| 27 নভেম্বর 2024
Categories
ধারাবাহিক

ধারাবাহিক: একাকিনী শেষের কথা (পর্ব-১১) । রোহিণী ধর্মপাল

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট
এখনও ভাবতে ভাবতে দ্রৌপদীর গা শিউরে উঠল! তিনি যদি সেই বুনো মেয়েটি হয়ে জঙ্গলেই থাকতেন, দেখিয়ে দিতেন এইসব  কাপুরুষদের। কিন্তু রাজার মেয়ে, রাজার স্ত্রী হওয়ার বড় জ্বালা! ওইরকম মণিমুক্তাখচিত পরিধেয় পরে, ভারী গহনা, মাথায় মুকুট পরে আস্তে আস্তে মনটাও ভারী হয়ে যায়। ছটফটে তীব্র গতির বুনো কালী কবে থেকে যেন ধীরস্থির কৃষ্ণা হয়ে গেলেন। এখন, জীবন যখন ধীরে ধীরে শেষ হয়ে আসছে, বুঝতে পারছেন তিনি, আর কিছুক্ষণ মাত্র, তারপরেই তিনি এই হিমশীতল সাদা পাথরে নিথর পড়ে থাকবেন, একা; তাঁর মনে আকুল ইচ্ছা জাগছে সেই অরণ্যের সবুজকে একটু ছোঁয়ার। কত রকমের সবুজ। নদীর টলটলে জলে নীল আকাশের আনাগোণা। খিদে পেলে জলে মাছ আছে। বনে পশু আছে। গাছে ফল আছে। যোগাড় করো। খাও। পাশে ছোট ভাইয়ের কলকলানি আছে। আর মায়ের গন্ধ আছে। আঃ! কত…….কত যুগ হয়ে গেল, মায়ের ছোঁয়া পান নি। মায়ের কোলের নিশ্চিন্ততা অনুভব করেন নি। না না। ভুল ভাবলে চলবে না। মায়ের মতো পেয়েছিলেন তো আরেকজনকে।  ভীমকে।
 
সত্যিই তো! স্বয়ংবরের দিন অর্জুন অবশ্যই আক্রমণকারী রাজাদের ঠেকিয়েছিলেন। কিন্তু একা তো নন। যোগ্য সঙ্গ দিয়েছিলেন ভীম। তাঁর হাতে তো কোনও অস্ত্র ছিল না! ওখানেই একটি গাছকে তুলে…… । এত কষ্টের মধ্যেও সামান্য হাসির ছোঁয়া লাগল দ্রৌপদীর ঠোঁটের গোড়ায়। পুরুষেরা সত্যিই কাপুরুষ হয়। যত তেজ যত দর্প যত উল্লম্ফন, তত দ্রুত লেজ গোটানো। তিনি দূর থেকে দেখেছিলেন কয়েকবার। দীর্ঘ দেহী ধুতি মালকোঁচা পরা এক যুবককে। গাছ তুলে ছুটছেন। গাছের কাণ্ডটি ধরে শাঁইশাঁই করে ঘোরাচ্ছেন। আর মহামহিম সব রাজারা কাছাখোলা হয়ে দৌড়চ্ছে। তাঁর নিজেরও একবার মনে হয়েছিল মাঠে নেমে পড়েন! তবে পরক্ষণেই আবার মনোনিবেশ করেছিলেন কৃষ্ণকায় স্বাস্থ্যবান যুবকটির দিকে, কিছুক্ষণ আগেই যাঁকে তিনি মালা পরিয়েছিলেন। এই এতদিন পরে, তাঁর মনে হচ্ছে অর্জুন ছাড়া আর একমাত্র ছিলেন ভীম, যিনি দ্রৌপদীর প্রতি নিজের অধিকার ফলাতে পারতেন। কিন্তু তা করেন নি। অপেক্ষায় ছিলেন দ্রৌপদীর বোঝার। কিন্তু তিনি যে অন্ধ ছিলেন। মনের আঁধার। যে মন অর্জুন ছাড়া আর কোথাও আলো দেখতে পেত না।

আরো পড়ুন: একাকিনী শেষের কথা (পর্ব-১০) । রোহিণী ধর্মপাল
 কিন্তু বৃহন্নলা সেই যে রাজকুমারী উত্তরার কক্ষে প্রবেশ করলেন, তার শিক্ষকরূপে, আর কি তাঁর কোনও কিছুই মনে রইল না? অন্তঃপুরে থেকেও কি তখন একটিবারের জন্য খবর পান নি রাণী সুদেষ্ণার মহলে কি চলছে? যদি নাও খবর পেয়ে থাকেন, তাঁরই তো সবথেকে বেশি সুবিধা ও সুযোগ ছিল দ্রৌপদীর সঙ্গে দেখা করার। দুজনেই অন্তঃপুরের। একজন রাণীর মহলের বাসিন্দা। আর একজন রাজকুমারীর মহলের। তিনি দাসী। যতোই রাণী তাঁকে সম্মান দিয়ে, যত্ন করে রাখুন না কেন! রাণীর বাকি দাসীরা, বিশেষ করে খাসদাসীরা এবং সখীরাও, তাঁকে কম ঈর্ষা করতো! হঠাৎ আসা একজন এমনভাবে রাণীর ভালোবাসা পাবে! আর তার এমন রূপ! সাধারণ একটি বস্ত্র, সাধারণ কয়েকটি গয়না পরেই কী বাহার খুলে যেত সেই দাসীটির। নিজেরাই বলাবলি করত বাকিরা। 
“এটা নিশ্চয়ই তন্ত্রমন্ত্র জানা কেউ।”
” কিভাবে রাণীকে বশ করল দেখলি”! 
“হ্যাঁ! হ্যাঁ। আমরা এতদিন ধরে তাঁর কী সেবাটাই না করছি, এক ফুঁয়ে সব উড়ে গেল গা”!
“দ্যাখিস না, কোনদিন না এই হতচ্ছাড়িই রাজার চোখে পড়ে আর রাজার মুণ্ডুখানা চিবিয়ে খাবে! তখন রাণী বুজবেন এখন”!
 
দ্রৌপদী ঘুরছিলেন। বিরাট রাজার প্রাসাদের সামনের রাস্তা ধরে। “আমি সৈরিন্ধ্রী। আমাকে কাজে রাখবেন? খাওয়া আর পরা দিয়ে?” না। মোটেও লজ্জা পান নি তিনি। সত্যিকারের রাজকন্যা আর রাণী হলে হয়ত অপমানে লজ্জায় গুটিয়ে যেতেন। ভয়েও। সবাই যেভাবে তাকাচ্ছিল তাঁর দিকে। পুরুষরা তো বটেই। মেয়েরাও। অথচ তিনি তাঁর বিশাল চুলটি ঢেকে নিয়েছিলেন। একটি কুচকুচে কালো কাপড়ে নিজেকে আবৃত করেছিলেন। তারপরেও তার রূপ আর ব্যক্তিত্ব চলকে চলকে বেরিয়ে আসছিল। তাঁর বেশ মজাই লাগছিল। একেবারেই অন্যরকম অভিজ্ঞতা। যেন জঙ্গলের মধ্যে দিয়েই হাঁটছেন তিনি একা। বড় বড় গৃহগুলি যেন আকাশচুম্বী গাছেরা। আর চকচকে চোখে শ্বাপদেরা তাকিয়ে। তবে ঝাঁপিয়ে পড়ার সাহস নেই। তিনি যেন জ্যামুক্ত একটি তীর। সেইভাবেই হাঁটতে হাঁটতে কখন ঢুকে পড়েছেন রাজ প্রাসাদের অন্দরমহলের দিকের রাস্তায়, খেয়ালও করেননি। হঠাৎই শুনলেন, “ও মেয়ে! ও সৈরিন্ধ্রী! এদিকে এসো। আমাদের রাণীমা তোমাকে দেখতে চান।” চমকে উপরে তাকিয়ে দেখলেন সামনের অলিন্দ থেকে একটি মেয়ে, খুব সেজে আছে, বোধহয় রাণীর খাসদাসী, মুখে পান গোঁজা, একদিকের গালটি ফোলা, সেইভাবেই তাঁকে ডাকছে। 
তিনি এগিয়ে যেতেই আরেকটি মেয়ে এসে দাঁড়াল।
 “এসো মেয়ে। এই পথ ধরে। শোনো, গিয়েই আগে পেণ্ণাম করবে। রাণীমা আমাদের ভারী দয়ালু। তিনি চাইলে তোমার হিল্লে হয়ে যাবে’খন। বুজেচ তো?”
 
তিনি মেয়েটির পেছন পেছন এগোলেন। রাস্তার শেষে মস্ত একটি দরজা। সেই দরজা দিয়ে ঢুকেই প্রথমে একটি বিরাট কক্ষ। সেখানে রঙবেরঙের জামাকাপড় পরে মেয়েরা ঘুরছে ফিরছে, গল্প করছে, কাজ করছে। 
“হাঁ করে কী দেকচো গো? এইরকম শত শত কক্ষ আছে। এই পুরো মহলটি রাণী সুদেষ্ণার। মহারাজা বিরাটের সবচে কাছের রাণী। চলো চলো। পা’টি চালাও তো!”
error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত