তৃতীয় বর্ষপূর্তি সংখ্যা গল্প: বেলা অ-বেলার গান । রাজীব কুমার ঘোষ
“হ্যালো, ফাঁকা আছিস? কথা বলা যাবে?”
“আছি। কিন্তু কথা বলা যাবে শর্তসাপেক্ষে।”
“অ্যাঁ! কী বললি!!”
“বললাম কথা বলা যাবে শর্তসাপেক্ষে।”
“খিস্তিটা পরে দিচ্ছি, আগে শর্তগুলো শুনে নিই। বল।”
“প্রথম শর্ত, কারো মরার খবর দিতে পারবি না।”
“কেন?”
“কারণ আমি শুনতে চাই না।”
“যে মরেছে সে যদি তোর খুব চেনা কেউ হয়?”
“তাহলে আরো চাই না। গুরু বলেছে সাত সকালে খারাপ খবর শুনবে না।”
“যাঃচ্চলে! তুই আবার কবে দীক্ষা নিলি? তুই তো ‘কালমা’ সাহেবের চ্যালা ছিলিস।”
“দীক্ষা নিইনি, শালির সূত্রে পাওয়া আমার অন লাইন হ্যাপিনেস ম্যানেজমেন্টের গুরু বলেছে আর ‘কালমা’ সাহেব এখন ব্যাক ডেটেট, অচল।”
“হ্যাপিনেস ম্যানেজমেন্ট গুরু! মানে ওই ছাগলটা! যে বলেছিল সরকারি স্কুলগুলো তুলে দেওয়া উচিত? ওটা তো পাঁড়েজির ছাগল যার এক হাত দাঁড়ি রে! তোর এবার শ্যামলালেরর দশা হবে, গুঁতোতে গুঁতোতে খানায় ফেলে দেবে।”
“যা খুশি বল আমি কারো মরার খবর শুনব না।”
“আমি মরে গেলেও আমার মরার খবর শুনবি না?”
“না শুনব না। তুই কে? আমার অস্তিত্ব আছে, তাই আমার মনে তুই আছিস। তুই মরলে আমার অস্তিত্ব তো আর হারিয়ে যাবে না। সুতরাং তোর বাঁচা মরার ওপর আমার কোনো নির্ভরশীলতা নেই।”
“হ্যাঁ, তা তো বটেই। ফাইনালে অর্গানিক কেমিস্ট্রিটা আমার খাতা থেকে ঝাড়ার সময় তোর এই বোধ কোথায় ছিল?”
“তখন আমি নির্বোধ ছিলাম।”
“এখন তুই শ্যামলাল। বেশ যদি তাই হয় তাহলে তুই কেন মরার খবর শুনবি না? তোর তো কিছুই এসে যায় না। তাহলে শুনলেই বা কী হবে?”
“বিচ্ছিরি হবে, আমিও যে মরতে পারি সেটা মনে পড়ে যাবে।”
“তুই কি অমর নাকি?”
“মরার খবর শুনলে আয়ু কমে যাবে। পজিটিভ তরঙ্গে মনকে রাখতে হবে। আমি সুখী তো জগৎ সুখী।”
“ওহে শ্যামলাল, তোমার দ্বিতীয় শর্ত শুনি।”
“ব্যঙ্গ করছিস? কর, আমি এখন এসবের ঊর্ধে। রোজ এখন আমি এবেলা ওবেলা চার ঘন্টা করে ধ্যান করি। ঈড়া, পিঙ্গলা সব এখন আমার হাতের মুঠোয়। আমার দ্বিতীয় শর্ত হল, কারো করোনা হয়েছে বা কোথাও ভর্তি হয়েছে এসব খবর দিতে পারবি না।”
“তার মানে আমার করোনা হলে আমি তোকে সাহায্যের জন্য ফোন করতে পারবো না? তোর চেনা জানা কারো টাকা পয়সার দরকার হলে ফোন করবে না?”
“করলে দেখা যাবে, কিন্তু তুই কোনো খবর দিবি না। যতটা নেগেটিভ খবর কমানো যায়। কমালেই মনের জোর বাড়বে।”
“মনের জোর বাড়িয়ে কী করবি?”
“কেন বেঁচে থাকব। আবার কী। বেঁচে থাকাটাই এখন সবচেয়ে বড় কাজ। আমরা দেশের সম্পদ, আমরা মরে গেলে দেশের ক্ষতি, অর্থনীতির কতো ক্ষতি।”
“আর যারা ছোটাছুটি করে লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সাহায্য করছে, তারা? তারা দেশের সম্পদ নয়?”
“ওরা মূর্খ। এসব সরকারের কাজ। এসব করার জন্য ডাক্তার, নার্স, মিউনিসিপ্যালিটির লোকজন আছে। এর জন্য মাইনে পায়। তাছাড়া ওরা স্পেশালিস্ট। যার কাজ তার করাই ভালো। তাছাড়া যা হবে, তা হবে, কেউ রোধ করতে পারবে না। সবই প্রভুর ইচ্ছা।”
“তোর বাড়িতে এখনো হ্যারিকেন-ট্যারিকেন আছে?”
“না নেই। কেন বল তো?”
“থাকলে ভালো হত, কেরোসিন ঢেলে জ্বালিয়ে দিতাম, দেশের আপদ বিদেয় হতো। এখন দামী এল পি জি খরচ করতে হবে।”
“দেখছিস এই মরার খবর, রোগের খবর শুনতে শুনতে তুই কতটা সহিংস হয়ে উঠেছিস, তুই হত্যার কথা ভাবছিস?”
“হ্যাঁ ভাবছি, আর তোরও বোধহয় আত্মহত্যার কথা ভাবা উচিত।”
“কেন ভাবব? আমি আছি তাই দুনিয়া আছে। এই দুনিয়া আমার ভোগের জন্য। এই দ্যাখ সবাই ছোটাছুটি করছে অক্সিজেন সিলিন্ডার, অক্সিজেন কনসেনট্রেটরের জন্য আর আমি দু’টোই বাগিয়ে বসে আছি। যার পকেটে মাল, তার ফুসফুসে অক্সিজেন।”
“তোকে এক সপ্তাহ আগে ফোন করেছিলাম, তখনো তো ঠিক ছিলিস। কী হলো তোর এক সপ্তাহে? পাগল-টাগল হয়ে গেছিস নাকি?”
“স্বাভাবিক হয়েছি বল। দাদাঠাকুর সেই কবে প্রশ্নেই উত্তর দিয়ে গেছেন। দুনিয়াটা কার বশে? দুনিয়া ‘টাকার’ বশে। ভারতের বেশিরভাগ বড়লোক, ফ্লিম স্টারগুলো দ্যাখ বাইরের দেশে গিয়ে বসে আছে। জানে এখানে হাসপাতালে ভিড়, টীকা পাবে কি পাবে না। অনেকে আবার প্রাইভেট জেটেই হাওয়া হয়ে গেছে। নামগুলো বলব? শুনবি?”
“না থাক। তুই গেলি না কেন?”
“কে বলল যাব না? ফ্লাইট ম্যানেজ করার চেষ্টা করছি। করোনার সময় আবার বেশি চার্জ। সে নিক। ম্যানেজ করতে পারলেই যাব। এবার আমার তৃতীয় শর্ত শোন।”
“থাক। আর শুনে কাজ নেই, বৌ আছে? বৌকে ফোনটা একবার দে।”
“কেন? খারাপ খবর কিছু আছে নাকি? এই একদম কোনো খারাপ খবর দিবি না। দিলে তোকে বরাবরের মতো ব্ল্যাক লিস্ট করে দেব।”
“আমিই তোকে ব্ল্যাক লিস্ট করে দেব। দে অর্চনাকে ফোনটা দে।”
“দিচ্ছি। কথা বল। আমি একটু বাথরুম ঘুরে আসি। তবে রেখে দিস না, তিন নং শর্তটা শোনাব।”
“হ্যালো।”
“কে অর্চনা? সোমেনের কী হয়েছে বলো তো? উল্টো পাল্টা বকছে।”
“আর বলবেন না, মাথা খারাপ হয়ে গেছে। হাই ব্লাড প্রেসার তার ওপর সুগার – কো মর্বিডিটির চূড়ান্ত, এই নিয়েই রোজ বেরোচ্ছে। পাড়ায় কার অক্সিজেন সিলিন্ডার দরকার, কোন করোনা বাড়িতে বাজার পৌঁছে দিতে হবে, কোথায় ওষুধ। একটা কিছু যদি হয়ে যায়, আমার কী হবে বলুন তো? আর সারা দিন ফোন আর ফোন। ফোনে কীসব গ্রুপ বানিয়েছে। কেবল একে ওকে ফোন, কাকে ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিচ্ছে, কাকে আবার অক্সিজেন সিলিন্ডারের খোঁজ, কার রক্ত চাই। আগের সপ্তাহে কোথায় আবার টাকা দিল একটা অক্সিজেন সিলিন্ডার আর অক্সিজেন কনসেনন্ট্রেটর কেনার জন্য। আপনি বলুন দাদা, টাকা দিচ্ছে, কিনে দিচ্ছে, অনেক তো করছে — করুক কিন্তু নিজে বেরোচ্ছে কেন? নিজে সংক্রমিত হলে কী হবে বলুন তো! আপনি একটু বুঝিয়ে বলুন না। এই যে এসেছে, একটু বলুন তো।”
“কীরে বৌকে আবার কী চুকলি করলি? কী বলবি বল।”
“বলব, আগে তোর তিন নং শর্তটা শুনি।”
“তিন নং শর্তটা হচ্ছে, ডোনেশন-টোনেশন চাইতে পারবি না। ডোনেশন চাইবি মানেই শুনতে হবে কারা চিকিৎসা পাচ্ছে না, খেতে পাচ্ছে না আরো কত খারাপ খারাপ খবর। তাছাড়া এখন টাকা ইনভেস্ট করা উচিত। সবার ফিউচার অনিশ্চিত হয়ে উঠছে। ব্যাংকের ইন্টারেস্ট ইনফ্লেশন রেটের নিচে চলে গেছে। বুঝে শুনে টাকা ইনভেস্ট না করলে বিপদ আছে। তাছাড়া লোকের জন্য ডোনেশন দেব তারপর আমার কিছু হলে আমার বৌ টাকার জন্য দোরে দোরে ঘুরবে? শুনছিস তো লোকের লাখ লাখ টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে।”
“ডোনেশন দেওয়া যাবে না, এটাও তোর গুরু বলেছে নাকি?”
“বলেছে বৈকি। ইউ টিউব লিঙ্ক পাঠাব দেখে নিবি। এবার স্পিরিচ্যুয়ালিটির দিকে একটু মন দে। গুরু বলেছে, ডোনেশন দেওয়া মানেই মানুষকে অপমান করা। তার ক্ষমতাকে অস্বীকার করা। বিনা চেষ্টায় মানুষ যদি সব পেয়ে যায় তাহলে তা একেবারেই ঠিক নয়। এবার বল কী বলবি।”
“আমার একাউন্টে আপাতত খান কুড়ি হাজার টাকা পাঠিয়ে দে।”
“এই যে বললাম, ডোনেশনের কথা বলবি না! আগের বার তো আমফানের জন্য একগাদা টাকা নিলি।”
“এটা ডোনেশন নয়, হ্যাপিনেস ইনভেস্টমেন্ট।”
“সেটা আবার কী!”
“বলছি। এই কুড়ি হাজারের বিনিময়ে দিন সাতেকের পরে আমি ফোন করে তোকে ভালো ভালো খবর শোনাব। তোকে তো খারাপ খবর বলা যাবে না। আর ভালো খবরের এখন আকাল, তাই তোকে খরচের বিনিময়ে আমি ভালো ভালো খবর শোনাব।”
“কী রকম? কী রকম?”
“এই ধর মরতে মরতে বেঁচে যাওয়া কোনো লোকের গল্প। আর বাঁচানোর খরচা তো হবেই।”
“তা তো হবেই, তা তো হবেই। বেঁচে থাকার ভালো খবরের জন্য খরচা তো আছেই। বলছি কুড়িতে হবে, না আরো কিছু দেব?”
“থাক এখন, তোকে তো প্রতি সপ্তাহেই ভালো খবর শোনাতে হবে। সামনের সপ্তাহে নাহয় আবার ইনভেস্ট করবি। সিপ স্টাইল বুঝলি না? ওতে বেনিফিট বেশি পাবি।”
“বুঝেছি। পাঠিয়ে দিচ্ছি আধা ঘন্টার মধ্যে। আমার কিন্তু ভালো ভালো খবর চাই। এই রাখছি এখন। অন্য ফোনটায় ফোন আসছে।”
“দাঁড়া দাঁড়া। তোর ওই ফোনটার রিং টোন ‘বেলা চাও’ না? তাই তো শুনছি মনে হচ্ছে।”
“হ্যাঁ, ওটাই।”
“ও পার্তিজানো পোরতামি ভিয়া? পার্টিজান আমাকে নিয়ে যাও? তা এ তোর কোন গুরুর জপমন্ত্র রে?”
ফোনের রিং টোন তখন প্রবল হয়ে উঠেছে, … এ সেইউ মুইও দা পার্তিজানো, তুমি দেভি সেপেলির।
‘আর যদি আমি মারা যাই পার্টিজান হয়ে, তুমি এসে আমাকে কবর দিয়ে দিও।’
জন্ম ১৯৭৭, পড়াশোনা, বেড়ে ওঠা চুঁচুড়া, হুগলি, চন্দননগর। ১৯৯৭ সাল থেকে নিয়মিত লেখালেখি। সম্পাদিত লিটল ম্যাগাজিন ‘সাইন্যাপস্ পত্রিকা’। আছে বেশ কিছু কবিতার বই ‘৩৫৮ বড়বাজার’, ‘চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হস্পিটাল’, ‘বিরাশি মাইল’, ‘অপূর্ব্ব কবিতাগুচ্ছ’ ও আরো কয়েকটি। এখনো পর্যন্ত গল্প সংকলন দুটি ‘ঘর ও দরজার গল্প’ (২০১৬) ও ‘অনেক জলের শব্দ’ (২০১৮)। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গল্প হল ‘সহদেববাবুর ঘোড়া’, ‘ভীষ্মদেবের মৃত্যুমুহূর্ত’, ‘অনেক জলের শব্দ’, ‘টাওয়ার অফ্ সাইলেন্স’, ‘হিবাকুশার ছেলে’, ‘শুভঙ্কর বলে কেউ নেই’। পেশায় বিজ্ঞান শিক্ষক। নেশায় পাঠক। প্রিয় অবকাশযাপন পাঁচশো বছরের পুরনো জনপদের অলিগলিতে সময়ের ভাঁজে ভাঁজে ঘুরে বেড়ানো। উল্লেখযোগ্য স্বীকৃতি চন্দননগর গল্পমেলা কর্তৃক ‘অনাদি স্মারক সম্মান ২০১৯’।