| 29 মার্চ 2024
Categories
২৬ মার্চ

২৬ মার্চ সংখ্যা: ঝিরাবাড়ির পীরচাচা । মঈনুস সুলতান

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

অনেকক্ষণ ধরে মিহি স্বরে কোরআন তিলাওয়াত করে ওজিফা বস্তনিতে পুরে চুপচাপ বসে থাকেন সৈয়দ মোদাব্বর হোসেন সাহেব। জানালা দিয়ে তিনি তাকিয়ে আছেন দূরের অনুচ্চ পাহাড়ের দিকে। নুরপাশা গ্রামের এই বর্ধিষ্ণু পরিবারের বাইরের টঙ্গিঘরে গেল রাত তিনি মেহমান হিসেবে কাটিয়েছেন। সফেদ দাড়ি, সৌম্য দর্শন মোদাব্বর হোসেন সাহেব এই বাড়ির ছেলেমেয়েদের কাছে ঝিরাবাড়ির পীরচাচা নামে পরিচিত। তাঁর পীর পরিচিতি সমাজে ব্যাপক নয়। সদর মহকুমার যে ঝিরাবাড়ি গ্রামে তাঁর সাকিন—তার বাইরে, বেশ দূরে দূরে—ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় ছড়ানো-ছিটানো জোর আট বা দশটি পরিবার পীর হিসেবে কদর করে তাঁকে। এই পরিবারগুলোর কেউ কেউ তাঁর মুরিদান। তিনি এদের খেশকুটুমের মতো খোঁজখবর করেন। নুরপাশা গ্রামের এই বাড়ির বড় গৃহিণী, যিনি হামছায়ায় বড় বিবি বলে পরিচিত, তাঁর কাছে বয়েত হয়েছেন আজ বছর দশেক হলো। দিন চারেক আগে তাঁর কাছে খবরিয়া বড় বিবির চিঠি নিয়ে গেলে হোসেন সাহেব গরজ করে এদের খোঁজ নিতে এসেছেন।
মে মাস শেষ হয়ে জুনে পড়েছে। শোনা গিয়েছিল, মে মাসের মাঝ বরাবর আমেরিকার মধ্যস্থতায় সামরিক জান্তার সঙ্গে বাঙালিদের সমঝোতা হবে, কিন্তু হয়নি। বিবিসির খবরে জানা গেছে, করাচি থেকে জাহাজে করে চট্টগ্রাম বন্দরে এসে নেমেছে ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের পাঠান সৈনিকেরা। পীর সাহেবের চেনাজানা কোনো কোনো মানুষকে ধরে নিয়ে গিয়ে খুন করেছে খানসেনারা। বাংলাদেশের ভেতরে বেড়েছে গেরিলা তৎপরতা। মুক্তিফৌজরা পাত্রখোলা চা-বাগানের কলঘর বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে। পত্রপত্রিকা আবার চালু হয়েছে বটে, দু-তিন দিন পরপর জেলা সদরের বন্দর-বাজারে পাওয়া যাচ্ছে দৈনিক পাকিস্তান বা পয়গাম। তবে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে আসেনি এখনো।
দেশগ্রামে গরমও পড়েছে জবর। পীর সাহেব তালপাখা দিয়ে হাওয়া করেন। বাড়ির ঝি-বেটি নিয়ে আসে এক পেয়ালা চা। চুমুক দেন তিনি, কিন্তু গুড়ে বানানো দুধ ছাড়া ফিকা চায়ে স্বাদ পান না কোনো। অবশ্য এতে মনঃক্ষুণ্নও হন না। তিনি সচেতন যে এই বাড়িতে গুড়ের ফিকা চা দিয়ে মেহমানদারির রেওয়াজ নেই।
হাটে-বাজারে আজকাল দরকারি জিনিসপত্র—চিনি বা মিঠাতেল পাওয়া যাচ্ছে না। ফার্মেসিতে নভেলজিনের মতো আদনা ট্যাবলেটের জোগান ফুরিয়ে গেছে। তালপাখায় বাতাস করতে করতে একটু আফসোস হয় তাঁর। গতকাল জেলা সদরের কাজির বাজারের ভেতর দিয়ে আসার সময় খানিক থেমে চেনাজানা আড়ত থেকে এই পরিবারের জন্য এক মছা চিনি বা একটু ময়দা নিয়ে এলে ভালো হতো।
ঝিরাবাড়ির পীর সাহেব তাঁর মুরিদানের সঙ্গে খেশকুটুমের মতো রিসতাদারি বজায় রাখেন। এদের কাছ থেকে খয়রাত হিসেবে কোনো টাকাপয়সা, বারিক চাউল, ঘি বা মোর্গা কিছুই নেন না; বরং ওদের বাড়িতে বেড়াতে এলে এক মছা জিলাপি, আমৃতি, গজা বা খেজুর কিনে নিয়ে আসেন। দেশে যুদ্ধ বেধে যাওয়ায় হিন্দু ময়রারা শরণার্থী হয়ে চলে গেছে ওপারে। মিষ্টির দোকানগুলো বিরান হয়ে পড়ে আছে। আসার পথে স্টেশনের দোকানে-দোকানে খুঁজে এক প্যাকেট নাবিস্কো বিস্কুটও মছর করতে পারেননি। প্রত্যেকবার কাঠিলজেন্স নিয়ে আসেন। এবার তাও আনতে পারেননি। তাই ‘পীরচাচা’ বলে আবদার করা এই বাড়ির বাচ্চারা খাজুল হয়েছে বোঝা যায়। তিনিও শরমিন্দা হয়েছেন বিঘতভাবে।
গেল রাতে পাতলা ডালের সঙ্গে শুধু ডিম ভাজা দিয়ে খানা খাওয়ার সময় বুঝতে পেরেছেন, সম্পন্ন এই পরিবারে হালফিল খাবারদাবারের আক্রা চলছে।
নুরপাশা গ্রাম রাজসড়ক থেকে বেশ ভেতরে। ছড়া নদীতে বাঁশের সাঁকো ধরে যেতে হয়, হিজল-জারুলের গাছপালায় গ্রামটি বেশ বিচ্ছিন্ন। এত প্রত্যন্ত গ্রামে খানসেনারা হয়তো ঢুকবে না—এই ভরসায় শহরের বেশ কিছু কুটুমখেশ এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছে।
খাওয়াদাওয়ার পর তাঁকে ঘিরে বসেছিল এই বাড়ির নিকটাত্মীয় দুই যুবক। এদের একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। অন্যজন ময়মনসিংহের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। এরা পরে বেলবটম প্যান্ট, রাতের বেলা ভলিউম কমিয়ে সঙ্গোপনে শোনে স্বাধীন বাংলা বেতারের সংবাদ। ওদের সঙ্গে পীর সাহেব প্রথমবার ‘চরমপত্রে’র ভাষ্য শুনেছেন।
যুবক দুজন স্বভাবে হাসিখুশি কিন্তু ভীষণ উদ্বিগ্নও। রেডিও পাকিস্তান থেকে ‘দেশ স্বাভাবিক হয়ে এসেছে’ দাবি করা হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ফিরে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না ওরা। খানসেনাদের ক্যাম্পে হামেশা যুবক ছেলেদের ধরে নিয়ে গিয়ে টর্চার করা হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে খুন করা হচ্ছে নির্মমভাবে। ওদের পরিচিত চার যুবককে রাজাকাররা ক্যাম্পে ধরে নিয়ে গেছে সপ্তাহ তিনেক আগে। কোনো খোঁজখবর পাওয়া যাচ্ছে না তাদের। গুজব রটেছে, ব্রাশফায়ার করে চার যুবককে হত্যা করেছে খানসেনারা। একজনের রক্তাক্ত লাশ নাকি নদীর জলে ভাটির দিকে ভাসতে দেখা গেছে। সীমান্তেও সিল পড়েছে। ওপারে—ভারতের ত্রিপুরায় যেতে গেলে ষাড়েরগজ পাহাড় হেঁটে পাড়ি দিতে হবে এখন। দুই যুবক কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। বড় বিবি তাই পীর সাহেবকে অনুরোধ করেছেন পাহাড়ের ভেতর দিয়ে ত্রিপুরা যাওয়া নিরাপদ হবে কি না, তা ইস্তেখারা করে জেনে নিতে।
ইস্তেখারা হচ্ছে রাতে সমস্যাটি কাগজে সাংকেতিক ভাষায় লিখে খুব পাক-সাফ হালতে কোরআনের নির্বাচিত কিছু আয়াত পাঠ করে আলেমুল গায়েবের কাছে সমাধান চেয়ে ঘুমাতে যাওয়া। পীর সাহেব মুরিদানদের জন্য ইস্তেখারা কখনো কখনো করেছেনও। তখন খোয়াবের মাধ্যমে গায়েবি থেকে তাঁর কাছে সমাধানও এসেছে। এই বাড়ির আরেকটি ছেলে, বড় বিবির দেবরপুত্র আশফাক সাত বছর আগে কী কারণে যেন পরিবারের ওপর রাগ করে যোগ দেয় পাকিস্তানি আর্মিতে। তারপর ১৯৬৫ সালে বাধে ছয় দিনের যুদ্ধ। খবর আসে, ছেলেটি খেমকারান সেক্টরে যুদ্ধরত।
এরপর তাসখন্দে লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর সঙ্গে আইয়ুব খানের শান্তিচুক্তিতে লড়াই-বিড়াইয়ের তামাদি হলেও আশফাকের কোনো খায়খবর পাওয়া যাচ্ছিল না। শোনা যাচ্ছিল, যুদ্ধে মৃত্যু হয়েছে আশফাকের। বড় বিবি তখন পীর সাহেবের শরণাপন্ন হলে তিনি এই বাড়িতে এসে ইস্তেখারা করেন। খোয়াবে পরিষ্কার দেখেন, করাচি বন্দরে একটি জাহাজে চেপেছে আশফাক। পীর সাহেব পরিবারের সবাইকে তাইশবিশ না করে বললেন অপেক্ষা করতে।
দিন সাতেক পর জাহাজে চেপে আশফাক সত্যি সত্যিই ফিরে আসে চট্টগ্রাম বন্দরে।
কিন্তু গত রাতের ইস্তেখারায় এই বাড়ির বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছেলে দুটির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে পীর সাহেব গায়েবি থেকে কোনো সংবাদ পাননি। খুব দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তিনি। তবে কি তাঁর নিজস্ব কোনো নাফরমানির জন্য কার্যকরী হয়নি ইস্তেখারা? একটি ব্যাপারে তাঁর সন্দেহ জাগে—তাহলে কি ইস্তেখারার পুরো বিষয়টি আগাগোড়া তাঁর কল্পনাপ্রবণ মনের বিভ্রান্তি? হাদিসদলিল জানা কোনো আলেম তিনি নন। আরবি-ফারসি যা জানেন, তার কারণ যত না ধর্মীয়, তার চেয়েও বেশি রাজনৈতিক।
শৈশবে পীর হওয়ার বিন্দুমাত্র বাসনাও ছিল না তাঁর। কৈশোরে ঝুঁকেছিলেন স্বদেশি আন্দোলনে। হিন্দুস্তানের আজাদির স্বপ্ন দেখতেন। ১৯৪২ সালে ভারত ছাড় আন্দোলনে শামিল হয়ে স্কুলে হরতালের জন্য পিকেটিং করে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক পরিচয় মার্কামারা হয়ে গেলে অন্য স্কুলও ছাত্র হিসেবে গ্রহণ করছিল না তাঁকে। পরে তাঁর নামে হুলিয়া বের হলে পালিয়ে চলে যান কলকাতায়। ওখানে তাঁর ভগ্নিপতি জাকারিয়া স্ট্রিটের একটি মসজিদে ইমামতি করতেন। পালিয়ে আসা শ্যালককে তিনি ভর্তি করে দেন মাদরসা-এ আলিয়ায়।
বড় বিবির দেবরপুত্র আশফাকের মতো তরুণ বয়সে পীর সাহেবও পরিবারের ওপর রাগ করে যোগ দিয়েছিলেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে। মাদরাসা-এ আলিয়ার তালবে আলেমগিরিতে মন বসছিল না তাঁর। বছর তিনেকের ভেতর রাজনৈতিক দুর্বিপাকের বাষ্প মুছে গেলে গ্রামের বাড়িতে ফিরে জানাশোনা এক রূপসী বিধবাকে গোপনে নিকাহ করেছিলেন। খবরটি জানাজানি হলে তাঁর বাবা অত্যন্ত রাশভারী গোছের মিরাশদার, কান ধরে ছাতাপেটা করেন তাঁকে। তাতে তাঁর মনে তীব্র তিকের সৃষ্টি হয়, পালিয়ে যোগ দেন সেনাবাহিনীতে। কিন্তু তত দিনে ব্রিটিশবিরোধিতা গাঁঢ় হয়ে বসেছে তাঁর চরিত্রে। ধর্মের দিকেও কী কারণে জানি মন রুজু হতে শুরু করেছে। ফৌজি কুচকাওয়াজের ফাঁকে আড়াল-আবডালে নামাজ-কালাম পড়তে শুরু করেন তিনি। রেশন থেকে সামান্য খাবার বাঁচিয়ে শেষরাতে গোপনে সাহ্রি খেয়ে রোজা রাখেন। এটি জানাজানি হলে খুব নাফরমান গোছের এক ফিরিঙ্গি ক্যাপ্টেন মরুভূমির রোদে দানাপানি ছাড়া সকাল-সন্ধ্যা তিন দিন একনাগাড়ে দাঁড়িয়ে থাকার শাস্তি দেয় তাঁকে। অবশেষে রব্বুল আল আমিনের অশেষ রহমতে এক বেলুচি ল্যান্স নায়েকের সহায়তায় পল্টন থেকে পালিয়ে আসতে সমর্থ হন তিনি।
রাওয়ালপিন্ডি থেকে পালিয়ে পয়লা আসেন অমৃতসরে। সেখান থেকে মানি অর্ডার করে জমানো কিছু টাকা পাঠান শাদি করা বিবির এক আত্মীয়ের ঠিকানায়। তারপর রেলগাড়িতে চেপে ঘুরতে শুরু করেন সিপাহি বিদ্রোহের জন্য খ্যাত স্থানগুলোতে। প্রথমে পুরোনো দিল্লি, তারপর যাত্রাবিরতি করেন আগ্রায়। অতঃপর কানপুরের এক মসজিদে এতেকাফ করে কাটান দিন চল্লিশেক। ঘুরতে ঘুরতে তাঁর থিতি হয় মিরাটের সুফি-দরবেশ শাবাজ খান চিশতির খানকায়। ইস্তেখারার এলেম পান চিশতি তরিকায় জিকিরের সময়েই। দরবেশ শাবাজ খান ছিলেন দিল্লির সেলিম চিশতির সিলসিলার পীর। খানকাতে পাক্কা দুই বছর খেদমত করার পর তিনি তাঁর খলিফা হিসেবে মোড়াছা বা পাগড়ি পান। এ সময় সুফি শাবাজ চিশতি তাঁকে দেশে ফেরার ইজাজত দেন।
বাড়ি ফেরেন তিনি। তত দিনে ইন্তেকাল হয়েছে তাঁর বাবার। নিকাহবন্ধ বিবিও পালিয়ে গেছেন আরেক মরদের সঙ্গে। আরও অনেক ঘটনা, এরপর মুরারীচাঁদ কলেজ থেকে এফ এ পাস করেন। কিছুদিন বেঙ্গল কাস্টমসে করেন চাকরি, নতুন করে সংসারেরও সূত্রপাত ঘটান। চাকরিতে উৎকোচ গ্রহণের জন্য ওপর-কর্তার তরফে চাপ ছিল। ত্যক্তবিরক্ত হয়ে তাই নিজ থেকেই ছাড়েন চাকরি। ঝিরাবাড়ি গ্রামে ফিরে বাফাউতি জমিজিরত নিয়ে সংসার করতে শুরু করেন। খেসারতের টাকা পাওয়া গেলে তা দিয়ে গ্রামে বসান রাইস মিল ও আটা কুটার হলার। তাতে রুজিরোজগার হচ্ছিল ভালোই। বাড়ির বাংলাঘরের বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে বসে পুরোনো পত্রিকা পড়ে সময় খারাপ কাটছিল না। মাঝেমধ্যে জেলা সদরে গিয়ে বলাকা বুক স্টোরস থেকে কিনে আনতেন সওগাত বা রিডারস ডাইজেস্ট ।
সুর করে ওজিফা পড়া ছাড়া তাঁর চরিত্রে জাহেরি কোনো ধর্মীয় আলামত দৃশ্যমান হতো না। তবে আল্লাহর মক্কর বোঝা মুশকিল। কীভাবে যেন জানাশোনা কয়েকটি পরিবার জেনে যায় শাবাজ চিশতির খলিফা তিনি। এদের কেউ কেউ বাতেনি এলেমের তালাশে মোড়াছার প্রান্ত ছুঁয়ে তাঁর বয়েত হয়।
বড় বিবির চিঠি পেয়ে গতকাল নুরপাশা গ্রামে আসতে একটু ঝামেলা হলেও তেমন কোনো মুসিবতে তিনি পড়েননি। জেলা সদর থেকে রেলগাড়িতে রওনা হয়েছিলেন, কিন্তু মুক্তিফৌজরা ইলাশপুরের ঢালার ব্রিজটি উড়িয়ে দিয়েছে। ট্রেন তাই এপারে দাঁড়িয়ে পড়ে। পীর সাহেব অন্যান্য যাত্রীর সঙ্গে মিলেঝুলে নৌকায় চেপে নদী পাড়ি দেন। হাতে তাঁর চা-গাছের শিকড়ে তৈরি কোঁকড়া লাঠি, গতরে ধবধবে সাদা ছকল্লি কোর্তার ওপর রেশমের হালকা কারুকাজ করা সদরিয়া। ব্রিজের গোড়ায় বসেছে চেকপোস্ট। ওখানে কারবাইন হাতে চৌকি দেওয়া খানসেনারা তাজিম করে সালাম-আলেক দেয় তাঁকে।
পুরোনো দিনের ইয়াদগারি থেকে বর্তমানের রূঢ় বাস্তবে ফিরে আসে পীর সাহেব সৈয়দ মোদাব্বর হোসেনের মন। এই বাড়ির বিশ্ববিদ্যালয়-পড়া ছেলে দুটির দ্বিধাগ্রস্ত উদ্বিগ্ন মুখ ভাসে তাঁর মনে। ওরা দেশে থাকলে যদি চোগলখুরি করে রাজাকারেরা খবর রটিয়ে দেয়, খানসেনারা ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যায় তাদের! আবার তাদের যে ত্রিপুরার দিকে পাড়ি দিতে পরামর্শ দেবেন, যাওয়ার পথে ওরা ধরা পড়ে যদি; কিংবা ওপারে গিয়ে ওরা হয়তো শামিল হলো মুক্তিফৌজে, তারপর খোদা না করেন, গেরিলা অপারেশনে যদি ওদের কিছু হয়?
ছেলে দুটোকে পীর সাহেব কী বলবেন, ধন্দে পড়ে টঙ্গিঘরের বারান্দায় পায়চারি করেন তিনি। কামের বেটি গরছির বেড়ায় মেলে দিচ্ছে ধোওয়া-পাকলা করা কাপড়। খালি গায়ে এক কামলা-বেটা সেঁউতি দিয়ে পুকুর থেকে সেঁচছে পানি। দুটি শুভ্রলোমের ছাগলছানা অজানা খুশিতে নাচ করতে করতে লাফিয়ে উঠে আবার পড়ে যায় সদ্য ভেজা থিকথিকে কাদায়।
তাঁর ঢোলা পিরহানের জেব থেকে আকিক পাথরের তেত্রিশটি গোটায় তৈরি ছোট্ট তসবি বের করেন পীর সাহেব। সুরুজের আলো পড়ে এর প্রতিটি পাথরে তিনি তাঁর মুর্শিদের মোনাজাতরত মুখ দেখতে পান। মনে ফিরে আসে বাতেনি বিশ্বাস। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেন তিনি, অবচেতনের অবতল থেকে উঠে আসা গায়েবি ইশারার জন্য।
তারপর কোঁকড়া লাঠিটি হাতে তুলে নিয়ে টঙ্গিঘর ছেড়ে ধীরে ধীরে চলে আসেন বাড়ির ভেতর-মহলে। দালানঘরের বারান্দায় উঠে গলা খাঁকারি দিতেই কামকাজের ঝি খুলে দেয় দরজা। পর্দা সরিয়ে কামরায় ঢোকেন তিনি। তোয়ালে-মোড়া চেয়ারে বসে পানদান থেকে খিল্লি তুলে মুখে পুরতেই বুঝতে পারেন, ঝুলন্ত চিকের ওপারে এসে নীরবে দাঁড়িয়েছেন বড় বিবি। বিশ্ববিদ্যালয়-পড়া ওই ছেলেরাও এসে হাজির। সিদ্বান্তহীনতার ছাপ ওদের চোখমুখে। রাতে ওরা একফোঁটা ঘুমায়নি। তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে ওরা বলে, ‘পীরচাচা…?’
হাত তুলে আশ্বস্ত করেন ওদের। কাঁধের ঝোলা থেকে বের করেন দিওয়ান-এ-হাফিজ নামে রায়বেরিলি থেকে প্রকাশিত একখানা ফারসি কেতাব। খানিক দ্বিধা নিয়ে দুচোখ বন্ধ করে ধ্যানস্থ হন একটু। সুফি শাবাজ চিশতিকে মুরিদানের বালা মুসিবতের সময় পারস্যের কবি হাফিজ শিরাজির দিওয়ান খুলে বয়েত পাঠ করে সমাধান খুঁজতে দেখেছেন তিনি। এই দিওয়ান-এ-হাফিজ কেতাবখানা খেলাফত লাভের দিন শাবাজজি হুজুরের হাত থেকে তিনি সওগাত হিসেবে পেয়েছিলেন। নীরবে তিনি সমাধান লাভের মোনাজাত করে চোখ খোলেন।
ছেলে দুজন অধীর প্রত্যাশা নিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে। পীর সাহেব এবার চামড়ার বটুয়া থেকে বের করে আনেন মোড়াছার ভাঁজ করা ঝ্যালঝ্যালে কাপড়। সেটি দিয়ে নিজের চোখ মুড়ে বেঁধে বিড়বিড়িয়ে কালামে-পাক জপতে জপতে পৃষ্ঠা ওল্টান তিনি সাবধানে। চোখ থেকে মোড়াছার কাপড় খুলে নিয়ে সুর করে বারবার পড়েন কেতাবে লেখা একটি ফারসি বয়েত, ‘মা রা ডার মঞ্জিল ই জানাম চি অমন ই/ জারাস ফরিয়াদ মাইদারাদ কি বার বানদিদ মাহমিল হা।’
মনোযোগ দিয়ে তাঁর কাছ থেকে বয়েতটির তরজমা শোনে দুই ছেলে। কী যেন ভেবে এর মধ্যে এক ছেলে ডায়েরি খুলে লিখে নেয় ফারসি চরণের অনুবাদ, ‘জীবনের যাত্রাপথ অস্থিতিশীল হয়ে আছে দায়িত্ববোধ এবং নিয়ন্ত্রণের বাইরে ঘটে যাওয়া ঘটনাপ্রবাহে।’ নিজেদের মধ্যে নিচুস্বরে ওরা কথা বলে ‘দায়িত্ববোধ’ শব্দবন্ধটি নিয়ে। ক্রমশ ওদের চোখমুখ থেকে মুছে যায় দোনামোনা ভাব। সিদ্ধান্ত হয়, এখনই খবরিয়া পাঠিয়ে যোগাযোগ করা হবে গ্রামের বোঙ্গা কারবারি মজর উল্লার সঙ্গে, নাসির বিড়ির চালান আনতে মাঝেমধ্যে যে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে যায় ত্রিপুরার কৈলাশহরে। সবাই আন্দাজ করে, মজর বেপারি হুঁশিয়ার লোক। সে সঙ্গে থাকলে ষাড়েরগজ পাহাড়ের ভেতর দিয়ে ওপারে পৌঁছে যেতে তেমন কোনো সমস্যা হবে না আর।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত