারো কথাই শুনল না। গাড়িতে চড়ে বসেছে ঠিকই কিন্তু বোম্বেতে আর পৌঁছে নি। না-জানি পথে তার উপর কী ঘটেছিল।
পেয়ার মিয়া ছিল ‘৪৭-এর দাঙ্গায় আমাদের বংশের প্রথম কুরবানি। আমি হিসাব করে দেখেছি, তখন থেকে এখন পর্যন্ত আমাদের বংশের একত্রিশজন সদস্য আল্লার প্রিয় হয়েছেন এবং একুশজন নিহত হয়েছেন। সাতজনকে হিন্দুরা ভারতে নৃশংসভাবে শহিদ করেছে। চৌদ্দজন পাকিস্তানে গিয়ে আপন মুসলিম ভাইদের হাতেই আল্লার নৈকট্য পেয়েছেন। এ চৌদ্দজনের একজনকে নির্বাচনে ফাতেমা জিন্নার মেয়েকে সাহায্য করার শাস্তি স্বরূপ আয়ুবের লোকেরা করাচিতে গুলি করে মেরে ফেলে। বাকি দশজন পূর্ব-পাকিস্তানে নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে ইমরান মিয়াকে আমি গণনায় ধরি নি। আল্লাহর রহমত থেকে বান্দার নিরাশ হওয়া উচিত না। আমার মন বলছে, আমাদের কলিজার টুকরো এখনো করাচি পৌঁছে না থাকলে সম্ভবত সে কাঠমান্ডু গিয়ে থাকবে। কাঠমান্ডু বলায় মনে পড়ল, ফারুক ভাইয়ার পুত্র শরাফতও ঢাকা থেকে কাঠমান্ডু যাচ্ছিল, যাত্রাপথে এখানে বিরতি দিয়েছিল। এ যেন আরেক পেয়ার মিয়া। এত বড় একটি দুর্ঘটনাও যদি তাকে কিছুটা প্রভাবিত করত। যে কয়টা দিন এখানে ছিল বায়োস্কোপ দেখে দেখে কাটিয়েছে। বিদায়ের জন্য যখন তৈরি হলো তখন কাঠমান্ডুর বদলে বোম্বের জন্য ব্যাগ গোছগাছ করল। বোম্বে যাওয়ার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে বলে, আমি রাজেশ খান্নার সঙ্গে দেখা করব। জিজ্ঞেস করি, রাজেশ খান্না এমন কোন অভিনেতা না টবিনেতা যে তার সঙ্গে দেখা করার জন্য অস্থির হয়ে আছ। আমার কথা সে এক কানে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে বোম্বে রওয়ানা হয়ে যায়। পরে শ্রীলঙ্কা থেকে তার খবর আসে। জানি নে কোন কোন পথ ঘুরে সে ওখানে পৌঁছেছে।
আরো পড়ুন: অনুবাদ রহস্য গল্প: নীল পদ্মরাগ । স্যার আর্থার কোনান ডয়েল
শরাফতকে জীবিত দেখে খোদার শুকরিয়া আদায় করি। কিন্তু তার মতিগতি দেখে খুব একটা খুশি হতে পারি নি। যেমনটা শুনেছি, পাকিস্তানে যেয়ে আমাদের মেয়েরা একটু বেশিই স্বাধীন হয়েছেন। যে মেয়ের ব্যাপারেই খোঁজ নিই-শুনি সে নিজের পছন্দে বিয়ে করে নিয়েছে। দেশভাগের পূর্বে বদনামি করার মতো বংশে একটা ঘটনাই ঘটেছিল। কিন্তু সে ঘটনাটাকেও সুন্দর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মিটমাট করে দেওয়া হয়েছিল। ছোট ফুফুর ছাদে একবার একটা ঘুড়ি এসে পড়ে। তুমি তো জানোই, যুবতী রয়েছে এমন বাড়ির আঙিনায় ঢিল পড়া কিংবা ছাদে ঘুড়ি আটকে যাওয়া কোনো ভালো লক্ষণ নয়। ছোট ফুফুর বড় মেয়ে খাদিজা তখন ডাঙর হয়ে উঠেছিল। ছোট ফুফু এ ঘটনার খবর এসে মিয়াজানিকে দিলেন। ঘুড়ির সঙ্গে যে চিরকুট ছাদে এসে পড়েছিল তা-ও সামনে রাখলেন। মিয়াজানি তো রাগে অগ্নিমূর্তি ধারণ করলেন। রেজা আলির ছেলের এতো সাহস যে আমাদের ছাদে তার ঘুড়ি এসে পড়ে—এসব বলে খুব তর্জন-গর্জন করেন। ছোট ফুফু ব্যাপারটার নেতিবাচক দিক বুঝিয়ে বললে মিয়াজানির গলা নেমে আসে। ওই বদমাশটার সঙ্গে দু’কলমা পড়িয়ে মেয়েটাকে ওর হাতে তুলে দেওয়া ছাড়া আর কী উপায় ছিল। এ ঘরের মেয়ে তার বউ হবে রেজা আলি সাহেব এ কথা স্বপ্নেও ভাবেন নি। দ্রুত বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়ে যায়। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে ‘মুতা বিয়ে’ পড়ানোর দাবি তোলে। মিয়াজানি রাগে গজরাতে থাকেন। কিন্তু করবেন কী, শেষ পর্যন্ত হ্যাঁ বলতে বাধ্য হন। এর পরিণামটা কী হলো? মাঝখান থেকে খাদিজার সন্তানগুলো এলোমেলো হয়ে গেল। একজন পবিত্র ফাতেহা-ই-ইয়াজদহম পালন করে তো অন্যজন মুহররমে মর্সিয়া করে। আর এখন তো আমাদের পুরো বংশটাই এলোমেলো। বংশলতিকা হারিয়ে গেছে, আমরা সবাই ‘মর্সিয়াকারী’। বংশীয় বৈশিষ্ট্য নষ্ট হয়ে গেছে। ভবিষ্যতে এ বংশকে কী করে আলাদাভাবে চেনা যাবে। এ বংশ এখন ঝরা পাতার মতো। বাতাসে উড়ছে, মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
প্রিয়, আমি এখন উড়ন্ত ঝরা পাতার মাতমকারী। এ বংশ যখন ফলে-ফুলে ভারী বৃক্ষ ছিল সে সময়কার কথা স্মরণ করি আর নষ্ট পাতা গুণি। যারা মৃত শুধু তাদেরকেই নয় বরং যাদেরকে জীবিত বলে ধরা হয় তাদেরও নামঠিকানা, হালহকিকত লিপিবদ্ধ করেছি। বংশের কোন সন্তান কোন দেশে বখে গেছে এবং কোন নগরের মাটি গায়ে মেখে আছে তা ভালো করে খোঁজ নিয়েছি। এ গুরুত্বপূর্ণ কাগজাদি আমি তোমাকে পাঠিয়ে দেবো। আমার নিভু নিভু বাতির তো কোনো ভরসা নাই। বাতি নিভে যেতে চাইছে। চোখ বন্ধ হতে চাইছে। তুমি এ বংশের ভালোবাসার বাতি। অন্ধকারে ঘূর্ণায়মানদের আলোতে আনার চেষ্টা করলে তোমার পুণ্য হবে। যদিও অভিজ্ঞতায় ভেঙে যাওয়া এলোমেলো বংশকে কখনো সামলে উঠতে দেখা যায় নি তবু চেষ্টা করে যাওয়াটা মানুষের জন্য জরুরি। এরকম একটা দুঃখী বংশের আশা হয়ে ওঠো, ভ্রষ্টদের খোঁজখবর রাখো। এখন নাকি দু’দেশে চলাচলের পথ খুলছে, এদিকেও একবার ঘুরে যাও। তোমার মুখটা একবার দেখিয়ে যাও। আমাদেরকেও দেখে যাও। তোমার চাচির ইচ্ছে, বউমাকেও সঙ্গে নিয়ে আসো। হ্যাঁ, মিয়া একা এসো না। এ সুযোগে তোমার ছেলে-মেয়েগুলোকেও দেখে নেবো কী রকম দেখতে হয়েছে ওরা, কে কালো কে ফর্সা? আরেকটা কথা, পাকিস্তান যাওয়ার পর এ বংশে যে বৃদ্ধি হয়েছে তার বিস্তারিত নাম পর্যন্ত আমি লিপিবদ্ধ করেছি। চেহারা-সুরত ও গঠন-আকৃতির বর্ণনা দিতে পারি নি।
এ ছকগুলো তুমি নিজে পূরণ করে নিয়ো। এই আড়াই থেকে পৌনে তিন বছরে বংশে যে হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটেছে তা-ও অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। এ সময়ের মধ্যে যারা ওদিকে গিয়ে থিতু হয়েছে তাদের বিস্তারিত আমাকে লিখে জানাও। আমি পৃথক পৃথকভাবে ক’জনকে পত্র পাঠাব? তা-ও ডাক খুললে কথা। কিন্তু ডাক খরচও এতো বেশি যে মনে হয় যেন টেলিগ্রাম পাঠাচ্ছি। আর আমি এটা কি শুনছি, খাদিজার ছোট মেয়েটা নাকি স্বামীর কাছ থেকে ‘খুলা’ তালাক নিয়ে পরিবার পরিকল্পনা অফিসে চাকরি নিয়েছে। নিজে তো গেছেই অন্যের সংসারেও অশান্তির সৃষ্টি করছে। হা মিয়া, বংশলতিকা তো হারিয়েই গেছে এখন এ বংশ যা-ই করুক তা সামান্যই। কিন্তু শুনছি অন্যান্য বংশ নাকি আরো এগিয়ে। কে যেন বলছিল, ইবরাহিম আটা ভাঙিয়ে ভাঙিয়ে চুরিটুরি করে নাকি আরো একটা মিল বসিয়ে ফেলেছে। এখানে বাজে অবস্থায় থাকা মিয়া ফয়জুদ্দিন নাকি ওখানে গিয়ে কালো টাকায় বাসাবাড়ি করে ফেলেছে। আমার জানতে ইচ্ছে করছে পাকিস্তানে কি সব বংশেরই বংশলতিকা হারিয়ে গেছে? অদ্ভুত বড় অদ্ভুত, আমরা এই ভারতে শত বছর কাটিয়ে দিলাম, সুখের সময় কাটিয়েছি, দারিদ্রের মধ্যে কাটানো দিনের সাক্ষীও আমরা, আমরা শাসন করেছি, শাসিতও হয়েছি কিন্তু সর্বাবস্থায়ই বংশলতিকা ধরে রেখেছি। আর ওদিকের লোকেরা সিকি শতাব্দিতেই নিজেদের বংশলতিকা খুইয়ে বসেছে। যাকগে, যেভাবে খুশি তারা ভালো থাকুক।
আর কী লিখব। লিখার তো আছে অনেক কিছুই কিন্তু তুমি এই অল্প লেখাকেই যথেষ্ট মনে করো। তোমাদের ভালোমন্দ জানিয়ো। আসার খবর দিয়ো। নামাজের সময় হয়ে যাচ্ছে, এখানেই শেষ করছি। নামাজ পড়ে মামলার কাগজপত্র গোছাতে হবে। কাল আবার শুনানি। এটা হবে চার শ’ সাতাইশতম শুনানি। ইনশাআল্লাহ, এবারো ভালোয় ভালোয় উতরে যাব আশাকরি। আমি সম্ভবত এই শুনানির জন্যই এখনো বেঁচে আছি নতুবা তোমাদের এই বৃদ্ধ চাচার মধ্যে বেঁচে থাকার মতো আর কিছু অবশিষ্ট নাই। এমনকি এখন আর বাঁচার আগ্রহও অবশিষ্ট নাই। এ দুনিয়ায় এসে অনেক কিছু দেখে ফেলেছি। যা দেখার ছিল না তা-ও দেখেছি। এবার তাড়াতাড়ি চোখ বন্ধ করতে পারলেই ভালো। তাহলে সারাজীবনে যা দেখার জন্য অপেক্ষা করছি তা হয়তো দেখতে পাব।
ইতি
তোমার দূরের চাচা
কুরবান আলি