Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,মীর সাহেব

ধারাবাহিক: অমৃতস্য পুত্রা (পর্ব-৬) । অনিন্দিতা মণ্ডল

Reading Time: 4 minutes

ভুলোকাকার ভাড়াটে বাড়ির গল্পে ওর না দেখা পূর্বপুরুষের আনাগোনা ঠিক রূপকথার মতোই। আমরা সব বাচ্চা হাঁ করে শুনতাম ঝড়ের রাতে কাপড়ের দোলনা থেকে মা কেমন বাচ্চাকে তুলে বুকে চেপে ধরত। কাকা বলত – তোমাদের বলব কী, সে ঝড় তোমরা কক্ষনো দেখোনি। আমার মনে দুঃখ হতো। কেন ঝড় হয়না অমন? মা তবে আমাকে ওরকম জড়িয়ে ধরবে? জিজ্ঞেস করতাম, ভুলোকাকা? তোমাকে তোমার মা ওরকম করে দোলনায় দুলিয়ে রাখত? ভয় পেলে কোলে নিতো? কাকা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতো -আঃ! কী যে কথার মাঝে কথা বলো! আমি কি মাকে দেখেছি নাকি? সে কবে চোখ বুঁজেছে!

মাকে দেখেনি ভুলোকাকা? আমরা অবাক হয়ে যেতাম। তা আবার হয় নাকি? মাকে দেখবেনা কেন? সব্বার মা থাকে। থাকেই। তবু চুপ করে থাকি। নয়তো গল্প শোনা হবেনা।

যা হোক, এভাবেই ভুলোকাকা ওর না দেখা অজস্র ভাড়াটে বাড়ির গল্প বলত আমাদের। একটা ওরকম গল্পে বাড়িটা ছিল জলা জায়গায়। কয়েকটা কাঠের খুঁটির ওপরে বসানো কাঠের ঘর। জমির সঙ্গে কারোর দেখা হতো না। আমরা ভাবতাম ইশ! আমাদের ওরকম একটা বাড়ি থাকলে কী ভালো হতো! মনে মনে টের পেতাম কেন ভাড়াটে বলে ভুলোকাকার অত গর্ব। এতগুলো অদ্ভুত বাড়িতে থাকার মধ্যে অহংকার নেই?

ভাড়াটে হয়ে থাকাই যে সবচেয়ে গর্বের, জীবনের লক্ষ্য, সেটা বুঝে গেছিলাম।

ততদিনে সুতপাদিদের বাড়িতে নতুন ভাড়াটে এসে গেছে। সদ্য বিয়ে হওয়া স্বামী স্ত্রী। মা বলেছিল আমাদের, বড় মেয়েদের সঙ্গে বেশি গল্প করতে নেই। আর সুতপাদি অনেক বড়। ওদের বাড়ির ভাড়াটেদের সঙ্গে ও গল্প করে। তাই মনে মনে বড় হয়ে গেছে। আমি রিকশায় বসে আড়চোখে শম্পাকে দেখতাম। ক্লাস থ্রিতে পড়লেই বা কি? ও কি কম বড় হয়েছে? মুখটা সবসময় গম্ভীর। ভুলোকাকা বলে, ওর দাঁতে ব্যাথা। তাই ও হাসতে পারে না। একথায় ও ভীষণ রেগে যেত। বলত—দাঁড়াও, বাবাকে অন্য রিক্সা ঠিক করতে বলব। ভুলোকাকা মিনতিভরা গলায় বলত—না না খুকু। বলো নি। আমি আর কক্ষনো এমন কথা বলব নি।  

ইশকুল থেকে ফেরার সময় ভুলোকাকা জোরে জোরে রিকশা চালাতো।  

আমাদের বাড়ির দরজায় নামিয়ে দিয়ে চলে যেতো গলির মুখে কালীবাড়ি। দুপুরের আরতিতে বড় ঘন্টা বাজাতো। বদলে পেতো শালপাতায় করা খিচুড়ি আর ভাজা।

দেরি হলে মাথা নাড়ত। খুকু তাড়াতাড়ি করো। ঘন্টা বাজাতে হবে। আমরা বলতাম, ঘণ্টা না বাজালে কি? খিচুড়ি দেবেই তোমাকে। ও দুঃখ পেতো – না না। এমনি খেলে গোনা হবে।

ওর বৌ আতর ওকে বলেছিল, কাজ না করে খেলে গোনা হয়। আমার ভুলোকাকাকে বলা হয়নি, মীর সাহেব বলেছে, খোদা গোনা গোণে না। ও মানুষের কাজ।  

ভুলোকাকার ভাড়াটে বাড়ি আর ভীষণ সাজানো রিকশা এখনো আমার মনের মধ্যে একটা স্বপ্নের দুনিয়া তৈরি করে।

রিক্সাটা ভীষণ সাজিয়ে রাখতো ভুলো কাকা।

এত সুন্দর সাজানো সচরাচর চোখে পড়ে না। স্টিলের গেলাসে ছোট ছোট ফুটো করে তার মধ্যে নাইলনের দড়ি ঢুকিয়ে মালার মতন করে রিক্সার পেছনে ঝুলিয়ে দিত।

সেই গ্লাসগুলো টুংটাং শব্দ তুলতো যেন নূপুর পরেছে।

আমি অবাক হয়ে দেখতাম বলে ভুলোকাকা বলতো রিকশাটা আজকের নয়। এও সেই সাত পুরুষের। ওরা যত যত জায়গায় গেছে সবই নাকি এই রিকশায় চেপে। রিক্সাটা সময় সময় এত বড় হয়ে যায় যে পরিবারের সব লোক তাতে ধরে যায়। ওদের সমস্ত পোঁটলাপুঁটলি বাক্স সহ ওরা রিকশায় ধরে যেত। ওর কথাগুলো আমি বিশ্বাস করতাম। সত্যিই তো এরকম একটা ক্যারাভান এর মতন রিকশা না থাকলে ওরা বাড়ি বদলাত কি করে?


আরো পড়ুন: অমৃতস্য পুত্রা (পর্ব-৫) । অনিন্দিতা মণ্ডল


আতরের কথায় মনে পড়ল ভুলো কাকার বউয়ের নাম যেমন ছিল আতর তেমনি কলকাতায় এসে একটা আতরের গন্ধ আমি পেলাম।

সে কোন মানুষের নাম নয় এবং কোন মানুষের গন্ধ নয়। সে ছিল একটা দোকান। স্টার থিয়েটার এর পাশে একটা বিরাট আতরের দোকান। খেলতে খেলতে ফুটপাতে এসে ওই দোকানের সামনে আমরা চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়তাম।

আতরের গন্ধ নাক দিয়ে জোরে ভেতর পর্যন্ত টেনে নিতাম। আর মনে পড়ত ভুলো কাকার বউয়ের কথা। ওকে আমি কখনো দেখিনি। কিন্তু আতরের গন্ধ আর ওর নাম মিলেমিশে একটা ছবি মনের মধ্যে তৈরি  হতো।

আতর শব্দটা শুনলেই আমার মীর সাহেবের কথা মনে পড়ে। পুরো নাম কখনও জানার চেষ্টা করিনি। ছোটদের মুখে ‘মীর সাহেব’ ডাক শুনতে নিশ্চয় মজা লাগত তাঁর। ফর্সা দুধ রঙের লম্বা চাপা কুর্তা আর ঢোলা পাজামা পরা মীর সাহেব বছরে একবার হয়তো আমাদের বাড়ি আসত। মীর সাহেব এলেই আমরা ভীষণ খুশি হতাম। মীর সাহেবের ঢোলা পাজামার জেব থেকে বেরিয়ে আসত অন্য রকমের শক্ত হলুদ বা বাদামী মিষ্টি। মীর সাহেব বলতেন, এই বাচ্চারা, হালওয়া খাও। আমরা হেসে এ ওর গায়ে ঢলে পড়তাম। এই হালুয়া? ধ্যুত! মা কেমন চকলেটের মতো বাদামী আঁচ লাগা সুজির হালুয়া করে! সে এরকম শক্ত নাকি? তবু সেই মেঠাই মুখে দিয়ে যেন আতরের সুবাস পেতাম। মীর সাহেব আমার বাবার গুরুভাই ছিল। দুজনে একই ওস্তাদের কাছে নাড়া বেঁধেছিল। গুরুর এন্তেকাল হয়েছিল। বাবা তখন উসকোখুসকো চুল নিয়ে সাদা পাতায় কী যে লিখে চলত! মীর সাহেব বলত -ভাই, কি লেখো? চলো, বাজাও। বাবা হেসে তবলা টেনে বসত। দুজনে বাজাতে শুরু করত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যেত। মীর সাহেব আর বাবার চোখ বন্ধ থাকত। অথচ কী অদ্ভুত উপায়ে দুজনের বাজনা একে অন্যের জুড়ি হয়ে বেজে চলত।

মীর সাহেব কলকাতায় ওঁর শাগির্দদের তালিম দিতে আসতেন বছরে একবার। বাকি সময়ে থাকতেন কাশী। সেও মজার কথা। বাবা বলতেন কাশী। মীর সাহেব বলতেন, বানারস। বাবা কাশীতে গিয়ে উঠতেন কাশীর দাদুর বাড়ি। কাশীর দাদুরা আমাদের কুলপুরোহিত ছিলেন বংশানুক্রমে। বাবা সেখান থেকে যেতেন মীর সাহেবের বাড়ি। মীর সাহেব নাকি কাশীর দাদুকে বিশেষ বিশেষ দিনে বাজনা শোনাতে যেতেন। বাবা তো তখন কলকাতায়।

মীর সাহেবের চোখে সুর্মা। আমরা মুখের কাছে মুখ নিয়ে চোখের পাতায় আঙুল দিয়ে দেখতাম। উনি হাসতেন -কি দেখছ বাচ্চা? বলতাম, তোমার চোখ দুটো কি সুন্দর! কত কালো! মীর সাহেব মিষ্টি হেসে জড়িয়ে ধরতেন -পাগলি। ও সুর্মা। ভাই বলতো, আর তোমার গায়ে কি সুন্দর গন্ধ! দিলখোলা হাসিতে উঠোন ভরিয়ে মীর সাহেব বলতেন -আচ্ছা আচ্ছা, আনবো আতর। খুসবু ভালোবাসো? সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে পড়ত ভুলোকাকার বউয়ের কথা। ওরও কি গায়ে গন্ধ ছিল এমন? নাহলে ওর নাম আতর কেন হলো? আমি মাথা ঝাঁকিয়ে বলে উঠতাম, আমি আতর জানি। আতর জানি। “কী রকম?” মীর সাহেব জিজ্ঞেস করতেন। ভুলোকাকার বউ তো আতর, আমি বলে উঠতাম। “বাঃ বাঃ! খুশবু পেয়েছ তো?” আমার মুখটা ছোট হয়ে যেত। বলতাম—ভুলোকাকা একদিনও ওর বউকে দেখায়নি। বড্ড বাজে ভুলোকাকা। মীর সাহেব আমার মাথার চুল ঘেঁটে দিয়ে বলতেন, দেখবে দেখবে। আতরের খুশবু আগে নাকে লাগে। তারপর দেখা যায়। আমার চোখের সামনে ভেসে উঠত একটা মুখ। মাথায় ঘোমটা দেওয়া। বড় বড় চোখ। বাঁশির মতো সরু নাক। আর সেই নাকে এই বড় নোলক। ভুলোকাকার বউ আতর। নিশ্চয় এইই ভুলোকাকার বউ। হবেই না বা কেন? ভুলোকাকা ওর  না দেখা বাড়িগুলো যদি হুবহু বর্ণনা দিতে পারে তবে খুশবু থেকে আমিই বা আতর বউয়ের মুখ দেখতে পাবো না কেন?   

মীর সাহেব কাশীর গল্প শোনাতেন। কত বুজুর্গ লোক আছে সেখানে! কত বেদাগ, বেমিশাল মানুষ! মীর সাহেব তো কখনও মাহফিলে বাজান না। গুরুর মানা ছিল। নাচের সঙ্গত করবি না। বাবা চুপ করে শুনতো। মাহফিলে বাজনা না বাজালে কি হবে? কলম বিকিয়ে তো মুজরোর লেখাই লিখতে হয়! চোখের কোণে জল দেখা যায়। মীর সাহেব হাত ধরেন -ভাই, বাজা। খোদার দেওয়া জিনিস। চল বাজা।  

সন্ধ্যের মুখে দুজনের সেই বাজনা আমরা তন্ময় হয়ে শুনতাম। লয়ের মধ্যে মিলিয়ে যেত দুজনে। আতরের খোশবাই সারা ঘর জুড়ে ম ম করত। আমি চোখ বন্ধ করে বাজনা আর খুসবুর সঙ্গে সঙ্গে সেই সুন্দর ফর্সা রোগা নোলক পরা মুখ দেখতে পেতাম। আতর। ভুলোকাকার বউ।    

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>