| 19 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক

ইরাবতী ধারাবাহিক: একাকিনী (পর্ব-১০) । রোহিণী ধর্মপাল

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট
দ্রৌপদীর অনেক সময়েই মনে হয়েছে অর্জুন তাঁকে ততখানি ভালোবাসেন না।  তা নয়ত যে অর্জুন দাদা যুধিষ্ঠিরের সব কথা নত মস্তকে মেনে নিতেন, সেই অর্জুন কাতর অনুনয় অগ্রাহ্য করেই তো বারো বছরের জন্য দ্রৌপদীকে একা রেখে চলে গেলেন! একাই। দ্রৌপদীর তাই মনে হতো। কত স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। যুধিষ্ঠির আর ভীমের সঙ্গে দুটি বছর পার করে তৃতীয় বছরে যখন অর্জুনকে পাবেন! নিবিড় করে! সেই ভাবনাতেই যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে কাটানো দিনগুলি যেন হু হু করে পার করে ফেলছিলেন তিনি। অথচ সেই স্বপ্ন গড়ে ওঠার আগেই হুড়মুড়িয়ে ভেঙে গেল!
একথা সর্বাংশে সত্যি, যে দ্রৌপদী নিজেও না চাইলে তাঁকে জোর করে পঞ্চপাণ্ডবের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া অসম্ভব ছিল। যে ব্যক্তিত্বময়ী মেয়ে সভার মধ্যে, হাজার লোকের সামনে নিজের মনের অনিচ্ছা জানাতে এতটুকু দ্বিধা করেন নি, তিনি নিজের বাবা-মার কাছে নিজের আপত্তির কথা জানাতে কেন লজ্জা পাবেন? যুধিষ্ঠির যখন দ্রুপদকে জানালেন, “দ্রৌপদীকে আমরা পাঁচ ভাই বিয়ে করব। আপনি আয়োজন করুন”– দ্রুপদ আকাশ থেকে পড়েছিলেন। “এ আবার কেমন অসৈরণ কথাবার্তা তোমার যুধিষ্ঠির! পাঁচ ভাইয়ের এক স্ত্রী! লোকে কী বলবে”!! যুধিষ্ঠির তাঁকে বোঝালেন। উদাহরণ দিলেন। জটিলা নামে গৌতমবংশের এক মেয়ের সাত জন স্বামী ছিল। বার্ক্ষী নামে এক মেয়ের প্রচেতা নামের দশ ভাইকে এক সঙ্গে বিয়ে করেন। তাছাড়া, যুধিষ্ঠির আরও বললেন,  “মমাপি দারসম্বন্ধঃ কার্য্যস্তাবদ্বিশাংপতে, আমি তো বড়। আমাকেও তো বিয়ে করতে হবে! অর্জুন শর্ত পূরণ করেছে ঠিকই। কিন্তু ওর আগে তো আমি আর ভীম আছি”। বাবার থেকে এই সব খুঁটিনাটি জেনেছিলেন কৃষ্ণা। যে মেয়ে জন্ম থেকেই জানেন আসন্ন এক মহাযুদ্ধের কথা, যে মেয়ে শুধুই রূপের ঠমকে নয়, গুণের চমকেও অসামান্য,  বিয়ের আগে-পরে সদাই নিজের স্বাতন্ত্র আর তেজস্বীতা বজায় রেখেছেন; তিনি নিশ্চিত ভাবেই সব রকমের আলোচনার খোঁজ রাখছিলেন। বিশেষ করে যেখানে তাঁর নিজের জীবন জড়িত। শুধু একটা বিষয়ে শুনে পরে আপনমনে হাসতেন তিনি। তাঁর প্রতি যুধিষ্ঠিরের লোভ যে সবচেয়ে বেশি ছিল, সারা জীবন ধরে তা বুঝেছিলেন তিনি। সেই প্রথম দেখা থেকেই। তাঁর দিকে তাকানো দেখে। বাবার সঙ্গে কথা বলার ধরণে। দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভায় আসার আগেই হিড়িম্বার সঙ্গে ভীমের মিলন ঘটে। হিড়িম্বা সরাসরি ভীমকেই চেয়েছিলেন। কিন্তু তখন তো এই বড়ভাই অবিবাহিত, এই কথাটি যুধিষ্ঠির তোলেন নি! কথাটি উঠল তখনই, যখন দ্রুপদ অর্জুনের সঙ্গে দ্রৌপদীর বিয়ের কথাটি পাড়লেন! 
যদিও দ্রুপদ তো শুরুতে একটু থতমত হয়ে গেছিলেন। ভাবলেন, তবে বুঝি যুধিষ্ঠির একাই বিয়ে করতে চাইছে কৃষ্ণাকে। কারণ তিনি তো কল্পনাই করতে পারেন নি পাঁচ ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব আসতে চলেছে। কিন্তু যুধিষ্ঠির এতবড় অন্যায়টাও তো হতে দিতে পারেন না, অর্জুকে বাদ দিয়ে তো বিয়ে করতে পারেন না ! কারণ যতোই হোক, নীতিগতভাবে দ্রৌপদীকে বিয়ের অধিকার একমাত্র অর্জুনের। সেই অধিকার তো কেড়ে নেওয়া যাবে না। আর ভীম, নকুল, সহদেবও তো ততদিনে দ্রৌপদীতে মুগ্ধ! এই মুগ্ধতা আরও বেড়েছে একসঙ্গে থাকার ফলেও। বিয়ের কথাবার্তা শুরু হওয়ার আগেই দ্রৌপদী দ্রুপদের ইচ্ছে অনুসারে তাঁরই নির্দেশে কুন্তী ও পঞ্চপাণ্ডবের সঙ্গে এক প্রাসাদে বেশ কিছুদিন থাকেন। এই কয়েকদিনে নিজের মন আর ভাইদের মন আরও ভালো করে বুঝেছেন যুধিষ্ঠির। বুঝেছেন এ ছাড়া উপায় নেই। দ্রৌপদীকে তাঁরা পাঁচজনই চান। এও বুঝতে যুধিষ্ঠিরের অসুবিধে হয় নি যে দ্রৌপদীর নিজের বিশেষ আপত্তি নেই। থাকলে তিনি এইভাবে এক প্রাসাদে পাঁচ ভাইয়ের সঙ্গে থাকতেও রাজি হতেন না। আর দ্রৌপদীরূপ সুতোতেই পাঁচজন বাঁধা থাকবেন সানন্দে। সত্যি বলতে কী, যুধিষ্ঠির এইখানে দুর্দান্ত ভবিষ্যত পরিকল্পনা করেছিলেন। যিনি যুদ্ধে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারেন বলে যুধিষ্ঠির, তিনি তো সব ক্ষেত্রেই মাথা মন শান্ত রেখে ভেবে চিন্তে কাজ করবেন। যুধিষ্ঠির জানতেন তাঁরা পাঁচে মিলে এক। পাঁচে মিলে অপ্রতিরোধ্য। তাঁদের মধ্যে ভেদ বাড়ানোর চেষ্টা শত্রুপক্ষ করবেই। রণনীতির মধ্যে ভেদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু পাঁচ ভাই যদি একটি নারীকে ভালোবাসে আর তার ছায়া পায়, তবে তাদের মধ্যে ভাঙন ধরানো অসম্ভব। দ্রৌপদীর সঙ্গে বিয়ের ফলে পাঞ্চালদের সঙ্গে পাণ্ডবদের বন্ধুত্ব দুর্যোধনকে রীতিমত চিন্তিত করেছিল। যাদের পুড়িয়ে মারা হয়েছে বলে নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন দুর্যোধনেররা, তাঁরা শুধু ফিরে এলেন না, যাকে বলে মহা ধূমধামসহ ফিরলেন। নিজেদের শক্তি বাড়িয়ে। এবার আরও শক্তি বাড়ানোর আগেই আবার আক্রমণ করা হোক। দুর্যোধনের কুটিল মাথা থেকে পরামর্শ এল, “দ্রৌপদীকে কেন্দ্র করে পাণ্ডবদের মনে ভেদভাব তৈরি করা হোক। বা পাণ্ডবদের প্রতি দ্রৌপদীর মনে    খারাপ ধারণা তৈরি করা হোক। সুন্দরী মেয়েদের এনে পাঁচ ভাইয়ের মাথা ঘুরিয়ে দাও। নিজেরা লড়ে মরুক। দ্রৌপদীর মন থেকে পাণ্ডবদের প্রতি ভালোবাসা শ্রদ্ধা চলে গেলে বাকি কাজটুকু অনায়াস হয়ে যাবে। তখন বরং দ্রৌপদীকে আমরাই তুলব!” কর্ণ তখন প্রত্যুত্তর করেছিলেন, এক স্ত্রীতে আসক্ত পুরুষদের মধ্যে আপনি পারস্পরিক ভেদ আনতে পারবেন না মহারাজ দুর্যোধন। আর দ্রৌপদীকেও আপনি পাণ্ডবদের প্রতি কোনও ভাবেই রাগিয়ে তুলতে পারবেন না। কারণ প্রথমত দ্রৌপদী নিঃস্ব ব্রাহ্মণ জেনেই অর্জুনকে বিয়ে করেছে। লক্ষ্যভেদ করা মানুষটি যে অর্জুন, তা জানার পর, যুধিষ্ঠিরদের পরিচয় জানার পর তার মনে তো অনুরাগ আরোই বাড়বে। তার ওপর এমন পাঁচ পাঁচটি স্বামী! দ্রৌপদী আর অন্য কোনও পুরুষে আসক্ত হবেই না! সুতরাং এইভাবে আপনি পাণ্ডবদের ক্ষতি করতে পারবেন না”। ঠিক এমনটা ভেবেও যুধিষ্ঠির দ্রুপদকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন।

আরো পড়ুন: একাকিনী (পর্ব-৯) । রোহিণী ধর্মপাল


এর পরেও দ্রুপদ আমতা আমতা করছিলেন। ধৃষ্টদ্যুম্ন পর্যন্ত এমন অদ্ভুত বিয়ে মেনে নিতে পারছিলেন না। এরপর আসরে নামলেন ব্যাস। তিনি দ্রৌপদীর পূর্ব জন্মের একটি গল্প বললেন, যা তিনি আগেই যুধিষ্ঠিরকেও বলেছিলেন। দ্রৌপদী নাকি আগের জন্মে রূপবতী এক ঋষি কন্যা ছিলেন, তবুও উপযুক্ত স্বামী পাচ্ছিলেন না। তখন তিনি শিবের তপস্যা করেন আর বর প্রার্থনা করার সময় একই কথা পাঁচ বার বলে ফেলেন — “আমি যেন সর্বগুণসম্পনন্ন স্বামী পাই”। সেই পাঁচবার বলার জন্যই মহাদেব বলেন, “তোমার পাঁচ জন স্বামী হবে”। 
দ্রৌপদী শুনেছিলেন ব্যাসের যুক্তি। ব্যাসের কৌশল। এমন গল্প শোনার পর দ্রুপদের আর কোনও আপত্তিই টিঁকল না। মহা আড়ম্বরে পাঁচ দিনে পাঁচ ভাইয়ের সঙ্গে দ্রৌপদীর বিয়ে হয়ে গেল।
শেষ পর্যন্ত ব্যাসই দিন ঠিক করে দিলেন এবং বলে দিলেন সবার আগে যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীর পাণিগ্রহণ করবেন। 
দ্রৌপদীর বিয়েতে সকল রাজ্যবাসী নেমন্তন্ন পেলেন। বড় বড় মানুষের সঙ্গে সাধারণ মানুষও। ব্যাস যেদিন এলেন, সেদিনই বিয়ে শুরু হবে। তাই রাজপ্রাসাদে ছোটাছুটি আরম্ভ হয়ে গেল। যেখানে বিয়ের মণ্ডপ হবে, সেই বিরাট খোলা জায়গাটি ঘিরে সাজানো হল গোলাপী আর নীল পদ্ম দিয়ে। রত্ন দিয়ে গাঁথা মালা চারিদিকে ঝুলিয়ে দেওয়া হল। নিমন্ত্রিত লোকজন সবাই সেজেগুজে আতর মেখে ঝলমল করতে করতে অপেক্ষা করছিল কখন বিয়ে শুরু হবে। সব মিলিয়ে দ্রুপদ রাজার বাড়ি দেখাচ্ছিল যেন নভো যথা নির্ম্মলতারকাণ্বিতম্, তারাভরা আকাশের মতোই জ্বলজ্বলে।
দ্রৌপদী ভেবেছিলেন প্রথম বিয়েটি হবে অর্জুনের সঙ্গে। আর তাঁর সঙ্গেই প্রথম বছরটি কাটাবেন তিনি। কিন্তু তা হল না। তাই মনটা তাঁর প্রথম থেকেই খারাপ হয়ে গেল। যদিও তিনিও তো সত্যিই কোনও আপত্তি জানাননি পাঁচ ভাইয়ের বধূ হতে! সুতরাং এখন তো আর কিছু করারও নেই। মনে কষ্ট নিয়েও তিনি শৃঙ্গার করতে বসলেন। পরণে জড়ালেন একটি আগুন রঙা বস্ত্র। লাল চুণীর অলঙ্কার। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল আগুনের লেলিহান শিখা। খুব যত্ন করে তাঁর কপালে দুই ভুরুর মাঝে লাল টিপ এঁকে তার চারপাশে লবঙ্গ দিয়ে চন্দন পরানো হল। মস্ত চুলের বোঝাটি শোকানো হল সুরভিত ধূপের ধোঁয়ায়। সেই কেশরাশি পাকিয়ে পাকিয়ে বাঁধা হল দীর্ঘ এক সর্পিল বেণী। তার মাঝে মাঝে গুঁজে দেওয়া হল হীরে লাগানো সোনার কাঁটা। সব শেষে গলায় দেওয়া হল জুঁইফুলের গোড়ের মালা।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত