ইতিহাস: মোঘলযুগে বাঙালীর বাণিজ্য । রানা চক্রবর্তী
ষোড়শ শতাব্দীর বঙ্গদেশে আগত ইংরেজ ব্যবসায়ী ‘রালফ ফীচ’ লিখেছিলেন, “উর্বরা বাংলার অপর্যাপ্ত ও সুলভ পণ্যের আকর্ষণে আরব, পারস্য এবং আবিসিনিয়ার বাণিজ্যতরী দূর সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ পাড়ি দিয়ে সেদিন ‘বেঙ্গলা’ বন্দরে আসত।” ষোড়শ শতাব্দীর বাংলাকে এক নতুন বাংলা বলা যেতে পারে। বিদ্যা-চর্চায়, জ্ঞানের অনুশীলনে, সাহিত্যে, সংস্কৃতিতে বঙ্গদেশে তখন যেন এক নবযুগের সূচনা হয়েছিল। সেই সময়ে ‘বিজয় গুপ্ত’ তাঁর ‘মনসামঙ্গল’ লিখছিলেন, ‘মালাধর বসু’ মহাভারত সম্পাদনা করছিলেন, ‘মুকুন্দ দাস’ চিকিৎসাবিদ্যা নিয়ে গবেষণা করছিলেন, ‘শ্রীরূপ’ তাঁর ‘বিদগ্ধমাধব’ গ্রন্থটি লিখতে ব্যস্ত ছিলেন, আর ‘সনাতন’ লিখছিলেন ‘হরিভক্তিবিলাস’। সুলতানী শাসনের দীর্ঘ অবক্ষয় ও দুঃখ-দুর্যোগের অন্ধকারের পরে মোঘল সম্রাট আকবরের উদারনীতি এবং সুশাসনের ফলে শেষপর্যন্ত বাংলার মানুষ যেন প্রসন্ন আলোর সামনে এসে দাঁড়াতে পেরেছিল। ওই সময়ে বঙ্গদেশ জুড়ে পুনর্জাগরণের আরও কারণ ছিল, তখন দুঃসাহসী বিদেশী ব্যবসায়ীরা সাগর পাড়ি দিয়ে দলে দলে বাংলায় আসছিলেন। তাঁরা নিজেদের সঙ্গে নতুন চিন্তা, নতুন ভাবধারা বহন করে আনছিলেন। বাংলার গঞ্জে গঞ্জে তাঁরা কুঠি, দুর্গ, আর গীর্জা গড়ছিলেন। দেশের মানুষের সঙ্গে তাঁদের ভাবের আদান-প্রদান হচ্ছিল। তাই উক্ত শতাব্দীর পর্যালোচনা করতে গিয়ে ইতিহাস গবেষক ‘ডঃ জে. এন. দাশগুপ্ত’ লিখেছিলেন, “Enthusiasts travelled from place to place, mind was brought into mind, there was a brisk circulation of fertilising ideas … the contact with the merchant adventurers, the liberal tolerant policy of a wise ruler, – all contributed to produce 16th Century in Bengal.” কিন্তু ষোড়শ শতকের বাদশাহী বাংলায় যেমন নবযুগ এসেছিল, বাঙালীর জীবনে যেমন আত্মিক ও আধ্যাত্মিক সমৃদ্ধির জোয়ার এসেছিল, ঠিক তেমনি সেই প্রদীপের উজ্জ্বল আলোর নীচে অন্ধকারও কিন্তু জমে উঠেছিল। ইতিহাস বলে যে, এটাই হয় – এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। যেখানে আলো থাকবে, সেখানে অন্ধকারও থাকবে। মানসিক উন্নতির বিপুল বন্যা বস্তুব জগতে, অর্থাৎ ‘মেটিরিয়েলি’ মানুষকে দুর্বল ও কর্মবিমুখ করে তোলে। তাই ওই সময় থেকেই বাংলার স্বদেশী সমুদ্রবাণিজ্যের ক্রমবিলুপ্তি, এবং বিদেশী বণিকদের ব্যবসায়িক সমৃদ্ধি শুরু হয়েছিল। ইউরোপীয় বণিকদের মধ্যে পর্তুগীজরা সর্বপ্রথম বঙ্গদেশে পদার্পন করেছিলেন। তারপরে এসেছিলেন ওলন্দাজরা, আর তাঁদের পরে একে একে এসেছিলেন ইংরেজ, দিনেমার এবং ফরাসীরা। কিন্তু কেন সেই সুদূর ইউরোপ থেকে তাঁরা উত্তাল সাগর পাড়ি দিয়ে বাংলায় তথা ভারতে এসেছিলেন, সেটা জানতে হলে তদানীন্তনকালের ইউরোপীয় পটভূমি পর্যালোচনা করবার দরকার রয়েছে।
ষোড়শ শতাব্দী ইউরোপেও একটা নতুন ভাবধারার বন্যা বইয়ে দিয়েছিল। ইউরোপীয় ঐতিহাসিক ‘H. G. Koenigsberger’ বলেছিলেন, “Traditional and established ways of men’s thought about themselves and their culture giving way to new and different concepts.” অর্থাৎ ষোড়শ শতাব্দীর ইউরোপের অধিবাসীদের প্রচলিত বিশ্বাস, এবং মূল্যবোধ পাল্টে গিয়েছিল; তাঁরা এক নতুন জীবনবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন। সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের ওপরে সব কিছু ছেড়ে নিজে নিরুপায় হয়ে বসে থাকা, পুরোহিতদের কঠিন অনুশাসন, তাঁদের নির্বিচার শোষণ ও উৎপীড়ণ ইত্যাদি শ্বাসরোধী সেই অবক্ষয়ী পরিবেশ থেকে তাঁরা তখন মুক্তির পথ খুঁজছিলেন। ওদিকে প্রচণ্ড মুদ্রা-স্ফীতির চাপ, ক্রমবর্দ্ধমান লোকসংখ্যা, দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় পণ্য মূল্যের উর্দ্ধগতি সেই সময়ের ইউরোপের মানুষকে দূরপ্রাচ্যের সেই সোনার দেশের মাটিতে ভাগ্যান্বেষণে বাধ্য করে তুলেছিল। কিন্তু পর্তুগীজরাই তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে প্রথমে ভারত তথা বঙ্গদেশে পদার্পন করেছিলেন কেন? ১৫৮০ খৃষ্টাব্দে স্পেন ও পর্তুগাল মিলে স্পেনের রাজার অধীনে একটি যুক্ত সরকার গড়ে তুলেছিল। কিন্তু তাতে স্পেনের মানুষের কাছে পর্তুগীজরা কোন মর্যাদা তো পানই নি, বরং একটা পরাধীন জাতির মত ব্যবহার পেয়েছিলেন। দ্বিতীয়তঃ, তখন স্পেনের প্রভাবাধীন আমস্টার্ডাম এবং এনটোয়ার্প পর্তুগীজদের প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের আমদানী রপ্তানীর প্রধান বন্দর ছিল। ওই দুটো বন্দরের মালিকানা নিয়ে হল্যান্ডের সঙ্গে স্পেনের বিরোধ সৃষ্টি হয়েছিল। ফলে ১৫৯৪ খৃষ্টাব্দে ওলন্দাজ এবং পর্তুগীজ – উভয়ের জন্যই ওই বন্দর দুটির ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাই নিজেদের ব্যবসাবাণিজ্য অমন করে প্রতিহত হওয়ার জন্য ওই দুটো ইউরোপীয় জাতি নিজেদের চেষ্টায় দূর প্রাচ্যে বাণিজ্য গড়ে তুলতে বাধ্য হয়েছিল। ১৫৯৪ খৃষ্টাব্দ থেকে সুদীর্ঘ ঊনসত্তর বছর ধরে বাংলার বন্দরে বন্দরে, গঞ্জে গঞ্জে তাঁদের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে রক্তাক্ত সংঘর্ষ চলেছিল, সেই ইতিহাস এখন আর কারো অজানা নয়। পর্তুগীজ বণিকেরা যখন ভারতে পদার্পন করেছিলেন, ভারতের তথা বাংলার বন্দরে বন্দরে মুররা এবং আরবরা চুটিয়ে ব্যবসা করছিলেন। সমকালীন বিদেশী বণিকদের বিবরণে পাওয়া যায় যে – গৌড়ে, সপ্তগ্রামে ও চট্টগ্রামে তাঁরা তখন রাজার মহিমায় বিরাজ করছিলেন। সেই সময়ে, কঙ্কন থেকে মালাবার উপকূল হয়ে একেবারে করোমণ্ডল উপকূল পর্যন্ত, অর্থাৎ আরব সমুদ্র থেকে ভারত মহাসাগর হয়ে বঙ্গোপসাগরের সর্বত্র মুরদের (উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার মুসলমান ব্যবসায়ী) অবাধ গতিবিধি ছিল। উক্ত সময়ে ভারত তথা বাংলার সর্বত্র আরবীয়রা কেন ‘মনোপলি’ করেছিলেন, ঐতিহাসিক ‘ফ্রেডারিক চার্লস ডানভার’ তাঁর লেখায় সেটার কারণ দিয়েছিলেন। তাঁর মতে, ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হজরত মহম্মদের মৃত্যুর পরে আরবের অধিবাসীরা বিশ্বজুড়ে ইসলাম ধর্মের প্রচার করতে শুরু করেছিলেন; একই সাথে তাঁদের রাজ্যবিস্তারও শুরু হয়েছিল। ক্রমে তাঁরা পারস্য, মিশরকে হারিয়ে গ্রীসকে তখনকার প্রাচ্য পণ্যের আমদানী-রপ্তানীর একমাত্র বন্দর আলেকজেন্দ্রিয়া থেকে উৎখাত করে দিয়েছিলেন। আলেকজেন্দ্রিয়ার ওপরে পূর্ণ আধিপত্য পাওয়ার পরেই, বাঘ যেমন রক্তের স্বাদ পায়, তেমনি আরবীয় বণিকেরা প্রাচ্যের বাণিজ্যের অনাগত আলোকজ্জ্বল ভবিষ্যৎ উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাই সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা – “enter upon the mercantile enterprise as warriors”; অর্থাৎ, যোদ্ধার মতই দৃপ্তভঙ্গীতে দূর প্রাচ্যে ব্যবসার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ন হয়েছিলেন। সেই বিষয়ে ‘খলিফা ওমর’ তখন আরবীয় বণিকদের প্রত্যক্ষ উৎসাহ দিয়েছিলেন। তিনি টাইগ্রীস ও ইউফ্রেটিশ নদী, এবং পারস্যপোসাগরের সংযোস্থলে ‘সাট-এল-আরব’ নদীর পাড়ে ‘বসোরা’ নামের সুদৃশ্য একটি বন্দর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বাংলার বন্দর সপ্তগ্রাম থেকে তাঁরা মসলিন, রেশম, জটামাংসী, আদা; এবং সিংহল থেকে দারুচিনি নিয়ে যেতেন। এছাড়া দাক্ষিণাত্য ও মালাবার উপকূলের বিভিন্ন বন্দর থেকে তাঁরা জাহাজ বোঝাই করে বহু বিচিত্র পণ্য বসোরায় এবং আলেকজেন্দ্রিয়ায় নিয়ে যেতেন। সেখান থেকে সেই সব পণ্য তাঁরা চড়া দামে ইউরোপে বিক্রি করতেন। আরবদের মাধ্যমেই ইউরোপের মানুষ প্রাচ্যের বহু জিনিসের সাথে পরিচিত হয়েছিলেন। যেমন মধ্যযুগের ইউরোপের অধিবাসীরা একদিন আরবীয় বণিকদের কাছে উজ্জ্বল রং ও টক-মিষ্টি স্বাদের একটা অদ্ভুত ধরণের ফল দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন। আরবীয়দের জিজ্ঞেস করে তাঁরা জানতে পেরেছিলেন যে, সেই ফলটির নাম ‘অরেঞ্জ’ অর্থাৎ কমলালেবু। আরবীয়রা তাঁদের জানিয়েছিলেন যে, ভারত থেকে সেই বিচিত্র রঙিন ফলটি তাঁরা ইউরোপে আমদানী করেছেন। ইতিহাস বলে যে, খৃষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীর আগে পর্যন্ত রোম ও গ্রীসের মানুষের কাছে কমলালেবু এক অজানা ফল ছিল। গোড়ার দিকে বন্য কমলালেবু খুব টক এবং তিতকুটে স্বাদের হত। চীন সেই বন্য কমলালেবুকে মিষ্টি কমলায় রূপান্তরিত করেছিল। প্রথমদিকে চীন থেকে দক্ষিণ ভারতে এবং সিংহলে সেই মিষ্টি কমলালেবু রপ্তানী করা হত। তখন সেই কমলালেবুকে বলা হত ‘চায়না অরেঞ্জ’। পর্তুগীজরা ষোড়শ শতাব্দীতে সেই মিষ্টি সুস্বাদু চাইনীজ কমলা ইউরোপে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু ‘ভার্থেমা’র মতে চীন নয়, দক্ষিণ ভারতের উপকূলেই তখন মিষ্টি কমলার চাষ করা হত। ইউরোপীয়দের মধ্যে পর্তুগীজরাই প্রথম ভারত থেকে সেই সুস্বাদু ফল ইউরোপে আমদানী করেছিলেন। তবে শুধু কমলালেবু নয়, ‘পেরিপ্লাসে’ বলা হয়েছে যে, প্রথমদিকে আরবীয় বণিকেরাই বঙ্গদেশ থেকে চীনা সিল্ক ইউরোপের বাজারে আমদানী করতেন। সেই সিল্কের প্রায় অদৃশ্য কাপড়ের ওপরে আরব ও সিরিয়ার সূচীশিল্পীরা সূক্ষ্ম এমব্রয়ডারীর কাজ করে দিতেন। সেই এমব্রয়ডারী ও নকশা করা সিল্ক চড়া দামে রোমের বাজারে বিক্রি করা হত। নিজেদের ভৌগোলিক সংস্থানের জন্য আরবই তখন প্রাচ্যের সঙ্গে দূর প্রতীচ্যের সংযোগকারী দেশ ছিল। তাই শুধু পণ্যসামগ্রীই নয়, আরবীয়রাই তখন অনেকক্ষেত্রে ভারতীয় সংস্কৃতি এবং ধ্যান-ধারনাকে ভগীরথের মত বহন করে নিয়ে ইউরোপের মূল ভূখণ্ডে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই কাহিনী এখানে অবান্তর, তাই আলোচনার কোন প্রয়োজন নেই।
মোঘল যুগের শ্রেষ্ঠ নৃপতি আকবর (১৫৪২-১৬০৫) থেকে শুরু করে ঔরঙ্গজেব পর্যন্ত (১৬৫৯-১৭০৭) প্রায় একশো সতেরো বছরের বাংলার বাণিজ্যের গতি প্রকৃতি এই প্রবন্ধের মূল আলোচ্য বিষয়। ইতিহাস বলে যে, আকবরের উদারনীতি, তাঁর সর্বধর্মসমন্বয় ও মানবিকতাবাদের স্নিগ্ধ স্নেহচ্ছায়াতেই কিন্তু বঙ্গদেশে বিদেশী বণিকরা ধীরে ধীরে পুষ্ট হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর আমলেই পর্তুগীজরা হুগলীতে নিজেদের কুঠি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শুধু তাই নয়, আকবর তাঁদের বিনাশুল্কে ব্যবসা করবার অনুমতিও দিয়েছিলেন। কিন্তু ভারতের দণ্ডমুণ্ডের মালিক হঠাৎই সাগরপারের সেই কতিপয় ভাগ্যান্বেষী শ্রেষ্ঠীর প্রতি অতটা উদার কেন হয়ে উঠেছিলেন? সেই কাহিনী মানরিখের বিবরণে ও ক্যাম্পোসের লেখা ইতিহাসে পাওয়া যায়। সাগরপাড়ের দূর দেশের সেই শ্বেতকায় দীর্ঘ সবলদেহী মানুষগুলোর ওপরে আকবরের একটা আকর্ষণ ছিল। হয়তো – ‘distance enchants the eyes’ – দূরের মানুষদের প্রতি ভারতীয়দের আগ্রহ বরাবরই খুব সহজাত; সেই স্বাভাবিক কারণ ছাড়াও তিনি দেখতে পেয়েছিলেন যে, ওই দুঃসাহসী বণিকদের দল মালাক্কা ও বোর্নিও থেকে বহুমূল্য আশ্চর্য সব পণ্য ভারতে রপ্তানী করেন। তাঁর খেয়াল হওয়ায় তিনি বাংলার সুবেদারকে হুকুম দিয়েছিলেন যে, সাতগাঁও (সপ্তগ্রাম) থেকে যে কোন দু’জন নেতৃস্থানীয় পর্তুগীজ বণিককে আগ্রায় তাঁর দরবারে পাঠানো হোক। কিন্তু বাংলার সুবেদারের অবহেলার জন্য বাদশাহের সেই আদেশ সপ্তগ্রামে পাঠাতে দেরী হয়ে গিয়েছিল। বাদশাহের আদেশ নিয়ে বাংলার সুবেদারের অনুচর শেষপর্যন্ত যখন সপ্তগ্রামের নদীর পাড়ে পৌঁছেছিলেন, তখন সেখানে পর্তুগীজদের চালাঘরগুলো খাঁ খাঁ করছিল। কারণ ততদিনে তাঁরা কেউ মালাক্কায়, তো কেউ আবার চীনে চলে গিয়েছিলেন। এখানে উল্লেখ্য যে, আকবরের ছাড়পত্র পাওয়ার আগে সপ্তগ্রামে, এবং হুগলীতে তাঁরা শুধু বর্ষার সময়টা অস্থায়ী চালাঘর বেঁধে বাস করতেন। বর্ষা শেষ হলেই নিজেদের বেচাকেনার পাট চুকিয়ে তাঁরা তাঁদের ভারতীয় হোমে, অর্থাৎ ‘গোয়া’য় ফিরে চলে যেতেন। যাই হোক, ঠিক পরের বছর সপ্তগ্রামের বন্দরে ‘পেড্রে৷ ট্যাভারস’ (Pedro Tavares) নামের এক পর্তুগীজ পদার্পন করেছিলেন; তিনি যেমন ঝুনো রাজনৈতিক তেমনি ডাকসাইটে ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি মোঘল সম্রাটের সেই বাসনার কথা জানতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে আগ্রায় ছুটে গিয়েছিলেন। আকবর তাঁর কথাবার্তায় ও ব্যবহারে খুব সন্তুষ্ট হয়েছিলেন, এবং বেশ কয়েকবার তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। তাঁকে তিনি বহুমূল্য অনেক উপঢৌকনের সঙ্গে ফরমান, বঙ্গদেশে বাণিজ্য করবার ছাড়পত্র দিয়েছিলেন। সেই বাদশাহী ফরমানে পর্তুগীজদের ঢালা হুকুম দেওয়া হয়েছিল যে, হুগলীর যেখানে খুশি তাঁরা স্থায়ীভাবে নিজেদের কুঠি তৈরি করতে পারবেন; এছাড়া আরো বলা হয়েছিল যে, বঙ্গদেশের যেখানে ইচ্ছা তাঁরা নিজেদের গীর্জা গড়ে তুলতে, এবং দেশীয় লোকদের (অনুমতি নিয়ে) ধর্মান্তরিতও করতে পারবেন। আকবর বাংলায় অবস্থানকারী মোঘল কর্মচারীদের পর্তুগীজদের কুঠি, বাড়ী-ঘর, গীর্জা তৈরীর কাজে সাহায্য করতেও নির্দেশ দিয়েছিলেন। এরপরে একদিন পর্তুগীজ জাহাজ থেকে ‘পাদ্রী জুলিয়ান পিয়ারী’(Juliano Pereira) বাংলার মাটিতে পা রেখেছিলেন। শোনা যায় যে, ফাদার জুলিয়ানই নাকি আকবরকে প্রথম খৃষ্টধর্মের প্রতি অনুরাগী করে তুলেছিলেন। ১৫৮০ খৃষ্টাব্দে বঙ্গদেশের মাটিতে যাঁদের সসম্মানে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, ঠিক তার ছিয়াশী বছর পরে (১৬৬৬ খৃষ্টাব্দে) সুবেদার ‘শায়েস্তা খাঁ’ চট্টগ্রাম বন্দর থেকে তাঁদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিলেন। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিল। দীর্ঘ এক শতাব্দী ধরে একটু একটু করে তাঁরা বাংলার জনজীবনের সঙ্গে, রাজনীতির সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন। ‘আকবর-নামা’তেই বলা হয়েছে যে, আকবরের সুবেদার ‘মীর্জা নজৎ খান’ উড়িষ্যার রাজার কাছে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে হুগলীর পর্তুগীজ গভর্ণরের কাছে (১৫৮০ খৃষ্টাব্দে) আশ্রয়প্রার্থী হয়েছিলেন। পর্তুগীজরা বাংলার মাটিতে যেমন ধীরে ধীরে সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠেছিলেন, তেমনি তাঁদের অর্থলোভও ক্রমশঃ বৃদ্ধি পেয়েছিল। মানরিখ তৎকালীন বাংলার উর্বরা মাটির কৃষিজাত পণ্যসামগ্রী দেখেছিলেন। সেই সময়ে বঙ্গদেশে চাল খুব সস্তা ছিল; এবং মাখন, ঘি, দুধ, ছাগল, ভেড়া, মুরগী, আম, জাম ইত্যাদি সুস্বাদু ফল অপর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যেত। ওই সব পণ্য পর্তুগীজরা নামমাত্র মূল্যে কিনে নিয়ে গিয়ে বোর্নিও, মালাক্কা, এবং সুদূর প্রাচ্যের দেশ-দেশান্তরে অসম্ভব চড়া দামে বিক্রি করে প্রচুর লাভ করতেন। সমুদ্রযাত্রায় বিমুখ বাঙালী বণিকেরা সেই সময় থেকেই পাইকারী বিক্রেতা হয়ে গিয়েছিলেন। ফিরিঙ্গিরা তাঁদের যে মূল্য দিতেন, সেটা নিয়েই তাঁরা সন্তুষ্ট থাকতেন। আর সেই সময় থেকেই তাঁরা অসাধু মোঘল কর্মচারীদের অন্যায় অত্যাচার আর অবিচারে জর্জরিত হতেও শুরু করেছিলেন। ওদিকে পর্তুগীজ বণিকদের টাকার অঙ্ক ক্রমশঃ ফুলে ফেঁপে উঠেছিল। তদানীন্তনকালের একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থেকে জানতে পারা যায় যে, তখন ধনাঢ্য পর্তুগীজ বণিকরা যে তেজী ঘোড়ার পিঠে চড়ে বাংলার হাটে বাজারে বন্দরে ঘুরে বেড়াতেন, সেই ঘোড়ার লাগাম বাংলারই সিল্ক দিয়ে তৈরী হত। সেই সিল্কের বল্গার মাঝে মাঝে আবার খাঁটি সোনার চুমকি বসানো থাকত। আর তাঁদের হাতে লাল, নীল, সবুজ রঙের মিনে করা রূপোর পাতের চাবুক থাকত। তাঁদের পরনে থাকত বহুমূল্য পোশাক। তাই এত যুগ পেরিয়ে এসে আজও কল্পনা করলেই চোখের সামনে যে দৃশ্যটা ভেসে ওঠে, সেটা হল – দুধে আলতা মেশানো গায়ের রঙ, দীর্ঘ সবল দেহে বর্ণাঢ্য পোশাকে সজ্জিত হয়ে পর্তুগীজ বণিকেরা বাংলার কৃশকরুণ আর ঘোর কৃষ্ণবর্ণ ব্যবসায়ীদের ভীড়ের ভেতরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
ষোড়শ শতাব্দীর ছ’য়ের দশকের গোড়ার দিকে ভেনিসের ব্যবসায়ী ‘সিজার ফ্রেডারিখ’ বাংলায় এসেছিলেন। তাঁর বিবরণে সেই পর্তুগীজ বণিকদের বিপুল ধনসমৃদ্ধির কারণ, এবং বাংলার আন্তর্জাতিক বন্দর সপ্তগ্রামের তথা দেশীয় বাণিজ্যের এক মনোজ্ঞ আর জীবন্ত আলেখ্য পাওয়া যায়। তিনি লিখেছিলেন, “আমি উড়িষ্যা থেকে বাংলার অভিমুখে রওনা হয়েছিলাম। গঙ্গার পাড়েই সমৃদ্ধশালী বন্দর সপ্তগ্রাম। ব্যবসা-বাণিজ্যের একটি বৃহৎ কেন্দ্র এই সমুদ্রবন্দর বন্দর। পণ্যবাহী বহু বিদেশী জাহাজ এখানে নোঙর করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই বন্দর উড়িষ্যা থেকে একশো সত্তর মাইল দূরে। উপকূল ঘেষে প্রায় চুয়ান্ন মাইল গেলে তবেই গঙ্গানদীর মোহনা পাওয়া যায়। এই মোহনা থেকে পুরো একশো মাইল গেলে তবে বাংলার ‘পিকানো’ (ক্ষুদ্রবন্দর) সপ্তগ্রামকে পাওয়া যায়। এই পথটুকু জোয়ারের সময়ে মাত্র আঠারো ঘণ্টায় পার হওয়া যায়। কিন্তু ভাটার নদীতে জাহাজ সেখানে কোন নিয়ে যাওয়া অসাধ্য। তাই জোয়ার আসা পর্যন্ত তীরে নৌকো বেঁধে অপেক্ষা করতে হয়। এই নৌকোর নাম বজরা। সাতগাঁর আগে গঙ্গার পাড়ে আরেকটি গ্রাম আছে, সেটার নাম বাতোর। বাতোরের উজানে বড় নৌকো নিয়ে আর যাওয়া যায় না। কারণ, সেখানে নদীর জল খুবই কম। তাই প্রত্যেক বছর যতদিন দেশী-বিদেশী ব্যাপারীদের জাহাজ থাকে ততদিন সেখানে অনেক চালাঘর তৈরী হয়ে যায়। রীতিমত একটা বাজার বসে যায়। আবার যেই জাহাজ চলে যায়, অমনি চালাঘরগুলো পুড়িয়ে দিয়ে ব্যবসায়ীরাও যে যাঁর ঘরে ফিরে যায়।” ফ্রেডরিখের এই বিবরণটুকুর ভেতরে তখনকার ধ্বংসোন্মুখ সপ্তগ্রাম বন্দরের একটা পরিষ্কার চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। সেই সময়ে স্বরস্বতী নদী মজে আসছিল, একটু একটু করে সেই নদীর গর্ভ ভরাট হতে শুরু করেছিল। তাই ফ্রেডরিখ দেখেছিলেন যে, ছোট জাহাজ সাতগাঁয় এসে পণ্য বোঝাই করছে। তবুও সেই সেই মৃতপ্রায় বন্দরে তখন অনেক বিদেশী ছোট ছোট জাহাজ আর বণিকদের আনাগোনা ছিল। তখনও প্রায় প্রত্যেক বছর ত্রিশ-পঁয়ত্রিশটি জাহাজে করে চাল, নানা ধরনের কাপড়, লাক্ষা, তেল, চিনি আর বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পণ্য সপ্তগ্রাম থেকে দূর দেশে রপ্তানী করা হত। সেই সপ্তগ্রাম বন্দর সম্বন্ধে ঐতিহাসিক ‘রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়’ জানিয়েছিলেন যে, ভারতে মোঘল সাম্রাজ্যের শুরুর দিক থেকেই সপ্তগ্রাম বন্দরের অবনতির শুরু হয়েছিল। সেই অবনতির কারণ হিসেবে তিনি বলেছিলেন – (১) তখন সরস্বতী নদী ধীরে ধীরে মজে আসছিল; (২) সপ্তগ্রাম থেকে টাঁকশাল উঠে গিয়েছিল; সেখানকার ‘মিন্ট’ থেকে সর্বশেষ যে রৌপ্যমুদ্রা ঐতিহাসিকেরা আবিষ্কার করেছিলেন, সেটা শেরশাহ এবং তাঁর পুত্র ইসলামশাহের রাজত্বের সময়ে ছিল। (৩) বঙ্গদেশে পর্তুগীজ বণিকদের আবির্ভাবও সপ্তগ্রামের পতনের কারণ হয়েছিল। বাংলার জবরদস্ত পাঠান সুলতানদের শাসনকালে সেই বিদেশী ব্যবসায়ীরা বঙ্গদেশে কখনোই মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারেন নি। কিন্তু মোঘলদের সহানুভূতির সুযোগ নিয়ে তাঁরা ব্যবসার নামে বাংলার বন্দরে বন্দরে নিষ্ঠুর দস্যুবৃত্তি করতে শুরু করেছিলেন। তাঁদের সেই উৎপাতের ফলে দেশীয় বণিকেরা সমুদ্র-বাণিজ্য থেকে একেবারে নির্বাসিত হয়ে গিয়েছিলেন।
সিজারের পরে ‘রালফ ফিচ’ নামের এক ইংরেজ ব্যবসায়ীর বিবরণেও সপ্তগ্রামের উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৫৮৫ খৃষ্টাব্দের শরৎকালের শান্ত গঙ্গা বয়ে বিদেশী বণিকদের একশো আশিটি পণ্যতরীর একটি বহর বাংলায় এসেছিল। সেগুলোর মধ্যে একটির আরোহী হয়ে তিনি আগ্রা থেকে সপ্তগ্রামে পৌঁছেছিলেন। বিদেশী বণিকদের ওই প্রত্যেকটি বজরায় লবণ, আফিং, হিং, সীসা ও কার্পেট ছিল। বঙ্গদেশে তিনি প্রথমে টাণ্ডায় পৌঁছেছিলেন। টাণ্ডা তখন তুলোর ব্যবসার মস্ত বড় এক গঞ্জ ছিল। ফিচ তাঁর লেখায় হুগলী বন্দরের কথাও বলেছিলেন। সপ্তগ্রাম বন্দর সম্বন্ধে তিনি বলেছিলেন যে, “Satgaon is a fair city for a city of the Moors and very plentiful of all things”, এবং সেখানে তখন পারসিক, আরবীয় ও অবিসিনিয়ার ব্যবসায়ীরা শুধু বাংলার কার্পাস-জাত কাপড় কেনবার জন্যই ভিড় জমাতেন। এরপরেই সপ্তগ্রামের ওপরে ইতিহাসের অন্ধকারের যবনিকা নেমে এসেছিল। সেই কারণেই, পরবর্তীকালের বিদেশী ভ্রমণকারী বা ব্যবসায়ীদের বিবরণে আর সপ্তগ্রামের নাম দেখতে পাওয়া যায় না।
অতীতের সেই সপ্তগ্রামের বিপুল গৌরবের ইতিবৃত্ত ‘কবিকঙ্কণ-চণ্ডী’, ‘চৈতন্যচরিতামৃত’, মনসার গীত, এবং সমসাময়িককালের বিভিন্ন মঙ্গলকাব্যে আজও খুঁজে পাওয়া যায়। ষোড়শ শতাব্দীতে লিখিত কবিকঙ্কণের একটি শ্লোকের ভেতরেই আভাস পাওয়া যায় যে, তখন বঙ্গদেশের ব্যবসায়ীরা ফিরিঙ্গী জলদস্যুদের ভয়েই হোক কিংবা অন্য যে কোন কারণেই হোক – আর সমুদ্রযাত্রা করতেন না।
“সপ্তগ্রামের বেণে সব কোথা নাহি যায়
ঘরে বসে সুখমোক্ষ নানা ধন পায়।”
সুলতানী যুগেও বাঙালী বণিকেরা সমুদ্রবাণিজ্য করে যে বিপুল অর্থসঞ্চয় করেছিলেন আর ষোড়শ শতাব্দী এবং তারও আগেকার বিখ্যাত বন্দর সপ্তগ্রাম যে সেইসব লক্ষপতি বণিকদের বাসভূমি ছিল, সেটা চৈতন্যচরিতামৃতে পাওয়া যায় –
“হিরণ্য গোবর্ধন নাম দুই সহোদর।
সপ্তগ্রামে বার লক্ষ মুদ্রার ঈশ্বর।”
এখন থেকে প্রায় সাড়ে চারশো বছর আগে বারো লক্ষ টাকার মূল্য যে কত ছিল, সেটা সহজেই অনুমান করে নেওয়া যেতে পারে। বলাবাহুল্য যে, প্রাচীন সাহিত্য এবং কাব্যে অবশ্যই কিছু অতিশয়োক্তি রয়েছে। কিন্তু মধ্যযুগের বাংলার বিপুল ঐশ্বর্যের ঐতিহাসিক ভিত্তিও রয়েছে। ‘তারিখ-ই-ফিরিশতা’ এবং ‘রিয়াজ-উস-সালাতিন’ থেকে জানা যায় যে, মধ্যযুগের গৌড়ে এবং পূর্ববঙ্গে বিত্তশালী বাঙালী গৃহস্থরা সোনার থালায় করে ভাত খেতেন। আলাউদ্দীন হোসেনশাহ গৌড় দখল করবার পরে শুধু এক হাজারেরও বেশি সোনার থালাই পেয়েছিলেন। স্মরণাতীতকাল থেকে বাঙালী বণিকের সার্থক বহির্বাণিজ্যই তৎকালীন বাংলার সেই বিস্ময়কর প্রাচুর্যের মূল ছিল। মধ্যযুগের বাংলা মঙ্গলকাব্যেও বাঙালীর সমুদ্রবাণিজ্যের অভূতপূর্ব তৎপরতার আভাস পাওয়া যায়। প্রায় পঞ্চাশজন কবির রচনায় পুষ্ট বাংলা-সাহিত্যের এই বহুল প্রচারিত ও জনপ্রিয় মঙ্গলকাব্যের ভেতরে ‘নারায়ণ দেব’ প্রাচীনতম মনসামঙ্গলটি লিখেছিলেন। ঐতিহাসিকেরা অনুমান করেন যে, খুব সম্ভবতঃ ত্রয়োদশ শতাব্দীতে সেটি লেখা হয়েছিল। নারায়ণ দেবের মনসামঙ্গলে উল্লেখিত চাঁদ সওদাগরের সমুদ্রগামী পণ্যতরী, এবং সমুদ্রযাত্রার বিশদ বিবরণ এখন আর কোন বাঙালীর কাছেই অজানা নয়। বলা বাহুল্য যে, যেকোন কাল্পনিক কাহিনীর নায়কের জীবনধারার ভেতরে সমসাময়িক সমাজজীবনের একটা ছাপ অবশ্যই পড়ে। তাই সেকালের সুদক্ষ বাঙালী ব্যবসায়ীদের প্রতীক চাঁদ সওদাগরের ইতিবৃত্তের ভেতরে যে ঐতিহাসিক সত্যিটা পরিস্ফুট হয়ে ওঠে, সেটা হল যে – অতীতের বাঙালীরা সত্যিই “বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী” প্রবাদটিতে বিশ্বাস করতেন, এবং নিজেদের সেই বাণিজ্যলব্ধ অর্থ দিয়েই পরবর্তীকালের বাঙালীরা সোনার থালায় ভাত খেতে পেরেছিলেন। আর চাঁদ সওদাগর আদৌ কোন ঐতিহাসিক ব্যক্তি ছিলেন কিনা, সেটা নিয়েও বিস্তর গবেষণা হয়েছে। সপ্তগ্রামের কাছে একটি অঞ্চলের নাম হল চন্দ্রহাটি। এই চন্দ্রহাটি নামটি সেকালের বিখ্যাত বাঙালী বণিক চাঁদ সওদাগরের নামের স্মৃতিকে আজও বহন করে টিকে রয়েছে। প্রচলিত কিংবদন্তী বলে যে, চাঁদ সওদাগর সেখানে একটি হাট বসিয়েছিলেন। বিপ্রদাসের ‘মনসামঙ্গলে’ পাওয়া যায় যে, চাঁদ সওদাগরের বাণিজ্যতরী ‘ত্রিবিণীগঙ্গা’ বেয়ে দূর সমুদ্রে যেত। সপ্তগ্রাম থেকে ত্রিবেণী খুব একটা বেশি দূরে নয়; আর গঙ্গার গতিপথও তখন ত্রিবেণীর কাছে ছিল। তাই বিপ্রদাস বলেছিলেন – ‘ত্রিবিণীগঙ্গা’। এবারে প্রশ্ন হল যে, বাঙালী ব্যবসায়ী চাঁদের নামের সঙ্গে ‘সওদাগর’ শব্দটি কেন যুক্ত হয়েছিল? আসলে ‘সওদাগর’ শব্দটি ফারসী ভাষা থেকে এসেছে। ইবন বতুতা, বারবোজা, ভার্থেমা থেকে শুরু করে রালফ ফীচ পর্যন্ত বিদেশীদের ভ্রমণ-বৃত্তান্ত থেকে জানা যায় যে, মধ্যযুগের সপ্তগ্রামে, সোনারগাঁয়ে (ঢাকা), চট্টগ্রামে ও হুগলীতে – আরব এবং পারসিক বণিকদের অস্তিত্ব ছিল। হয়তো চাঁদের মত একজন বিপুল বিত্তশালী বাঙালী ব্যবসায়ীকে তাঁরাই ‘সওদাগর’ উপাধি দিয়ে সম্মান দেখিয়েছিলেন।
(আগামী পর্বে সমাপ্ত)
(তথ্যসূত্র:
১- Bengal in XVI Century, Dr. J. N. Dasgupta.
২- Europe in XVI Century, H. G. Koenigsberger & G. L. Mosses (Introduction).
৩- Portuguese in India, Vol. I, Danver.
৪- Manrique, Fr. Cardon’s translation, Bengal Past & Present, April-June, 1916.
৫- Portuguese in Bengal, J. Campos.
৬- Pyrad-de-Lavel’s travel, Hakl Edition. Pt. II.
৭- বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা, ১৫তম বর্ষ, ১ম সংখ্যা, ১৩৬১ বঙ্গাব্দ।
৮- Akbar, Vincent Smith.
৯- বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা, ১৩২৭ বঙ্গাব্দ।
১০- Ain-i-Akbari, Abul Fazal, Vol. 2, Edited by Jarret.
১১- Commercial policy of Mughal, Dr. D. Parit.
১২- মধ্যযুগের বাংলা, কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়।)
কনটেন্ট রাইটার, ইতিহাস নিয়ে লিখতে ভালবাসেন।