এবারের শীত সময় হওয়ার আগেই বিদায় নিলেও প্যাচপ্যাচে ঘামের গরম শুরু হয়নি। বিদেশ থেকে ভাই, ভাইয়ের বউ আর বাচ্চারা এসেছে, তার ওপর পরপর তিন দিনের ছুটি, মারজিয়াকে তাই যেতেই হলো কক্সবাজারে বেড়াতে। ব্যাংকের একঘেয়ে ঘানি টানার ক্লান্তির ফাঁকে এক টুকরো ফুরসত তো মিলল।
বউ আর মেয়ে গেল কিন্তু ফয়সল গেল না। বড় কুটুমের পরিবারকে সঙ্গ দেওয়ার ধার না ধেরে গোঁ ধরে থাকল সে, বলছি তো তোমরা যাও, জরুরি কাজ আছে আমার।
কাজ যে আছে মারজিয়া তা জানে না তা নয়, তা ছাড়া হুট করে ওর এমন সুযোগও তো আসে না খুব একটা—তিন দিনের ছুটি, বাড়িতেও কেউ থাকবে না, বইপত্র ঘেঁটে ভেবেচিন্তে প্রজেক্ট প্রোপোজালটা এগিয়ে নেবে। মারজিয়ার মন খুঁতখুঁত করলেও আর ঘাঁটায় না সে ফয়সলকে। ফয়সলও হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। মাত্র সাত দিন হাতে আছে, এর মধ্যে ফাইলটা জমা দিতে হবে তাকে—এনজিওর কাজে সুখ যেমন আছে, অসুখও কিছু কম নয়।
যাওয়ার আগে পইপই করে বুঝিয়ে যায় মারজিয়া, কোথায় কোন বক্সে কী আছে, খাবার আগে যেন খুঁজে নেয়, টেলিভিশন ছেড়ে রেখে যেন না ঘুমায়, সকালে বুয়া এলে যেন জেগে গিয়ে দরজা খুলে দেয়, একা ঘরে মদ সিগারেট যেন বেশি না খায়—এই সব চৌদ্দ ফিকির।
দুই দিন কোথাও বের না হয়ে কি-বোর্ড আর মনিটরে লেপ্টে থাকে ফয়সল। তার মাথা ধরে। সে চা বানিয়ে খায়। টিভি দেখে। বই পড়তে পড়তে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নেয়। খাবার গরম করে। আবার ডুবে যায় সে কি-বোর্ড আর মনিটরে। ভিলেজ এডুকেশন সেন্টারে সেক্সুয়াল অ্যান্ড রিপ্রোডাকটিভ হেলথ রাইটস নিয়ে এখন তার কাজ। কিশোরী আর বয়ঃসন্ধিকালীন সচেতনতা, অপ্রাপ্তবয়সে যৌনতা, মাতৃসাস্থ্য, বাল্যবিবাহ, মা হওয়ার আগে-পরের বিষয় থেকে শুরু করে পুরুষেরও সর্বস্তরে সচেতন হয়ে ওঠা নিয়ে যতই লিখছে সে মনমতো হয়ে উঠছে না তার কিছুই। তারপরও দুই দিনের মধ্যে প্রোপোজালটা গুছিয়ে আনে ফয়সল। ডাটা কালেকশন, মাঠপর্যায়ে ভিজিট, জনে জনে সাক্ষাৎকার, অফিসে মিটিংয়ের পর মিটিং সব আগেই সেরে নিয়েছিল সে। লেখার কাজও তো শেষ, এখন ঠান্ডা মাথায় আগাগোড়া একবার দেখে নিলেই হবে।
দুপুর থেকে আকাশ ভারী হয়ে আছে। মারজিয়ার সঙ্গে কথা হলো, ওখানে ঝকঝকে রোদ, ওরা মিস করছে তাকে। হাতের কাজ গুছিয়ে ফয়সলের একা লাগতে থাকে। একে ওকে কয়েকটা ফোন করে।
বন্ধু আজহারের বাসায় একটা মেয়েকে বেশ ভালো লেগেছিল। খালি বাড়িতে খুবই ব্যক্তিগত সেই গোপন আড্ডায় মাত্র ঘণ্টা তিনেকের পরিচয়। ওর নম্বরটাও তো টুকে নিয়েছিল। ফোনবুকে ঢুকে খুঁজে খুঁজে তাকেও কল করে ফয়সল।
ফোন ধরে পরিচয় পাওয়ার পর মেয়েটা বলে, আসতে তো চাই, কখন? আকাশের অবস্থাও তেমন ভালো না। কী করি বলেন তো?
কিচ্ছু হবে না। সন্ধ্যায় আসো, রান্না করব। মন চাইলে থেকে যেতেও পারবে। আর একটা কথা, আজহারকে কিন্তু বলবে না, প্লিজ। এরপর মালিবাগের ঠিকানাটা বুঝিয়ে বলে সে, হ্যাঁ হ্যাঁ, আইডিয়াল স্কুলের পাশে স্বপ্নের গলিটাই। তোমাকে দিচ্ছি, বলে এসএমএস করে ফয়সল।
বিকেল থেকে ছটফট শুরু হয় ওর। কী রাঁধবে না রাঁধবে, তা-ই নিয়ে ভেবেটেবে দোকানে যায়। ব্রয়লার মুরগি গরম মসলার সঙ্গে তেলে পুরিয়ে ধনেপাতার একটা রেসিপি ভালো করে ফয়সল। আর মালয়েশিয়ান পরোটা তো ফ্রিজে আছে, ভেজে নিলেই হবে। বুয়া এসে গুছিয়ে গেছে, তবুও এলোমেলো ভেবে ঘর গোছায়। ডিপ ফ্রিজের আইস কিউবে পানি ভরে রাখে।
সন্ধ্যা পার করে এল মেয়েটি। হলুদের ওপর ছোপ ছোপ লাল রঙের শাড়ি পরেছে সে। কাপড়ের সঙ্গে মিলিয়ে পরেছে মাঝারি আকারের টিপ। ঠোঁটের লিপস্টিকের রং চোখে পড়ার মতো নয় কিন্তু পাপড়িতে হালকা করে মাসকারা লাগানো চোখ দুটো বড় বেশি উজ্জ্বল ওর। ফয়সল একেবারে অস্থির হয়ে উঠল।
চা খাবে, চা বানাই? হারবাল গ্রিন টি আছে, রেয়ার কালেকশন। কেমন রং ছড়ায় দেখবে, মাইল্ড গ্রিন।
চা বানিয়ে এনে মুখোমুখি বসে ফয়সল। কাপে আলতো করে চুমুক দিল মেয়েটি। ওর অভিব্যক্তি থেকেই বুঝতে পেরেছে ফয়সল, এই চায়ে অভ্যস্ত সে নয়। কাজুবাদামের বাটিটা তুলে দিয়ে বলে, আইসক্রিম খেতে পারো, না হয় চকলেট।
আমি ওসব খাই না, বাদাম খুব প্রিয় আমার, বলে দেয়ালে ঝোলানো একটা পোর্ট্রেটের দিকে তাকিয়ে জানতে চায় ও, ওটা কার?
আমার বউয়ের। আর ওই যে ড্রয়ারের ওপর স্ট্যান্ডে ওটা আমার মেয়ের।
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে মেয়েটি, কী যেন ভাবে, একটু কি লজ্জা পেয়েছে সে? বাদামের বাটিটা রেখে উঠে গিয়ে কাচের শেলফে মৃদু আলোর মধ্যে ছোট্ট ছোট্ট ফ্রেমে বাঁধানো গ্রুপ ছবিগুলো থেকে মা-মেয়েকে আলাদা করে নেয়। ছবির মারজিয়া কটমট করে তাকায়, কী বেহায়া মেয়ে রে বাবা, আবার তন্ন তন্ন করে খোঁজা হচ্ছে! মেয়ে রুকাইয়ার তো বাবার ওপর অভিমান, কে না কে একজন এল অমনি আমার চকলেট আর আইসক্রিম সাধছে বাবা! ভাগ্যিস ও খেতে চায়নি।
ফয়সলের ছটফটানিটা কিন্তু গেল না। সে মাংসে মসলা মাখানোর পর কড়াইয়ে তেল গরম করতে দিয়ে আলমারি থেকে স্কচের বোতলটা বার করে আনে। দুটো গ্লাসে ঢেলে ওকে বলে, এই, তোমাকে আইস দিই?
ছবি ফেলে শেলফে সাজানো বিচিত্র মিনিয়েচারগুলোয় চোখ আটকে আছে মেয়েটির। কম দিয়েন, গলা বসা আমার, পেছন ফিরে না তাকিয়েই বলে সে। ফয়সল গ্লাস বানিয়ে গিয়ে কাঁধে হাত রাখে ওর। একটা মিষ্টি গন্ধ আসছে ঘন কালো ঝলমলে চুল থেকে। স্নানের আগে আজ শ্যাম্পু করেছে নিশ্চয়। ওর চুলে নাক ঘষে সে আর বলে, সুন্দর না? জানো, যেখানেই গেছি কিছু না কিছু নিয়ে এসেছি, আমার শখ বলতে পারো।
চুলোর ওপর তেল পুড়ে যাচ্ছে। দৌড়ে যায় ফয়সল, মেয়েটাও যায় পিছু পিছু। এরপর মাংস ভাজার ফাঁকে ফাঁকে এক ছিপ এক ছিপ করে চুমুক দেয় ওরা, চুমু দেয়, নাকে নাক ঘষে। গরম তেলে নাড়তে থাকা কষানো মাংস থেকে একটু একটু করে গন্ধ ছড়াচ্ছে। বসার ঘরের দেয়াল আর ড্রয়ারের ওপর থেকে রান্নাঘরে কী হচ্ছে, মারজিয়া বা রুকাইয়া তা দেখতে পায় না।
মধু আর মসলার বনে ঘুরপাক খেতে খেতে যখন ওরা শোবার ঘরে এল, বাইরে তুমুল বাতাস দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি শুরু হয়েছে। খাটের পাখায় হেলান দিয়ে আছে ফয়সল। যেটুকু খেয়েছে, তাতেই ঢুলুঢুলু করছে চোখ। অর্ধেক গ্লাস পাশটেবিলে রেখে মেয়েটি ওর গা ঘেঁষে বসে। বলে, বুকটা চিনচিন করতেছে, আর না খাই।
শাড়িটা সরিয়ে ব্লাউজের মধ্যে হাত রাখে ফয়সল, হতে পারে অ্যাসিডিটি, একটা ট্যাবলেট দিই?
না থাক, মাঝে মাঝে এমন হয়, একটু পরেই ঠিক হবে।
ওর কথার রেশ ধরেই হঠাৎ মেয়েটাকে ম্লান আর ক্লান্ত লাগে ফয়সলের। ব্লাউজের ভেতরের কোমলতা থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে একটু গুছিয়ে বসে সে, তুমি না একটা জব করতে?
ছেড়ে দিছি। কৃতিত্বভরা গলা ওর, বস ব্যাটার মাত্রাছাড়া আবদার, বুঝলেন। ফাঁকে ফাঁকে ম্যানেজারের আবদার। যা বেতন! তার চেয়ে স্বাধীন আছি, এই-ই তো ভালো।
তারপরও এটা তো কোনো পথ না, তাই না?
পথ যে না তা মানতেছি, কিন্তু ছোট ভাইটা কলেজে পড়ে, মায়রে টাকা পাঠাইতে হয়, উপায় কী, বলেন?
বসার ঘরে চার্জে দেওয়া ফোনটা বেজে উঠতেই তড়াক করে খাট থেকে নেমে গিয়ে ফোন ধরে ফয়সল,…আরে না, না, এখানে তো জোর বাতাস দিয়ে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে।…তুমি পাগল নাকি! সব বন্ধ করেছি। বললাম তো ছাদে কিছু দেই নাই।…কথায় তাড়াহুড়া থাকলেও রাগের কণ্ঠস্বর যদ্দুর সম্ভব কোমল করে রাখে ফয়সল। ওঘর থেকে তা অনুভব করতে পারে মেয়েটি। ফিরে এলে সে বলে, এই তো ফোনে কথা বলতে গিয়া রাইগাই তো ছিলেন, রাগ কি দেখাইতে পারলেন? সব সময় সব কাজের উপায় থাকে না, ফয়সল ভাই।
একা ঘরে একটা মেয়েকে ডেকে রান্না করছে, মদ খাচ্ছে, চুমু খাচ্ছে, বাকি কাজ তো পড়েই আছে এখনো; বউকে এর ছিটেফোঁটাও বুঝতে না দিয়ে ফোনে যে শুধু নিজের রাগটাই চেপে ধরেছে সে—অনুভব এড়ায়নি তেইশ-চব্বিশ বছরের এই মেয়েটার। আর বুদ্ধি করে ও যেভাবে বলল, তা ভেবে ফরসা মুখখানার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ফয়সল। বলে, একটু চেষ্টা করলে কীই-না হতে পারত তোমার, বলো?