| 29 নভেম্বর 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প

অসমিয়া অনুবাদ উপন্যাস: অর্থ (পর্ব-২৭) । ধ্রুবজ্যোতি বরা

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

ডক্টর ধ্রুবজ্যোতি বরা পেশায় চিকিৎসক,অসমিয়া সাহিত্যের একজন স্বনামধন্য লেখক ২৭ নভেম্বর ১৯৫৫ সনে শিলংয়ে জন্মগ্রহণ করেন ।শ্রীবরা ছাত্র জীবনে অসম্ভব মেধাবী ছাত্র ছিলেন ।’কালান্তরর গদ্য’ ,’তেজর এন্ধার‘আরু’অর্থ’এই ত্রয়ী উপন্যাসের লেখক হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত। ২০০৯ সনে ‘ কথা রত্নাকর’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য আকাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। বাকি উপন্যাসগুলি ‘ভোক’,’লোহা’,’যাত্রিক আরু অন্যান্য’ ইত্যাদি।ইতিহাস বিষয়ক মূল‍্যবান বই ‘রুশমহাবিপ্লব’দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ’,’ফরাসি বিপ্লব’,’মোয়ামরীয়া বিদ্রোহ’।শ্রীবরার গল্প উপন্যাস হিন্দি, ইংরেজি, বাংলা, মালয়ালাম এবং বড়ো ভাষায় অনূদিত হয়েছে।আকাডেমিক রিসার্চ জার্নাল’যাত্রা’র সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন ।’ কালান্তরর গদ্য’ উপন্যাসের জন্য ২০০১ সনে অসম সাহিত্য সভার ‘ আম্বিকাগিরি রায়চৌধুরি’ পুরস্কার লাভ করেন।শ্রীবরা অসম সাহিত্য সভার প্রাক্তন সভাপতি।


অনুবাদকের কথা

কালান্তর ট্রিলজির তৃতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস হল’অর্থ’। সশস্ত্র হিংসার পটভূমি এবং ফলশ্রুতিতে সমাজ জীবনের দ্রুত অবক্ষয়ের মধ্যে বেঁচে থাকার তাড়না এবং বেঁচে থাকার পথ অন্বেষণেই আলোচ্য উপন্যাসের কাহিনী ভাগ গড়ে তুলেছে। সম্পূর্ণ পৃথক একটি দৃষ্টিকোণ থেকে এখানে অসমের মানুষ কাটিয়ে আসা এক অস্থির সময়ের ছবি আঁকার চেষ্টা করা হয়েছে। মানুষের অন্বেষণ চিরন্তন এবং সেই জন্যই লেখক মানুষ– কেবল মানুষের উপর আস্থা স্থাপন করতে পারে।

এবার উপন্যাসটির বাংলা অনুবাদ নিয়ে এলাম।আশা করি ইরাবতীর পাঠকেরা এই ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত অসাধারণ উপন্যাসটিকে সাদরে বরণ করে নেবে। নমস্কার।

বাসুদেব দাস,কলকাতা।


 

পরের দিনও আমি নাকি প্রায় অচেতন অবস্থায় ছিলাম। ঠিক অচেতন নয় হয়তো অচেতন অবচেতনের মাঝখানের একটি অবস্থা। মাঝে মধ্যে গভীর ঘুমে ডুবে যাচ্ছিলাম ।ভাইটি পরে বলেছিল সেটা নাকি ঘুম ছিলনা, আমি অচেতন হয়ে পড়েছিলাম। মাঝেমধ্যেবিড়বিড় করে কী সব বলছিলাম। ঠিক কী বলছিলাম কেউ বুঝতেপারছিল না। অস্ফুট অসংলগ্ন কথাবার্তা। তেইশদিন এভাবেই পার হয়েছিল। আমার কিন্তু বিশেষ কিছুই মনে নেই। এখন ভাবলে,মনে করার চেষ্টা করলে খুব অস্পষ্টভাবেই একটা সুরঙ্গের ছবি মনের মধ্যে ভেসে উঠে। অন্ধকার একটি সুরঙ্গ—গভীর কালো মুগা রঙের। সুরঙ্গের শেষ দেখাটা আমার মনে পড়ে না কিন্তু সুরঙ্গের ভেতরে যেন নীল বেগুনি রঙের একটা আলো ছিল, বাতাস ছিল আরেকটাশোঁশোঁ শব্দ ছিল। আসলে এই ছবিটা কতটুকু সত্যি দেখা এবং কতটা পরে করে নেওয়া একটি ধারণা সেই বিষয়ে আমি নিজেও খুব স্পষ্ট নই। এরকম একটি ছবি দেখা বলে ভাবলামহয়তো আর দেখতে আরম্ভ করলাম।

জ্ঞান যখন ফিরে এল, যখন প্রায় প্রকৃতিস্থ হলাম তখন নাকি আমি কথা বলিনি। সেই সময়টুকু ছিল আমার কাছে একটা ব্ল্যাংকপিরিয়ড—এক শূন্য অবস্থা। কোনো কথাই আসলে মনে পড়ে না। কিন্তু তখনকার ছবি এখন  দেখা বলে আমার মনে ভেসে উঠে। একটি জঙ্গলের ছবি। জ্যোৎস্না রাতের একটি জঙ্গলের ছবি। জঙ্গলটার গাছগুলি আকাশের দিকে হাত মেলে  দাঁড়িয়ে রয়েছে—ওদের শরীর থেকে অজস্র ডাল বের হয়েছে এবং সমগ্র আকাশ জুড়ে সেই ডাল গুলি একটা জলের সৃষ্টি করেছ। সেই জালের সৃষ্টি করেছে।সেই জালের সিলিঙেরওপর দিয়ে একটা ক্রোধী  চাঁদ খুব দ্রুত এক দিক থেকে অন্য দিকে যাচ্ছে। কিন্তু চাঁদটা যাচ্ছে যদিও তার কিন্তু স্থানের পরিবর্তন হয়নি। আসলে জঙ্গলটাই এক পাশ থেকে অন্য পাশে যাচ্ছে আর চাঁদটা স্থির হয়ে রয়েছে। আর গাছের ডালের জালের মধ্যে দিয়ে গলিত জ্যোৎস্না  মোমের মতো গলে গলে ভেতরে প্রবেশ করছে। গোটা জঙ্গলটা জুড়ে একটা অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে। কী ধরনের শব্দ আমি বলতে পারছি না। বুঝাতে পারছি না।

আমার মনে পড়ে মা ,বাবা ,ভাইটি,অঞ্জুদা—ওরা সবাই মিলে কথা বলছে। দিল্লিতে যাবার কথা বলছে। আমার সামনেই বলছে। আমাকেও দিল্লির কথা কিছু বলছে। কী কথা বলছে আমার মনে নেই, হয়তো মনে ঢুকেইনি,কিন্তু দিল্লিদিল্লি এই শব্দটা আমার মাথার ভেতরে ঘোরপাক খেতে শুরু করেছে। একটা পোকার মতো বোঁবোঁ করে মস্তিষ্কের ভেতর শব্দটা ঘুরছে। চারপাশের মানুষগুলির মুখে ক্রমাগতভাবেদিল্লিদিল্লি শব্দটি শুনে থাকার পরে আমি নাকি একদিন হঠাৎ মৌনব্রত ভঙ্গ করে বলে উঠেছিলাম দিল্লি ভারতের রাজধানী’।

সেটাই আমার মুখ থেকে বের হওয়া প্রথম কথা ছিল।

তারপর আমি নাকি একটা দুটো করে কথা বলছিলাম। নিজের দিক থেকে নয়, কেউ জিজ্ঞেস করলে কখনও কিছু একটা উত্তর দিতাম। বেশিরভাগসময় দিতাম না।

অনেক পরে বুঝতে পেরেছিলামঅঞ্জুদা বাবা এবং গুয়াহাটির ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে একমাস পরে আমাকে দিল্লিতেচিকিৎসার জন্য পাঠিয়েদিয়েছিল। সঙ্গে রমেনকেওপাঠিয়েছিল। ভাইটি এবং অন্য একটি ছেলেও সঙ্গে এসেছিল। রমেন তখনও হাঁটতে পারত না। সে হুইল চেয়ারে বসে এসেছিল। আমরা এসে তিনটি শোবার ঘর থাকা একটি সুদৃশ্য ফ্ল্যাটে উঠেছিলাম। পড়ে জানতে পেরেছিলাম সেটা অঞ্জুদার ফ্ল্যাট। সেখানে আমরা এসেছিলাম। আমাকে নাকি দুদিনেরমতো হাসপাতলে রেখেছিল। সেই কথাগুলি কিন্তু আমার মনে নেই। কেবল দুদিনেরমতো এই ফ্ল্যাটে না থেকে অন্য কোথাও থাকার কথা আমার মনে পড়ে। পরে জানতে পেরেছিলাম সেই জায়গাটা ছিল হাসপাতাল। আসলে সেই সময়ের বহু কথাই আমার একেবারে কিছুই মনে নেই, যেভাবে আমার শৈশবের কথা অনেক কিছুই মনে থাকেনা। পরে অন্যের কাছ থেকে শুনে শুনেআমরা শৈশবের অনেক কথার ছবি মনের মধ্যে নিজেইসাজিয়েনিয়ে স্মৃতির পুনর্জন্ম দান করি। সেভাবে এবারও আসলে আমার বোধ করি সেই সময়টুকুর কিছু কথাই মনে নেই, কিন্তু অন্যের মুখে শোনা কথা, পরে নিজে দেখা কথা এই প্রত্যেকটি একত্রিত করে আমি সেই সময়ের কিছু স্মৃতি মনের মধ্যে নির্মাণ করে নিয়েছি। ধূসর কিছু স্মৃতি।

আসলে আমার স্মৃতিভ্র‌্ংশইহয়েছিল।  

এমনিতেও আমার স্মৃতি নির্বাচিত, সমস্ত কথা মনে থাকেনা বা মনে রাখি না। মগজ কিছু জিনিস ছেকে বের করে দেয়, মুছে দেয়।

আর কথাটা খারাপ নয়। সেই সময়ের কোনো কথাই আমি মনে রাখতে চাই না। সেই স্মৃতি— সেই আবর্জনা।

আমাকে অনেকদিন একজন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ সপ্তাহে তিনদিন এক ঘণ্টা করে কথা বলতেন এবং পাঁচশো টাকা ফীসনিতেন। তিনি আমার কাউন্সেলিং করতেন আর ঔষধ খেতে দিতেন। প্রথমে তো অনেক ঔষধ দিতেন। পরে ধীরে ধীরে কমে এসেছিল। প্রথম ঔষধ গুলি খাবার সময় আমার নিজেকে নেশাগ্রস্ত বলে মনে হত।

ভাইটি সঙ্গে ছিল ।সে পরেদিল্লির একটি হাসপাতালে রেসিডেন্সির কাজে ঢুকেছিল। সে আমার খাওয়া দাওয়া ঔষধ পত্রের তদারক করত। বাথরুমেনিয়েশাওয়ার খুলে স্নান করিয়ে দিত। আমি নাকি তার সামনে ছোটো ছেলের মতোকাপড়চোপড় খুলে উলঙ্গ হয়ে স্নান করতাম।’ হাতে সাবান লাগা, গায়ে সাবান দে মুখে সাবান লাগা ‘, এভাবে বলে বলে সে আমাকে স্নান করাত । অবাধ্য ছোটো ছেলেকে ধমকানোরমতো  আমাকে ধমকে  খাবার খাওয়াত। আমিও নাকি বাধ্য ছেলের মতো তার কথামতোই কাজ করতাম। এক মাসের চেয়েওবেশি এভাবেই চলছিল। তখন সে হাসপাতালের কাজে যোগ দেয় নি।

মা বাবা একবার এসে আমাকে দেখে গিয়েছিল। মা আসার সময় রাজধানী এক্সপ্রেস এ খেতে  দেওয়া ফলের রসের প্যাকেট, টমেটো সসেরপ্যাকেট, জলের বোতল ইত্যাদি বহন করে নিয়ে এসেছিল। ফ্ল্যাটে থাকা কয়েকদিন নানা রকমের রান্না করেছিল। দিল্লির সবজির স্বাদ অন্যরকম,নীরস; মাংস গুলি ভেড়ার মাংস, গন্ধ করে, মা এই ধরনের অনেক আপত্তি করেছিল। মা এক মাসের মতো ছিলেন। বাবা চলে গিয়ে আবার এসেছিলেন। মা বাবা গুয়াহাটিতে ফিরে যাবার সময় রাজধানীতে উঠিয়ে দেবার জন্য আমিও স্টেশনে গিয়েছিলাম। মা সহজাত লজ্জা সংকোচ সমস্ত কিছু একপাশে সরিয়ে রেখে রেল স্টেশনে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলেন। আমার চোখেও জল এসে গিয়েছিল। 

স্মৃতিভ্রংশের পরের কালটুকু আমার  আমার কাছে দ্বিতীয় শৈশব ছিল।

আমি কিছুদিনের জন্য পুনরায় আমার শৈশবে ফিরে গিয়েছিলাম।

কিন্তু আমার এই দ্বিতীয় শৈশবে পাড়ার অলিতে গলিতে মুক্তভাবেদৌড়েবেড়ানোর আনন্দ নীল আকাশে উড়ন্ত রঙ্গিন ঘুড়ি, ড্ৰেনদিয়েবয়ে যাওয়া বৃষ্টির জলের স্রোতে ভাসিয়ে  দেওয়া কাগজের নৌকা ছিল না।

মেঘে গাভীনি আকাশের অনিশ্চয়তাহয়তো ছিল। রমেনও সেই সময় সঙ্গে ছিল।

মিলিটারি ডাক্তার অপারেশন করার পরও তার সমস্যা ছিল। হাড়জোড়া লেগেছিল যদিও একটু বাঁকা হয়ে রইল। অনেকদিন পর্যন্ত তাকে ওজন নিতে নিষেধ করা হয়েছিল। এখানে এসে অনেক চেকআপ ইত্যাদি করা হয়েছিল। প্রথমে পুনরায় অপারেশনের কথা উঠেছিল নাকি। কিন্তু পরে পায়ে ওজন দেবার আগেই নানা ধরনের ব্যায়াম করতে দেওয়া হল। ব্যায়ামে কাজ করায়অপারেশনের আর প্রয়োজন হল না। হাত ক্রমে ঠিক হয়ে গেলেওরমেনের গুলি লাগা উরুর ওপরের ত্বকে কোনো অনুভূতি ছিল না। প্রথম দিকে অনেক জায়গায় স্পর্শ করলে ও বুঝতে পারত না। 

‘ অন্য লোকের উরুতে হাত দেওয়ারমতো মনে হয়’, সে বলেছিল।’ নিজের শরীরে যদি হাত রাখিস তাহলে তুই হাতটায় টের পাবি, স্পর্শ করা জায়গাটাও টের পাবে। ডাবলসেনসেশন। এখন নিজের উরুতে হাত দিলে যেহেতু সেখানে কোনো অনুভূতি নেই অন্যের উরুতে হাত দিয়েছি বলে মনে হয়বুঝেছিস। আমাদের চিকিৎসা পর্ব চলার সময় একদিন বিছানায় বসে নিজের উরুতে হাত বোলাতে বোলাতে সে বলেছিল।’ লোম–টোম নেই, একেবারে মেয়েদেরউরুতে হাত দেওয়া বলে মনে হচ্ছে। সেনসেশনটা খারাপ নয়।’

তখন সে হাঁটতে পারে না। পায়ে ওজন দিতে দেয়নি। তখনও আর তারপরেক্ৰাচে ভরদিয়ে হাঁটা অবস্থাতেও সে কিছুটা সময়ের জন্য হলেও আনন্দ ফুর্তি করতে ছাড়েনি। আমাকে আসলে কাউন্সেলরের  চিকিৎসা এবং পরামর্শই বেশি ভালো করেছিল নাকি রমেনের সান্নিধ্য এবং হাসি ঠাট্টা বেশি ভালো করেছিল তার ঠিক নেই।

সে যখন ক্রাচ ছেড়েদিয়েহাঁটতে সক্ষম হল তখন তার মনে হল যে সে তার দামিবিদেশি ক্রাচ জোড়া কোনো দুঃখীভিখারিকে দান করবে। সে নাকি আগে একবার জুম্মা মসজিদের সামনে একজন ভিখারিকেবাড়িতে তৈরি দুটো ভারী ক্রাচ নিয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখেছিল।

সেই ভিখারির খোঁজে আমরা সবাই জুম্মা মসজিদের কাছে গিয়েছিলাম।

‘ সেখানে বোধহয় কত ক্রাচ নিয়ে চলা ভিখারি আছে। আপনার পরিচিত ভিখারিটাকে চিনতে পারবেন কি?’ ভাইটিজিজ্ঞেস করেছিল।

‘ পাব পাব সেই ভিখারিটাকে পাব। ভিখারিবুড়োটিরবড়ো সুন্দর চেহারা।দেখলে মনে হয় যেন অতীতের কোনো বাদশাহ টাদশাহের বংশধর, কালের গতিতে এসে ভিখারিহয়েছে,’রমেনজোর  দিয়ে বলে উঠেছিল।

অনেক ভিখারিকে ভিক্ষা দেওয়ার পরে রমেন সত্যিই সেই নির্দিষ্ট ভিখারিটিকে খুঁজে বের করেছিল। সত্যিই দুটো ভারী কাঠের ক্রাচ, শতচ্ছিন্ন ময়লাকাপড়, উন্নত নাক এবং পাতলা রঙের চোখে তাকে একজন সুন্দর বৃদ্ধ বলে মনে হচ্ছিল।

‘বাবা’, রমেন ডেকেছিল।

মানুষটা আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে ছিল। তারপরে ক্রাচে ভর দিয়ে এসে সালাম করে ভিক্ষার বাটিটা এগিয়েদিয়েছিল।

‘আজ তোমাকে ভিক্ষা দিতে আসিনি বাবা’রমেন বলেছিল। তোমাকে ক্রাচ দুটো দিতে এসেছি।

রমেন ক্রাচ দুটো বের করে দিয়েছিল। বৃদ্ধ লোকটিসংকুচিত হয়ে পড়েছিল। রমেন নিজে এগিয়েগিয়েবুড়োরপুরোনো ক্রাচটা সরিয়ে নতুন জোড়া বৃদ্ধের উচ্চতার সঙ্গে মিলিয়েদিয়েছিল। তাকে সেটা নিয়ে হাঁটতে বাধ্য করেছিল। বুড়ো মানুষের মুখটা আনন্দের দ্যুতিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। থপ থপ করে এদিকে ওদিকে হেঁটে মানুষটাবিদেশি ক্রাচটা পরীক্ষা করে দেখছিল। জুম্মা মসজিদের আশেপাশেরভিখারি এবং পথচারীরা দলবেধে আমাদের ঘিরে ধরে দেখছিল। বৃদ্ধের পকেটে কিছু একটা গুঁজেদিয়েরমেন দ্রুত এসে গাড়িতে উঠেছিল। বৃদ্ধটি আশীর্বাদ দানের মত দুই হাত ওপরে তুলেছিল। দাঁড়িয়ে থাকা অন্য ভিখারি এবং পথচারীরাও আশীর্বাদের ভঙ্গিতে হাত তুলেছিল। বৃদ্ধের চোখে চোখের জল তিরবির করছিল। আমি ফিরে তাকাতে দেখতে পেলাম বৃদ্ধটি অন্য কয়েকজন ভিখারীর সঙ্গে দুই হাতে আশীর্বাদ প্রার্থনা করছে।

ফিরে আসার সময়রমেনপুরোটা রাস্তা চুপ করে ছিল। তার চোখের কোণ বোধ হয় ভিজে উঠেছিল। সে বাইরের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল।

রাতে আমরা ফ্ল্যাটের বড়োবেডরুমটাতেশুয়ে ছিলাম। দুটি বেডেরএকটিতে সে, অন্যটিতে আমি। বিছানা গুলি বড়োসড়ো, প্রায় ডাবলবেডের সমান ছিল। এই রুমেএসি থাকার জন্য গরমের দিনে ভাইটি প্রায়ই এসে আমার সঙ্গে ঘুমোত। একদিন আমি ঘুমিয়ে যাবার সময়ওরা দুটি কথা বলছিল। কিছুক্ষণ পরে জেগে উঠে আমি বুঝতে পারি যে ওরা তখনও কথা বলছে। কিছুক্ষণ কান খাড়া করে শুনলাম সে ভাইটিকেমেয়েদের বিষয়ে জ্ঞান দিচ্ছে। আমি ঘুমের ভান করে পড়েরইলাম। রমেন বলছে,

আগে খুব ভালো ছিল বুঝেছ ভাইটি। ইচ্ছা মতো তুমি ফুর্তি করতে পার। দিল্লির বিভিন্ন জায়গায়, পুরোনো দিল্লিতে সুন্দর সুন্দরব্রথেলগুলি আছে। নাচ ,গান ,সুরা, সেক্স সবকিছুই পাওয়া যায়—কম দাম থেকে বেশিদামি পর্যন্ত, যার যেরকম চাহিদা। আর মেয়েদের ক্ষেত্রেও তুমি চুজ করতে পার। কাশ্মীর,গাড়োয়া্‌ল, নেপাল তিব্বত যা চাই। যে বয়সের চাই।’

‘আপনি গিয়েছেন?’ভাইটিজিজ্ঞেস করেছিলে।

‘কতবার গিয়েছি তার হিসাব নেই। কলেজে পড়ার সময়। তখন এতটাভয়ও ছিল না বুঝেছ। সিফিলিসই মারাত্মক অসুখ। পেনিসিলিননিলেইখালাশ। এখন কিন্তু যেতে ভয় করে। এইডচকিলবিল করছে।’

ভাইটি কিছু একটা বলল আমি বুঝতে পারলাম না।

‘এখনো ভালো ভালো জায়গা আছে। দামটাই কেবল বেশি। দামি কল গার্লের জায়গা। যাবে? আমি তোমাকে নিয়ে যেতে পারি।’

‘যাব,’—বলে ভাইটি উত্তর দিয়েছিল।

‘ঠিক আছে আমি কাল যোগাযোগ করব। কিন্তু দামি হলেও সাবধানের মার নেই। প্রটেকশন ব্যবহার করাই ভালো। কথাটা ভুলো না।’

‘ভুলবো না’, আগ্রহী শিক্ষানবিশ চট করে উত্তর দিয়েছিল।

তারপরেরমেনভাইটির সামনে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের মেয়েদের সরস বর্ণনা দিয়েগিয়েছিল এবং ভাইটিও সেই সমস্ত কথায় রসাল মন্তব্য দিয়েছিল। প্রথমে আমার বিরাট রাগ হয়েছিল যদিও আমি চোখ বুজে কথাগুলি শুনছিলাম। শুনে শুনে রস পাচ্ছিলাম। একটা সময় আমি হঠাৎ আবিষ্কার করেছিলাম যে অনেকদিন মেয়ে এবং যৌনতার কোনো কথাই আমার মনে উদয়হয়নি। এই সমস্ত বিষয় সম্পর্কে আমি যেন নির্বিকার হয়ে পড়েছিলাম। মনের মধ্য থেকে ওই দিকটা যেন হারিয়েগিয়েছিল। এখন এই রাতের বেলা রমেনের অধিক বানানো অর্ধেক সত্যি কথাগুলি শুনতে শুনতে আমার মনে আগের মতো নারী এবং সেক্স কৌতুহল আর আকর্ষণ জেগে উঠেছিল। আমি বোধহয় স্বাভাবিক হওয়ার পথে আর ও এক পা এগিয়েগিয়েছিলাম। সেদিন রাতে আমি অনেকদিন পরে যৌন উত্তেজনা অনুভব করেছিলাম।

পরের দিন কিন্তু ভাইটির সামনে সেই সমস্ত কথা বলার জন্য রমেনকেবকাবকি করেছিলাম।

‘রাখ, রাখ, সে ডাক্তার নয়?’রমেন মুখ ভেঙচে উঠেছিল।’ভাইয়ের জন্যই ছোটো হয়ে আছে বলে কেন ভাবছিস। তার নিজের সেক্সুয়াল অভিজ্ঞতা নেই বলে কেন ভাবছিস? আমাদের থেকে হয়তোবেশিই জানে।’পুরোনো দিন হলে এতদিনে তিনজনের বাবা হয়ে যেত। পুরোনো দিন কেন, এখনও গ্রামের দিকে হয় না নাকি?’

আমি চুপ করে ছিলাম।

‘আসলেই সেক্স জীবনের একটা বড়োএনজয়মেন্ট,’রমেন বলে চলেছিল।’তাই নয় কি। তুই শালা এনজয় করিস নি?’

আমি তখনও চুপ করে ছিলাম।

‘কোন দিন মরে যাব ঠিক নেই। পারলে এবং পেলে সমস্ত এনজয় করে নেওয়া উচিত। আমাকে যে গুলি করেছিল ছেলেটি, সে তো মারা গেছে। মরে ভূত হল। আমি বেঁচে গেলাম; আমি এখনও জীবনের, সেক্সের আনন্দ এবং মাদকতা অনুভব করতে পারব। কিন্তু সেই মরাটা?’

সেই মৃত ছেলেটির কথা আমাকে ভয়ানক ভাবে চমকে দিল। এই প্রথমবারের জন্য রমেন প্রসঙ্গটা উত্থাপন করল।

‘মরাটার জন্য জীবনের আনন্দ এবং সেক্সের আমেজ সমস্ত কিছুই শেষ। সে মরে  ভূত হল,’রমেন কর্কশ ভাবে বলে গেল।’ভূতের পৃথিবীতে সেক্স আছে কিনা কে জানে? ভূত ভূতনীরসেক্স!’

‘তুই যা তা কমেন্ট করবি না,’আমি হঠাৎ কঠোরভাবে তাকে বলে উঠেছিলাম।’মানুষের মৃত্যু নিয়ে অন্তত এত সহজ এবং হালকা কমেন্ট করিস না।’

‘দেখ, মৃত্যু-কে দুই ভাবে দেখা যেতে পারে। তোর ধারণায়, সিরিয়াসলি। এভাবে নিলে মনে কষ্ট পাবি, দুঃখ পাবি, কিন্তু শেষ ফল একই। মৃত্যুই। না হলে আমার মতো হালকা ভাবে, সহজ ভাবে নিতে পারিস। যা বেশি স্বাভাবিক। এভাবে তুই মৃত্যু এবং মৃত্যু ভয় দুটোকেই জয় করতে পারবি। বুঝেছিস।’






 

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত