১.
চলতে শুরু করেছে চুল্লিটা ,
খাচ্ছে সে , গোগ্রাসে খাচ্ছে ।
কাম-প্রেম-ঘৃণা-প্রীতি চল্লিশ মিনিটে
একমুঠো ছাই ।
প্রজ্ঞা ও প্রতিভা বড় বোকা বনে যায় ।
২.
ঘাট থেকে উঠে আবার ঘাটে নামা
নিরবধি ।
কূটতর্ক করে যাই আমরা যে যার মতো ,
মেলে না উত্তর ।
অবশিষ্ট থাকে শুধু প্রগাঢ় বিস্ময় ।
৩.
রোদে-ঝড়ে অনেক চলেছে ,
থামতে হল ।
এ থামাও চলা ? এ কথা জানলে
ভাবনাহীন ।
৪.
জবাব দিয়েছে ডাক্তার । সে যাচ্ছে ।
কেমন ঘোলাটে চোখ । অস্থির অস্থির ।
এখনও ভাবছে কিছু ? বলতে চায় ?
অলৌকিক দৃশ্য কিছু ? অন্ধকার টানেলের মতো ?
আমরা এখানে আছি । তার এত তাড়াহুড়ো কেন ?
৫.
আমরা দেখি নি কেউ তাকে ।
হয়তো মুমূর্ষু দেখে । দেখতে পায় ।
তখন সে অভিভূত । বলার আগেই
সিগন্যাল ক্লিয়ার হয়ে যায় ।
৬.
মৃতদেহ দেখে হাসতে লাগল উলু পাগলি ,
আপনমনে বলল , যাচ্ছিস ? যা , যা ।
কেউ ধমকে উঠল , তাড়া করল কেউ,
হাসির তরঙ্গ কিন্তু ঘুরে ঘুরে দিগন্তে ছড়ালো :
যাচ্ছিস ? যা , যা …..
৭.
শ্বাস উঠছে । গঙ্গাজল দাও মুখে । হরিবোল হরিবোল ।
কেন ? বিশ্বাসের হেতু ? আঃ, সান্ত্বনা , সান্ত্বনা ।
থাকুন বা না থাকুন শ্রীহরি সহায় ।
৮.
মধ্যরাত । অসতর্ক প্রতিপক্ষ । নিদ্রার আবেশ ।
ভাবলেশহীন আঙুল ট্রিগার চাপে । শেয ।
৯.
হার্টব্লক ছিল । চলে গেল ঘুমোতে ঘুমোতে ।
মানুষটি পয়মন্ত । দুশ্চিন্তার দিল না সুযোগ ।
ঘুমের ভেতরে কোন কা্য়াহীন ছায়া
ডেকেছিল কি না তাকে জানাই গেল না ।
১০.
আছে কি মৃত্যু-র কোন রঙ ?
যে দেখে সে বলার আগেই বিমানগতিতে যায়
বিদেশ বিভুঁই ।
১১.
বড়দিনের সন্ধ্যা । পার্কস্ট্রিট । জমজমাট ।
আচমকা বাসের ধাক্কা । একটু চিৎকার ।
পড়ে আছে । রক্তমাখা দেহ । পুলিশের গাড়ি ।
তুলে নিল । স্বাভাবিক । সব স্বাভাবিক ।
১২.
জনগণমননন্দিত মানুষটি শ্মশানে । নিঃসাড় ।
একই শ্মশানে শুয়ে আছে নকুলচন্দ্রের দেহ ।
ক-অক্ষর গোমাংস নকুল নিতান্তই নামগোত্রহীন ।
অথচ একই শ্মশান । দুজনেই সেখানে ‘বডি’ ;
সমপরিমাণ আগুন লাগবে দুজনের ।
চুপচাপ দুজনেই হয়ে যাবে গোত্রহীন ছাই ।
১৩.
টেবিলে হিসেবের খাতা ।
পরিচ্ছন্ন , নিটোল ।
হিসেব মেলে নি কিন্তু শেযে ;
ভাবে নি সে আচমকা চলে আসবে পেয়াদা পাইক ।
১৪.
বুদ্ধি দিয়ে , বিজ্ঞান প্রযুক্তি দিয়ে
ঠেকাবার চেষ্টা করে যাই ,
তথাপি গড়াই ,
গড়াতে গড়াতে সেই মূক তমিস্রায় ,
ক্রমাগত যার দিকে চলেছি গড়িয়ে ।
১৫.
জানালাগুলো হাট করে খোলা ,
হুড়মুড় করে ঢুকছে হাওয়া,
উড়িয়ে নিয়ে যাক টুকরো টুকরো ছবি
ধুলো জমার আগে ,
যে নাই তার জন্যে থেমে নেই কিছু ।
১৬.
তার সঙ্গে আমাদের লুকোচুরি খেলা ।
এ ভাবে পা ফেলে আসে সেই কালবেলা ।
তখনও তেমনি থাকে মোহিনী আড়াল ।
বাজায় নতুন বাঁশি কালের রাখাল ।
১৭.
ছবিগুলো দেখি । ঘটনার ক্রম মনে পড়ে যায় ।
মনে পড়ে মনে পড়ে , আর কিছু নয় ।
তুমি তো কেবলই ছবি ইট কাঠ পাথরের মতো ,
কায়াহীন ছায়া ।
বছর গড়িয়ে গেলে পড়ে থাকে অনাদৃত অ্যালবামের কোণে ।
১৮.
রাত গভীর । বৈতরণীর তীর । নিস্তব্ধ নির্জন ।
অন্ধকারে একাকার । চেতনার মানে নেই কোন ।
অন্ধকার । আশাহীন ভাষাহীন অন্ধকার । হয়তো মরণ ।
১৯.
ফাঁকা মাঠ । একটা দেহ । নিথর । অজ্ঞাতকুলশীল ।
ধীরে ধীরে তাকে টানছে মাটি ।
সে মিশছে মাটির সঙ্গে । হয়ে যাবে মাটি ।
২০.
এপি সেন্টারের কাছে বাড়ি । মা-বাবা বাইরে ।
ফুটফুটে শিশুদুটি ঘুমে অচেতন ।
কলঙ্কিত করে নি পৃথিবী তারা , ছড়ায় নি বিষ ।
ফুটফুটে শিশুদুটি দেবতার মতো ।
দেবতার রুদ্র রোষ ছুঁয়ে গেল তাদের শরীর ।
২১ .
শব্দটব্দ থেমে যায় । নিভে যায় আলো ।
অন্ধকার দুহাত বাড়ালো ।
মুছে যায় দৃশ্যপট । স্মৃতিও লোপাট ।
অর্থহীন প্রাক্তন সে হাট-মাঠ-ঘাট ।
২২.
মৃতদেহ একটা আয়নার মতো ,
যে আয়নায় ফুটে ওঠে নিজের মৃত্যুর ছবি ।
সে ছবি দেখামাত্র পাশ কাটাই ।
যাঃ , দিব্যিতো আছি , আমার কেন …….
ঘন্টা বাজিয়ে যায় মৃতদেহ দারুণ নীরবে ,
ভিতরে কম্পন জাগে , ভয় ভয় ভয় ….
২৩.
সৌরজগতের ঘূর্ণিপাক ,
ফিরে পাক এবং হারাক ।
২৪.
গুছিয়ে টুছিয়ে রাখে । যাবার প্রস্তুতি ।
যাবার সময় হলে বৈরাগ্য উধাও ।
আর্ত কাতরতা মাখে তার কণ্ঠস্বর :
কেন যাব ? কেন যাব ? কেন যেতে হবে ?
২৫.
কুয়াশা যে ! চোখ চলে না । কোথায় যাবো ?
উঁচুতে কি ! অনেক নিচে ! সব যে সমান ।
উঠবে কি রোদ ? স্বচ্ছ হবে ? দেখতে পাবো ?
এতটা কাল যা দেখেছি সে সব আছে ?
২৬.
নিয়মের পৃথিবীতে সব কিছু নিয়মেই চলে ।
ঘড়ির কাঁটার মতো টিক টিক ঠিক ঠিক ।
কে বলেছে ? বাজে কথা । মৃত্যু-কে চেনে না ।
মৃত্যু বড় স্বেচ্ছাচারী । মানে না নিয়ম ।
২৭.
আচমকা এসে যাবে মায়াবী ঘাতক ,
যার কথা ভেবে ভেবে শঙ্কিতভবদুপযানম ।
তমসার রঙ মেখে দাঁড়াবে দুয়ারে ।
শব্দহীন সেই ডাক বড়ই অমোঘ ।
২৮.
সে ছিল রোদের মতো অকপট অসহ্য সুন্দর ।
রোদ কিন্তু আসে যায় বিরামবিহীন ।
সে ছিল বৃষ্টির মতো স্নিগ্ধ শান্ত পেলব সুন্দর ।
বৃষ্টি কিন্তু আসে যায় বিরামবিহীন ।
সে কিন্তু সেই যে গেল এল না তো আর –
পৃথিবীর দুই গতি নিরুদ্দেশে নিয়ে গেছে তাকে ।
২৯.
সিঁদ কাটে । সামগ্রী ছোঁয় না । কি করে সে ?
ঘুমপাড়ানি গান গায় শুধু ।
সে গানের সুরে আছে তীব্র সম্মোহন ,
অবাধ্য স্নায়ুরা হয় ধীরে ধীরে অবশ শিথিল ,
রক্তে জাগে হিম শীতলতা ।
৩০.
যথেচ্ছ রোদ্দুর মাখছি হররোজ ,
কাঠ[পাতা জ্বালিয়ে আগুন ,
শুনেছি শীতের দেশ , শরীর অসাড়
হবার আগেই চাই আগুনের ঘনিষ্ঠ উত্তাপ ।
৩১.
প্রখর এই মধ্যাহ্নে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে
যে উদ্ভিন্নযৌবন,
সে সত্যি পাগল কি না বলবে কোন পাগল ?
৩২.
চিনচিনে ব্যথা বুকের বাঁদিকে । ছড়াচ্ছে ছড়াচ্ছে ।
শরীরে ঘাম । অস্থির অস্থির । সে আসছে ।
জিভের তলায় সরবিটেট । কতক্ষণ ঠেকিয়ে রাখবে
দস্যুশিরোমণি ?
৩৩.
কোন কথাই শোনে না পাগল ।
কবরখানার মাটি খুঁড়ছে দিনরাত ।
বিড় বিড় করে বলছে আপনমনে :
এ মাটির মধ্যে আছে সেই প্রাণকণা ।
৩৪.
এমন নিঃশব্দে কেউ দাঁড়ায় দুয়ারে ?
দাঁড়ায় সম্মুখে চুপচাপ ?
নিয়ে যায় শব্দহীন পথে ?
৩৫..
‘আসছি’ বলে চলে গেল নাচতে নাচতে ,
ফিরেও এল নাচতে নাচতে খাটিয়ায় ,
তখন মুখর ছিল , এখন সে মূক,
অবারিত সূর্যালোক আগেকার মতো ।
৩৬.
লরির ধাক্কায় ছিটকে পড়ল রাজপথে ,
আহা ঘুমোক ঘুমোক ।
পরিশ্রান্ত ছিল বড় , শরীর মনের
বড়ই ধকল গেছে , এই অবসরে
একটু ঘুমোক এই মুখরিত ব্যস্ত রাজপথে ।
৩৭.
মৃত্যু কাছে দাঁড়িয়ে শ্বাস ফেললে
কেমন বোকা বোকা হয়ে যায় মানুষ ;
মৃত্যু হাত বাড়ালে একটু বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়
আছে , আছে , কিছু একটা আছে ।
৩৮.
মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এলো । বৈরাগ্য মাখেনি ।
মৃত্যুকে মৃত্যুর মতো মনেই হয় নি । তাই
অকম্পিত সে এখন অজস্র মজলিশে
অসীম অতৃপ্তি নিয়ে হইহই ঘোরে ।
৩৯.
রক্তের বিকল্প নেই । তবু রক্ত ঝরে
নগরে প্রান্তরে ।
রক্তের বিকলপ নেই । রক্তে হোলিখেলা ।
আসে কালবেলা ।
রক্তহীন শবগুলি রক্ত চায় ।
নীতিকথা বড় অসহায় ।
৪০.
নার্স জানে , কিন্তু আজ যে এসেছে এই বেডে
সে কিছু জানে না ।
কাল ছিল এই বেডে একজন , তরতাজা যুবক ।
চলে যেতে হল তাকে জরুরি তলবে ।
তার খোঁজে কেউ যেন এসেছিল আজ,
সে বলে : কেমন করে কি যে হয়ে গেল,
এই ছিল এই নেই , খেই নেই খেই নেই ।
৪১.
একেবারে রবাহূত । না চাইলেও আসে ।
ছিন্নমূল করে দেয় । অজানা প্রবাসে
অস্বস্তি যে হতে পারে ভাবে না সে কথা ।
বিতর্ক অযথা ,
কারণ সে গোঁয়ার বড় এবং বধির,
শ্রেণি বিভাজন নেই পুরুষ নারীর ।
৪২.
বহুকাল মৃত্যু-র মতো স্তব্ধতায় যাপন করে
মৃত্যুবরণ করলেন সুচিত্রা ।
জীবন ও মৃত্যু-র সীমারেখা মুছে দেওয়া এ যাপন
ব্যতিক্রমী অথবা অদ্ভুত ।
৪৩.
পল্টুদার বডি এল । পল্টুদা কোথায় ?
বডির ভেতরে থাকে যে মানুষ
নিরুদ্দেশে সে কেন হারায় ?
৪৪.
দরজা বন্ধ করতে গিয়ে ফিরে এল । বিভ্রম ।
ফিরে আসে যদি ! ডাক দেয় আগেকার মতো !
ঘটে যা তা সব সত্য নয় , এই কথা ভেবে
দরজার পাশে বসে স্নায়ু টান টান ।
৪৫.
রাস্তার কুকুর মরে পড়ে আছে রাস্তার উপর ।
অত্যন্ত নিস্পৃহভাবে তাকে দেখে চলে যাচ্ছে রাস্তার কুকুর –
ব্যথাহীন , প্রতিক্রিয়াহীন ।
কিভাবে আয়ত্ত করে স্টয়িক দর্শন ?
৪৬.
তিনশো আশি কোটি বছর আগে মূক এই পৃথিবীতে
এসেছিল প্রাণকণা । কত জন্ম মৃত্যুর ভিতর দিয়ে তার
রূপান্তরের লীলা সমানে চলেছে বিশ্বে….যখন নিশ্চিন্ত হব
আমি সেই , আমি সেই , তখন এ মৃত্যুভয়
দূরে চলে যাবে , করণ তখন আমি জরা-মৃত্যুহীন ।
৪৭.
সুহাসকে সুপুরুষ বলা যায় । বিয়ে-থা করেনি ।
চাপা স্বভাবের ছেলে, জানত না কেউ
মনের গভীরে তার কি খেলা চলেছে ।
সুহাসকে জিতেন্দ্রিয় বলা যায় , ধর্মে-কর্মে মতি,
সে সুহাস আত্মঘাতী হল কেন এমন সকালে !
হতবাক আত্মীয়-বান্ধব খোঁজে লৌকিক কারণ ।
৪৮.
দেশের জন্য মরতে পারে অনেকে ,
প্রেমের জন্য মরতে পারে অনেকে ,
মরার জন্য মরতে পারে যারা
তারা কি পাগল কিংবা বুদ্ধিহীন নয় !
৪৯.
ট্রেনে-বাসে যাবে বহুদূর । লটবহর কম নয় বড় ।
প্যাকারকে ডাকা হয় । ঠিকঠাক বাঁধাছাঁদা চাই ।
দুপুর দুটোয় গাড়ি । আসে ছোট হাতি ।
হঠাৎ কি হল তার ! পড়ে গিয়ে চুপ !
সব কিছু ঠিকঠাক , যে যাবে সে নেই ।
চলে গেছে বহুদূর , পাবে না হদিশ ।
৫০.
এ তার উৎকট শখ—সুযোগ পেলেই
নাড়েচাড়ে মৃতদেহ , তন্ন তন্ন খোঁজে
কোনখানে প্রাণ ছিল , কোনখানে ঠিক !
গবেষক