| 19 এপ্রিল 2024
Categories
শারদ সংখ্যা’২২

শারদ সংখ্যা গল্প: কন্ঠস্বর । প্রতিভা সরকার

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

রেল লাইনের ধারে বেশ খানিকটা জায়গা নিয়ে ছুটতে থাকা লম্বা ছিরিছাঁদহীন টালির চালে ছাওয়া কুষ্ঠাশ্রমের ঘরগুলো যেখানে শেষ হয়েছে সেইখানে শিব মন্দিরের সিঁড়িতে মেয়েটা বসে মোবাইল ঘাঁটছিল। ওর নাম মুন্নি। সন্ধ্যাবেলায় সামনের পাকুড় গাছটায় এতো পাখি ডাকাডাকি করে যে মাঝে মাঝেই তাকে পাকিস্তানি সিরিয়াল হামসফরের ডায়ালগ শোনার জন্য মোবাইলটা কানে চেপে ধরতে হচ্ছিল। ইয়ারফোনটা তার ভাইয়া হারিয়ে ফেলেছে। 

ঠিক তখনই ছেলেগুলো তার সামনে এসে দাঁড়াল। ঘ্যাচাং করে ব্রেক কষা একটা লাল বাইকে চারজন। একরকম দেখতে  চারটেকেই, গাট্টাগোট্টা, বেঁটে মোটা বখাটে ছেলে, বাপে খ্যাদানো মায়ে তাড়ানো। কপালে লম্বা করে পরা লাল টিকা। একজন শুধু একটু অন্যরকম, কারণ তার গালে থুতনিতে রয়েছে কালো চাপদাড়ি। অত অল্পসময়ে এইটুকুই ঠাহর করতে পেরেছিল মুন্নি।

দাড়িওয়ালাটাই বাইক চালাচ্ছিল।  একটাও কথা বলেনি। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছিল। যেন কে কী করছে দেখবে না ঠিক করেছে। অন্যগুলো খলবলাচ্ছিল, লাফাচ্ছিল, সদ্য পয়দা হওয়া ল্যাজ-তোলা এঁড়ে বাছুর তিনটে। আকন্ঠ মালে বোঝাই, এ ওর পায়ে জড়িয়েমড়িয়ে হোঁচট খেতে খেতে মুন্নির সামনে এসে দাঁড়াল, তারপর একটা হাত এতো জোরে কেড়ে নিল মোবাইলটা, যে সবুজ কাচের চুড়ি ভেঙে গেল, পট। নিজের রক্ত চেটে নিয়ে মুন্নি বাঘিনীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে, মোবাইল ছিন লিয়া রে!

তিনটেই বিকট উল্লাসে হো হো হা হা করে, হাতে উঁচু করে ধরে রাখে মোবাইল, যেন কুকুরের নাকের ওপর টুকরো বিস্কুট। ওদেরই কেউ একজন স্খলিত কন্ঠে বলে, গদ্দার, কুত্তি কাঁহিকা, পাকিস্তানি ড্রামাবাজি হচ্ছে !

তা কুত্তির মতোই লাফায় মুন্নি, তার জানসে প্যায়ারা মোবাইল, শিব মন্দিরের কাঁসার রেকাব, কোশাকুশি, আরও এন্তার বাসন সোনার মতো করে মাজার পয়সা আর স্টেশন মাস্টারের অফিস ঘর ঝাড় দেবার পয়সা জমিয়ে কেনা। 

এতো লম্ফঝম্পে তার দোপাট্টা খসে পড়ে, তার সুঠাম বুকজোড়াও লাফায়, কেঁপে কেঁপে ওঠে কুর্তিতে ঢাকা পেছনের উইঢিপি। শরীরের সব রক্ত মুখে এসে জমে বলে বদমাসদের একজনের হঠাত তাকে লাগে যেন উরফি জাভেদ। ফিসফিস করে কিছু বলে সে বন্ধুদের, তারপর মোবাইল নিয়ে টেনে দৌড় মারে, অন্ধকার তাকে গিলে নিলে তার পেছন পেছন অন্য দুটোও।  

মুন্নিও দৌঁড়তে যাচ্ছিল পেছন পেছন, কেউ তার ড্যানা চেপে ধরে। টিকা লাগানো দাড়িওয়ালাটা। বাইক নিয়ে সেটা তখনও স্থাণু। বলে, “যাস না।” হাত ছাড়াবার প্রাণপণ চেষ্টা করে মুন্নি, “উসকো ক্যিঁউ নেই সমঝাতা? দেখা ন মেরা মোবাইল ছিন লিয়া। তব গুঙ্গা বনকে ব্যয়ঠা থা, কুছ বোলা ভি নেহি !”

ছেলেটা আবার তাকে বলে, “বলছি যাস না। গেলে বড় বিপদ হবে।”

এসেছেন এখন বড়া বিপদ বোলনেওয়ালা! গা পিত্তি জ্বলে যায় মুন্নির। বন্ধুদের কিছু না বলে তাকে আটকাতে এসেছে। এ তো ভারী আশ্চর্য লোক ! আগুপিছু না ভেবে ক্ষিপ্ত মুন্নি ছেলেটার কবজিতে দাঁত বসায়, মুক্ত হয়ে ছুটে চলে যায় অন্ধকারে।  


আরো পড়ুন: তৃতীয় বর্ষপূর্তি সংখ্যা গল্প: রঙছবিতে সোনালি সূর্য । সেলিনা হোসেন


            (২)

ঘটনার পর তিন মাস তো হয়েই গেল, এখন সব ঝাপসা থেকে আরও ঝাপসা হচ্ছে। সাত সকালে নামা তুমুল বৃষ্টির ভেতর জল ছিটিয়ে মেল ট্রেনের দাবড়ানির পরও যেমন লাইনে আর প্ল্যাটফর্মে ন্যাতানো কাগজ ওড়ে, জল-লাগা প্লাস্টিকের প্যাকেট, ভেজা পাতা, খড়কুটো, তেমনি এলোমেলো চিন্তা মুন্নির চারপাশে উড়তে থাকে। সারাক্ষণ দোপাট্টায় মুখ ঢেকে চাটাইয়ে শুয়ে ভাবব না, ভাবব না, ভেবেও,  একই কথা ভাবা। অথচ কে তাকে অন্ধকারে ছুঁড়ে ফেলে মাটিতে, কে ফেঁড়ে দেয় সালোয়ার, এসব ধোঁয়া ধোঁয়া হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে, সে কিছুই মনে রাখতে পারছে না। ওদের মুখগুলো বেমালুম হারিয়ে গেছে। শুধু তার কানে থেকে থেকে ভেসে আসে গম্ভীর নীচু স্বরের চেতাবনি, মৎ যা, যাস না। গলাটায় কী যেন ছিল, একটা ভবিতব্যের ছোঁয়া, নাকি উদবেগ, সেসব ভুলে যায় সে, মনে থাকে শুধু গভীর একটা কন্ঠস্বর। মেল ট্রেনের হর্ণের মতো দূরগামী, গম্ভীর আর বিপদবার্তায় পূর্ণ।  এমনটা সে আগে কখনও শোনেনি। 

 ট্রেনের চাকার কম্পন জল ঠেলে চলে যাওয়া স্টিমারের মতো মাটিতেও তরঙ্গ  তোলে, ছড়ায় বহুদূর । মুন্নি সেজন্য কেঁপে কেঁপে ওঠে, নাকি তরাসে, কে জানে, শুধু কানের পর্দা ফুটো করে দেওয়া হুইসিলের সঙ্গে  তীরের মতো ঢুকে পড়ে আজিব কন্ঠস্বরে উচ্চারণ করা কয়েকটি শব্দ, “গেলে বড় বিপদ হবে।” ঐ গলাটা আর কথাগুলো যেন সারাক্ষণ তার পিছু পিছু ঘোরে, কাঁঠালের ওপর নীল ডুমো মাছির হামলে পড়ার মতো।

চেতাবনি দিয়েছিল, কিন্তু বাধা দেয়নি তো ! বন্ধ হয়ে যাওয়া জুটমিলের ধুলো আর মাকড়সার জাল ভরা গুদাম ঘরের মেঝেতে মুন্নির গায়ের ওপর হামলে পড়েছিল তিন তিনটে টিকাদার, আর তারই এক কোণে ও সারাক্ষণ গলায় বোতল উপুড় করে  যাচ্ছিল। তাকায়ওনি ফিরে। অনেকক্ষণ হয়ে গেলে মেঘ ডাকার মতো শুধু একবার বলেছিল, “এবার থাম। মেরে ফেলবি নাকি!” বজ্র বিদ্যুত থমকে থাকা সেই আওয়াজে  ছেলেগুলো সত্যি থেমে গেল। বোধহয় ওদেরও দম ফুরিয়ে এসেছিল। এতক্ষণ দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করবার চেষ্টায় ক্ষান্তি দিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলবার ঠিক আগে মুন্নি দেখল, ছেলেগুলো ধুলো ঝেড়ে জামা প্যান্ট পরছে। পকেট থেকে চিরুনি বার করে চুল আঁচড়াচ্ছে। আর দাড়িওয়ালা সবার আগে গুদাম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। কাঁধদুটো সামনে ঝোঁকানো, এলোমেলো চলন, যেন যা হয়েছে তাতে ওর সায় ছিল না।  

এগুলো সত্যি না সবটাই তার বানানো,  রেল লাইন ঘেঁষা বস্তির ঘরে মাটিতে শোয়া মুন্নির গুলিয়ে যায়। হতে পারে এসব কিছুই ঘটেনি, সবই তার কল্পনা। এতোদিন পর মুখগুলোও তো আর মনে পড়ে না, শরীরের ক্ষত অনেকটাই সেরে উঠেছে, শুধু মনের মধ্যে টুপ্ টাপ রক্ত পড়ছেই। বাংলা দিদির মুখে স্কুলে শোনা সেই কহানিটার মতো, বাঘের বাচ্চার মাথা কেটে জ্বলন্ত উনুনে বসানো তাওয়ার ওপর ঝুলিয়ে রেখে মানুষ বৌ বাঘ-স্বামীকে তেলের ওপর রক্তের ফোঁটা পড়ার চড়বড়ানি  শোনায়, আর বলে, ঐ তো পিঠে ভাজা হচ্ছে।

জানওয়ার ভি কতই এইসা বেরহম  নেহি হোতা। তার কুত্তা মেরিগোল্ড, মিশনারী স্কুলের নান-দিদির দেওয়া নাম, অসুস্থ মুন্নির দোরগোড়ায় বসেই থাকে দিনের বেশি সময়। করুণ চোখে তাকে দেখে, কখনও এসে খরখরে জিভ দিয়ে মুখ চেটে দেয়।  গাঁট্টাগোট্টা অচেনা মুখ ধারেকাছে দেখলেই আকাশের দিকে মুখ তুলে লম্বা ভৌউউউউ হেঁকে ছুটে যায়। যেন সে জেনে ফেলেছে ঐরকমই কেউ, সব নষ্টের গোড়া।

 কেসটা এগিয়ে গেলেই বাপ মা তাকে বিহারের সাসারামে পাঠিয়ে দেবে ঠিক করে ফেলেছে। দেশ গাঁওয়ে বুজর্গদের চোখের সামনে মেয়ে হয়ত বেশি নিরাপদ থাকবে। মুন্নি শুয়ে শুয়ে কাঁদে, তার শিবমন্দির, শিবজীর কাঁসা পেতলের বাসন, টিশন মাস্টারজীর ফাইলে ভরা ঘর, তার মেরিগোল্ড, সহেলি গুড়িয়ারানির চুলে খেজুর পাতার বিনুনি, সব মন্ড পাকিয়ে নাভি থেকে উঠে আসা একটা গলার স্বরের রূপ ধরে নেয়। গাট্টাগোট্টা শরীর মনে পড়ে, অথচ মুখ সব হাপিস। যেন কন্ধকাটার দল। কতক্ষণই বা দেখেছে সে, তাও তখন মাথার ঠিক ছিল নাকি! 

শুকিয়ে আসা কান্নার দাগ চোখের কোলে নিয়ে ছাড়া ছাড়া ঘুমের ভেতর মুন্নি শোনে পেছনের টইটম্বুর ডোবায় ব্যাঙ ডাকছে। সবার গলা ছাপিয়ে যেটা, সেটা সবার চাইতে বেশি প্রেমিক পুরুষ-ব্যাঙ। গুড়িয়ারানি তাকে বলতে বলতে হেসে গড়াগড়ি খেয়েছে, নাকি ব্যাঙের গা গরম হলে ঐভাবে ডাকতে থাকে। ঠান্ডা জলের নীচে থাকলে ভি গা গরম হয়, তাজ্জব কী বাত ! তার পেটে খোঁচা মারে  গুড়িয়া, বুদ্ধু কাঁহিকা, গা সবারই গরম হয়। তোর মেরিগোল্ডের ভি। দেখিস না মাঝে মাঝেই উবে যায় দিন কতকের জন্য।

সে যাই হোক, ব্যাঙের শীতঘুম ভেঙেই গরম লাগতে থাকে। ডোবার ভেতর এধার লাফায়, ফির ওধার, তারপর টিশন মাস্টারজীর বেটির মতো গলা সাধতে বসে। সে কী গলা সাধার চোট!  ঘুম ভেঙে অন্য ব্যাঙ বাবাজীরাও গলা মেলায়। মাঝে মাঝে মনে হয় এক পাল হাঁস প্যাঁকোর প্যাঁকোর করে পরিত্রাহি চিল্লাচ্ছে। লোকের নিন্দ চটকে যায়।

এইবার ঘুম ভাঙে মেয়ে ব্যাঙের। সে বিশাল মুখের বাইরে লম্বা জিভ বার করে হাই তোলে। চার ঠ্যাং নাড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙে। কলমী শাকের আড়ালে তখন মৃদু শব্দ হয়, ছপাত। মূহুর্তের জন্য কোরাস থেমে যায়। তারপর আবার দ্বিগুণ উৎসাহে শুরু হয়। মেয়ে ব্যাঙ কান খাড়া করে শোনে সেই কোরাসের মধ্যে কোন গলাটা সবচেয়ে জোরালো, ভারী, ভালবাসায় মাখামাখি, জলের ওপর ছোট ছোট লাফ দিয়ে সে পৌঁছে যায় তার কাছেই। সামনের দুই হাতে পিঠের ওপর দিয়ে তার গলা পরম আদরে জড়িয়ে ধরে গায়ক, শরীরে শরীর মিশলে দুই শরীর থেকে জলের ওপরেই ক্ষরিত হয় জীবনের বীজ। ছোট ছোট ঢেউয়ে দূরে চলে যায় নিষিক্ত প্রাণগুলি, কলমী ডাঁটায় বা কচুরিপানার কিনারায় লেগে থাকে, যতদিন না সেগুলো পরিবর্তিত হচ্ছে কুচি কুচি ব্যাঙাচিতে।

এই জন্য যত ডাকাডাকি শোনা যায় সব পুরুষ ব্যাঙের, মেয়ে ব্যাঙ ডাকলে নাকি সর্বনাশ। গুড়িয়ারানির দাদি বলেছে মেয়ে ব্যাঙের কান্না শোনা গেলে আকাশ ভেঙে মাথায় পড়বেই। দেশে খরা বন্যা আকাল খুন জখম মেয়েদের ইজ্জত নিয়ে টানাটানি, তখন কিছুই বাকি থাকে না। জল থেকে উঠে আসা অভিশাপের মতো সে কান্নাও নাকি খুব অদ্ভুত, যে শোনে সে পাগল হয়য়ে যায়। গুঙিয়ে গুঙিয়ে খুব একটানা কষ্টের কান্না, বেশিক্ষণ কানে গেলে কলিজা টুকরো টুকরো হয়ে যায়।

ভেবেই গায়ে কাঁটা দেয় মুন্নির, সবই তো বোঝা গেল, কিন্তু এখানে তো জবরদস্তির  কোনো কহানি নেই। অন্ধকারে ভুলিয়ে নিয়ে চেপে ধরা নেই, সবই আদর আর আলোয় মাখামাখি। আবার কাঁদতে শুরু করে সে, সেদিন মোবাইলের পেছনে ছোটাই তার কাল হল।

                 (৩)

কেসটা হাতের বাইরে চলে যাচ্ছিল প্রায়। আশেপাশের লোকালিটিতে সবাই খেপে আছে। ঘরের মা বোনকে নিয়ে টানাটানি চলতে থাকলে কতদিন আর মানুষ চুপ থাকবে। আগেও এমন ঘটনা ঘটেছে। দুদিন আগে রেল লাইন ঘন্টা দুয়েক অবরুদ্ধ ছিল। সন্ধ্যায় স্থানীয় বিধায়ক নিজে থানায় এল, “দারোগা, এ ব্যাপারটা দেখেন। মেয়েটা নাকি বলেছে এক শালা রেপিস্ট তাকে ভয় দেখিয়েছে, সে পরমেশ্বরের ভাইয়ের জিগরি দোস্ত, কাউকে কিছু  বললে মেয়েটার ঘরে ঢুকে বাপ মার সামনেই আগুনে পুড়িয়ে দেবে ! দলে আমার নাম খারাপ করতে উঠে পড়ে লেগেছে কিছু লোক। এই কেসটাকে তারা কাজে লাগাচ্ছে।”

পরমেশ্বর ওঝা লোকাল কাউন্সিলর, বিধায়কের ডান হাত। 

ওসি সাহেবের বদলে এই দারোগা সম্বোধন প্রশান্ত রায়কে ক্ষিপ্ত করে তোলে, কিন্তু  প্রত্যেক বারই সে মুখে একটি ভারী মিষ্টি বশংবদ হাসি ঝুলিয়ে রেখে হাত কচলায়। উনিশ শতকের দোর্দণ্ড প্রতাপ জমিদারের মোসাহেবের মতো মনের রাগ মুখে আসতে দেয় না সে। মোলায়েম সুরে বলে, “পরমেশ্বর স্যারের মাসতুতো ভাই জটুর কব্জিতে ডিপ স্ক্র‍্যাচ মিলেছে স্যার। সেদিন পুরনো গোডাউন থেকে তাকে নেশা করে দলবল নিয়ে বেরতেও দেখেছে আমার ইনফর্মার। কিন্তু কেউ কি ওর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে? তবে হি ইজ আন্ডার এরেস্ট। মুশকিল হচ্ছে মেয়েটা কাউকে চিনতে পারেনি। শুধু ঐ কথা বলছে যে তাকে ভয় দেখানোর সময় কাউন্সিলর সাহেবের নাম নেওয়া হয়েছিল।”

বিধায়ক এক মূহুর্ত কিছু ভাবে। পরমেশ্বর খুবই কাজের ছেলে। জটু তো রীতিমতো পড়ালিখা জানা। কাঁচা পয়সার লোভে গুন্ডা বনে গেল। বৌটা কার সঙ্গে যেন প্রেম করত। একদিন প্রেমিক সুদ্ধ ভ্যানিশ হয়ে গেল। লোকে বলে এর পেছনে  জটুর হাত আছে।

থাকতে পারে, বিধায়ক অতো ছোট ব্যাপারে মন দেয় না। যতক্ষণ কাজে লাগছে ততক্ষণ জটু জটায়ুর মতো ডানা মেলে সারা আকাশের দখল ্নিতে পারে। কিন্তু বেশি বাড়লেই কোনো দ্বিধা ছাড়াই তার ডানা কেটে দেওয়া হবে, কুচ। রাজনীতিতে এটাই চিরকাল হয়ে এসেছে, হবেও। তবে এটা ঠিক, বৌ নিখোঁজ হবার পর থেকে  কেমন যেন ভ্যাদা মেরে গেছে ছেলেটা। কথা বলে খুব কম। কাজে থাকে বেশি। আর রাতদিন নেশায় টুপ্টুপ। যেন রসে ভাসা রসগোল্লা।

বিধায়ক দামী কাপের সুগন্ধি চা শেষ করে একটা সিগ্রেট ধরায়, তারপর বলে, “দারোগা, আপনি খোলা মনে কাজ করুন। এই ইন্ডাস্ট্রিয়াল বেল্ট কোনদিকে ঝুঁকে সেটা আপনার চেয়ে ভাল কে জানে ! আমার ওপরেও চাপ আছে। আপনি কোনো কমতি রাখবেন না। পুজোর আগে এই এলাকায় নো ঝুটঝামেলা।” থানার বারান্দায় দাঁড়ানো দুই কনেস্টবলের সেলাম নিতে নিতে বিধায়ক গাড়িতে ওঠে, জানালা দিয়ে প্রশান্তকে আবার বলে, “ঐ কথাই রইল তাহলে।”

প্রথমে ধমক দিয়েই শুরু করেছিল প্রশান্ত রায়। ছেলেগুলোর সঙ্গে তার আশনাই  ছিল কিনা জিজ্ঞাসা করতেই মেয়েটা ফুঁপিয়ে ওঠে। দুদিন চুপ করে থাকবার কারণ হিসেবে ভয় দেখানোর কথা বলে, তারপর লজ্জা অপমান নাকি ভয়ে প্রশান্তের  ঘরেই চোখ উলটে দেয়। হাসপাতালে পুলিশ পাহারা ছিল, তার মধ্যেই কী করে মেয়েদের নিয়ে কাজ করা এক এনজিও ঢুকে পড়ে। কেস দিন দিন কিচাইন হতে শুরু করে। তবে ঐ এক কথা যে মেয়েটা কাউকে চিনতে পারেনি। এ তল্লাটের সব ছোট বড় গুন্ডা বদমাসের ছবি দেখান হয়েছে তাকে, কিন্তু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোনো ভাবান্তর দেখা যায়নি। মনে হয় ঘরোয়া মেয়ে, বেশি বারটপকা নয়। ঐ শিবমন্দির, মোবাইল, স্টেশন মাস্টারের ঘর সাফা করা এইসব নিয়েই থাকত। পাড়াপড়শি সবাই একবাক্যে সার্টিফিকেট দিচ্ছে ভাল মেয়ে। অভাবের তাড়নায় পড়া ছেড়েছে, বাপ মা নাকি বিয়ের চেষ্টা করছিল।

এদিকে দুড়দাড় করে পুজো চলে আসছে। মা আসার আর আঠার দিন / নাচছে সবাই তাধিন ধিন, এই জাতীয় কোনো বিজ্ঞাপন, ফ্লেক্স, কী ফেসবুক পোস্ট চোখে পড়লেও প্রশান্ত দাঁত কিড়মিড় করে উঠছে। তাই যা থাকে কপালে বলে সে করোবরেটিভ এভিডেন্স হিসেবে টি আই প্যারেডের আবেদন করে বসল। অপরাধীকে মুখোমুখি দেখে যদি চিনতে পারে মেয়েটা। কখনও এক ঝলক চাউনি, মাথা ঘোরাবার ভঙ্গি বা শুধু চলার ধরন অপরাধীকে ধরিয়ে দেয় এটা তার পুলিশি জীবনে বার বার দেখেছে প্রশান্ত।

            

 (৪)

এই ঘরটা বাইরে থেকে দেখা ঐ কুষ্ঠরোগীদের ছাউনির মতোই লম্বা আর অন্ধকার। পাশের বাথরুমে নিশ্চয়ই অল্প করে কোনো কল খোলা আছে, টপ টপ করে জলের ফোঁটা পড়ছে। মৃদু কিন্তু মারাত্মক শব্দটা। নিস্তব্ধতা ঘিরে থাকলে স্নায়ুকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। মুন্নি ঢোকার আগের মূহুর্তে ফটাফট আলো জ্বলে উঠল। কত ওয়াটের কে জানে, একফোঁটা অন্ধকার নেই আর, এদিক দিয়ে আলো, উল্টোদিক দিয়েও আলো, কাটাকুটিতে মানুষের নিজের ছায়ারও দফারফা।

 ভেতরে ভুতের মতো লাইন করে দাঁড়ান একই উচ্চতা, একই গড়ন, একই গাত্রবর্ণ, একই বয়সের দশ জন নড়েচড়ে উঠল। প্রায় এক দেখতে দশজনের মধ্যেই আছে সেই অপরাধী, যাকে দেখে চিনে নেবে নির্যাতিতা। হঠাত তাদের গরম লাগতে শুরু করল, রুক্ষ কপালে বিনবিনে ঘাম, জুলফির পাশ দিয়ে ধারা গড়িয়ে পড়ছে। আসলে ভয় পেয়েছে, আলো জ্বলে ওঠা মানেই মেয়েটার আসবার সময় হয়েছে। যার গা ছুঁয়ে সে বলবে এইই তার সঙ্গে খারাপ কাজ করেছে সেদিন, ভুল হোক আর ঠিক, তাকেই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশেরা টেনে হিঁচড়ে লাইন থেকে বার করে নিয়ে যাবে। তারপর সবাই শুনতে পাবে তার মরণ চেঁচানি। কেউ রুল ঢুকিয়ে মোচড় মারছে, কোনো খাকি পোশাক তার খাবলা চুল ছিঁড়ে হাতের মুঠো ভরে নিল। টি আই প্যারেডের পর থানার লকআপে সবই জায়েজ। লোকটার গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে দিলেও সবাই বলবে লজ্জায়  আত্মহত্যা করেছে। তাই এই প্যারেড মানেই বেদম হাতের সুখ। স্পেশাল মারকুটে খাকিরা ফাইবারের লাঠি, কম্বল, নখ ওপড়াবার ছোট বাঁকানো ছুরি নিয়ে  তৈরিই থাকে।

ঘরটার দুদিকে দরজা, একদিকে ঢুকে অন্যদিক দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া যায়। যখন দুপাশে দুজন মহিলা পুলিশ মুন্নিকে ধরে নিয়ে আসে, সে চৈত্রমাসের ঘূর্ণি হাওয়ার মুখে ওড়া বাঁশপাতার মতো কাঁপছিল। বুকের ওপর আঁচলটা ভালো করে টেনে নিয়ে সে ভয়ে ভয়ে তাকায়। এতো আলোয় এতোগুলো অচেনা মরদ তার সামনে দাঁড়িয়ে। হঠাত মুন্নির গলার ভেতরটা শুকিয়ে খটখটে।

এ তো আর ছাদনাতলায় শুভদৃষ্টি হচ্ছে না যে কোনমতে একবার দেখে নিলেই হল।  দেখতে হবে খুঁটিয়ে, যতটা পারা যায় ভালো করে, বিছানায় নিজের পাশে ল্যাংটো মরদকে প্রথম প্রথম যেমন দেখে বৌয়েরা। এইসব তাকে পাখিপড়া করে বুঝিয়ে তবে মুন্নিকে এ ঘরে ঢুকিয়েছে দুই পুলিশ দিদি। সে কথা ভেবেই বোজা চোখ প্রাণপণে খোলা রাখবার চেষ্টা করে মুন্নি, তাকায় প্রথম লোকটার পাক্কা চুল্লুখোরের মতো মুখের দিকে। বুকের ভেতরে ঝড় ওঠে তার, যে মুখগুলো সে ভুলেই গেছে, ভুলে যেতে চেয়েছে প্রাণপণ চেষ্টায়, তাদেরকে সে খুঁজে বার করে কী করে!  দুহাতে আঁকড়ে ধরে ডানদিকের পুলিশ দিদির উর্দি, যেন আর্জি জানায় মুঝে ছোড় দো।

জবাব আসে একটা রাগত ঝটকায়। কানের কাছে মুখ এনে পুলিশদিদি বলে, ইনসাফ মাঁগ রহি থি,হ্যায় না ? মুন্নি আবার তাকায়। একই রকম ঘাড়ে গর্দানে সবকটা, কেউ চোখ পিটপিট করছে, কেউ মুখ নামিয়েই আছে। কারো চোখে মস্ত ভয়, মেয়েটা যদি ভুল করেও খামচে ধরে তার বুকের কাছের জামার অংশটা ! মুখগুলো ছুঁয়ে যেতে যেতে মুন্নি দেখে ওদের মধ্যে একজন শুধু বিন্দাস তাকিয়ে তার দিকেই, একদৃষ্টে, যেন চোখের পাতা পড়ে না। সেই চোখে সোজাসুজি  কিছুক্ষণ তাকালে আপনি দৃষ্টি নুয়ে আসে। কি যে আছে সেই নজরে, অনুশোচনা,অনুতাপ, রাগ, দুঃখ, প্রতিহিংসা নাকি সব মিলেমিশে অন্য কিছু, মুন্নি লোকটার সামনে থেকে নড়তে পারে না। শেকড়-গজানো গাছের মতো স্থির হয়ে থাকে, শুধু ভেতরে ভেতরে দ্বিধা আশঙ্কার ডালপালা প্রচন্ড ঝড়ের মুখে এতো আলোড়িত হতে থাকে যে মুন্নি টাল খেয়ে পড়ে যেতে নেয়, পুলিশদিদিরা না থাকলে লোকটার গায়ে গিয়ে পড়ত। লোকটার যেন তাতে কিছুই যায় আসে না, এমন ভাবে মেয়ে পুলিশের দিকে তাকিয়ে বলে,” হটাও ইস বেওকুফ লড়কি কো।”

পায়ের পাতা থেকে মাথা অব্দি ঝনঝন করে ওঠে মুন্নির। এ তো সেই গলা, মেল  ট্রেনের হুইশলের মতো জোরালো গভীর আর দূরগামী। এই গলা তাকে সাবধান করেছিল, আবার তার ওপর চূড়ান্ত অত্যাচার হচ্ছে দেখেও মদের বোতল ছেড়ে ওঠেনি। আবার তাকে বেওকুফ বলা হচ্ছে, শালে হারামখোর চুতিয়া, ভয়ংকর রাগে মুন্নি লাফিয়ে উঠে কলার চেপে ধরে লোকটার। এই সে, যাকে দশজন একই চেহারার নিরপরাধের সঙ্গে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল, মুন্নি ঠিক লোককে চিনতে পারে কিনা দেখার জন্য। ওর আজনবি গলার স্বরই ওকে ধরিয়ে দিল।

দরজার পাশ থেকে খেটো লাঠি হাতে পুলিশেরা দৌড়ে এল, আলাদা করে টানতে টানতে নিয়ে যেতে থাকল লোকটাকে। অন্য লোকগুলো আনন্দে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরতে লাগল। যেন খুব বাঁচা বেঁচে গেছে। পাশ থেকে পুলিশদিদি বলল, এইবার জটুকে ঠিকমতো জেরা করলেই বেরিয়ে আসবে অন্যগুলোর পরিচয়। হোক সে কাউন্সিলারের ভাই, টি আই প্যারেডে ধরা পড়া কী চাট্টিখানি কথা! 

মুন্নি পাগলের মতো কাঁদতে থাকে তবুও, নিজের গন্দা কাজের সাজা পাবে লোকটা, কিন্তু তার থেকে থেকে মনে পড়ে সেই চেতাবনি, মৎ যা, বিপদ হবে। নিজেকে একটা মেয়ে ব্যাঙের মতো লাগে তার, যে ঘুম ভেঙে দ্যাখে ডোবা ফাঁকা। যে পুরুষটির গভীর ডাকে তার ঘুম ভেঙেছিল সেটা আসলে রক্তখেকো অন্য জলজ জীব। তার প্রেমিক নয়। মেয়ে ব্যাঙ তাই হতাশায় দুঃখে কাঁপতেই থাকে। আর ডাকতেই থাকে। অভিশাপের মতো সেই কান্না ডেকে আনে বন্যা, খরা, বজ্রপাত, অতিমারি।

সবাই ভাবে মুন্নি মেয়েটা টি আই প্যারেডের উত্তেজনায় আর অপরাধীকে ধরিয়ে দেবার আনন্দে অঝোরে কাঁদছে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত