সকাল আটটা তিরিশ। লড়াই শেষ। পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে ড: বর্মণ বেরিয়ে এলেন আই টি ইউ থেকে। হাসপাতাল চত্বরে এখন তেমন ভিড় নেই। খবরটা প্রচারিত হলে বাড়বে ভিড়। তখন দ্রুত হাতে সম্পন্ন করতে হবে সবকিছু। অবশ্য প্রস্তুতি আছে। গত দু’দিন ধরে অনুমান করা যাচ্ছিল। তদনুযায়ী নেওয়া হয়েছিল প্রস্তুতি। অত্যন্ত সংগোপনে। জানতেন শুধু পরিবারের কয়েকজন, প্রশাসনের কিছু শীর্ষকর্তা, আর হাসপাতালের কয়েকজন ডাক্তার।
মোবাইল বেজে উঠল। বোতাম টিপলেন ডা : বর্মণ। ভেসে এল তাঁর স্ত্রীর কণ্ঠস্বর,কেমন আছেন এখন?
একটু সংযত করলেন নিজেকে, তারপরে বললেন, হেরে গেলাম।
সংবাদ মাধ্যমের কাছে খবর চলে গেছে। তারা এসে পড়ল বলে। তারপর শুরু হয়ে যাবে ব্রেকিং নিউজ।
গতকাল বিকেলের কথা মনে পড়ছে ড: বর্মণের। বিকেল থেকে ম্যাডামের আচ্ছন্নভাব। অবনতির লক্ষণ। মেডিকেল বোর্ডের বৈঠক। শরীরে দ্রুত বাড়ছে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ। লাইফ সাপোর্ট প্রয়োজন। অন্যবারের মতো এতে ঘোর আপত্তি ম্যাডামের।পরিবারের লোকজন আর ডাক্তারদের কাতর অনুরোধে রাজি হলেন অবশেষে। নেবুলাইজেশন আর বাই্প্যাপ শুরু হল। রাত দশটা থেকে অক্সিজেন। ধাপে ধাপে ভেন্টিলেশনের মাধ্যমে অক্সিজেন।সারা রাত চলেছে সেই চিকিৎসা। বাড়ি যেতে পারেননি ডাক্তার। বারে বারে তাঁর স্ত্রী ফোন করে খবর নিয়েছেন ম্যাডামের। মনে হচ্ছিল হাড্ডাহাড্ডি লড়াইতে ভোরের আলোর মতো একটা আশার রেখা ফুটবে।
ভোরের আলো ফুটল, কিন্তু মিলিয়ে গেল আশার রেখা। সকাল সাতটা। হঠাৎ অচেতন হয়ে গেলেন ম্যাডাম। তারপরেই হৃদস্পন্দন নব্বুই থেকে নেমে চল্লিশ। শুরু হল লেবার ব্রিদিং। যেখানে সাধারণ মানুষের সূচক মিনিট পিছু ষোল থেকে কুড়ি,সেখানে তাঁর মাত্র পাঁচ থেকে ছয়। তাহলে কি শেষ হয়ে গেল লড়াই? তবু চেষ্টা।প্রথমে দেওয়া হল অ্যাসপিরিন। তারপর অ্যাসপিরিন অ্যাড্রোনালিন নেবুলাইজেশন। কিন্তু কমছে রক্তচাপ।তাকে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। দেওয়া হল নর-অ্যাড্রেনালিন আর ডবুটামাইন। পাম্প করা হচ্ছে। তীব্র শ্বাসকষ্ট ম্যাডামের। ঘন্টাখানেক চলল। মনে হল একটু যেন সুস্থ হলেন। কিন্তু…কিন্তু হঠাৎ বেড়ে গেল হৃদস্পন্দন,তীব্র শ্বাসকষ্ট,একটু পরে হৃদস্পন্দন নেমে গেল কুড়ি-তিরিশে। বুকের উপর থেকে কার্ডিও পালমোনারি কম্প্রেশন দেওয়া শুরু হল।
কিন্তু বৃথা চেষ্টা।আটটা পঁচিশে থেমে গেল লড়াই।
আর কিছু করার নেই। উঠে দাঁড়ালেন ডা: বর্মণ। অন্তরালবর্তিনী চলে গেলেন অসীম অন্তরালে।
তিনতলা থেকে নেমে এলেন ডাঃ বর্মণ। ঢুকে গেলেন রেস্ট রুমে। কেমন উদভ্রান্তের মতো লাগছে। মৃত্যু দেখলেন বলে? না,তা কেন? রোজই দেখা হয় মৃত্যুর সঙ্গে। কত রকম রূপেই না মৃত্যুকে দেখেন তিনি। তাহলে উদভ্রান্ত কেন? রুপোলি পর্দার এক বিখ্যাত নায়িকার জন্য শোক? তাও নয়। সে জগতের প্রতি তাঁর আকর্ষণ নেই।অন্তরালবর্তিনীর মানসিকতাই তাঁকে বিস্ময় বিমূঢ় করে রেখেছে।
এক সময়ে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন রুপোলি পর্দার জগত থেকে বিদায় নেবেন। নিলেন বিদায়। তারপরেও বেঁচে রাইলেন।কিন্তু লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গেলেন।তাঁকে ঘিরে তৈরি হল এক কৌতূহলের প্রবাহ। সে প্রবাহ বয়ে চলেছে কয়েক দশক। তিনি আছেন,অথচ নেই। তাঁর এই অন্তরালে চলে যাওয়া অস্বাভাবিক হলেও,তার পক্ষে একটা যুক্তি আছে। কিন্তু ম্যাডামের নির্দেশ ছিল,মৃত্যুর পরেও তিনি থাকবেন অন্তরালে। কেন? সময় আর জরার থাবা যাতে দৃশ্যমান না হয়,তার জন্য? হলেও বা,তখন তিনি তো আর সেটা উপলব্ধি করতে পারতেন না।তাহলে কেন মৃত্যুর পরেও এই অন্তরাল?
যে গুটিকয়েক মানুষ তাঁর দর্শন পেত, যাঁদের মধ্যে খুব সাধারণ মানুষও ছিলেন,তাঁরা তাঁর ইচ্ছেকে মর্যাদা দিয়েছেন। মোবাইল ফোনের কৃপায় ছবি যখন সহজলভ্য, তখন সংগোপনে কেউ তাঁর ছবি তুলে প্রচার মাধ্যমের হাতে তুলে দেন নি। ডাঃ বর্মণ নিজেই তো তার উদাহরণ।তিনি তাঁর স্ত্রী অথবা সিনেমা-অনুরাগী অনুজ ডাক্তারের অনুরোধ রক্ষা করতে পারেন নি।
কেন পারেন নি?
ম্যাডামের ব্যক্তিত্বের চৌম্বকশক্তি?
সন্দেহ নেই ব্যক্তিত্ব তাঁর ছিল।প্রখর ব্যক্তিত্ব।স্ত্রীর মুখে তিনি শুনেছেন কেরিয়ারের মধ্য গগনেও ম্যাডামের ব্যক্তিত্বের রশ্মি বিকীরিত হত।একটা অদৃশ্য বলয় তাঁকে ঘিরে থাকত। সহজলভ্য ছিলেন না তিনি।
একজন পরিচিত সাংবাদিক ঢুকলেন ঘরে। বললেন,ড: বর্মণ,আই টি ইউ তো ফাঁকা। ম্যাডামের বডি কোথায়?
সাংবাদিকের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন ডাক্তার,বললেন,নেপথ্যে।
-এর মধ্যেই!আগে থেকে সব ঠিক করা ছিল না কি?
-ছিল তো নিশ্চয়ই।নেপথ্যেই মৃত্যুশয্যার সজ্জা হবে।
আপনমনে সাংবাদিক বললেন,জেদ বটে।
-শুধু জেদ নয়,বলুন লড়াই।
-ঠিক বলেছেন।নিজের সঙ্গে নিজের লড়াই।বাহির আর ভিতরের লড়াই।
তারপরে সাংবাদিক টেপ রেকর্ডার চালু করে বললেন,মৃত্যু কি ভাবে হল একটু বলবেন?
-ম্যাডামের সি ও পি ডি অর্থাৎ ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ হয়েছিল।এতে তীব্র শ্বাসকষ্ট হয়।তবে তাঁর মৃত্যু হয় ব্র্যাডিকার্ডিয়াতে।
-ব্র্যাডিকার্ডিয়া? একটু এক্সপ্লেন করুন প্লিজ।
-হৃদস্পন্দনের হার অনিয়মিত হওয়াকে বলে অ্যারিদমিয়া। এটার আবার দুই ভাগ—ট্যাকিকার্ডিয়া এবং ব্র্যাডিকার্ডিয়া।প্রথমটায় হৃদস্পন্দনের হার অস্বাভাবিক বেড়ে যায় আর দ্বিতীয়টায় অস্বাভাবিক কমে যায়।এত অল্প সময়ের মধ্যে ম্যাডাম ব্র্যাডিকার্ডিয়াতে আক্রান্ত হলেন যে আমাদের করার কিছু ছিল না।অস্থায়ী পেসমেকার বসানোরও সময় পাওয়া যায় নি।
সাংবাদিক চলে গেলেন।একজন গেলেন,আর একজন আসবেন। ডাক্তার মৃদু হাসলেন।আপন মনে বললেন, সংবাদ শিকারি। তারপর ভাবলেন,দোষ দিয়ে লাভ কি!এটাই এঁদের জীবিকা।গোপন সংবাদ সংগ্রহ সেই জীবিকার অঙ্গ।
ততক্ষণে হাসপাতাল চত্বরে ভিড় জমতে শুরু করেছে। সেলিব্রিটি থেকে সাধারণ মানুষ।বাড়তে থাকবে ভিড়।এদিকে লোকচক্ষুর অন্তরালে ম্যাডামকে শেষযাত্রার পরিচ্ছদ পরানোর কাজও শেষ।সাদা গরদের শাড়ি। তার উপর সোনালি গরদের চাদর জড়ানো।মাথায় ঘোমটা।অন্তরাল। কফিনে বন্ধ হল সেই দেহ। দ্বিতীয় অন্তরাল। এবার সে কফিন ঢুকল মরদেহবাহী শকটে।তৃতীয় অন্তরাল। সে শকট আবার ফুলে ফুলে ঢাকা।চতুর্থ অন্তরাল।
সে সব দেখতে দেখতে ডাঃ বর্মণ নিজেকেই প্রশ্ন করেন: ম্যাডাম কি আগে থেকেই এই ছক সাজিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন? কেন? কেন মৃত্যুর পরেও এই সতর্কতা? এই অন্তরালের আয়োজন? তিনি দেখবেন বাইরের জগতকে,কিন্তু বাইরের জগত তাঁকে যেন না দেখতে পায়।প্রত্যক্ষভাবে না হলেও তিনি দেখতেন বাইরের জগতকে। টিভি দিয়ে,বেতার দিয়ে,প্রিয়জনের মুখ ও চোখ দিয়ে দেখতেন তিনি। কিন্তু তাঁকে দেখা যেত না।নির্জনতা আমরা অনেকে পছন্দ করি।কিন্তু নির্জনতায় নির্বাসন চাই না।এই নিবিড় নির্জনতায় হাঁপিয়ে উঠতেন না ম্যাডাম? তিন তিনটি দশক…বছরের পর বছর…শীত,গ্রীষ্ম,বর্ষা,বসন্ত…কত উৎসব, কত হট্টগোল,কত মেলা,কত পার্বণ…।তিনি অন্তরালে,অন্তরালে তিনি…দিনের পর দিন,মাসের পর মাস,বছরের পর বছর…। আচ্ছা,ম্যাডাম কি প্রকৃতিস্থ? নিজের মনে আবার প্রশ্ন করেন। আবার নিজেই উত্তর দেন,হান্ড্রেড পার্সসেন্ট।ডাক্তারের সজীব অভিজ্ঞতা সে কথাই বলে। তাহলে এই নির্জনতা এমন করে মেনে নিলেন কি করে? আধ্যাত্মিক সাবলিমেশন? এটা ডাক্তার ঠিক বুঝতে পারেন না।তবে এ কথা তিনি জানেন যে মন কোন বিষয়ে অভিনিবিষ্ট হলে অন্য সব কিছু তুচ্ছ হয়ে যায়। ডাক্তার বর্মণের স্ত্রী ছিলেন সাহিত্যের ছাত্রী। স্ত্রীর মুখে ডাক্তার শুনেছিলেন শ্রীরাধার তন্ময়তার কথা। রাধার জগৎ ছিল কৃষ্ণময়।তাই তাঁর বাহির দুয়ারে কপাট লেগেছে ভিতর দুয়ার খোলা।
চলতে শুরু করেছে শববাহী শকট।
পেছনে ভি আই পিদের গাড়ি। ডাক্তার বর্মণ গাড়িতে ওঠেননি।আজ তাঁর হাঁটতে ভালো লাগছে। আরও অনেকের সঙ্গে হাঁটছেন তিনি।শরীরটা ভালো নয়।কিন্তু না গিয়ে পারলেন না। বেশ অনেকদিন জড়িয়ে ছিলেন ম্যাডামের সঙ্গে। তৈরি হয়েছিল এক অদৃশ্য মায়াবন্ধন। হাঁটছেন ডাক্তার। কিন্তু মন তাঁর তলিয়ে গেছে স্মৃতির গভীরে।সেসব স্মৃতি বেশ সজীব।
আরো পড়ুন: পুনঃপাঠ গল্প: আমার বন্ধু পিনাকী । সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়
খ.
এই তো গত মাসের মাঝামাঝি। আঠারো…হ্যাঁ,আঠারো তারিখ।হাসপাতালে সবে ঢুকেছেন ডাক্তার বর্মণ। ফোন এল। তাঁর এক সহকর্মী বললেন,ম্যাডামের প্রাইভেট নার্স ফোন করেছিলেন।বললেন ম্যাডামের শরীরটা খারাপ।ঠাণ্ডা লেগেছে।আপনাকে একবার যেতে বলেছেন।
সেদিন বিকেলেই ডাক্তার গেলেন ম্যাডামের বাড়ি। ম্যাডামকে পরীক্ষা করে বুঝলেন,ঠাণ্ডাই লেগেছে।ঘড় ঘড় শব্দ হচ্ছে।তার মানে কফ আছে বুকে। হালকা জ্বরও আছে।অ্যামোক্সিলিনের সঙ্গে আরও দুটো ওষুধ দিলেন ডাক্তার।বলে দিলেন,এর সঙ্গে সুগার আর থাইরয়েডের ওষুধ যেমন চলছে তেমনি চলবে। ম্যাডাম বললেন,ডাক্তার আমার চোখের ছানি ধরা পড়েছে। এবার অপারেশন না করলে নয়। বই পড়তে পারছি না।বড্ড অসুবিধে হচ্ছে।
ডাক্তার তাঁকে আশ্বাস দিলেন।কোথায় ছানি অপারেশন হবে সে সব আলোচনা হল।
পরের দিন নিজেই ফোন করলেন ম্যাডাম। বললেন, জ্বর কমে নি, সর্দিও আছে, শ্বাস নিতে অসুবিধে হচ্ছে। ধ্যানেও বেশিক্ষণ বসতে পারছি না। আপনি কি আজ বিকেলে একবার আসতে পারবেন?
বিকেলে ডাক্তার বর্মণ তাঁকে দেখতে গেলেন। পরীক্ষা করার পর বললেন,সব টেস্টগুলো ভালো করে করা দরকার।তার জন্য দুএকদিন হাসপাতালে থাকুন না ম্যাডাম।
ম্যাডাম হাসলেন একটু। ভুবনমোহিনী হাসির ছটা সে হাসিতে এখনও লেগে আছে। বললেন,ডাক্তার বর্মণ, আপনি তো জানেন যে হাসপাতাল বা নার্সিহোমে থাকতে আমার ভালো লাগে না। কেমন দম বন্ধ হয়ে আসে। যা করার বাড়িতেই করুন না!
তারপর ম্যাডাম ডাক্তারের বাড়ির সকলের খোঁজখবর নিলেন। ডাক্তারের বাড়ির কেউ ম্যাডামকে কোনদিন সামনা সামনি দেখেন নি। অথচ ম্যাডাম তাঁর কর্ণেন্দ্রিয় দিয়ে তাঁদের দেখতে পান।এই ব্যাপারটা বিমূঢ় করে ডাক্তারকে।আধ্যাত্মিকতার আশ্রয় নিয়েছেন ম্যাডাম,কিন্তু মানুষ সম্পর্কে তাঁর সজীব আগ্রহ আছে। পরোক্ষভাবে তাদের জীবনে জীবন যোগ করেন তিনি।বাগানের মালি,নার্স,পরিচারিকা–সকলের খোঁজখবর রাখেন তিনি,তারা সকলেই তাঁর প্রীতি ও মমতার স্পর্শ পায়।অথচ তিনি অন্তরালবর্তিনী থেকে যান।
তার পরের দিনও দেখা গেল অবস্থার বিশেষ পরিবর্তন হয় নি। আগের ওষুধে বিশেষ কাজ হচ্ছে না। তাহলে কি অ্যান্টিবায়োটিক ইঞ্জেকশন দেবেন তিনি? ভাবছিলেন ডাক্তার।
তেইশ তারিখে ম্যাডামের বাড়ি গেলেন তিনি।পরীক্ষা করে বুঝলেন বুকের কফ এতটা শুকিয়ে গেছে যে কাশিতে কফ উঠছে না। এমন অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি না করালে নয়। সে কথা ডাক্তার ম্যাডামের একমাত্র কন্যাকে বললেন।কন্যা দ্বিধাগ্রস্ত।তিনি তাঁর মায়ের মনোভাব জানেন।তাছাড়া,হাসপাতালে ভর্তি হবার খবর একটু লিক করলেই মুশকিল।সংবাদ মাধ্যম ছেঁকে ধরবে। পিল পিল করে মানুষ আসবে। দীর্ঘদিন অন্তরালে থেকে ম্যাডাম জনমানসে একটা অপ্রতিরোধ্য কৌতূহল সৃষ্টি করেছেন।খবর লিক করা মানে কৌতূহলের মৌচাকে ঘা দেওয়া।
ম্যাডামের কন্যাকে ডাক্তার বললেন,জানি,জানি।ম্যাডাম ইজ আ ভেরি পারসোনাল লেডি।আপনি সিওর থাকুন,আমরা তাঁর প্রাইভেসি মেইনটেইন করব।তিন তলার যে কেবিনে আগে উনি থেকেছেন,সেই কেবিনেই থাকবেন।খবর লিক হলেও সে কেবিনে কেউ ঢুকতে পারবে না কোনমতে।
শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন ম্যাডাম।সেদিন মধ্যরাতে ম্যাডামকে আনা হল হাসপাতালে।রাতের অন্ধকার সৃষ্টি করে স্বাভাবিক অন্তরাল।
হাসপাতালে ভর্তি হলেন ম্যাডাম।চলতে লাগল ওষুধ।কিন্তু কোন ফল পাওয়া গেল না।এটা কি বেশি সিগারেট খাওয়ার ফল? হতে পারে।এখন ফুসফুস সেই অত্যাচারের প্রতিশোধ নিচ্ছে। ব্রঙ্কো ডায়ালেটর নেবুলাইজেশন চালু করা হল।একই সঙ্গে দেওয়া হল অক্সিজেন।একটু যেন রিলিফ পেলেন ম্যাডাম। একদিন রসিকতা করে বললেন,নাঃ,বোধহয় আর চিন্তার কোন কারণ নেই।বেশ জব্দ হয়েছে ফুসফুস। মনে হয়দিন দুয়েক পরে আপনার সঙ্গে বসে কফি খেতে পারব।
ম্যাডামকে উৎফুল্ল দেখে ডাক্তার বললেন,ম্যাডাম,এখানে থাকতে থাকতে চোখের ছানিটা অপারেশন করিয়ে নেব।
রসিকতার সুর বজায় রেখে ম্যাডাম বললেন,এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চান আর কি!
উনত্রিশ তারিখে ঘটল অঘটন। সন্ধেবেলায়।সকালে ম্যাডাম ভালোই ছিলেন।ডাক্তাররা ঠিক করেছিলেন পরের দিন ছানি অপারেশন করাবেন।যে চোখের জাদুতে আবিষ্ট হত মানুষ,সেই চোখে ছুরি-কাঁচি চালাতে হবে।ডাক্তার বর্মণ বলেছিলেন,একটু অভয় দেবেন ম্যাডাম।শুনে ম্যাডাম একটু হেসেছিলেন।
কিন্তু সন্ধেবেলা থেকে বেড়ে গেল শ্বাসকষ্ট।কেবিন থেকে ম্যাডামকে নিয়ে আসতে হল আই টি ইউতে।শুরু হল অক্সিজেন স্যালাইন।পর পর দুদিন কাটল দারুণ টেনশনে।নতুন বছরের প্রথম দিনটিতে ম্যাডামকে অনেকটা ভালো মনে হল। এই দিন দক্ষিণেশ্বরে কল্পতরু উৎসব হয়। সে কথা ডাক্তারকে মনে করিয়ে দিলেন ম্যাডাম।ডাক্তার জানেন শ্রীরামকৃষ্ণ ও রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে ম্যাডামের যোগাযোগের কথা। অনেকে বলেন ম্যাডাম লোকচক্ষুর অন্তরালে যাবার পর শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যে আশ্রয় সন্ধান করেছেন।ডাক্তার তাঁর স্ত্রীর মুখে এ কথাও শুনেছেন যে ম্যাডাম সাংসারিক জীবনে যখন ছিলেন,যখন তিনি জনমোহিনী নায়িকা,তখনও ছিলেন রামকৃষ্ণ ভক্ত।কর্মহীন অবকাশে ধ্যানে বসতেন তিনি।তাহলে কি অনাসক্তি আর বৈরাগ্য তাঁর ব্যক্তিত্বের অঙ্গ? এই অনাসক্তি আর বৈরাগ্য কি উদ্দাম ভোগস্পৃহার পথে সৃষ্টি করেছিল বাধা? তাঁর জীবন যাপন নিয়ে তৈরি হয়েছিল নানা মুখরোচক কাহিনি।সেসবের মধ্যে কল্পনা ছিল,বস্তুভিত্তি ছিল না।
ডাক্তার দেখছেন দু-তিন দিন ধরে ম্যাডামের শারীরিক অবস্থা অস্থিতিশীল। রক্তে অক্সিজেন কখনও ৮৮, আবার কখনও ৭৮। ম্যাডাম বলেন, আর কতদিন থাকব এখানে? আমাকে বাড়ি পাঠাবার ব্যবস্থা করুন।
কিন্তু এ অবস্থায় ম্যাডামকে কিছুতেই বাড়িতে রাখা সম্ভব নয়। ফুসফুসের অবস্থা ভালো নয় তাঁর।বরং বলা যায় খারাপ হচ্ছে ক্রমাগত।সবসময়ে রোটেশনে একজন ডাক্তারকে রাখা হচ্ছে।মেডিকেল টিমের শিডিউল তৈরি করা হয়েছে।
একদিন ডাক্তার পোদ্দার ডাক্তার বর্মণকে বললেন ম্যাডাম তাঁকে বলেছেন,শুনেছি তুমি তোমার মাকে খুব ভালোবাস। আমারও তো খুব সেবা করছ তুমি। আমাকে তুমি মা বলে ডাকতে পারো।
শুনলেন ডাক্তার বর্মণ। মনে মনে বললেন, তাহলে যে লোকে বলে তিনি শুধু রোমান্টিক নায়িকার ইমেজ ধরে রাখার জন্য স্বেচ্ছায় অন্তরালের নির্বাসন বেছে নিয়েছেন? রোমান্টিক নায়িকার মধ্যে এমন মাতৃহৃদয়, এমন স্নেহবুভুক্ষা এল কোথা থেকে?
পাঁচ তারিখ। আজ একটা চমক দিলেন ম্যাডাম। আগের দিন ম্যাডামের শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নেবার জন্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এসেছিলেন হাসপাতালে। ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলে চলে গিয়েছিলান তিনি। ম্যাডামের অন্তরালের সিদ্ধান্তকে সম্মান দিয়ে তিনি ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেন নি। মুখ্যমন্ত্রীর আসার কথা কানে গিয়েছিল ম্যাডামের। আজ তিনি ডাক্তার বর্মণকে বললেন, শুনলাম কাল মুখ্যমন্ত্রী এসেছিল। আমার কাছে এল না কেন?
কথাটা শুনে চমকে উঠেছিলেন ডাক্তার।
ম্যাডাম বলছেন তাঁর সঙ্গে দেখা করার কথা!
মুখ্যমন্ত্রী এক রাজনৈতিক দলের মানুষ। রাজনীতি সম্বন্ধে ম্যাডামের কোন আগ্রহ নেই বলে তিনি জানেন। এর আগে কোন কোন রাজনৈতিক দল তাঁকে জনপ্রতিনিধি হিসেবে দাঁড় করাতে চেয়েছিল। তিনি রাজি হন নি। তাঁকে জাতীয় পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। তিনি সে পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করে দেন, কারণ সশরীরে পুরস্কার তিনি গ্রহণ করতে পারবেন না। তাহলে? তাহলে তিনি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার জন্য আগ্রহী হলেন কেন? রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নারী বলে? কিন্তু জাতীয় স্তরে আরও অনেক মহিলা নেত্রী আছেন,তাঁদের সঙ্গে দেখা করার কোন আগ্রহ তো প্রকাশ করেন নি ম্যাডাম?
পরের দিন দুপুরে মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার বর্মণকে ফোন করে জানালেন,ম্যাডাম নিজেই ফোন করেছিলেন আমাকে। আমি আজ যাব না কাল যাব প্রশ্ন করতে তিনি বললেন আজই আসতে,কারণ কাল যদি ভালো না থাকেন।আমি আজই আসছি।
এসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রায় আধঘন্টা ছিলেন ম্যাডামের কেবিনে। কি কথা হল তাঁদের,কেউ জানবে না। ম্যাডামের ক্ষেত্রে এটা ব্যতিক্রম।তবে কি ম্যাডাম এবার অন্তরাল থেকে বেরিয়ে আসবেন?
ম্যাডামের বুকে জমা কফ সমস্যার সৃষ্টি করেছে।চেস্ট ফিজিওথেরাপি অর্থাৎ বিশেষ পদ্ধতিতে মালিশ প্রয়োজন। কিন্তু কিছুতেই রাজি হতে চান না ম্যাডাম।অনেক কষ্টে তাঁকে বোঝানো হল।আনা হল এক মহিলা ফিজিওথেরাপিস্টকে।এই পদ্ধতিতে কফ উঠল কিছুটা।কিন্তু আট তারিখে চরমে উঠল শ্বাসকষ্ট।এবার ভেন্টিলেশন না দিলে নয়।কিন্তু ম্যাডামের মেয়ে কিছুতে রাজি হলেন না।একটা ভীতি তাঁকে তাড়িত করছিল।ভেন্টিলেশনে দিলে মা যদি আর ফিরে না আসেন?মেয়ের এই আবেগকে মর্যাদা দিতে হয়।
ডাক্তারদের সঙ্গে পরামর্শ করে ড: বর্মণ ঠিক করলেন নন-ইনভেসিভ ভেন্টিলেশন বা বাইপ্যাপ করা হবে। এতে মুখের মধ্যে নল ঢোকাবার দরকার হয় না। মুখে একটা মাস্ক পরিয়ে খুব জোরে অক্সিজেন প্রবেশ করানো হয় ফুসফুসে।
এদিকে আর এক সমস্যা।
কিভাবে ম্যাডামের সংকটজনক অবস্থার খবর পৌঁছে গিয়েছে সংবাদ মাধ্যমে।ভিমরুলের চাকে ঘা পড়েছে যেন।হাসপাতালের মূল দরজার সামনে সাংবাদিক আর ক্যামেরাম্যানদের ভিড়। ডাক্তার বর্মণ আর তাঁর টিমের ডাক্তাররা তাঁদের টার্গেট। ডাক্তাররা পড়েছেন উভয় সংকটে।একদিকে সাংবাদিকদের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার দায়,অন্যদিকে হিপোক্র্যাটিক ওথ রক্ষার দায়। টিমের ডাক্তাররা বন্ধ করে রেখেছেন তাঁদের মোবাইল। সাংবাদিকদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছেন তাঁরা।টিমের একজন জুনিয়র ডাক্তার রসিকতা করে বললেন,আসুন আমরা ছদ্মবেশ ধারণ করে ম্যাডামের মতো অন্তরালে চলে যাই।
এগারো তারিখ।
শুরু হয়েছে যমে-মানুষে টানাটানি।একদিকে ম্যাডামের রোগযন্ত্রণা,অন্যদিকে না খেতে পারার জন্য কাহিল অবস্থা। ডাক্তার ম্যাডামকে কথা দিয়েছিলেন যে তাঁকে কোন কষ্ট দেবেন না। প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন কথা রাখার। কিন্তু পারলেন না। সন্ধেবেলায় এণ্ডোট্র্যাকিয়াল টিউব পরানোর সময় যন্ত্রণা পেলেন ম্যাডাম। গলা থেকে রক্তও পড়ল কিছুটা। কিন্তু কোন উপায় নেই। ম্যাডামের শরীরে নিউট্রিশনাল সাপ্লিমেন্টের পরিমাণ বাড়াতেই হবে। তাই পরাতে হল রাইলস টিউব।
এ দিকে সংবাদ মাধ্যম সমস্যা করে যাচ্ছে। ম্যাডাম সম্পর্কে নানা খবর প্রকাশিত হচ্ছে। এক পোয়া দুধে তিন পোয়া জল মিশিয়ে রচনা করা হচ্ছে সংবাদ। ছুটছে কল্পনার ঘোড়া। খবর লিক হচ্ছে,এটা নিশ্চিত। কোথা থেকে লিক হচ্ছে, তা ধরার সময় এটা নয়। নিয়মিত আসছেন মুখ্যমন্ত্রী। অন্য ভি আই পিরাও আসছেন। খবর লিক হবার সুযোগ থেকে যাচ্ছে।
ম্যাডাম কি কিছু বুঝতে পারছেন? তাঁকে কেমন যেন অস্থির,কেমন যেন অভিমানী মনে হচ্ছে। ব্যক্তিগত নার্সকেও কাছে আসতে দিচ্ছেন না। ওষুধ খাওয়াতে গেলে বলছেন,আগে বাড়ি নিয়ে চলো,তারপরে ওষুধ খাব,সব কথা শুনব তোমাদের।
বাড়ি যাওয়ার কথাটা ধাক্কা দিচ্ছে ডাক্তার বর্মণকে।অন্তরালে থাকার আকাঙ্খায় বাড়ি যাবার ইচ্ছা এটা নয়। অনেক মুমূর্ষুর মুখে বাড়ি যাবার ইচ্ছার কথা শুনেছেন ডাক্তার। নিজের কথা ভাবেন তিনি।পৃথিবী ছেড়ে যাবার আগে তিনিও কি বাড়ি যেতে,প্রিয়জনদের কাছে যেতে চাইবেন? সে চাওয়া কি সচেতন চাওয়া?
ষোলো তারিখের রাতে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বিধ্বস্ত ডাক্তার ভাবছিলেন এ সব।আরও একটা কথা মনে পড়ল তাঁর।ম্যাডামের মেয়েকে তিনি যখন টোটাল ভেন্টিলেশনের কথা বলছিলেন,তখন ম্যাডাম ঘোরের মধ্যে বলছিলেন,আমাকে ছেড়ে দাও তোমরা,আমাকে ছেড়ে দাও,আমি বাড়ি যাব,আমাকে বাড়ি যেতে দাও।
কিছু কি বুঝতে পারছিলেন ম্যাডাম?
বোঝা কি সত্যি যায়?
কেমন সে অনুভূতি?
গ .
মরদেহবাহী শকটে রাখা হল কফিন। এবার শুরু হবে যাত্রা।অন্তিম যাত্রা। প্রথমে যাওয়া হবে দক্ষিণ কলকাতায় ম্যাডামের বাসভবনে।সেখান থেকে শ্মশানে। অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করতে হবে সব। করতে হবে সুশৃঙ্খলভাবে। মর্যাদা দিতে হবে ম্যাডামের ইচ্ছাকে। তাই প্রশাসন তৎপর।ম্যাডামের শেষযাত্রার সঙ্গী রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। মাইক্রোফোন হাতে তুলে নিয়ে তিনি বললেন,পতন হয়ে গেল এক মহীরূহের।আজকের দিন শোক ও দুঃখের।নিজেকে আড়াল করে রেখেছিলেন তিনি বহুদিন। চেয়েছিলেন শান্তিপূর্ণভাবে পৃথিবী ছেড়ে শান্তিতে সমাহিত হতে।আমরা তাঁর ইচ্ছাকে মর্যাদা দেব। তাই একটুও বিশৃঙ্খলা যেন না হয়।
ইতিমধ্যে পুলিশ শ্মশানের আয়োজন সম্পূর্ণ করে ফেলেছে। ১৪০ কেজি চন্দনকাঠের সঙ্গে বাবলা ও শিরিষ কাঠ এসেছে। এসেছে ৫০ কেজি ঘি আর ১৪ কেজি ধুনো। ভি আই পিদের বসার জন্য শামিয়ানা টাঙানো হয়েছে,কয়েক ডজন সবুজ চেয়ার পাতা হয়েছে। শ্মশান চত্বর মুড়ে দেওয়া হয়েছে ফুলে ফুলে।কড়া নিরাপত্তা।ছাড়পত্র ব্যতীত শ্মশানে প্রবেশ করা অসম্ভব।
চলছে শকট। চলতে চলতে বারবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছেন ডাক্তার বর্মণ।ম্যাডাম কি জীবনকে ফাঁকি দিলেন? জীবনের মতো মৃত্যুকেও ফাঁকি দিতে চেয়েছিলেন তিনি? এই অস্বাভাবিক জীবন যাপনের জন্য তাঁর মনে কি কোন ক্ষোভ ছিল না? বেশ কয়েক বছর তিনি ম্যাডামের কাছে যাতায়াত করছেন।কিন্তু ক্ষোভ বা ক্লান্তি তিনি আঁচ করতে পারেননি। বরং তাঁর মনে হত এক দর্পিত একাকিত্ব ও নীরবতা ম্যাডামের ব্যক্তিত্বেরই অঙ্গ।নির্বাচিত গুটিকতক মানুষের সঙ্গে আলাপ করে,জানালার কাচের ভেতর দিয়ে বর্হিজগতকে দেখে তৃপ্ত থাকতেন তিনি। ডাক্তার ভাবেন,আচ্ছা,বসন্তের আকুল সমীরণে,মায়াবী জ্যোৎস্না রাতে,বিষণ্ণ গোধূলিতে বারি ঝরে ঝরঝর মধ্য রাত্রিতে কোন আকুলতা জাগত না তাঁর মনে? স্মৃতির আলোড়ন কি কষ্ট দিত না তাঁকে? তাড়া করত না প্রিয়জনদের ছায়ামূর্তি?
ম্যাডামের বাসভবনের গেট খুলে গেল। মরদেহবাহী শকট আর নির্বাচিত কিছু মানুষ ঢুকতে পারলেন ভেতরে।বহুবার এখানে এসেছেন ডাক্তার।আবাসনের তিনতলায় ম্যাডামের ঘরে ঢুকেছেন। ডাক্তারি পরীক্ষা করেছেন,কফি খেয়েছেন, ব্যক্তিগত সীমারেখা বজায় রেখে গল্প করেছেন ম্যাডামের সঙ্গে। প্রত্যেকবার বেরিয়ে আসার সময় ভেবেছেন,তাঁকে যদি এরকম জীবন যাপন করতে হত,বজায় রেখে যেতে হত এ রকম অদৃশ্য অথচ অমোঘ অন্তরাল,পারতেন কি তিনি? না,পারতেন না। কিছুতেই পারতেন না।তিনি স্বল্পভাষী,নির্জনতাপ্রিয়,তবুও তিনি পারতেন না। বাইরের প্রকৃতি,পরিবেশ ও মানুষের সংসর্গ ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না কেন? মুক্ত হতে পারে না বলে? অস্তিত্বের সংকট দেখা দেয় বলে? তাহলে দীর্ঘ তিন তিনটি যুগ কি ভাবে বেঁচেছিলেন ম্যাডাম? এই যে আবাসন,এখানকার নানা ঘরের নানা বাসিন্দার সুখ-দুঃখ বিজড়িত তপ্ত জীবন প্রবাহের সঙ্গে কোন যোগ ছিল না তাঁর।একই ছাদের তলায় থেকে সে সব মানুষজনকে কোনদিন দেখেন নি তিনি। তাঁরাও কোনদিন সামনা-সামনি দেখতে পান নি ম্যাডামকে।আজ তাঁরা শ্রদ্ধা জানানোর জন্য বেরিয়ে এসেছেন কফিনবন্দি মৃতদেহের সামনে। আজও বজায় আছে অন্তরাল।
শ্মশান চত্বরে শকট যখন পৌঁছাল তখন দ্বিপ্রহর।বাইরে চারিদিকে অসংখ্য মানুষ।ভিতরে কঠোর নিরাপত্তা। গেটের বাহিরে শকট থেকে নামানো হল কফিন।আশপাশের মানুষ চঞ্চল হয়ে উঠল। যে যতটা পারে ঝুঁকে পড়ে দেখার চেষ্টা করছে প্যাণ্ডোরার বাক্স। যার ভেতর লুকানো আছে এক অসীম রহস্য।ডাক্তার মনে মনে বললেন,মানুষের এই কৌতূহল বজায় রাখার জন্য কি অন্তরালের রহস্যের আবরণ তৈরি করেছিলেন ম্যাডাম? আর তার জন্য এত মূল্য দিলেন?
আত্মীয়-স্বজন কাঁধে করে কফিন বয়ে নিয়ে এলেন চিতার কাছে। বেজে উঠল বিউগল। গান স্যালুট দিলেন জওয়ানরা।কফিনের উপর ফুলের মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানালেন অভ্যাগতরা।মালা দিলেন ডাক্তারও। এবার কি কফিনবন্দি দেহ স্থাপন করা হবে চিতায়? না,কফিন খোলা হচ্ছে।তাহলে কি দূর হবে অন্তরাল? কফিন থেকে বেরোল সাদা কাপড়ে ঢাকা দেহ।সেই বস্ত্রাবৃত দেহ স্থাপন করা হল চিতায়।অন্তরাল থেকে গেল।আকাশ-বাতাস-ধরিত্রী-ধরিত্রীমাতার সন্তানরা দেখতে পেল না তাঁকে।দেখতে পাবে শুধু সর্বদর্শী সর্বভূক অগ্নি।মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করলেন পুরোহিত।মায়ের পা ছুঁয়ে প্রণাম করলেন একমাত্র কন্যা।চন্দনকাঠে ঢেকে দেওয়া হল দেহ।ঢালা হল ঘি।চিতা প্রদক্ষিণ করে আগুন দিলেন ম্যাডামের কন্যা।
জ্বলে উঠল আগুন।
তার লেলিহান শিখার দিকে তাকিয়ে আছেন ডাক্তার।এই সর্বভূক সব আত্মসাৎ করে ফেলবে।পড়ে থাকবে দু মুঠো ছাই। এই কি জীবনের পরিণতি? বিজ্ঞানমনস্ক ডাক্তার কেমন অন্যমনস্ক হয়ে যান।যুক্তির ক্রম আর কার্যকারণ বোধ অবিন্যস্ত হয়ে যায়। তাঁর মনে হয়,ভোগী আর স্বার্থপর মানুষকে চিতার আগুনের কাছে রাখা দরকার।
ম্যাডামের শেষকৃত্যে উপস্থিত হয়েছেন অনেক অভিনেতা ও অভিনেত্রী। ডাক্তার তাকালেন,তাঁদের দিকে তাকিয়ে দেখলেন।তাঁরা কি মানেন যে দেহপট সনে নট সকলই হারায়? তাঁরা কি এই চিতার সামনে দাঁড়িয়ে বলতে পারবেন:চামড়া ঝুলে যাওয়া,ভুঁড়ি হয়ে যাওয়া,জীর্ণ চেহেরা নিয়ে আর রুপোলি পর্দায় দেখা দেবো না,দেবো না,দেবো না…
চমকে উঠলেন ডাক্তার।
তার মানে ম্যাডাম কি যৌবনের ইমেজটা ধরে রাখার জন্য অন্তরালের পথ বেছে নিয়েছিলেন?
এতদিন কার চিকিৎসা করে্ছিলেন ডাক্তার?কালের নিয়মে এক জরাগ্রস্ত নারীর,না যৌবনের কিংবদন্তী রহস্যময়ী এক নারীর?
বিকেলের শরীরে লাগল সন্ধ্যার রঙ। নিভে এসেছে চিতার আগুন। সে আগুন ম্যাডামের শরীর দগ্ধ করে ছাই করে দিয়েছে। তাঁর ইমেজটা থেকে গেল মানুষের মনে। কালের আগুন সে ইমেজকে দগ্ধ না করতে পারলেও বিবর্ণ করে দেবে নিশ্চয়।
তাহলে?
সেলফোন বেজে উঠল। স্ত্রী ফোন করেছেন। ডাক্তার অন্যমনস্কভাবে বলে যেতে লাগলেন,অন্যভাবে বেঁচে থাকার লড়াই করে চিতার আগুনে ছাই হয়েছেন ম্যাডাম।
গবেষক