ইরাবতী ধারাবাহিক: খোলা দরজা (পর্ব-১৩) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
একেবারে বড় হবার পর যখন শহরের বা বাইরের বড় স্টেজের অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করেছি ,তখনও সেই বাড়ির ছাদের অনুষ্ঠানের স্মৃতির ঝলক হঠাৎ করে মনের মধ্যে ভেসে উঠেছে।
আর মনে হয়েছে আমাদের ছোটবেলাটি ভারী মহৎ ছিল।কিছু পাওয়া,কিছু না পাওয়ার সঙ্গে বরাবর মিলেমিশে বসবাস করেছে। কোনওদিন বিন্দুমাত্র আপত্তি তোলেনি।
এসময়ে পয়লা বৈশাখকে কেমন একলা বৈশাখ মনে হয়। সেই ভরভরন্ত বাড়ির ধারণাও উধাও।বড় পরিবারের সেই বিশাল জালার ঠান্ডা কর্পূর মেশানো জল, হাতপাখার পরিশ্রমী বাতাস,কানাউঁচু কাঁসার বগিথালার বড় বড় তরমুজ আর গুড় বা চিনি মাখানো ফুটির আহ্লাদ ,মনে পড়ে বেদনা জাগায়।
এখনকার ব্যস্ত ছেলেমেয়েদের কাছে সেই ঘন রঙের ওপর ফুটকি দেওয়া ,কাঠের বাঁট দেওয়া ছাতা গুলোর কী কোন মূল্য আছে? যেগুলো চড়কের মেলায় খুব কমপয়সায় কিনে আমরা জড়ো করতাম বাড়িতে।অথবা কাঁচের বাক্সে সাজানো সেই কাঁচের চুড়ি আর আংটির জন্য আমাদের মত তারা কী পয়সা জমায় এখনও?
বাড়ির বড়রা সবাই রথে,চরকে, আমাদের মেলায় খরচ করার জন্য পয়সা দিতেন। সেই আটআনা,একটাকা জড়ো করে আমরা মেলায় যেতাম।বাদামভাজা থেকে শুরু করে কাঁচের চুড়ি, আংটি, ছাতা, পুতুল, কুলপী বা আইসক্রিম সবই কেনা হত ওই পয়সায়।বড়রা সঙ্গে থেকে পয়সার ঘাটতি মিটিয়ে দিলেও মনের সাধ পুরো মিটত কই।অফুরন্ত ইচ্ছার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সব সাধ পূরণ করার মত সামর্থ্য আমাদের কোনদিনই ছিল না তো।
আরো পড়ুন: ইরাবতী ধারাবাহিক: খোলা দরজা (পর্ব-১২) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
চড়কের মেলা-য় কেনা ওই ছাতাগুলো ছিল শুধুই বাহারি, কোন কাজে লাগত না।ঠিক সেরকম অনেক জিনিস আমরা সংগ্রহ করতাম মেলায় গিয়ে,যার কোন কেজো ব্যবহার ছিল না।তবু ওই অকেজোর সন্ধানে আমাদের আনন্দ উপচে উঠত।
এখন আর পয়লা বৈশাখের দিন দোকানে দোকানে তেমন ভিড় হয়না।কোন কোন গয়নার দোকান অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে ফুলমালা দিয়ে গেট বানায়।মিষ্টির বাক্স, ক্যালেণ্ডার হাতে তুলে দেয়।কোল্ড ড্রিংকস্ বা আইসক্রিম পরিবেশন করে।তবে তার মধ্যে সেই সার্বজনীন ভাব নেই।বৈশাখ মাসের প্রথম দিনে সবাই মিলে আনন্দ করতে হবে, এমন কোন কথা রাস্তাঘাটের নিঝুম হাবভা্ব দেখেও মনে হয়না।
তখন আর একটা ব্যাপার ছিল।বিশেষ বিশেষ দিনে বাড়িতেও মিষ্টি আনানো হত। ভাল ভাল খাবার তৈরি করা হত।পয়লা বৈশাখে তার ব্যতিক্রম হত না।নতুন কাপড়জামা পরে বাড়ির গুরুজনদের প্রণাম করে তার ভাগ পেতাম আমরা। ব্যবসায়ী পরিবারে লক্ষ্মী গণেশের পুজো হত পয়লা বৈশাখে,কখনও আবার মন্দিরে নিয়ে গিয়ে তাদের পুজো করিয়ে আনা হত।
এখনও মন্দিরে পুজোর ভিড় হয়।মা লক্ষ্মী আর গণেশের পুজোও অব্যাহত।কিন্তু ছেলেমেয়েদের আনন্দ করে চড়কের মেলায় ঘুরতে যাওয়া, কিংবা পয়লা বৈশাখের সন্ধ্যায় আনন্দ করতে যাওয়ার মত নিশ্চিন্ত অবকাশের সবটাই নির্ভর করে পরীক্ষার নির্ধারিত বিশেষ দিনের ওপর ।পরীক্ষার মধ্যে বা আগে বিশেষ দিনের বিশেষ গুরুত্ব এখনকার ছেলেমেয়েরা বা তাদের গার্জেনরা দেন না।
মেলা প্রসঙ্গে ভুলে যাচ্ছিলাম বেলুন আর বাঁশির কথা বলতে।ওইসব মেলা-য় বেলুন ওয়ালাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকত।লম্বা লাঠিতে নানা বর্ণের আর আকৃতির বেলুন ঝুলছে,আর সেসব বেলুন কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একজন মানুষ।আমার মনে হত তার মত ভাগ্যবান মানুষ এই পৃথিবীতে দুটি নেই।
রঙ বেরঙের বিশাল, মাঝারি, ছোট,লম্বা,চ্যাপ্টা বেলুন আকাশের দিকে ডানা মেলে উড়ছে আর সে তাদের সামলাতে সামলাতে বেলুন বিক্রি করছে।নানা বয়সের বাচ্চা ,বুড়ো,মাঝবয়সীরা তার চারপাশে ভিড় করে বেলুন কিনছে, আর সে খুব নিস্পৃহ ভঙ্গিতে তাদের হাতে রঙচঙে ঝকমকে বেলুনগুলো একটুও মায়া না করে এক এক করে তুলে দিচ্ছে।
আমি বাড়ি ফিরেই ভাবতাম এজন্মে নাহলেও পরের জন্মে বেলুনওলা হব,আর বেলুনভরা লাঠি হাতে নিয়ে পথেঘাটে,মেলায় ময়দানে, ঘুরে বেড়াব।
মেলা-য় নানা রকমের বাঁশির সুর আমাদের উদ্ভ্রান্ত করে দিত।তারপর বাঁশি কিনে বিচিত্র সেসব চ্যাঁ ভ্যাঁ আওয়াজ আমরাও রপ্ত করতাম। বাড়িতে ফিরে সেসব বাজালে বড়রা তিতিবিরক্ত হতেন।আর বলাবাহুল্য সেসব বাঁশি বাজেয়াপ্ত হত।
তখনকার দিনের সেসব আমোদ আর তেমন করে নজরে পড়েনা। এখনও তা নিজের মত করে আছে নিশ্চয়ই।হয়ত তার রূপ রঙ বদলেছে তাই চিনতে পারিনা।

ঐতিহ্যময় শহর চন্দননগরের স্থায়ী বাসিন্দা সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায় বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির স্নাতক।১৯৯৬ সালে প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়’দিবারাত্রির কাব্য’ পত্রিকায়।২০০১ সালে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়।‘আনন্দবাজার’, ‘বর্তমান’, ‘আজকাল’, ‘প্রতিদিন’, ‘তথ্যকেন্দ্র’, ‘উত্তরবঙ্গ সংবাদ’ ছাড়াও, ‘অনুষ্টুপ’, ‘কুঠার’, ‘এবং মুশায়ারা’-র মতো বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনেও তার কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ প্রকাশের ধারা অব্যাহত। প্রকাশিত উপন্যাস পাঁচটি, গল্পগ্রন্থ চারটি, এবং কবিতার বই একটি।