মুকুন্দ খবরকাগজের প্রথম পাতায় চারটি মৃত্যুসংবাদ দেখল, বাসিমুখেই। দুজন বিদেশি মন্ত্রী, একজন বাঙালি ডাক্তার ও কেরলের জনৈক এমপি। চার জনই করোনারি থ্রম্বোসিস-এ। ওদের বয়স ৭২, ৫৫, ৫৮ ও ৫৬। মুকুন্দর বয়স ৫১, কিন্তু সে ব্যাঙ্কের প্রবীণ কেরানি। থাকে পৈতৃক বাড়িতে, ছোটো সংসার, এক তলা ভাড়া-দেওয়া।
দোতলার রান্নাঘর ও কলঘরের লাগোয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁত মাজতে মাজতে সে চিন্তিত স্বরে লীলাবতীকে উদ্দেশ করে বলল, থ্রম্বোসিস-এ আজকাল খুব মরছে।
লীলাবতী চা তৈরিতে ব্যস্ত। বলল, কে আবার মরল?
হাঁ-করে ভিতরের পাটিতে বুরুশ ঘষতে ঘষতে মুকুন্দ বলল, খবরের কাগজে দিয়েছে, চারজন।
থ্রম্বোসিস হয়েই তো ছোটোঠাকুরঝির শ্বশুর আপিস যাওয়ার সময় বাসের মধ্যে মরে গেল। পাশের লোকটা পর্যন্ত টের পায়নি। কী পাজি রোগ রে বাবা!
এরপর লীলাবতী যা-যা বলবে মুকুন্দর জানা আছে। কী দশাসই চেহারা ছিল, কী দারুণ রগড় করত, কী ভীষণ খাইয়ে ছিল ইত্যাদি। এক-তলার কলঘরের ছিটকিনি খোলার শব্দ হতেই মুকুন্দ বারান্দার ধারে সরে এল। শুকনো শাড়িটা আলগা করে সদ্যস্নাত দেহে জড়িয়ে শিপ্রা বেরোচ্ছে। হাতে গোছা করে ভিজে কাপড়। শীতলপাটির মতো গায়ের চামড়া, দেহটি নধর। লীলাবতী রান্নাঘর থেকে একটানা কথা বলে যাচ্ছে। মিরা স্কুলে যাবার জন্য আয়নার সামনে। মনু তার ঘরে এখনও ঘুমোচ্ছে।
শিপ্রা উঠোনের তারে কাপড় মেলে দিতে দিতে মুকুন্দকে দেখে দ্রুকুটি করেই হাসল। গোড়ালি, মুখ ও দুটি হাত তোলা। চিবুক এবং বগলের কেশ থেকে জল গড়াচ্ছে। হাসতে গিয়েই ভারসাম্যটা টলে গেল সামান্য। তাইতে ওর বুক ও পাছার যৎসামান্য কম্পনটুকু উপভোগ করতে করতে মুকুন্দ মাজনের ফেনা গিলে, চেটো দিয়ে কষ মুছে নিয়ে হেসে লীলাবতীকে বলল, এর থেকেও পাজি রোগ ক্যানসার। নীচের ভাড়াটে শিপ্রার স্বামী গৌরাঙ্গকে দিন কুড়ি আগে জবাব দিয়ে ক্যানসার হাসপাতাল ছেড়ে দিয়েছে। এখন দিন গুনছে। লীলাবতী গলা নামিয়ে বলল, যা অবস্থা দেখলুম, মনে হচ্ছে এ মাসের মধ্যেই হয়ে যাবে। বউ-মেয়ের যে কী দশা হবে এরপর! মনুকে তুলে দাও তো, চা হয়ে গেছে।
মনুকে ডাকতে গিয়ে মুকুন্দ দরজার কাছে থমকে গেল। কাত হয়ে খাটে ঘুমোচ্ছ, লুঙ্গিটা হাঁটুর উপরে উঠে রয়েছে। বাইশ বছরের ছেলে, কলেজে পড়ে। ঈষৎ গম্ভীর প্রকৃতির। বাপের সঙ্গে কম কথা বলে। মুকুন্দ সন্তর্পণে লুঙ্গিটা নামিয়ে মনুর কাঁধে মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ওঠ, চা জুড়িয়ে যাচ্ছে।
ঘর থেকে বেরিয়ে কলঘরে মুখ ধুতে যাবার সময় মুকুন্দ দেখল, মেয়ের ফ্রকটা তারে মেলবার জন্য শিপ্রা ছুড়ে দিল এবং পড়ে গেল উঠোনের মেঝেয়। মুকুন্দর মনে পড়ল, তারটা এত উঁচু করে বেঁধেছিল গৌরাঙ্গই। ও খুব লম্বা। তখন ওর ক্যানসার ধরেনি।
দোতলা থেকে সিঁড়িটা এক-তলায় এসে ঠেকেছে শিপ্রাদের দরজার পাশেই। ডান দিকে ঘুরে গেছে হাত-পনেরোর একটা গলি সদর দরজা পর্যন্ত, বাঁ-দিকে উঠোন ও শিপ্রার রান্নাঘর। মুকুন্দ বাজারের থলি হাতে নীচে নামতেই রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল, আজ কিন্তু রেশন তোলার শেষ দিন, নইলে হপ্তাটা পচে যাবে।
অফিস যাবার সময় দেব। বলেই মুকুন্দ ওর পাছায় হাত রাখল।
ধ্যাত। শিপ্রা ফাজিল হেসে ছিটকে সরে গেল।
সদর দরজার গায়েই শিপ্রাদের ঘরের জানলা। মুকুন্দ এক বার তাকাল। গৌরাঙ্গ বুকের ওপর হাত রেখে কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে। বাজার থেকে ফেরার সময়ও সে তাকাল। গৌরাঙ্গ জানলার দিকে মুখ ফিরিয়ে, চোখ দুটো কঠিন বরফের মতো ঝকঝকে। যেন শীতল ক্রোধ জমাট বেঁধে রয়েছে। অফিসে যাবার সময় মুকুন্দ শব্দ করে সিঁড়ি দিয়ে নামল। শিপ্রা দাঁড়িয়ে আছে। পিছনে ঘরের দরজাটা ভেজানো। মুকুন্দর হাত থেকে দশ টাকার নোটটা নেওয়ামাত্রই শিপ্রাকে সে জড়িয়ে ধরল। চুমু খেতে যাবে, কিন্তু শিপ্রার দৃষ্টি আকর্ষণ করে পিছন ফিরে তাকিয়েই তার বুকের মধ্যে প্রচন্ড এক বিস্ফোরণ ঘটল। মনু সদর দরজার কাছে। পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে। মুকুন্দর শরীরের মধ্যে তখন ধোঁয়া কুন্ডলী পাকিয়ে মাথায় উঠছে, হাড় থেকে মাংস খুলে খুলে পড়ছে।
শিপ্রা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। মনু মাথা নীচু করে মুকুন্দর পাশ দিয়েই উপরে উঠে গেল। সদর দরজার পাশে দাঁড়িয়ে মুকুন্দ অসহায় বোধ করে অবশেষে শিপ্রার ঘরের জানলায় তাকাল। গৌরাঙ্গর চুল ধরে বাচ্চামেয়েটি টানাটানি করছে। গৌরাঙ্গর চোখ থেকে জল গড়িয়ে ঠোঁটের কোল ঘুরে চোয়ালে পৌঁছে টলটলে একটা বিন্দু হয়ে রয়েছে।
বাসে প্রচন্ড চাপের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মুকুন্দর মনে পড়ল, জয়ার শ্বশুর বাসের মধ্যে থ্রম্বোসিসে মরে গেছল। তারপর মনে হল, মনু কি আমায় ঘেন্না করবে?
আজ সকালে আমাদের পাড়ার মধ্যে একটা খুন হয়েছে। মুকুন্দর পিছনে কে একজন কাকে বলল, পাইপগান দিয়ে মেরেছে। বছর আঠারো বয়স হবে।
রাস্তাতেই?
তবে না তো কোথায়? বাড়ি থেকে বার করে রাস্তা-ভরতি লোকের সামনেই।
কেউ কিছু করল না?
পাগল! করতে গিয়ে কে প্রাণ খোয়াবে?
পুলিশ?
এসে বডিটা নিয়ে গেল।
অ্যারেস্ট করেনি তো কাউকে? যা পেটান পেটাচ্ছে তাতে নাকি চিরজীবনের মতো পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে?
বাসের লোকেরা এরপর পেটানোর নানান বীভৎস পদ্ধতির আলোচনা শুরু করল। মুকুন্দ তখন ভাবতে লাগল, আরও পনেরো-কুড়ি বছর যদি বাঁচি, তাহলে মনুকে নিয়েই তো বাঁচতে হবে। কিন্তু কী করে বাঁচব যদি ও ঘেন্না করে?
অফিসের লিফটে পাঁচ তলায় ওঠার সময় সে ভাবতে লাগল, মনু কি ওর মাকে ব্যাপারটা বলে দেবে? একেবারে ছেলেমানুষ নয়, সিরিয়াস ধরনের। হয়তো লজ্জায় নাও বলতে পারে। এই সময় মুকুন্দ শুনল, তার সামনের লোকটি পাশের জনকে বলছে, না ভাই, শরীর খারাপ নয়। ভাগনাটা পরশু মার্ডার হয়েছে, এখনও লাশ পাওয়া যাচ্ছে না। মনটা তাই.. লিফট চার-তলায় থামতেই ওরা দুজন বেরিয়ে গেল।
চেয়ারে বসামাত্র পাশের টেবিলের অজিত ধর মাথা হেলিয়ে বলল, মুকুন্দদা আজকের কাগজ দেখেছেন? চার-চারটে থ্রম্বোসিস ডেথ ফ্রন্ট পেজেই। সবাই অ্যাবাভ ফিফটি।
আমার ফিফটি ওয়ান। মুকুন্দ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল টেবিলের ফাটল থেকে উঠে আসা ছারপোকাটার দিকে, এবং সেটা একটা ফাইলের মধ্যে সেঁধিয়ে যাবার পর আবার বলল, আমার একান্ন শুরু হয়েছে।
এবার সাবধান হোন। স্নেহ-জাতীয় জিনিস খাওয়া কমান আর লাইট ধরনের কিছু ব্যায়াম
করুন।
অজিত ধরের স্বাস্থ্যটি চমৎকার। বছর পনেরো আগে ওয়েটলিফটিং-এ স্টেট চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ফেদারওয়েটে। বিয়ে করেনি। এখন তবলা শিখছে। মুকুন্দ ড্রয়ার থেকে দোয়াত বার করে কলমের ক্যাপ খুলতে খুলতে বলল, তোমার এসব হবে না।
কী করে জানলেন?
যারা হ্যাপি যাদের উদবেগ নেই তাদের হয় না। থ্রম্বোসিসে ক-টা মেয়েমানুষ মরেছে?
কিন্তু আমি মেয়েমানুষ নই। অজিত ধর গম্ভীর হয়ে মুখ ফেরাল। মুকুন্দর মনে পড়ল জয়ার শ্বশুরকে পাঁচ দিন পর মর্গে পাওয়া যায়, পচ ধরে বীভৎস দেখাচ্ছিল, মুখে রুমাল চাপা দিয়ে বেরিয়ে এসেই জয়ার ভাশুর বমি করে ফেলে। আইডেন্টিফাই করার মতো কোনোকিছু সঙ্গে থাকলে ভদ্রলোক তার ছেলেকে বমি করাত না।
এবার মুকুন্দ কৌতূহলবশতই ভাবল, বাসে আজ যদি থ্রম্বোসিসে মারা যেতাম, তাহলে আমার লাশটার কী হত? বাসটা নিশ্চয় থেমে যাবে। কেউ বলবে হাসপাতালে, কেউ বলবে থানায় বাসটাকে নিয়ে চলো। তার মধ্যে সেই লোকটা যে বলেছিল, পাগল! করতে গিয়ে কে প্রাণ খোয়াবে? বলবে একদমই যখন মরে গেছে তখন আমাদের অফিস লেট করিয়ে লাভ কী, বরং এখানেই নামিয়ে দিন, পাবলিক কিংবা পুলিশ ব্যবস্থা করে দেবে। শুনে মনে মনে সবাই হাঁফ ছাড়বে, তবে দু-একজন আপত্তি জানিয়ে বলবে রাস্তায় নামিয়ে দেওয়াটা খুবই নিষ্ঠুর দেখাবে, বরং বাসের একটা সিটে বসে থাকুক। সবাই অফিসে নেমে গেলে তারপর থানায় বা হাসপাতালে পৌঁছে দিলেই হবে। এই কথার পর তর্ক বেঁধে যাবে। তখন ড্রাইভার বিরক্ত হয়ে বাসটা চালিয়ে দেবে। সবাই ড্রাইভারকে তখন, উল্লুক বলবে।
মুকুন্দর মজা লাগছিল এইরকম ভাবতে। কিন্তু সত্যিই যদি থ্রম্বসিসে মারা যেতুম? এই অজিত ধর কি লিফটে উঠতে উঠতে কাউকে বলবে—না মশাই, শরীর আমার ফিট আছে। বারো বছরের কলিগ মুকুন্দ সেন আজ পাঁচ দিন ধরে নিখোঁজ। যা দিনকাল, মার্ডার-টার্ডার হল কি না কে জানে। লোকটা অবশ্য একদিক থেকে ভালোই ছিল, পলিটিক্স করত না তবে মদ-টদ খেত শুনেছি।
আড়চোখে মুকুন্দ তাকাল অজিত ধরের দিকে। শরীর দুর্বল হয়ে যাবে বলে বিয়ে করেনি। শরীর গরম হতে পারে বলে ফুটবল খেলা পর্যন্ত দেখে না। আড়াইটে বাজলেই ড্রয়ার থেকে একটা আপেল বার করে খায়। ওর থ্রম্বোসিস হবে না। ওর ছেলে থাকত যদি, সে বমি করার সুযোগ পাবে না। পকেট হাতড়ে মুকুন্দ কয়েকটা নোট, খুচরো পয়সা আর এলাচের মোড়ক বার করল। এর কোনোটা দিয়েই তাকে আইডেন্টিফাই করা যাবে না। মোড়কটা জনৈক ভোলানাথ গুইয়ের লন্ড্রির বিল। সেটা কুচিয়ে ফেলে মুকুন্দ নিজের নাম-ঠিকানা ইংরেজিতে একটা কাগজে লিখে, বুকপকেটে রেখে স্বস্তি বোধ করল।
অফিস থেকে বেরিয়ে মুকুন্দ শুনল, উত্তর কলকাতায় ট্রাম পুড়েছে তাই ট্রাম বন্ধ। বাস স্টপে গিয়ে দেখল শিশির নামে লিভ সেকশনের নতুন ছেলেটি দাঁড়িয়ে। বছর পঁচিশ বয়স, ফাস্ট ডিভিশনে ফুটবল খেলে। অফিস টিমে খেলবে বলেই চাকরি পেয়েছে। আঁটসাঁট প্যান্ট, নাভির নীচে বেল্ট, উঁচু গোড়ালির ছুঁচোলো জুতো আর ছিপছিপে শরীর। অফিসের মেয়েরা যে ওর দিকে তাকায় এটা ও জানে। কিন্তু শিশির এখন ধুতি-পাঞ্জাবি-চটি পরে দাঁড়িয়ে।
ব্যাপার কী? এই বেশে তোমায় ঠিক মানাচ্ছে না ভাই, কেমন যেন বয়স্ক বয়স্ক লাগছে।
শিশিরকে মুহূর্তের জন্য অপ্রতিভ দেখাল। একটি সুঠাম মেয়ে শ্যামবাজারের বাসে ওঠার জন্য মরিয়া হয়ে ধাক্কা দিতে দিতে এগোল এবং হ্যাণ্ডেল ধরে পা রাখামাত্র বাস ছেড়ে দিল। পা-দানির একটি যুবক তৎক্ষণাৎ মেয়েটির পিঠে বাহুর বেড় দিল। শিশির বাসটার থেকে চোখ সরিয়ে তিক্তস্বরে বলল, এখন সব থেকে সেফ বুড়ো হয়ে যাওয়া। আমার পাশের বাড়ির ছেলেটাকে মাস খানেক আগে পুলিশ রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে এমন মেরেছে যে হাঁটু দুটো এখনও ভালো করে মুড়তে পারে না। আমি জানি ছেলেটা কোনো গোলমালে নেই। শুধু ডাঁটো বয়সের জন্যই ওর সর্বনাশ হল।
মুকুন্দ চিন্তিত স্বরে বলল, আমার ছেলেও গোলমালে থাকে না, কিন্তু কার সঙ্গে মিশছে তা তো জানি না।
শিশির আলতো করে চুলে হাত বুলিয়ে বলল, আমার ভাই কাল বাড়িতে বোমা এনে লুকিয়ে রেখেছিল। জানেন মুকুন্দদা, আমরা খুব গরিব। খেলার জন্যই এই চাকরি। পঙ্গু হয়ে যাই যদি আমায় রাখবে কেন, এখনও তো কনফার্মড হইনি। এই শরীরটাই আমার সব।
মুকুন্দকে আর কিছু বলতে না দিয়ে শিশির প্রায় ছুটেই রাস্তা পার হয়ে ভিড়ে মিশে গেল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে মুকুন্দও হাটতে শুরু করল। আধ ঘণ্টা হাঁটার পর তার মনে হল রাস্তা ক্রমশ ফাঁকা দেখাচ্ছে, পথচারী কম, গাড়িগুলি জোরে যাচ্ছে, সিআরপি-ভরতি লরি তিন-চার বার চোখে পড়ল, ক্ষীণ বিস্ফোরণের শব্দও শুনতে পেল। মুকুন্দ স্থির করল, গলি ধরে যাওয়াই ভালো।
মিনিট কয়েক পরেই মুকুন্দর গা-ছমছম করতে লাগল। যতই এগোয়, সব কিছু ভূতে পাওয়ার মতো ঠেকছে। বাড়িগুলোর দরজা-জানলা বন্ধ। চাপা ফিসফাস শোনা যাচ্ছে। অন্ধকার ছাদে আবছা মুখের সারি। দূরে দূরে রাস্তার আলো, মাঝেরটা নেভা। দু-ধারের শ্যাওলাধরা, পলেস্তারা খসা, বিবর্ণ দেওয়ালগুলোর মাঝখানে গর্ত, ঢিপি আর আস্তাকুঁড়ভরা রাস্তাটাকে প্রাচীন সুড়ঙ্গের মতো দেখাচ্ছে। নিজের পায়ের শব্দে মুকুন্দর এবার মনে হতে লাগল কেউ পিছু নিয়েছে।
আর একটু এগিয়ে ডান দিকের গলিটা দিয়ে তিন-চার মিনিটের মধ্যে বাড়ি পৌঁছানো যায়। তবু মুকুন্দ আর এগোতে সাহস পেল না। পাশের সরু গলির মধ্যে ঢুকে বড়োরাস্তার দিকে কিছুটা এগিয়ে আচমকা একটা রাইফেল ও দুটো পিস্তলের মুখোমুখি হয়ে দু-হাত তুলে সে দাঁড়িয়ে পড়ল।
কোথায় যাচ্ছেন? সাদা প্যান্ট, হলুদ বুশশার্টপরা লোকটি মুকুন্দর পেটে পিস্তলের নল ঠেকিয়ে রুক্ষস্বরে প্রশ্ন করল।
বাড়ি যাচ্ছি স্যার, পাশের বন্ধু সরকার লেনে থাকি।
তাহলে এখানে কেন?
অফিস থেকে ফিরছি। গোলমাল দেখে গলি দিয়ে যাচ্ছিলুম।
পাড়ায় কারা কারা বোমা ছোড়ে?
জানি না স্যার।
না কি বলবেন না?
ইউনিফর্মপরা ভারিক্কি ধরনের যে-লোকটি এতক্ষণ শুধুই মুকুন্দর দিকে তাকিয়েছিল, বলল, নিয়ে গিয়ে দেখাও তো, আইডেন্টিফাই করতে পারে কি না।
মুকুন্দর কোমরে পিস্তলের খোঁচা দিয়ে হলুদ বুশশার্ট বলল, বাঁয়ে।
সে তখুনি বাঁ-দিকে ফিরে, দু-হাত তুলে চলতে শুরু করল। রাস্তার যেখানটায় আলো কম এবং দুটো বাড়ির দেওয়াল দ-এর মতো হয়ে একটা কোণ তৈরি করেছে সেখানে টর্চের আলো ফেলে লোকটি বলল, ওকে চেনেন?
মুকুন্দ দেখল, একটা দেহ উপুড় হয়ে পড়ে, মুখটা পাশে ফেরানো। দু-হাত তোলা অবস্থায় এগিয়ে এসে ঝুঁকে মনু বলে অস্ফুটে কাতরে উঠেই বুঝল, দেখতে অনেকটা মনুর মতোই। চোখের পাতা খোলা, নীল জামাটা ফালা হয়ে পিঠ উন্মুক্ত, কঠিনভাবে আঙুলগুলো মুঠোকরা, ঠোঁট দুটো চেপে রয়েছে, গলায় গভীর ক্ষত। হিঁচড়ে টেনে আনার দাগ প্যান্টে। গলা থেকে চোয়ানো রক্ত থকথকে হয়ে উঠতে শুরু করেছে।
এর নাম মনু?
না না, আমার ছেলের নাম মনু। একে অনেকটা তার মতো দেখতে। একে আমি একদম চিনি না স্যার।
কখনো একে দেখেননি? ভালো করে দেখে বলুন।
মুকুন্দ আবার ঝুঁকে পড়ল। গোড়ালি থেকে মাথার প্রান্ত জমাটবাঁধা আগ্নেয়গিরি লাভার একটা ঢেউ-খেলানো খন্ডের মতো। এই খন্ডটাই উত্তপ্তকালে ওর সর্বস্ব ছিল। ওর যন্ত্রণা, বিস্ময় আর দাপট। এখন ভোলা চোখ দুটি থেকে শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই নির্গত হচ্ছে না।
মাথা নেড়ে মুকুন্দ বলল, না, একে কখনো দেখিনি।
আচ্ছা চলে যান, এধার-ওধার করবেন না।
কিছুদূর গিয়ে মুকুন্দ ফিরে তাকাল। বুশশার্ট তাকে লক্ষ করছে। লাশটা এখন অন্ধকারে। মুকুন্দ মনে মনে বলল, আর একটা আনআইডেন্টিফায়েড ডেডবডি। তারপর বুকপকেটে হাত দিয়ে স্বস্তি বোধ করল। এবার গলিটা আর একটা গলিকে কেটে সোজা মুকুন্দর পাড়ায় ঢুকে গেছে। মোড়টা আধো অন্ধকার। দুটি ছেলে হঠাৎ দেওয়াল কুঁড়েই যেন তার সামনে এসে দাঁড়াল। একজনের হাতে ফুট দুয়েক লম্বা ঝকঝকে ইস্পাত।
আরো পড়ুন: যুক্তফ্রন্ট । মতি নন্দী
কী জিজ্ঞাসা করছিল?
মুকুন্দ চিনতে পারল ছেলেটিকে। মনুর বন্ধু ছিল ছোটোবেলায়। তখন বাড়িতে আসত, নাম তাজু। না-থেমে গঙ্গা পারাপার করে বলে শুনেছে। এখন পাড়ার মোড়ে চায়ের দোকানেই প্রায়-সময় কাটায়। মনু এখন ওর সঙ্গে মেশে না।
কিছুই না। শুধু জানতে চাইল লাশটাকে চিনি কি না।
আমাদের কারুর কথা জিজ্ঞেস করল?
না।
খবরদার, বলবেন না কিছু।
ওরা দুজনে আবার দেওয়ালে সেঁধিয়ে গেল। দুটি স্ত্রীলোককে নিয়ে একটি রিকশা আসছে। একজনকে বিরক্ত স্বরে মুকুন্দ বলতে শুনল–ওম্মা, এইতো যাবার সময় দেখে গেলুম সব ঠাণ্ডা।
জানলায় শিপ্রা দাঁড়িয়েছিল। মুকুন্দকে দেখেই আলো জ্বেলে দরজা খুলে বলল, যা ভাবনা হচ্ছিল।
আমার জন্যে?
তবে না তো কী?
শুনে মুকুন্দর ভালো লাগল প্রথমে। তারপর ভাবল গৌরাঙ্গর জন্য একদম না ভাবাটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। তাই বলল, গৌরাঙ্গ আছে কেমন?
একইরকম। শিপ্রা সাধারণভাবে বলল এবং সহসা গলা নামিয়ে যোগ করল, মনু কেমন কেমন করে তাকাচ্ছিল। কাউকে বলে দেবে না তো? আমার কিন্তু বড় ভয় করছে।
বড়ো হয়েছে। মনে হয় না বলবে।
মুকুন্দ তাড়াতাড়ি উপরে উঠে গেল। ঘরের জানলাগুলো বন্ধ। মিরা ও লীলাবতী সিঁটিয়ে বসে রয়েছে। তাকে দেখে ওরা হাঁফ ছাড়ল।
মিরা বলল, জান কী কান্ড হয়েছে? একটা ছেলের গলা কেটে ফেলে রেখে গেছে খুদিরাম বসাক স্ট্রিটে!
মনু পাশের ঘর থেকে এসে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে গম্ভীর স্বরে বলল, গোলমালের সময় অতুল বোস লেন দিয়ে না ঢুকে শেতলাতলার গলিটা দিয়ে আসাই সেফ।
ওর কথা শুনতে শুনতে মুকুন্দর মনে হল, মনু তাহলে এতক্ষণ উদবেগের মধ্যে ছিল। ছেলেটা আমার জন্য ভাবে, হয়তো বমি করবে না।
পরদিন অফিসে বেলা বারোটা নাগাদ মুকুন্দকে একজন টেলিফোনে উত্তেজিত স্বরে বলল, আপনার ছেলে মানবেন্দ্র সেনকে পুলিশ রাস্তা থেকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেছে।
কী বলছেন! মনুকে? মুকুন্দ চিৎকার করে উঠল। আপনি কী করে জানলেন?
আমার ভাইকেও ধরেছে। থানায় গেছলুম। আমাকে নাম আর ফোন নম্বর দিয়ে আপনার ছেলে জানিয়ে দিতে বলল। এখুনি থানায় গিয়ে চেষ্টা করুন ছাড়াতে পারেন কি না।
ফোন রেখে দেওয়ার শব্দ পেল মুকুন্দ। তারপরই ওর চোখ-কান দিয়ে হু-হু করে বাতাস ঢুকতে লাগল। কিছুক্ষণ সে কিছুই দেখতে পেল না, শুনতে পেল না। তারপর কাতর স্বরে অজিত ধরকে বলল, এইমাত্র একজন খবর দিল, ছেলেটাকে পুলিশে ধরেছে রাস্তা থেকে। কিন্তু মনু তো ওসব করে না, অত্যন্ত ভালো ছেলে। এখন কী করি বলো তো?
দেরি করবেন না, এখুনি থানায় গিয়ে ছাড়িয়ে আনার চেষ্টা করুন। কেস লিখিয়ে ফেললে আর উপায় নেই, চালান করে দেবে। শুনেছি প্রচন্ড মার দিচ্ছে থানায়।
তোমার কেউ চেনাশোনো থানায় আছে? অন্তত যাকে বললে মারধর করবে না। মনুর ভীষণ দুর্বল শরীর।
অজিত ধর মাথা নাড়ল।
তুমি যাবে আমার সঙ্গে থানায়?
সাড়ে তিনশো লোকের স্যালারি স্টেটমেন্ট তৈরি করছি মুকুন্দদা, চার দিন পরই মাইনে। এখন তো ফেলে রেখে…।
মুকুন্দ পাঁচতলা থেকে নামল সিঁড়ি দিয়ে। ট্যাক্সিতে বার দুয়েক বলল, একটু জোরে চালান ভাই।
থানায় আট-দশটি ছেলের সঙ্গে মনুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওসি-কে বলল, আমার ছেলে কোনোকিছুর মধ্যে থাকে না স্যার, ওকে ভুল করে এনেছেন।
কোনটি আপনার ছেলে? গম্ভীর এবং যেন ক্লান্ত, এমন স্বরে ওসি বলল।
মুকুন্দ আঙুল তুলে দেখাবার সময় মনুর পাশে দাঁড়ানো হাফপ্যান্ট পরা ছেলেটিকে কনুই তুলে খুব মন দিয়ে বাহুর থ্যাঁতলানো জায়গাটা পরীক্ষা করতে দেখল। মনুর দিকে তাকিয়ে ওসি বলল, সব বাপ-মা এসেই বলে, তাদের ছেলে নিরপরাধ। যদি নিরপরাধ হয়, তাহলে ছাড়া পাবে। আগে আমরা খোঁজ নিয়ে দেখি।
কখন ছাড়বেন তাহলে?
ওসি কিছু-একটা বলতে যাচ্ছিল, মনু হঠাৎ হাউহাউ করে কেঁদে বলল, আমি কিছু করিনি। স্যার আমি কিছুই জানি না। বিশ্বাস করুন, আমি শুধু কলেজে যাচ্ছিলুম। খাতা ছাড়া হাতে আর কিছু ছিল না।
চুপ করো। কর্কশ কন্ঠে চিৎকার করে উঠল ওসি-র পাশে দাঁড়ানো ধুতিপরা লোকটি। থতোমতো হয়ে মনু তাকাল মুকুন্দর দিকে। দুটি ছেলে পাংশুমুখে নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করল। লোকটি ধমকে আবার বলল, তাজু তোমার পাড়ার ছেলে আর তাকে তুমি চেন না?
মুকুন্দ ব্যস্ত হয়ে বলল, আমার ছেলে ওর সঙ্গে মেশে না স্যার।
বাজে কথা। আমাদের কাছে খবর আছে আপনার ছেলে ওর বন্ধু। তাজুকে কোথায় পাওয়া যাবে, দলে আর কে কে আছে বলুক, আপনার ছেলেকে ছেড়ে দোব।
মুকুন্দ দেখল মনু ঠকঠক করে কাঁপছে। ওকে এত ভয় পেতে দেখে সেও কাতর হয়ে পড়ল। চোখের জল মনুর ঠোঁটের কোল ঘুরে চোয়ালে পৌঁছে টলটল করছে। মুকুন্দের চোখ বাষ্পচ্ছন্ন হয়ে এল। আবছাভাবে গৌরাঙ্গর মুখটা ফুটে উঠল তার মনে। কাল সকালে এইরকম একটা বিন্দু টলটল করছিল ওর থুতনির কাছে। মেয়েটা তখন চুল ধরে টানছিল। কিন্তু মনুর তো ক্যানসার হয়নি! মুকুন্দ বিষগ্নচোখে তাকিয়ে রইল মনুর দিকে। শুধু কি শরীরের জন্যই ওর এই কান্না। রাস্তায় কাল বেওয়ারিশ লাশ হয়ে পড়েছিল যে-ছেলেটি, সেও কি শরীটাকে ভালোবাসত না!
ওসি ঘরের একধারে গিয়ে লোকটির সঙ্গে চাপাস্বরে মিনিট দুয়েক কথা বলে ফিরে এল। আপনি এখন যান, সন্ধের দিকে এসে খোঁজ নেবেন।
বিশ্বাস করুন স্যার, আমার ছেলে জীবনে কখনো পলিটিকস করেনি। আপনারা খোঁজ নিয়ে দেখুন। মুকুন্দ ঝুঁকে ওসি-র হাঁটুতে হাত রাখল। হাতটা সরিয়ে দিতে দিতে ওসি বলল, আচ্ছা, ঘণ্টা দু-তিন পরেই আসুন, নিরাপরাধ হলে নিশ্চয়ই ছেড়ে দেব।
বেরিয়ে এসে মুকুন্দ ঠিক করতে পারল না এবার কী করবে। থানার সামনেই একটা বাড়ির রকে বসে পড়ল। এখন অফিসে ফেরা আর এখানে বসে থাকা একই ব্যাপার। লীলাবতীর কান্নাকাটির থেকেও ভালো। বসে থাকতে থাকতে সে অবসন্ন বোধ করতে শুরু করল। দেওয়ালে ঠেস দিয়ে তাকিয়ে রইল থানার ফটকে। ক্লান্ত মস্তিষ্কে এলোপাথাড়ি নানান বীভৎস দৃশ্য এখন সে দেখতে পাচ্ছে, অদ্ভুত করুণ শব্দ শুনতে পাচ্ছে। প্রত্যেকটাই স্নায়ুবিদারক।
ছটফট করে মুকুন্দ উঠে পড়ল। দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে বার বার সে শিপ্রার দেহে, নানাবিধ অশ্লীল শব্দে এবং থ্রম্বোসিসে নিজেকে আবদ্ধ করে অন্যমনস্ক হবার চেষ্টা করল। কিন্তু সফল হল না। সব কিছু ছাপিয়ে মনুর কান্নাটা তাকে পেয়ে বসছে। ঘণ্টা খানেক পরে সে আবার থানার সামনে ফিরে এল এবং রকে বসতে গিয়েই দেখল মনু মাথা নীচু করে বেরিয়ে আসছে।
মনু। তীক্ষ্ণস্বরে মুকুন্দ ডাকল। মনু মুখ তুলে তাকাল। মুকুন্দ ছুটে গিয়ে প্রথমেই তন্নতন্ন করে ওর আপাদমস্তক দেখল। তারপর হেসে বলল, ছেড়ে দিল।
মাথা নেড়ে মনু ফিকে হাসল।
মারধর করেনি?
হাতটা মুচড়ে দিয়েছিল ধরার সময়।
ওর কাঁধে আলতো করে হাত রেখে, হাঁটতে হাঁটতে মুকুন্দ বলল, অনেকক্ষণ খাসনি, আয় এই দোকানটায়।
আমার খিদে নেই।
ধরল কেন তোকে?
যে-ছেলেগুলোকে থানায় দেখলে, ওরা একটা স্কুলে ভাঙচুর করে বোমা ফাটিয়ে এসে আমার পাশ দিয়েই যাচ্ছিল। হঠাৎ প্লেন-ড্রেস পুলিশ ঘিরে ধরে মারতে মারতে ওদের সঙ্গে আমাকেও ভ্যানে তুলল।
তুই যদি বুড়োমানুষ হতিস তাহলে ধরত না।
মনু জবাব দিল না। মিনিট খানেক পর মুকুন্দ বলল, অফিসে ফোন পেয়েই সোজা থানায় এসেছি। বাড়ির কেউ জানে না, তুই বাড়িতে এ সম্পর্কে কিছু বলিস না, তাহলেই তোর মা কান্না জুড়ে দেবে।
ঘাড় ফিরিয়ে মনু তাকাল ওর দিকে। চোখ দুটো দেখে মুকুন্দর বুকের মধ্যে ক্ষীণ একটা বিস্ফোরণ ঘটে গেল। ধোঁয়ার কুন্ডলীর মধ্যে দিয়ে সে গৌরাঙ্গর চোখ দুটি দেখতে পেল। ঠিক এই চাহনিতেই সে চিত হয়ে কড়িকাঠের দিকে তাকিয়েছিল। মুকুন্দর আবার মনে হল, মনুর কেন ক্যানসার হবে!
তোকে আর কিছু কি জিজ্ঞাসা করেছে?
চমকে উঠে মনু ক্রু কুঁচকে অস্বাভাবিক স্বরে বলল, কী জিজ্ঞাসা করবে?
যা জানতে চাইছিল?
কিছু জিজ্ঞাসা করেনি। মনু দাঁড়িয়ে পড়ল। আমি এখন বাড়ি যাব না, তুমি কি বাড়ি যাবে?
আমি, মুকুন্দ দু-ধারে তাকিয়ে নিয়ে বলল, দেখি কোথাও গিয়ে সময় কাটাতে পারি কি না।
মনু ভিড়ে মিলিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত মুকুন্দ তাকিয়ে রইল। তারপর স্থির করল, ও ক্লাস নাইনে ওঠার পর আর মাতাল হইনি, আজ হব।
রাত প্রায় বারোটায় মুকুন্দ বাড়ি ফিরল। কড়া নাড়ার আগেই সদর দরজা খুলে গেল। অন্ধকারে শিপ্রাকে জড়িয়ে ধরার জন্য হাত বাড়াতেই চাপাস্বরে মনু বলল, এখন এত রাত করে বাড়ি ফিরো না।
মুকুন্দ অন্ধকারের মধ্যে মনুর মুখটা দুই করতলে এক বার চেপে ধরে কথা না বলে দোতলায় উঠে গেল।
সকালে দেরিতে ঘুম ভাঙল তার। চা খেতে খেতে মনুর খোঁজ করল। দুটি ছেলে তাকে ডেকে নিয়ে গেছে শুনেই চায়ের কাপ রেখে তাড়াতাড়ি মুকুন্দ রাস্তায় বেরিয়ে এসে মনুকে দেখতে পেল না। ভয়ে বুক শুকিয়ে গেল তার, শিপ্রাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করল, কারা ডাকতে এসেছিল?
এক জনকে দেখেছি, রোগাপানা, ফর্সা, মনুরই বয়সি।
হাতে কিছু ছিল?
কেন? ভীতস্বরে শিপ্রা বলল।
ধমকে উঠল মুকুন্দ, যা জিজ্ঞাসা করছি তার জবাব দাও।
অতশত দেখিনি।
মুকুন্দ এবার ছুটে বেরোল। পরিচিতদের কাছে খোঁজ নিতে নিতে ট্রামরাস্তা পর্যন্ত পৌঁছোল। সেখান থেকে দু-তিনটে গলি ঘুরে গলাকাটা লাশটা যেখানে পড়েছিল সেখানে হাজির হল। এইসময় তার বুকফাটা কান্না পেল। বাড়ি ফিরতেই শিপ্রা রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে বলল, মনু তো অনেকক্ষণ ফিরেছে।
একটা করে সিঁড়ি টপকে মুকুন্দ দোতলায় এল। মনু তার ঘরে চেয়ারে বসে জানলার বাইরে তাকিয়ে। মুকুন্দ ঘরে ঢুকেই বলল, কেন ওরা এসেছিল?
কারা। মনু স্থির চোখে মুকুন্দর চোখের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে চাহনিটা তুলে নিয়ে আবার জানলার বাইরে রাখল।
ওরা কি জেনেছে? ব্যগ্র স্বরে মুকুন্দ বলল।
কী জানবে? মনু এবার তীব্র চোখে তাকাল।
মুকুন্দ ফিসফিস করে বলল, আমি জানি রে, আমি জানি।
কী জান তুমি?
তোকে ভয় পেতে দেখেছিলুম।
কীসের ভয়?
শরীরটার জন্য ভয়।
তুমি পাও না? প্রশ্নটা করার জন্যই যেন নিজের উপর অভিমানে মনুর বসার ভঙ্গি কঠিন হয়ে গেল।
হ্যাঁ পাই। মুকুন্দ কোমল কণ্ঠে বলল, আমি তোকে দোষ দিচ্ছি না রে। যদি বলতে না চাস তো বলিস না। কিন্তু তুই আমার ছেলে, তোর জন্য আমি ভয় পাচ্ছি। সব বাবাই পায়। এটা কাপুরুষতা নয়।
তোমার ভয়টা ছেলের প্রাণের জন্য, তাই সেটা কাপুরুষতা নয়। মনু যান্ত্রিক স্বরে যেন মুখস্থ বলল।
এভাবে কথাটা নিচ্ছিস কেন! মুকুন্দ বিব্রত হয়ে বলল, আমাকে ঘেন্না করার নিশ্চয় অন্য কারণ আছে কিন্তু এজন্য করিসনি।
তুমি কি আমায় ঘেন্না করছ, আমি যা করেছি?
মোটেই না। আমি চিরকাল তোকে ভালোবাসব।
কিন্তু আমি নিজেকে ঘেন্না করছি। থানায় তুমি অমন করে আমার দিকে তাকালে, মনে হল আমি একটা মরামানুষ। কীরকম যেন ভয় করল আমার। নয়তো একটা কথাও বলতাম না, কিছুতেই না। মনু উঠে দাঁড়াল। টেবিলের বইগুলো অযথা ওলটপালট করতে করতে মমাচড়ানো স্বরে বলল, তোমার জন্য, শুধু তোমার জন্য। তুমি আমায় করাপ্ট করেছ।
মনু এক বার শুধু মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। মুকুন্দ তখন প্রত্যাশামতো নিশ্চিতরূপে দেখতে পেল, কঠিন বরফের মতো ঝকঝকে ওর চোখ দুটি। যেন শীতল ক্রোধে জমাট বেঁধে রয়েছে।
মুকুন্দর অফিসে যাবার সময় শিপ্রা দাঁড়িয়েছিল তার ঘরের দরজায়। সে হাসল। মুকুন্দ ক্ষেপ করল না। গলির মোড়ে লাল ডোরাকাটা জামা গায়ে তাজু দাঁড়িয়ে। মুকুন্দ তাকাল। বাস মাঝপথে বিকল হয়ে থেমে গেল। মুকুন্দ কণ্ডাক্টরের কাছ থেকে ভাড়ার পয়সা ফেরত নিল না। অফিসে অজিত ধরের প্রশ্নের উত্তরে জানাল, খবরটা ভুল। মনুকে ধরেনি। ছুটির পর ট্রাম থেকে নেমে মিনিট তিনেক হেঁটে বাড়ি। নামমাত্র দেখল জটলা করে লোকেরা ভীতচোখে তার পাড়ার দিকে তাকিয়ে বলাবলি করছে। একজন তাকে বলল, ওদিকে যাবেন না মশাই। এইমাত্র পর পর চারটে গুলির শব্দ হল। মুকুন্দ সেকথায় কান দিল না। একটা পুলিশের ভ্যান দাঁড়িয়ে। সেটাকে ঘুরে পার হয়েই সে থমকে গেল কয়েক মুহূর্তের জন্য, তারপর মাথা নামিয়ে গলিতে ঢুকল। তার পাশ দিয়ে দুটো লোক পিস্তল রাইফেল পরিবৃত একটা লাল ডোরাকাটা নিথরদেহ বহন করে নিয়ে গেল। টপ টপ করে রক্ত ঝরছে। মুকুন্দ পিছন ফিরে তাকাল না। থমথমে গলির দু-পাশে ভীত, বিস্মিত এবং অব্যক্ত চাহনি ও মন্তব্যের মধ্য দিয়ে সে বাড়িতে ঢুকল।
মনু তার ঘরে খাটে উপুড় হয়ে শুয়ে। মুকুন্দ দরজার কাছ থেকে বলল, তাজুকে পুলিশ নিয়ে গেল। বোধ হয় বেঁচে নেই।
লীলাবতী ও মিরা ছুটে এল বিবরণ শোনার জন্য। মুকুন্দ তখন কলঘরে ঢুকল। হঠাৎ পিছনে পায়ের শব্দে সে ঘাড় ঘোরাতেই দেখল মনু ঘর থেকে টলতে টলতে বেরিয়ে কলঘরের দিকেই আসছে। কী হল! বলে মুকুন্দ দ্রুত গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরল। মনু তখন হড়হড় করে মুকুন্দর গায়ে বমি করল।
মধ্যরাত্রে মুকুন্দ নীচে নেমে এসে শিপ্রার ঘরের দরজায় টোকা দিল। দরজা খুলে যেতেই সে ঘরে ঢুকে শিপ্রাকে জড়িয়ে ধরল।
একী, একী! ঘরের মধ্যে নয়। ও রয়েছে যে!
থাকুক গে। শিপ্রাকে মেঝেতে শোয়াতে শোয়াতে মুকুন্দ বলল, ও তো মরে যাচ্ছেই, তাহলে আবার ভয় কীসের।
জন্ম: [১০ জুলাই ১৯৩১ – মৃত্যু: ৩ জানুয়ারি ২০১০) ছিলেন ভারতের কলকাতা ভিত্তিক একজন বাঙালি লেখক। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র মতি নন্দী ছিলেন মূলত ক্রীড়া সাংবাদিক এবং উপন্যাসিক ও শিশু সাহিত্যিক। তিনি আনন্দ পুরস্কার এবং সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেছেন। তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘কোনি’।