| 29 মার্চ 2024
Categories
চলচ্চিত্র বিনোদন

সদ্য দেখা সিনেমাগুলো । ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য্য

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট
একজন সাহিত্যপ্রেমী মানুষ হিসেবে বই পড়ার পাশাপাশি মুভি দেখতেও আমার দারুণ লাগে। তার একটা বিশেষ কারণ হয়তো এই যে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একটা ভালো মুভি একটা ভালো বইয়েরই ভিসুয়্যাল এক্সটেনশন হয়ে দাঁড়ায়। অনেকদিন থেকেই অবশ্য সাহিত্যভিত্তিক ছবি তৈরির চল অস্তগামী। আবার অনেক সময় একটা ভালো গল্পের চলচ্চিত্রায়ণও সঠিকভাবে হয় না, যার একটা সাম্প্রতিকতম উদাহরণ হল কাকাবাবুর প্রত্যাবর্তন। এত দুর্বল ছবি এরকম একটা দুর্দান্ত গল্পের ক্ষেত্রে আশাই করা যায় না। ক’দিন আগে আবার দেখেছিলাম ওয়েব সিরিজ মার্ডার ইন দ্য হিলস্। Hoichoi এর এই সিরিজের একমাত্র অথেন্টিক পাওনা বোধ হয় দার্জিলিঙের অচেনা সব দৃশ্যনন্দন পাহাড়ি অলি গলি আর সেখানকার পাহাড়ি জীবন। তবে এটা অঞ্জন দত্তের কাছ থেকে তো প্রাপ্যই, তাই আলাদা করে কোনও ক্রেডিট দেওয়ার নেই। এর বাইরে পরে থাকে যে গল্প তার আদ্ধেকটা দার্জিলিঙে সত্যজিতের ফেলুদাকাহিনীর প্রথম গল্প ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি আর আগাথা ক্রিস্টির বিখ্যাত এরক্যুল পোয়ারো উপন্যাস মার্ডার ইন দ্য ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসের হুবহু কপি, অথচ যেখানে এতটুকু ঋণ স্বীকারের দায়বদ্ধতা নেই। এই ক্ষুদ্রতাগুলো সত্যিই মনকে আঘাত দেয় ভীষণভাবে, কারণ আমি দৃঢ় ভাবে মনে করি একটা সৃষ্টি যতখানি স্রষ্টার, ততখানিই তার পাঠক বা দর্শকের। তাই একটা সৃষ্টির সব ধরনের ভাল বা মন্দের সাথে দুজনেরই আবেগ জড়িয়ে থাকে একইরকম ভাবে, তার প্রতি দুজনেরই সমান অধিকার। ভাল বই তাই বারবার পড়তে ইচ্ছে করে। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে ধরা দেয় সে, আর জীবন দেখার দৃষ্টিভঙ্গি দেয় বদলে। একটা ভাল মুভিও সেরকমই, তা সে সাহিত্যধর্মী হোক কি প্রোজেক্টটির ক্রিয়েটিভ টিমের দ্বারা ম্যানুফ্যাকচারড, একবার দেখলে মনে গেঁথে যায় চিরকালের মতো। এক একজনকে এক এক ভাবে ছোঁয় সে, কিছু কিছু মুহূর্ত ভোলা যায় না, ছবি শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও হন্ট করে যায় তা বারে বারে। আর এইরকম বই পড়তে বা ছবি দেখতেই কিন্তু সবচেয়ে ভালোও লাগে। ভাগ্যক্রমে, গত কয়েক সপ্তাহে এরকম তিন তিনটে ছবি দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। এবং আশ্চর্যজনকভাবে, তিনটিই তিন সম্পূর্ণ ভিন্ন ঘরানার, দুই আলাদা মেরুর দুজন মহিলার মানসিক টানাপোড়েন সংক্রান্ত ওয়েব মুভি জলসা, একটা ভীষণ জরুরি ইতিহাসের অধ্যায় নিয়ে তৈরি ডকুমেন্টারি ধারার ছবি The Kashmir Files, আর ফাইন্যালি, The Unapologetically Showbiz মুভি RRR.
জটিল আর ভীষণ ব্যাক্তিগত নানান মানসিক টানাপোড়েন একটি ছবিতে ফুটিয়ে তুলে দর্শককেও ইমোশনালি সেই দ্বন্দ্বে কানেক্ট করিয়ে ফেলার জন্য কিছু খুব শক্তিশালী পারফরম্যান্স লাগে আর সেই জায়গাতেই এই জলসা মুভিতে বিদ্যা বালান এবং শেফালি শাহ্ চূড়ান্ত ভাবে সফল। এত স্লো পিকআপের একটি ছবি, অথচ কখনও যার ছন্দপতন হয় না, এর জন্য কিছু অসাধারণ শিল্পীর দরকার। কিছু কিছু আর্টিস্ট আছেন যাঁদের কাজ আমি ব্যক্তিগত ভাবে দেখতে পছন্দ করি, শুধুমাত্র তাঁদের অভিনয় দক্ষতার কারণে নয়, তাঁদের Choice of Movies এর কারণেও, বিদ্যা এবং শেফালি তাঁদের মধ্যে অন্যতম। বাকিদের কথা আর আলাদা করে বললাম না। কারণ, তাঁরাও নিজ নিজ ক্ষেত্রে একদম যথাযথ। শুধু ছবির নামকরণের বিশেষ কোনও যৌক্তিকতা খুঁজে পেলাম না, এইটুকুই যা খুঁতখুঁতানি বাকি রয়ে গেল এই অসাধারণ কাজটি থেকে।
The Kashmir Files মূলত একটি ডকুমেন্টারি ছবি যাকে কিছুটা সিনেম্যাটিক পালিশ দেওয়া হয়েছে সাধারণ দর্শকের কাছে দৃষ্টিনন্দন হওয়ার জন্য। The Tashkent Files এর আদলেই তৈরি এই ছবির মূল USP এর চাবুকে সত্যবাদিতা। ইতিহাসের যেকোন ঘটনাকেই শুধুমাত্র মানবিকতা আর নৈতিকতার কারণেই নির্মোহ আর দ্ব্যর্থহীন সততার সাথে তুলে ধরা উচিৎ, বাকি বিচার তো পরে, আর এই কাজটা বিবেক অগ্ণিহোত্রী তাঁর এই ছবিতে সত্যিই সফল ভাবে করে দেখাতে পেরেছেন। কাশ্মীরি পণ্ডিতদের তাঁদের মাটি থেকে বিতারন সংক্রান্ত একটা বিতর্কিত এবং প্রায় ভুলে যাওয়া বিষয়কে এত জ্বলন্তভাবে আবার প্রাসঙ্গিক করে তোলার জন্য কোনও ধন্যবাদই যথেষ্ট নয়। এই ধরনের ছবি এখন বারবার তৈরি হওয়া উচিত, কারণ এই ধরনের ছবি দেখার মতো মানসিকতা এখন তৈরি হয়ে গেছে, যেটা আশপাশের রোজকারের নৈতিকতা আর মূল্যবোধের গভীর অবক্ষয়ের মধ্যেও একটা ভীষণ পজিটিভ সাইন।
আর, ফাইন্যালি, RRR!!!
আমি সাউথের মুভি প্রায় দেখতাম না বললেই চলে। মেজাজে মিলতো না আসলে। এমনকি ক’বছর আগে সারা দুনিয়ায় সাড়া ফেলে দেওয়া বাহুবলী মুভিও আমি বহু পরে অনলাইন মাধ্যমে দেখি। আর তারপর, বাকিটা ইতিহাস! আমার কোনও ধারণা নেই ওটা যে সেই প্রথম বারের পরে আরও কতবার দেখেছি এবং আশ্চর্য এই যে প্রতিবারই মুভিটা সেই একইরকম ভাবে ভালো লেগেছে। এই অনুভূতি একমাত্র বহু বছর আগে আমাদের স্কুল টাইমে রিলিজ করা টাইটানিকের ক্ষেত্রেই হয়েছিল। এরপরই আমার সাউথ মুভিজ নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয় এবং কারুর কারুর কাজ সম্বন্ধে কনফিডেন্স আসতে শুরু করে। আর তেমনি একজন এই এস এস রাজামৌলি। লজিক, গল্প বলার মুনসিয়ানা আর সিনেম্যাটিক গ্র্যাঞ্জার সবক’টিকে একসাথে গুলে মনমোহিনী রূপে প্রেজেন্ট করার মাস্টার ফিগার হয়ে উঠেছেন আজ এই রাজামৌলি। এন্টারটেনমেন্ট মানে যে আসলে কি, মুভি ম্যাজিক বলতে ঠিক কি যে বোঝায়, তার প্রকৃত উদযাপন হয় এখন একমাত্র এই একজনের কাজের মাধ্যমেই, যিনি আশ্চর্যজনকভাবে আমার সূক্ষ্ণ বাঙালি রসবোধ আর জমজমাট সাউথ মুভি ম্যানিয়াকে একদম জাদুকরী দক্ষতায় মিশিয়ে দিতে পেরেছেন!
২.
বাংলা নববর্ষ আর বাংলা সিনেমা, বাঙালির কাছে এই দুইয়ের যুগলবন্দির স্থান চিরকালীন। বিগত দুটো বছর আমাদেরকে অনেক দিক দিয়ে প্রায় পঙ্গু করে দিয়েছে, কিন্তু ঠিকঠাক ছবি হলে এই হলে গিয়ে ছবি দেখার স্পিরিটে যে একবিন্দুও চিড় ধরাতে পারেনি, সে প্রমাণ আবারও একবার প্রত্যক্ষভাবে পেলাম গতকাল আমার এবারের নববর্ষ মুভি The একেন দেখতে গিয়ে।
এবারের নববর্ষে যেকোন বাংলা ছবির একমাত্র শক্তিশালী কম্পিটিটর হয়ে দাঁড়িয়েছে দুর্দান্ত কিছু দক্ষিণী ছবি, KGF 2 যার মধ্যে একটা ভীষণ শক্তিশালী নবতম প্রতিপক্ষ, আর পাশাপাশি RRR তো চলছেই। কাজেই এই অবস্থায় ভাষা আর কৃষ্টি নির্বিশেষে যেকোন ভাল ছবির আদর করা বাঙালির কাছে এ যেন প্রায় এক অগ্নিপরীক্ষা! সৌভাগ্যক্রমে RRR আমার আগেই দেখা হয়ে গিয়েছিল আর নববর্ষে বাংলা ছবি ছাড়া অন্য কিছু দেখার কথা এবার চিন্তাও করতে হয়নি, যার এক এবং অদ্বিতীয় কারণ ওটিটি প্ল্যাটফর্মে সাড়া ফেলে দেওয়া সিরিজ একেনবাবুর প্রথম বড় পর্দার ছবির জন্যে। অবশ্য এর আগেই কাকাবাবুর প্রত্যাবর্তনেও তাঁকে দেখেছি, আর সেখানেও তিনি পুরোপুরি সফল, অত্যন্ত দুর্বল ছবি আর কাকাবাবু সন্তুর একঘেয়ে চর্বিত কেমিস্ট্রির উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে যিনি দর্শকের চোখের আর মগজেরও আরাম হবে দাঁড়িয়েছেন গোটা ছবিটা জুড়ে।
The একেন ছবিটি সিরিজের মতোই। অর্থাৎ, এখানেও গল্পের চেয়ে ব্যক্তি অনির্বাণ চক্রবর্তী তথা একেনবাবুর ওপরেই পুরোটা নির্ভর। সিরিজে অভিনয়ের সূত্রে যে আকাশছোঁওয়া উচ্চতায় উনি পৌঁছেছিলেন এখানেও তাঁর কাছে থাকা সেই উচ্চাশার অন্যথা হয়নি। আশ্চর্য হয়ে দেখেছিলাম যে বয়েস নির্বিশেষে এখানে সকলেই একেনবাবুকেই দেখতে এসেছিলেন। উপরি পাওনা বাঙালির বারবার দেখলেও পুরনো না হওয়া দার্জিলিং, আর সেখানেও সেই চিরন্তন গ্লেনারিস্, কেভেন্টারস্, ম্যাল আর ম্যালের কিউরিও শপ। তবে পার্শ্বচরিত্রের নিখুঁত সঙ্গতে একজন কাল্ট অভিনেতার চরিত্রায়ণ যে আদতে আরও বহুগুণে প্রস্ফুটিত হতে পারে তা এই ছবিটি বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগের পরে আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেল। এখানে বাপ্পাদিত্য আর প্রমথের চরিত্রে নতুন অভিনেতা হলেও এই ত্রয়ীর কেমিস্ট্রি এখানেও একটুও টাল খায়নি। আর আছে গতি, গল্পেরও এবং ভয়ঙ্কর সুন্দর পাহাড়ি প্যাঁচালো চড়াই আর ঢাল বেয়ে দুরন্ত গতিতে ছুটে চলা গাড়িরও, যা খুব সাবলীল ভাবে গল্পের সাসপেন্স আর থ্রিলকে দর্শকের ধমনীতে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে, আর তাই গল্প হিসেবে দুর্বলতা থাকলেও ছবি হিসেবে The একেন শেষপর্যন্ত সফলভাবেই উৎরে যায়। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা এই যে, বয়েস ও ব্যক্তিগত পছন্দের বাইরে গিয়ে বাঙালি অ্যাট লাস্ট একজন এমন চরিত্র অভিনেতাকে দেখতে হলে গিয়েছে, যে কোনও দিক দিয়েই না টিপিক্যালি নায়কসুলভ আর দুর্দান্ত অভিনয়ই যাঁর একমাত্র মূলধন। এটা এই নববর্ষে সিনেপ্রেমী যেকোন বাঙালির কাছে সত্যিই একটা ভীষণ গর্বের আর ভীষণ স্বস্তিরও বটে। এমন এক বলিষ্ঠ এবং আনকনভেনশনাল ধারার অভিনেতার উপস্থিতি বর্তমান বাংলা ছবির অনেক ফাঁকা জায়গাকে নিখুঁত দক্ষতায় ভরাট করে দেবে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়, যা সত্যিই আশার, যা সত্যিই গর্বের ।
পরিশেষে, সিরিজ মাধ্যমের বাইরে বেড়িয়ে সব ধরনের দর্শকের ভালোলাগার মতোন করে এইরকম একটি ফ্রেশ গোয়েন্দা ছবি উপহার দেওয়ার জন্যে পরিচালক জয়দীপ মুখার্জিকে আন্তরিক ধন্যবাদ।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত