| 29 মার্চ 2024
Categories
ধারাবাহিক

ইরাবতী ধারাবাহিক: একাকিনী (পর্ব-১৪) । রোহিণী ধর্মপাল

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

“আপনি বলেছিলেন খোঁজ পেলেই আগে আপনাকে জানাতে। আমার অনুমান ওই দুই  সন্তানের বাবা কোনও আদিবাসী পুরুষ নয়। তাহলে বালকের গায়ের রঙটি এমন হতো না। কিন্তু আমি আগেই আপনার কাছে এসেছি মহারাজ। আপনি আদেশ দিলে তবেই বাকি খোঁজটুকু করব।” এই বলে মহী চুপ করল।
দ্রুপদ অনেকক্ষণ ভাবলেন। তারপর সিদ্ধান্ত নিলেন। “মহী, এবার আমিই যাব। তুমি শুধু আমাকে ঠিক করে অঞ্চলটি বুঝিয়ে দাও”।
কয়েকদিন পর দ্রুপদ বের হলেন। ঘোড়ায় চড়ে। এসে থামলেন, নদীর ধারে সেই ব্রাহ্মণ বসতিতে। সেইখানে ইতস্তত ঘুরতে ঘুরতে যাজোপযাজৌ ব্রহ্মর্ষী সোহপশ্যৎ, যাজ ও উপযাজ নামে দুই ব্রহ্মর্ষিকে দেখতে পেলেন। উপযাজ যাজের থেকে বয়সে ছোট, তাই তাঁর সঙ্গে কথা বলতে সুবিধা হবে, এই ভেবে দ্রুপদ উপযাজের কাছেই গেলেন। তাঁকে নির্দ্বিধায় সব কথা খুলে বললেন। বললেন, “দ্রোণবধের জন্য আমার উপযুক্ত সন্তান চাই। আপনি তার ব্যবস্থা করে দিন। আপনি যা চাইবেন, তাই দেব”।
উপযাজ কোনও কথাই বললেন না। বহু অনুনয় বিনয়ের পরেও তাঁর সম্মতি পাওয়া গেল না। হতাশ দ্রুপদ ফিরে এলেন। কিছুদিন পর আবার গেলেন। এইভাবে পার হয়ে গেল একটি বছর। রাজার ধৈর্য্য দেখে অবশেষে উপযাজ মুখ খুললেন। তিনি বললেন, “আমার দাদা যাজের কাছে খোঁজ করো”। আর দুটি কথা যাজের সম্পর্কে বলে দিলেন। প্রথমত যাজ মাটির পবিত্রতা অপবিত্রতা বিচার করেন না। দ্বিতীয়ত, অন্যের উচ্ছিষ্ট ভোজনেও কখনও ঘৃণা করেন না। এই দুটি ইঙ্গিতই যথেষ্ট ছিল দ্রুপদের জন্য। তিনি বুঝলেন এক বছর ধরে ধৈর্য্য ধরে থাকার ফল তিনি পেয়েছেন। যাজই সেই ব্রাহ্মণ যিনি আদিবাসী-রমণী (ভূমি) সংসর্গ করেছেন। সেই রমণীর স্বামী থাকলেও (উচ্ছিষ্ট অন্ন) তিনি অবলীলায় এমন মিলন ঘটিয়েছেন। অর্থাৎ সেই ব্রাহ্মণ যতোই যাগযজ্ঞ করুন না কেন, তিনি লোভী। তাঁকে দ্রুপদ উপঢৌকন দিয়ে নিজের কথা মানাতে পারবেন।
পরদিনই রাজা ভোর বেলায় এলেন সেই বসতিতে। এই একবছর ধরেই দ্রুপদ এসেছেন একেবারে সাধারণ বেশে। এই দিনও তার ব্যতিক্রম হল না। যাজ তখন সকালের স্নান সেরে হোমে বসার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। এই সময়ে আগন্তুকটিকে দেখে একটু আশ্চর্য হলেন। এই লোকটিকে বেশ কিছুদিন ধরেই তিনি দেখছেন ভাই উপযাজের কাছে আনাগোনা করতে। আজ তাঁর কাছে কেন? কী চায় লোকটি? চেহারাপত্তর তো বেশ সম্ভ্রান্ত। তিনি আগ বাড়িয়ে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। দেখা যাক, লোকটি কী বলে।
ঘোড়া থেকে নেমে দ্রুপদ এগিয়ে গেলেন। যাজকে প্রণতি জানালেন। বললেন, “আপনার সঙ্গে আমার অত্যন্ত জরুরী আর গোপন কিছু কথা আছে। আমি চাই না আর কেউ তা জানুক। তাই আমি একাই এসেছি। আমি পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ”।

আরো পড়ুন: একাকিনী (পর্ব-১৩) । রোহিণী ধর্মপাল


যাজ ভেতরে ভেতরে একটু চমকে গেলেন। স্বয়ং দ্রুপদ? রাজা তাঁর কাছে কী চান এমন? কী সেই দরকারী কথা?? মুখে স্মিত হেসে বললেন, “আসুন মহারাজ! ব্রাহ্মণের কুটিরে আপনাকে স্বাগত”। কুটিরের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ইরা, বাইরে আর একটি আসন এনে দাও তো”।
সচকিত দ্রুপদ তাকিয়ে দেখলেন, এক ঘোর কালো রঙের রমণী বেরিয়ে এল ভেতর থেকে। হাতে একটি আসন। পরণে নীল একটি কাপড়। আঁটোসাঁটো করে পরা। অসম্ভব সুন্দর একটি শরীর। রমণী সামনে এসে আসনটি পেতে একবার তাকাল। তারপর নীরবে ঢুকে গেল। কিন্তু আশ্চর্য চোখ। কী অদ্ভুত তাকানো। যেন মনের ভেতর পর্যন্ত সেই দৃষ্টি চলে যায়! এই তবে সেই রমণী!
রাজার মনের ভাব খানিকটা আঁচ করে যাজ বললেন, “ইরা সামনের এই বনেই থাকে। আমার কাজে একটু সাহায্য করে। মেয়েটি বড় ভালো। স্বামী মারা গেছে। দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে ঘর বেঁধে একাই থাকে। ছেলেমেয়ে দুটিও ভারী ভালো। আমার কাছে মাছ ধরে নিয়ে আসে মাঝে মাঝেই। আমিও খানিক পড়াশোনা করাই। দুজনেই খুব বুদ্ধিমান। সহজেই যা বলতে চাইছি, বুঝে যায়। যাক। এবার আপনি বলুন। আপনার কী কথা আছে”?
 দ্রুপদ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে মনের মধ্যে এতদিন ধরে ভেবে চলা কথাগুলো আর একবার গুছিয়ে নিলেন। তারপর বলতে শুরু করলেন।
 “আপনার ভাইকে আমি সমস্ত কথা ইতিমধ্যেই বিস্তারিত জানিয়েছি আপনাকেও আরেকবার বলছি আমার গুরু ভাই দ্রোণ আমাকে ভয়ানক অপমান করেছে। আমি সেই অপমানের প্রতিশোধ নিতে চাই। আমি চাই এমন এক সন্তান, যাকে আমি এই কাজের জন্য তৈরি করব। আপনি আমাকে এই কাজে সাহায্য করুন”।
 যাজ বিস্মিত হলেন। বললেন, “মহারাজ এই কাজে আমি কিভাবে সাহায্য করবো আপনাকে? আপনি কি পুত্রযাগ করতে চান”?
 “না। এই যজ্ঞ করলেও আমি যে আমার মনের মত সন্তান পাব তার কি কোন নিশ্চয়তা আছে? আমি কোন রকম ঝুঁকি নিতে চাই না। তাই জন্য আপনার কাছে এসেছি। আমি জানি আপনার দুটি সন্তান আছে। আমি ওদের চাই। অবশ্যই লোক দেখানো একটি যজ্ঞের আয়োজন করা হবে। কিন্তু সেই যজ্ঞ থেকে উঠে আসবে আপনার দুই ছেলে এবং মেয়ে। সমস্ত পৃথিবী জানবে তারা আমার সন্তান। আপনাকে এবং ওদের মাকে সমস্ত কথা ভুলে যেতে হবে। ধরে নিন পাঞ্চাল রাজ্যের প্রতি এ আপনাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য”।
 যাজ বুঝলেন মহারাজা সব রকম আঁটঘাঁট বেঁধেই এসেছেন। অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। তিনি শুধু বললেন, “আমার কয়েকটা দিন সময় চাই। ভাববার জন্যও। ইরার সঙ্গে কথা বলার জন্যও”।
“হে ঋষি, সময় বড়ই কম। আপনি এখনই আলোচনা করুন। তারপর বাকি ব্যবস্থা করতেও যথেষ্ট সময় লাগবে। কিভাবে সবার সামনে ওদের হঠাৎই নিয়ে আসা হবে, তা নিয়ে ভাবতে হবে। ওদেরকেও সবটা জানাতে হবে। আমি কারুর অসম্মতিতে এই কাজ করতে চাই না। আমার মহিষীকেও আমি সব বলে রাজি করিয়েছি। আপনিও সব বলুন। রাজি করান। দেখুন, কী অসম্ভব দৈব ইঙ্গিত কাজ করছে! আমি যেমন চাই, তেমন ভাবে আপনিই তৈরি হয়েছে ওই বালকবালিকা। তার ওপর আপনার কাছে পড়াশোনা শিখেছে। ফলে নগরের ভাষার সঙ্গে, শাস্ত্রীয় ভাষার সঙ্গেও ওদের পরিচয় আছে। এ কী দুরন্ত যোগাযোগ”!
“কিন্তু মহারাজ, আপনি ওদের বলছেন কেন? কন্যাটিকে আপনার এই পরিকল্পনার কোথায় প্রয়োজন”?
“প্রয়োজন। অসম্ভব প্রয়োজন। ওর রূপ আর গুণের কথা যা শুনেছি, আজ এখানে ওদের মাকে দেখে আমার অভিজ্ঞ চোখ  মন বলছে এ মেয়ে বড় সোজা হবে না। ও হবে আমার আরেক শাণিত অস্ত্র। আপনি আমাকে ফেরাবেন না। এ সব কিছুই দৈবনির্দিষ্ট। আমি কথা দিচ্ছি, ওরা ভালো থাকবে”।
“আপনি তো যুদ্ধের কথা ভেবে চাইছেন ওদের। ভালো থাকবে কি করে”?
“ওদের যেতে দিন ঋষি। এখানেও বা কী ভালো থাকবে ওরা! আমি আপনি না থাকলে এই বিরাট পৃথিবীতে অনাথ, বনেই জঙ্গলে বেড়ে ওঠা দুজনকে কে দেখবে? বরং এই ভালো। নিজের দেশের জন্য, নিজের রাজার জন্য যদি কোনও কাজ করতে পারে, ভালোই তো। আপনারা ভেবে নিন। আমার ছেলেমেয়েকে বোঝানোর দায়িত্ব আমার”।
 ইরা যে কখন বাইরে এসে দাঁড়িয়ে সব কথা শুনেছে, দুজনের কেউই খেয়াল করেন নি। ওর দৃঢ় কন্ঠস্বর শুনে চমকে উঠলেন দুজনে। যাজ বললেন, “ঠিক আছে মহারাজ। ওদের মা যখন রাজি, তখন…..। তবে একটা কথা, আপনি যা জানলেন, তা যেন গোপন থাকে”।
“নিশ্চিন্ত থাকুন ঋষি। নিজের স্বার্থেই তো আমাকে এখানকার কথা পুরোপুরি গোপন রাখতেই হবে। আমাকে বরং আপনি পুত্রযজ্ঞের সমস্ত উপকরণ বলে দিন। আর একটি দিন স্থির করে দিন যজ্ঞের। আমি সেই সব ব্যবস্থা করে আবার আসব। ততদিন আপনারা ধৃষ্টদ্যুম্ন আর দ্রৌপদীকে সব বুঝিয়ে দিন। আর এই নামে দুজনকে অভ্যাস করিয়ে রাখুন। আমি কাল এসে উপকরণের তালিকা নিয়ে যাব”। এই বলে দ্রুপদ যাজকে নমস্কার করে, ইরার দিকে একবার তাকিয়ে ঘোড়ায় চড়ে বেরিয়ে গেলেন। তিনি আজ ভয়ানক উত্তেজিত। তাঁর স্বপ্ন আস্তে আস্তে সাকার রূপ ধারণ করছে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত