ধারাবাহিক: রাণীয়ার রান্নাঘর (পর্ব-১৫) । ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়
বিদেশের মাটিতে গোটাসেদ্ধ
বড় মেয়ে মিঠির এখন রান্নার বাই চেপেছে ।দিনকতক নিজের হাতে রেঁধে খাওয়ার খুব শখ হয়েছে তার। আবার ক্ষান্ত দেয় কর্পোরেট প্রেসার নিতে নিতে আর তারপর স্ট্রেশ কমাতে রাঁধতে বসে। ব্যাঙ্গালোর থেকে যখন তখন সে ফোন করে মা’কে। বোন কে। ছোটো বোন রাণীয়াও কম নয়। সেও আজকাল পেন্ডুলামের দৌলতে সুদূর বাংলার রান্নায় মজে রয়েছে। হঠাত ফোনকল, যখনতখন ভিডিও কল পোষায় না তার … তবে তার টাইমজোন আলাদা। এই যা রক্ষে। এই তো সেদিন মায়ের কাছ থেকে জেনে নিয়ে কুমড়োর ছক্কা আর লুচি করেছিল। কুশলের সে কী পরিতৃপ্তি চোখেমুখে।
অনসূয়া বললেন, হ্যাঁ রে মিষ্টি কুমড়ো পেলি ওখানে? তোর লুচি ফুলেছিল?
রাণীয়া বলল, হ্যাঁ। একর্ণ স্কোয়াশ। এক্কেবারে কুমড়োর স্বাদ। দানাগুলো শুকিয়ে রেখেছিলাম। আমার বাগানে ছড়িয়ে দিতেই গাছ বেরিয়েছে ঠিক কুমড়ো লতার মতোই।
অনসূয়া ভাবেন, সত্যিই লক্ষ্মী মেয়ে। কিছুই ফেলেনা।
আর লুচি?
হ্যাঁ গো হ্যাঁ। তোমার কর্পোরেট মেয়ের মত ট্যারা বেঁকা লুচি হয়নি আমার আর তোমার মত ফুলো ফুলো গোলও হয়নি প্রত্যেকটা। তবে লুচিই হয়েছে সবকটা।
দুই বোনের মধ্যে যেন কোথাও একটু বেসুর, বেতাল। চিড় খাওয়া একটা সম্পর্কের টানাপোড়েন। অনসূয়া ভাবেন তিনি মা। দুয়ের মধ্যে সব চিড়টুকু তিনি সারাই করে দেবেন একদিন।
সেদিন রাতদুপুরে হঠাত রাণীয়ার ফোন।
মা, গোটার ডাল কখন যেন বানাতে তুমি?
অনসূয়া চমকে ওঠেন অসময়ে মেয়ের ফোন এলে। আবার রান্নার কথা শুনলেই মন শান্ত হয়। উফফ! পারে বটে এই মেয়েটা। হ্যাঁ গোটার ডাল ষষ্ঠী ছাড়াও বানানো যায়।
মায়ের মুখের কথাগুলো কেড়ে নিয়ে রাণীয়া বলে, শীতকালে বানাতে না?
আমাকে বলতে দে। শীতের শেষে। মাঘ মাসে। সরস্বতী পুজোর পরদিন।
কী যেন একটা বলে না? মেয়ের আবারও প্রশ্ন।
হ্যাঁ, গোটা ষষ্ঠী।
খুব মিস করি মা ওই ডাল টা আমি এখানে।
তা বানিয়েই খেয়ে ফেল না একদিন। তাহলেই সব ঝামেলা মিটে যাবে।
সবসময় বানানো যায়?
অফকোর্স। কেউ দিব্যি দিয়েছে? তোমরা দুই বোন যা সব ফ্যামিলি প্ল্যানিংয়ের চক্কোরে পড়েছ এখন তাতে আগেভাগে গোটার ডাল বানিয়ে খেলে যদি মা ষষ্ঠী একটু সদয় হন তোমাদের ওপর। তাহলেও বাঁচতাম আমি। মা হাসতে হাসতে বলেন।
রাণীয়া সেসব হেঁয়ালি বুঝতে পারেনা। বলে শিগগীর লিখে পাঠাও হোয়াটস্যাপে। আর হ্যাঁ। শুধু রেসিপি নয় কিন্তু। সঙ্গে ছোটোখাটো পার্সোনাল টাচ তোমার।
অনসূয়া একলাটি থাকেন। ছোটো মেয়ের এই ছোটোখাটো অনুরোধগুলো রাখতেও মন্দ লাগেনা তাঁর।
এদিকে পেন্ডুলাম তার সময় মত ঠিক দুলে ওঠে। এদিক থেকে ওদিক। রাণীয়া বলতে শুরু করে। তার পেন্ডুলাম ভ্লগে।
আরো পড়ুন: রাণীয়ার রান্নাঘর (পর্ব-১৪) । ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়
বারোমাসেই রাঁধুন গোটার ডাল। পুষ্টিতে ভরপুর, স্বাস্থ্যসম্মত এক ডাল। গ্লোবালাইজেশনের দৌলতে, গ্যাস্ট্রোনমির কেমিস্ট্রি বদলানোর আগেভাগে আমরা কিছুতেই হারিয়ে যেতে দেবো না বাংলার হারানো সংস্কৃতি, হারিয়ে যাওয়া রেসিপি। তাই আজ বলব গোটা সেদ্ধ নিয়ে। ডাল আমাদের বাংলার স্টেপল ফুড। প্রোটিনে ভরপুর কিন্তু তা যদি হয় গোটার ডাল? এই ভিডিও টি সম্পূর্ণ দেখবেন। আমাদের নিউট্রিশানিস্ট কী বললেন এই ডাল নিয়ে তাও শুনতে থাকুন। বারোমাসই রাঁধা যায় পুষ্টিতে ভরপুর, সুপাচ্য, সুস্বাদু এই গোটার ডাল। কমপ্লিট ফুড একটা। এদেশে শীতকাল আমাদের কেমন যেন একটু অলস করে দেয়। আমার দেশেও বিশেষতঃ বৃদ্ধরা যেন এইসময় আরো জরাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। শীতল ষষ্ঠী বা গোটা ষষ্ঠীর ব্রতের কাহিনীতে সংসারের কর্ত্রী এক বৃদ্ধা মাঘমসেও গরম ভাত খেতে চান আর উষ্ণজলে স্নান করতে চান। তার ফলে তাঁর বিপদ আসে। আর ধর্মভীরু মানুষকে এই কাহিনী শুনিয়ে বলতে হয়, বসন্ত এসে গেছে, এবার শীতকে বিদায় জানাও। গরম জামাকাপড় বাক্সে ভরো। ঠান্ডা জলে স্নান করো। শরীর ঠান্ডা রাখো নয়ত রোগভোগ হবে। এখন গরম খেলে, গরম পড়লে রোগের প্রকোপ বাড়বেই। তাই ঠান্ডা খাও, ঠান্ডা পরো, স্বাগত জানাও নাতিশীতোষ্ণ পরিমন্ডলকে। তাই বুঝি গোটার ডাল। একটা দিন বাংলার ঘরে তোলা থাকে শিলনোড়া! একটা দিন জ্বলবেনা গ্যাস-উনুন। শিলকে হলুদ জলে স্নান করিয়ে তেল হলুদ ছোপানো ঠান্ডা কাপড় পরিয়ে জোড়া শিম, জোড়া মটরশুঁটি রেখে তার কোলে সন্তান সম নোড়াটি রেখে পুজো করে আমার বাড়িতে, আমার মা, ঠাকুমা, দিদিমা। আপনারাও হয়ত করেন অনেকেই।
শ্রীপঞ্চমী থাকিতেই গোটাসিদ্ধ করিও
জোড়া জোড়া ছয়টি আনাজ গোটা মুগে ফেলিও।
গোটা শুকনোলংকা, তাও দিও জোড়ায়
লবণ, সরিষার তেল ঢালিও শেষ ফোটায়।
আতপচালের পান্তা ভাতে, জল ঢালিও রাতে
টোপাকুলের অম্বল রাঁধিও, সজনেফুল সাথে।
টক দৈ খাইও শেষে, ঠান্ডা, ঠান্ডা সবই
শীতলষষ্ঠী পালন হোক, এই তো আমরা চাহি।
নিষ্ঠার সঙ্গে গোটাসেদ্ধ রাঁধতে রাঁধতে তাঁদের মুখে বলতেও শুনেছি এই ছড়া। পাছে মুখের থুতু পড়ে যায় ডালের মধ্যে। ঠাকুর কে নিবেদন করা হবেনা তবুও ভোগের মতোই ছিল সে আয়োজন। তাই ডাল সেদ্ধ বসিয়ে উনুনের ধার থেকে সরে গিয়ে কথা বলতেন তাঁরা ।
কিন্তু আমাদের গ্রীষ্মপ্রধান দেশে শুধুই মাঘ মাসেই নয় গোটা ষষ্ঠীর ডাল কিন্তু সম্বচ্ছর রাঁধা যায়। অনেক মানুষ শখে রাঁধেন।
গোটা মুগকলাই ডালকে শুকনো খোলায় একটু নেড়ে নিতে হবে যতক্ষণ না হালকা গন্ধ বেরোয় । কিন্তু প্রেসারে রাঁধা চলবে না। গোটা শিম, গোটা মটরশুঁটি, গোটা রাঙা আলু, গোটা আলু, গোটা বেগুণ জোড়া সংখ্যায় দিয়ে নুন দিয়ে ফেলতে হবে সেই ডালের মধ্যে। সঙ্গে গোটা শুকনো লঙ্কা আর নুন। ঢিমে আঁচে হবে ডাল। আর কিছু পরে ঢাকা খুলে দেখতে হবে। সেদ্ধ হয়ে গেলে কাঁচা সরষের তেল দিয়ে নামিয়ে রাখা হয় ।
রাণীয়া এগিয়ে চলে তার পেন্ডুলাম কে সঙ্গী করে। পেন্ডুলামের সাফল্য খুব আশাব্যঞ্জক। রাণীয়ার মনোভাব যে সবসময়ই বি পজিটিভ। ভাগ্যিস মা জানিয়েছিল সেই লোকমুখে প্রচলিত ছড়াটা! মা’কে প্রোগ্রাম শেষে প্রণামের ইমোজি পাঠাতে ভোলেনা রাণীয়া।
উত্তর কলকাতায় জন্ম। রসায়নে মাস্টার্স রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে। বিবাহ সূত্রে বর্তমানে দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা। আদ্যোপান্ত হোমমেকার। এক দশকের বেশী তাঁর লেখক জীবন। বিজ্ঞানের ছাত্রী হয়েও সাহিত্য চর্চায় নিমগ্ন। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায়। প্রথম উপন্যাস সানন্দা পুজোসংখ্যায়। এছাড়াও সব নামীদামী বাণিজ্যিক পত্রিকায় লিখে চলেছেন ভ্রমণকাহিনী, রম্যরচনা, ছোটোগল্প, প্রবন্ধ এবং ফিচার। প্রিন্ট এবং ডিজিটাল উভয়েই লেখেন। এ যাবত প্রকাশিত উপন্যাস ৫ টি। প্রকাশিত গদ্যের বই ৭ টি। উল্লেখযোগ্য হল উপন্যাস কলাবতী কথা ( আনন্দ পাবলিশার্স) উপন্যাস ত্রিধারা ( ধানসিড়ি) কিশোর গল্প সংকলন চিন্তামণির থটশপ ( ধানসিড়ি) রম্যরচনা – স্বর্গীয় রমণীয় ( একুশ শতক) ভ্রমণকাহিনী – চরৈবেতি ( সৃষ্টিসুখ) ২০২০ তে প্রকাশিত দুটি নভেলা- কসমিক পুরাণ – (রবিপ্রকাশ) এবং কিংবদন্তীর হেঁশেল- (ধানসিড়ি)।অবসর যাপনের আরও একটি ঠেক হল গান এবং রান্নাবাটি ।