| 29 নভেম্বর 2024
Categories
শারদ সংখ্যা’২২

শারদ সংখ্যা গল্প: ধান । বদরুন নাহার

আনুমানিক পঠনকাল: 14 মিনিট

একবেলা রোদ্দুর ধরতে না ধরতেই দিন শেষ। রাফিজা বেগম সেই সাত-সকালেই বুঝতে পেরেছিলেন রোদ উঠবে। তখনও পূবের আকাশে সূর্য ওঠে নাই। গোলাঘরে মোরগ লম্বা গলা তুলে বাগ দিয়েছে মাত্র, ওমনি ঘরের খিড়কি পেড়িয়ে ঘুম ঘুম চোখেই সে বাইরে এসে দেখেছিলো পূর্বের আকাশটা রক্তের মতো লাল। কত্তদিন টানা বাদলার পর এমন আকাশের রঙ। সূর্য ছাড়া আর কি! রাফিজা দৌড়ে উগারের দিকে যায়, সেখানে তখন বাইনে ভাষা অপক্ক কাঁচা ধান, বৃষ্টিতে আটকা থেকে বেসম গন্ধ! আগের দিন হইলে রাফিজার বমি হতো, ক্ষ্যাত ভর্তি ডুবে যাওয়া এই ধান গত সাতদিনের বাদলায় আরও পচন ধরেছে। আটকা থেকে থেকে ভীষণ গন্ধযুক্ত, তবুও কোথা থেকে রাফিজার নাকে নাড়ার আগুনের ধোঁয়া, ভাঁপ ওঠা সেদ্ধধানের সোঁদা গন্ধে ভরে যায়। ওই সুবে সাদিকের দিকে তাকিয়েই যেন তার মনে রোদ ভর করেছিল। সে আর দেরি করে না, ধামা ভরে ধান তুলে আর তখন তার হাতে পিচ্ছিল সবুজ ধান, কেমন যেন নিজের নবজাতক শিশুটির মতো লাগে। এই ধানের মতো সেও পরিপক্ক হয়ছিল না। সাতমাসের উঁচু পেটের মতো অপক্ক ধান হাতের মুঠোয় ধরে বছর দশেক আগে হারানো অপরিণত শিশুটির কথা মনে পড়ে। যেই শিশুটির মুখে বুকের শালদুধটা পর্যন্ত দিতে পারে নাই, কবরে শুয়ে দিতে হয়েছিল। রাফিজার তবুও আশা আজকের রোদ পড়বে কড়া, একবার কটকটা শুকাতে পারলে এই ধানেও ভাত হবে।

সূর্য সকালে নরম গা নিয়েই এলিয়ে পড়েছিল ফজল আলীর বাড়িতে, রাফিজা বয়স্ক কোমড় বাঁকিয়ে ধামা ধরে সেই খাঁজে, আর উঠোন জুড়ে ধানের বৃত্ত করে চলে। গ্রামে আকাল বলে কেউ আজকাল জুগাল কাজের লোক রাখে না। হাভাতি লোক সব গঞ্জ আর শহুরে কাজে ছোটে। কিন্তু রাফিজার বৃত্ত ভরাট হয়না, তার আগেই ঘটনাটা ঘটে। চারপাশে পানির জোয়ার, হাওড়ের গ্রাম মানেই এমন পানিবন্ধী জীবন, নতুন না। কিন্তু এইবার পানির হুড়াহুড়ি দেখে পুরো গ্রামের মানুষ তসল্লীকালের হাটভাঙ্গা পানির গল্প পেতে বসে। পানির গল্প, ধানের গল্প আর জমে বর্ষায় অকাজের গল্পও। বড় মেশিন নৌকায় পাঁচ টাকায় গঞ্জে যায় কেউ কেউ। কিন্তু সে যে যেইখানেই যাক, কথা ওই একটাই এম তর অঘটন আগে ঘটে নাই, তা হাছা। রাফিজারও তাই মনে হয়, এত বছর বয়সের হিসাবে এমন ঘটনা আগে সেও কি দেখেছে? ধান ছড়ানি চিন্তা সব। বর্ষায় গাঙ্গের পানি বেড়ে ফসলের মাঠ ডুবে, হাওড়ের পানির কোন কুলকিনারা নাই। রঙহীন পানির পানে চেয়েই হাওড়বাসীর স্বপ্নহীন যে দিন যায় তাতে তো ওই মুখের কথাই ভেসে বেড়ায়। কিন্তু এবার যে গাঙ্গের মাছ হাওড়ের পানির তোড়ে মরে! ভাসতে থাকে হাওড়ে, এ আবার কি আকালের দিন আসলো, সবার দিশেহারা অবস্থা সে সব ভাবনায়।
রাফিজার নিজের খোপের পাঁচটা হাঁস মরছে, বাকি দুইটাকে ঝাঁপার নিচে আটকায় না রাখলে পানিতে ওই দুইটাও শেষ হত। চারপাশে বিভৎস মরা মাছেদের, হাঁসেদের ডুবসাঁতার। বাদলার দিনেও মানুষ চালতা তলায়, ডুমুরের ডালে, কেউ বা কদমগাছের ডালে উঠে খেলা দেখে, শহুরের মানুষ ভটভটি নাও-এ করে এসে এসে মরা মাছের চোখে আলো ফেলে। ফিরে গিয়ে কত গল্প বানায়! তা কি আর রাফিজা দেখতে যায়, ছেলে-ছোকরার দল হেসে গড়িয়ে পড়ে সে গল্প, বাড়ি বাড়ি ছড়ায়। কিন্তু এত বিপদের মধ্যে পাওয়া রোদটাকেও কাজে লাগানো গেল না বলে রাফিজার যে দুঃখ, তা তো ওই জহরত আলীর বৌ-এর কারণেই।
২.
জহরত আলীর বৌ সুন্দরজান তাদের পরিবারে যেন বিষফোঁড়া। সবার মতে তার রূপ আছে ঠিক, আর তার সাথে আছে কেবল বিষ! সে স্বামী খাওয়া মাগী! আলী পরিবারের দুঃখের ঘন্টা কেবল সে-ই বাঁজায়। বিয়ের দশ বছরের মাথায় স্বামী মরছে। ওই মেয়ের বিষেই জহরত আলী বিমারে মরেছে, সে বিষয়ে বাকী তিন ভাই ফজল আলী, ইজ্জত আলী আর কিসমত আলীর মনে কোন সন্দেহ নাই। সকলের ছোট ভাই হয়ে জহরত সবার আগে মরবে ক্যানো? সে প্রশ্নের উত্তরের তারা সুন্দরজানের মুখ ছাড়া কিছুই খুঁজে পায় না। আর মাত্র দশ বছরে চারটি সন্তান জন্মদান! এও এক দোষের বিষয় বলে তাদের কাছে বিবেচিত। কেননা সুন্দরজান যত অজাত-কুজাতের মেয়ে হোক না কেন, ওই পোয়াগুলো তো এই বংশেরই। একেবারে পেটমোচাটা তো বাপের মরার পর জন্মালো। বাপ মরল আশ্বিনে, পুরি হইল অগ্রাহায়নে। তা এখন তাদের কি হবে? বংশের ছেলে সন্তান নিয়ে তাদের চিন্তা ওইটুকু, সাহায্যের কণা ধানও তাদের হাত গলে মৃত ভাইয়ের ঘরে ঢোকে না। তাতেও দোষ ওই সুন্দরজানেরই। অজাত-কুজাতের পুরির সঙ্গে তাদের বাতচিত নাই।
সুন্দরজানের দোষ খুঁজতে গেলে সবার মনেপড়ে রূপজানের কথা। যেই রূপজান এই পৃথিবী ছেড়েছে তাও চল্লিশ বছরের বেশি ছাড়া কম নয়। কিন্তু এই হাওর পাড়, বাদালী গ্রামের সবার কাছে রূপজান বেগম নতুন করে ফিরে আসে তাঁর ভাইয়ের ঘরের নাতনী সুন্দরজানের সাথে। গ্রামের সবার ধারনা দাদীর দোষ নাতনী সুন্দরজানের উপর ভর করছে। নাহলে এককালের তালুকদার পরিবারের ছেলে জহরত আলী যুবক বয়সে গ্রামের কোন গৃহস্থ ঘরের দিকে নজর দিল না! তার চোখ পড়ল ওই পাড়ের কামলা হাটিতে! তাও আবার রূপজান বিবির ঘরে? যে কি-না জহরত আলীর দাদা হিকমত আলীর ধানের দাসী ছিল।
এই বিয়ের ফলে জহরত আলী কিছুদিন ঘর ছাড়া হয়। তবে বাপের ভিটা থেকে তাকে ভাইরা একেবারে বঞ্চিত করে নাই। হাওরের সব কান্দাভাঙ্গা ঘরবাড়ি মধ্যে তালুকদার বাড়ি তো তালুকদার বাড়িই থাকে। তা সে তালুকদারী থাকুক আর নাই থাকুক। ভিটা ভাগ হয়ে গেলেও তো তা খানিকটা আলাদাই। এই যে যেমন, উত্তরদিকের পুকুরসহ বড় ভাই ফজল আলীর ঘর, সেই ঘরের বারান্দায়ই থাকতো জহরত আলী, বিবাহের পর, বারান্দার কপাট বন্ধ। দক্ষিণের আম ভিটায় ছোট বাগানসহ মেঝ ভাই ইজ্জত আলী আর সামনের উগারসহ সেজ ভাই কিসমত আলীর ঘর। তা বাদে জহরতও তো ভিটায় ফেরে, তারও একখানা ঘর হয়।
সুন্দরজানকে বিয়ের মাস খানিক বাদে কামলা হাটি ছেড়ে জহরত আলী ফিরে এসে বাপদাদার ভিটায় তাঁর অধিকার নিয়ে হৈ চৈ শুরু করলে ভিতর বাড়ির ভাঙ্গা দালানের অংশে তাকে এক চিলতে জায়গা দেওয়া হয়। একশ বছর আগে শেষ হয়ে যায় আলী পরিবারের তালুকদারী। জহরত আলীর দাদা হিকমত আলী যে দালান ঘরে বাস করে গেছেন, সেই দালানের কোন কুঠোরিই আর অবশিষ্ট নাই। কেবল একখানা আধভাঙ্গা দেওয়াল, আর খোলা বারান্দার সিমেন্টের সিঁড়িসহ ভিটখানা ছাড়া। অবশ্য আরও একটা ইটের চক্কর আছে, যার মধ্যে কিছু মৃত গাছের শিকড় বাকড় অবশিষ্ট ফসিল আর পোকামাকড়ের বাস। এই চক্করের হাত থেকে বাঁচার জন্যই বড় আলী, মেঝ আলী আর সেজ আলী নিজেদের ঘরখানা মূল বাড়ির ফটক থেকে, এই খোলাবারান্দার সামনে থেকে সরিয়ে বানায়। ফলে অবশিষ্ট মূল ফটক, বাড়ির চৌকাঠ মূলত জহরত আলীই পায়।
ভিটার দখল নিয়ে সে ভাঙ্গা দেওয়ালের সঙ্গে করচার ডাল আর খড়পাতা দিয়ে ছাউনি তুলে। সামনের খোলা বারান্দ্রার একচিলতে সিমেন্টের ভিটসহ সিঁড়িটা বড় বেমানান, তা কারো চোখে পড়ে না। কিন্তু সবার চোখে পড়ে সুন্দরজানের চেহারাখানা।
৩.
খোলা বারান্দার সামনে গোল চত্তরখানা তৈরী করেছিলো জহরত আলীর দাদা হিকমত আলী। সেই থেকে দাদীজান হাফিজুন নেসার সঙ্গে তার বিরোধ। কেননা এটা তৈরী হয়েছিল একটা হাসনাহেনা গাছের জন্য। এই তল্লাটে এই প্রথম কেউ হাসনাহেনার গাছ লাগাল। এই গাছ সম্পর্কে এলাকায় খুব ভালো কোন কথা চালু নাই। সাপের আনাগোনা এই এলাকায় নতুন কিছু না হলেও এইগাছের সঙ্গে সাপের যে মিথ চালু আছে, তা ভালো না। জহরত আলীর দাদীজানের মতে, সেই থেকে বাড়িতে বাস্তুসাপ! এই সাপ একবার বাসা বাঁধলে তা থেকে নিস্তার নাই।
হাসনাহেনা গাছের সঙ্গে আলী পরিবারের যে সাপ প্রবেশ করে তাতে সারা জীবন দংশিত হয়েছে হাফিজুন নেসা। এই সাপের বিরোধ এই বংশের তিন পুরুষের বিরোধ। হজরত আলী সবটা না জানলেও বংশের বর্তমান বড় হিসাবে ফজল আলী সব জানে। জন্মের পর সে তার দাদীজানের কাছেই মানুষ। রাতদিন এক নিঃসঙ্গ মানুষের কাছে বেড়ে ওঠায় কেমন একটা ঝিমমারা স্বভাবের হয়েছে জুলমত আলীর বড় ছেলে ফজল। যদিও সে যুবক হওয়ার আগেই দাদীজানের মৃত্যু, তবুও এইসব কথা মনেথাকে। কেননা দাদীজান হাফিজুন নেসার জীবনে ওই হাসনাহেনা কোন ফুল গাছ নয়, আস্ত এক সাপ হয়ে এসেছিল। রাত হলেই দাদাজান হাসনাহেনার গন্ধে মজে যেতেন। আর দাদীজান সাপের ভয়ে সারারাত ছটফট করেছেন। ফজল আলী এটাও জেনেছে যে ওই কামলা হাটি থেকে আগত এই বাস্তুসাপ। যে রূপজানের মধ্যে মানুষের রূপ ধারন করে ওই হাটিতে থাকলেও, তাঁর আত্মা এই বাড়িতে ঢুকে গিয়েছিল। আর ওই দেহের টানে দাদাজান নাও নিয়ে ছুটে যান কামলা হাটিতে।
রূপজানের স্বামী দুলু সর্দার। সে এই গ্রামের আদি বাসিন্দা না। একবার এক তুফান রাতে তাকে পাওয়া যায়। স্রোতের তোড়ে ভেসে এসেছিল। সে রাতে যুবক হিকমতের বজরাও দূরের এক গঞ্জ থেকে ফিরতি পথে শনির হাওরে পড়ে। মাঝিরা এমনিতেই ছিল ভীত। শনির হাওরের ঝড়ে পড়া মানে মৃত্যু। সবার চোখে মুখে ভয় আর আল্লাহ-নবীর নাম। উথাল-পাথাল ঢেউ-ও বজরায় কি যেন আটকায়, ঝড় তখন থামা, কিন্তু বাদলা চলছে মুশুল ধারে। মাঝিদের মধ্যে ভয় আর কাঁপাকাঁপি বেড়ে গেলেও হিকমত আলীর সাহসের কমতি ছিল না, সে নিজেই নাওএর মাথায় গিয়ে টর্চ ফেলে, একটা মানুষের অবয়ব! সে নির্দেশ দিলেও মাঝিরা সে দেহ তুলতে চায় না। কিন্তু হিকমত আলীর ধমকে তারা টেনে তুলে সে দেহ। একটা চোখে ক্ষত, মনে হয় মাছে খেয়েছে, নাকি কেউ উপড়ে নিয়েছে। সে যাত্রা এভাবেই নতুন জীবন ফিরে পায় দুলু সর্দার। তাই যতদিন বেঁচেছিল দুলু সর্দার দাদাজানের পোষা কুকুর হয়েই ছিল।
মৃত প্রায় দুলু সর্দারের প্রথম দিন সাতেক কাচারীতেই, আশ্রয় হয়। ওষুধ পানি পেয়ে সে আবার তাগড়া হয়ে ওঠে। আর তখন হিকমত আলী তাঁকে কামলা হাটিতে একখানা ঘর দেয়। ফজল আলীর বড় দাদা হিজরত আলী তালুকদার জীবিত। দাদাজান হিকমত আলীর যুবক বয়স, বছর ঘুরেছে কি ঘুরে নাই ঘরে বউ এসেছে। তাঁর বাপ হিজরত আলী সদ্য তালুকদারি হারিয়েছে। তার তালুকের পরিমান ছোটখাটো জমিদারের সমান ছিল। তাতে সব হারায়নি, জমিজিরাত, রাখাল, লাঠেল সবই তখনও অবশিষ্ট। বাড়িতে কাজের লোকের অভাব নেই, তারমধ্যে হিকমত যখন আবদার করল দুলু সর্দারকে রাখার, তাতে বাপের কোন অমত ছিল না। এমন কি তখন হাফিজুন নেসাও অমত করেনি। তার মতামত যে খুব নেওয়া হয়েছে এমনও না। হিকমত আলী কিছুকাল কলকাতা থেকে পড়াশোনা করেছে, বায়োস্কোপ দেখা, মেমদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার মতো চলনসই হিকমত এই গন্ডগ্রামে কার সঙ্গেই বা মাতে। বরং নতুন বউ হাফিজুন কিশোরগঞ্জের জমিদার বংশের মেয়ে, আদব-কায়দা আর কিছু শিক্ষা তারও আছে। তাই সে না চাইতে নানা বিষয়ে বাতচিত করত। তা কোন সিদ্ধান্তের জন্য না, কথা বলার কথা হিসাবে। তা আবার বউ-এর পেটে সন্তান আসচ্ছে, তাই হিকমত আলী বৌ-এর সঙ্গে খোঁশ গল্প করে, কাচারীর কথা, গঞ্জের কথা, এমন কি নবাগত দুলু সর্দারের কথাও বলত। ব্যাটা গান গায়, হাফিজুন নেসা একবার আবদার করে তার গানও শুনেছে। বড় মায়ার গলা, পরাণ কান্দে এমন সুরে গান গায়। ব্যাটা লাঠাল, জোয়ান এক মর্দ্দ, কিন্তু গানের সময় যেন আজলা আজলা পানি। তখন তার কোন কিনার থাকে না।
বাড়িতে আশ্রিত আসবে, সেবা করবে, খাবে পড়বে এইসবে হাফিজুন নেসার কোন দ্বিমত নাই। তাঁর বাপও তো কিশোরগঞ্জের জমিদার বংশের পোয়া। ছোটবেলায় সে তো এসবের মধ্যে দিয়েই বড় হইছে। কিন্তু সমস্যা দেখা গেল কিসমত আলীর জন্মেরও বছর খানিক পর।
কিন্তু তারও আগে আরও ঘটনা ঘটে। হাওরে পানি, বসে থাকে একসময় সেই পানি যায়ও। কিন্তু মানুষের মনে গল্প যায় না, তারা কোন ঘটনা সহজে ভোলে না। সেই যে একদিন কাউরে কিছু না বলে দুলু সর্দার উধাও হয়। সে কথাও গ্রামের লোকেদের বহুকাল মনে থাকে। দুলু সর্দার তো যেই সেই লোক না, শনির হাওর থেকে বেঁচে ফেরা মানুষ! তার গল্প মানুষ চাইলেই ভুলতে পারে না।
হিকমত আলীর কেমন যেন একটা অভ্যস্থতা হয়েছে, হাঁটতে বেরুলে লাঠি হাতে দুলু মিয়া হাঁটবে, তা মিয়ায় কই গেল? এ যেন ভেলকি বাজি। প্রথম প্রথম কয়দিন হিকমত আলী বেরই হয় না। ঘরে তখন ছোট বাচ্চা ক্যা ক্যা করে, বউ তা সামলাতে ব্যস্ত। উত্তরের ঘরে বাপজান গুম হয়ে বসে, হারানো তালুক তাকে আত্মধ্যানে ডুবিয়েছে। মা কুলসুম বেগম যেন তার অভ্যন্তরীণ মূখপাত্র। সেই এখন সব দেখে শোনে, যদিও কাচারীর কাজে হিকমতকেই করতে হতো। তা সে কাজ থেকে কুলসুম বেগম ছেলেকে ছুটি দিতে চাইলেন। এত তাড়াতাড়ি ক্ষাত-খামারি নিয়ে পড়লে চলবে, সেই তালুক কি আর তাদের আছে। তাছাড়া সে চান হিকমতের বাবা আবার সরব হয়ে উঠুক, বেটা মানুষ যদি ঘরের কোণে থাকে তা কোন মানুষের ভালো লাগে? তার মতে হিকমতের বিয়ে হইছে, আবার বাচ্চাও হইচ্ছে। এখন হিকমত আবার কলকাতা গিয়া বাকী পড়াশোনা শেষ করুক। তার বাপেরও সেই ইচ্ছা। কিন্তু হিকমতের সেদিকে কোন মত নাই। সে গ্রামে হাওয়া লাগায় ঘুরেফেরে, গান-বাদ্যি শোনে, সঙ্গে তার খাস সাগরেত দুলু।
কিন্তু সেই দুলু নাই! ব্যাটার মধ্যে এক যাদু আছে, মনের ঢুকে বসে আছে। হিকমত ঘরের মধ্যে পায়চারি করে, এত লোক থাকতে তার কেবল দুলু সর্দারের অভাব লাগে! এমন আনমনা সময়ে মা কুলসুম বেগম আবার ছেলেকে তাড়া দেয়। কুলসুম বেগমের মতে ইংরাজ যাবি বলেলই তো যায় নাকি, এই সময় জমাদারি নাই, ইংরাজ শিক্ষা শেষ না হলে বংশের কোন ক‚ল থাকে না। তাই সে রাতদিন ছেলের পেছনে লেগে থাকে, বুঝায়-সুজায় যদি কলকাতা ফেরত পাঠানো যায়।
প্রায় মাস খানিক হলো দুলু সর্দার উধাও। সব মিলে হিকমত আলীও ভাবল কলকাতায় চলে যাবে। ইদানিং কলকাতার নানা খবর পায়, ম্যালা হট্টগোল সেখানে। যাবে কি যাবে না, এই সব ভাবনাও মাথায় সঠিক সিদ্ধান্ত আসে না। অস্থিরতা হিকমতকে ছুটিয়ে নেয় হাওর থেকে হাওরে, গঞ্জে, শহরে। বজরা নিয়ে প্রতিদিন সে গঞ্জের হাটে খবর শোনে। লোকের মজমা দেখে।
এমনি দিনে এক সন্ধ্যায় শহর থেকে বাস আসে সুনামগঞ্জে। হিকমত তার দু’চার জন ইয়ারবন্ধু নিয়ে চা খাচ্ছিল। আর আনমনে বাস থেকে যাত্রি নামা দেখে। হঠাৎ দেখে বাস থেকে নামে দুলু সর্দার! হাতে রঙিন ট্রাঙ্ক আর একটা হাসনাহেনা গাছ! নেমেই সে ছুটে আসে হিকমতকে দেখে, হুজুর বলে পায়ের উপর পরে।- কই যাওনের সুম পায়নাই নাইকা।
তারপর একটু সরে দাঁড়ায়, তখন হিকমত আলী দেখতে পায় ঘোমটা দেওয়া একটা বউ, ছাপার রঙিন শাড়ির মধ্যে কোন মুখ তখনও দেখা যায় নাই। কেবল কিছু কাঁচের চুড়ি নড়ে উঠেছিল। পেছনে বালক এক দাঁড়িয়ে, বউর আঁচলের কোণা ধরে। প্রথমে হিকমত আলী ভেবেছিল পরিবার আর সন্তান। পরে জানতে পারে সঙ্গে বাপ-মা মরা শ্যালক নিয়ে ফিরেছে দুলু সর্দার।
সেই ছিল সুন্দরজানের আগমন। দুলু সর্দার বউ আর শ্যালক নিয়ে কামলা হাটিতে নেমে পড়ে, কেবল হাসনাহেনা ফুলের গাছটা সে মনিবের পায়ে ভেট দেয়। এটা তার খুব পছন্দের ফুল, অনেক কষ্টে জোগার করেছে হিকমত আলীর জন্য।


আরো পড়ুন: বিশেষ রচনা: মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয় । দিলীপ মজুমদার


৪.
বাড়ি ফিরে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে হাসনাহেনা গাছটা খোলাবারান্দার সামনে পুতে হিকমত আলী। কলকাতায় তাদের মেসের সামনেও এমন একখানা গাছ ছিল। রাত্রে এই গাছের সৌন্দর্য্য তাকে সেই সময় মুগ্ধ করেছিল। গঞ্জ থেকে ইট-সিমেন্ট এনে গোল বেরি দিয়ে দেয় গাছের গোরায়। আর হাওরের বাতাসে তরতর করে বেড়ে ওঠে হাসনাহেনা। হাফিজুন নেসার কোলে বেড়ে ওঠে কিসমত আলী। এদিকে হিকমত আলী সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত করে ফেলে, সে আর কলকাতা যাবে না। এ নিয়ে বাড়িতে কোন উচ্চবাচ্য হয় না। কেননা তার বাবা জুলমত আলী তালুকদারের এখন সেই মেজাজ নাই, সে ভেঙ্গে পড়েছে। কিন্তু এ নিয়ে কথা বলে হাফিজুন নেসা। দু’দিন আগেও যে চায়নি স্বামী কলকাতা যাক, এখন সে চায় হিকমত আলীর কলকাতা যাওয়ায় ভালো। কেননা যে স্বামীকে কাছে পাবার আসায় কলকাতার বিষয়ে এতদিন নিরব ছিল, তা স্বামীকে সে কাছে পায় কই? সারাদিন কাচারী-জমি আর রাত হলে কামলা হাটি।
দুলু সর্দারের বৌ সুন্দরজানের রূপ এই বাদালী গ্রামে কেউ আগে দেখেনি। সবাই বলে বেড়ায়, কানা বেটা কই থিক্কা রাইজকন্যা চুরি কইরছে যেন! কিন্তু সুন্দরজান কামলা হাটির বউ। আর কামলা হাটিতে যারা বাস করে তারা সবাই কোন না কোন কালে তালুকদার বাড়ির দাস-দাসী হিসাবে নিয়োজিত থাকে। অন্য সবার মতো সুন্দরজান ধান বানতে এই বাড়িতে আসে, কিন্তু ইতিমধ্যে এটাও গ্রামের মানুষ জানে যে জমিদার পুত্রের রক্তে ধানের দাসী এসে জুটেছে। রাতেরবেলা একচোখা দুলু সর্দার নাও বেয়ে হিকমত আলীকে নিজের ঘরে পৌঁছে দেয় আর তখন দরিয়ার পাড়ে কদমতলায় বসে যে বিচ্ছেদী গান বাতাসে ভেসে বেড়ায় তা হাফিজুন নেসার কান পর্যন্ত পৌঁছায়। নদীর ঢেউ-এর ছালাৎ ছলাৎ তোড়ে মিশে এই পাড়ে আসে। ঘুমহীন চোখে হাফিজুন নেসা কখনও জানালা, কখনও বা খোলা বারান্দায় ছটফট করে। আর হাসনাহেনার ফুলের গন্ধে তার দম বন্ধ হয়ে আসে।
শাশুড়ি কুলসুম বেগম কড়া গলায় বলে- জোয়ান পোয়া, তারে বাইন্ধ যাইতো না। ইছাড়া বংশের রেওজ তাইনি। জোয়ান পোয়া যায়ই।
হাফিজুন নেসার সর্য্য হয় না। সে রূপজানকে তার পাঁকাল থেকে, ধানের উগার থেকে বাদ দেয়। তালুকদার ভিটায় তার আসা বন্ধ। তাতে সুন্দরজানের সংসারের শ্রী কমে না, বরং বেড়েই যায়। কামলা হাটিতে ছোনের বাতা ফেলে দুলু সর্দারের ঘরের মাথায় চৌচালা বসে, তালুকদার পুত্রের রাত্রি যাপনের উপযুক্ত ঘরই না হলে চলে না। সেই সাথে ধানের বতর পর্যন্ত উঠে আসে সেই ঘরে। দুলু মিয়া শান শওকতে বালক শ্যালক বড় হয়। সন্তানহীন রূপজানের সন্তান যেন সে।
গ্রামের সবাই জানে রূপজান হইতেছে ধানের দাসী। শহুরের রঙ-ঢঙ শিখে এসেছে। রাতে হ্যাজাক বাত্তিতে ওই ঘরে আসর জমে।
৫.
সেই ধানের দাসীর ভাইয়ের ঘরের নাতনী সুন্দরজান যখন জহরত আলীর পেছন পেছন বাড়িতে ঢুকে, তখন ফজলের কেবল দাদীজানের কথা মনেপড়ে। সারাটা জীবন স্বামীকে হারানোর দুঃখ আর বাস্তুসাপের ভয়ে কেটেছে হাফিজুন নেসার। বিয়ের মাত্র দুই বছর না যেতেই স্বামীর নজর হারায়। কালে ভাদ্রেও স্বামীর সোহাগ জোটে না তার। সে খাঁচার পাখির মতো ছটফট করে। যদিও কুলসুম বেগম মারা গেলে সেই এই এলাকার তালুকদার গিন্নী, কিন্তু তাতে কি? রূপজানের কাছেই তো সে পরাজিত!
সুন্দরজান যে দাদীর মতো বিষধর তা ফজল আলী শুরুতেই বুঝেছিল। দাদাজান মারা যাবার পর হাফিজুন নেসা সবার আগে উপড়ে ফেলেছিল ওই হাসনাহেনা গাছ। সুন্দরজান কি-না আবার সেই গাছ এনে লাগাল! ভাসুর-জা কেউ কোনদিন সুন্দরজানের ধারের কাছে আসতো না। রাফিজা বেগম খালি মাঝে মধ্যি দূর থেকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখত। তাতেই মেঝ জা কোহিনূর বেগম ম্যালা কথা শুনিয়েছে, ওই অজাত পুরিরে দেখছো কিলাই? ধানের দাসীর জাত। ওদের সঙ্গে তাদের যায় না, তাকানোও খারাপ বড় জাকে সে তা বোঝায়। কোহিনূর বেগমও এক জমাদার বংশের মেয়ে। তাই তার ঠাঁট একটু বেশী। গেহস্থ ঘরের মেয়ে রাফিজা বেগম যে খুব সুন্দরজানের জন্য চাইতো তা না, ছোট দেওর জহরত আলীকে সে বেশ ছোট পেয়েছে। শাশুড়ি মারা যাওয়ায় তার কাছেই তো মানুষ। নিজের বড় পুত হুসেন আলীর থেকে বছর দশেক বড় হবে। একটা মায়া লাগে।
ফজর আলীর ভাইয়ের প্রতি কোন মায়া নাই। দাদীজানের জানের বিষ, সেই ঘরের পুরি বিয়ে করায় ভাই তার শত্রæ। এত সবের মধ্যে দিয়ে জহরত আলী আর সুন্দরজান পুরানো ইটের মধ্যে বেঁধে নেওয়া কুঁড়ে ঘরে ভালোবাসে, হাসনাহেনা গাছে আবার ফুল ফোটে। তাতে কোহিনূর বেগমের নাকি গন্ধে মাথার বেদনা হয়। কিন্তু তাতে কান দেয় না জহরত আলী। তার ঘরের একে একে তিনটা পোয়ার জন্ম হলে ভাইরেরা নাক সিটকায়। কিন্তু রাফিজা বেগম আরে আরে শিশুগুলোকে দেখে, মনচায় একটু আদোর করে। নিজের তো সেই একটা মাত্র পোয়া, শহরে পড়ে। তার আরও বেশি করে মৃত শিশুটির কথা মনেপড়ে। নিজের পেটের সাতমাসে জন্মনো সন্তানটি মারা যাবার পর যখন জহরতের ঘরের প্রথম সন্তান জন্মাতে দেখে তার মন শিশুর কান্না খোঁজে। বেদনায় সুন্দরজান কান্দে, তখন রাফিজার জোঠরের কেমন মুচরায়। সে অন্ধকারের মধ্যে পেছন বাড়িরর জঙ্গলা দিয়ে সেই ঘরে উঁকি মারে। আর তখনই আলতা আলী পৃথিবীতে আসে। রাফিজার মনেহয় মরে যাওয়া শিশুটিই যেন ওই ঘরে ফিরে আসছে!
তাই কোথায় যেন সে মায়ায় পড়ে। তো ওই চোখের দেখাই, তার আর কি করার সাধ্যি। তালুকদারী না থাকলেও এই গ্রামে তাদের বাড়ির ভিন্ন রেওয়াজ।
৬.
জহরত আলী বৌ আবার পোয়াতি, ঘরের মধ্যে এক চিলতে জায়গায় তিন তিনটা বাচ্চা, আবার একখান আসতেছে। কিন্তু তা নিয়ে কারো মাথা ব্যাথা থাকে না। সমস্যা জহরত আলীর বিষম বিমার, জ্বর, গা যেন শত বছরের বেদনায় চুরমার হয়। শেষে জানা গেল রক্তের মধ্যে দোষ, ক্যান্সার। সারা গায়ে ছড়িয়ে পড়ছে। আলীদের তিন ভাই এই নিয়ে চিৎকার চ্যাঁচামেচি করে বাইরে বাইরে। সব ওই সুন্দরজানের বিষ, ওই হাসনাহেনা গাছ এই বাড়ি থেকে তাড়ানো না গেলে, কারো রেহায় নেই। সারাদিন জহরত আলী শুয়ে শুয়ে এইসব শোনে, তার কথা বলারও শক্তি থাকে না। সুন্দরজান মানুষের বাড়িতে বাড়িতে কাজ করে যা পায় টুকায় এনে সন্ধ্যায় চুলা জ্বালায়। যদিও তাতে বংশের নাম যায়, কিন্তু জহরত আলীর এখন করার কিছু থাকে না।
বড় পোয়ার মাত্র নয় বছর বয়স, তাকেও গঞ্জে এক আড়তদারের কাজে দিছে। তাতেও ভাইদের রাগ। এই বংশের পোয়া, এমন কাজ করছে না! অথচ গেঁদা বাচ্চা দুইটো সারাদিন ফ্যা ফ্যা করে ঘোরে, চাচাদের তাতে মায়া নেই। ফেলনা ভাত কাকে খায়, তবুও এক নালা ওদের জোটে না। কেবল তাদের সম্মানের ভয়, সমাজের লোকের কথার ভয়, মায়া-মমতার কোন বালাই নাই। এনিয়ে কিছু বলার মুখতো জহরত বা সুন্দরজানেরও থাকে না। সবচেয়ে বড় অপরাধ তো তারাই করছে। এ পিড়িত করেই তারা বিষম দুঃখে পেল!
সুন্দরজানের পেট ক্রমশ বড় হয়। আর তাঁকে অকুল দরিয়ায় রেখে জহরত আলী চোখ বোঁজে। তাতে ফজল আলী সবার আগে এসে উপড়ে ফেলল সে-ই হাসনাহেনা গাছ। সব দোষ ওই গাছের, যদিও ফজল আলীর ইচ্ছা করছিল সুন্দরজানের চুলের মুঠি ধরে ওই উগারের বাইরে ছুড়ে ফেলতে, তা সে করে না। তালুকদার বংশে মেয়ে মানুষের গায় হাত তোলাও ইজ্জত হারানোর ভয়।
সুন্দরজানের ছোট ছেলে দুইটা আজকাল ঘরে থাকে না, গ্রামের কই কই ঘোরে। কি-সব লতাপাতা তুলে আনে, কোথায় তারা এই বুদ্ধি পায়, সুন্দরজান বোঝে না। কিন্তু তা সেদ্ধ-মেদ্ধ করে পেট চলে। সেই জহরত আলীর বউ এই সুন্দরজান, স্বামী মারা যাবার মাস দুই বাদে একটা কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়। আর সকলের চোখের আড়ালে হাসনাহেনার গোড়া থেকে নতুন পাতা ফোটে। সুন্দরজান সেখানে কিছু বৈড়ই কাটা রেখে দেয়। যাতে কারো নজরে না পড়ে।
চার চারটা সন্তান জন্ম দেওয়ার পরও সুন্দরজানের দেহে কোন ভাঁজ নাই। কোল নেওটা নিয়ে গ্রামে কাজে যায়। কাজে না গেলে খাবে কি? কিন্ত সবার চোখে তার সবই বিষের লাগে। পুরির এত তেজ আর রূপ থাকার পেছনে কারণ হিসাবেও সবাই ভাবে, ধানের দাসীর বংশ বলে কথা!
৭.
রাফিজা বেগমের বানে ভাসা ধান শুকানোর রৌদ বয়ে গেল, বাড়ির হৈট্টগোলে। তা ওই সুন্দরজানকে নিয়েই। মেঝ জা কোহিনূর বেগম প্রথম চিল্লাইন দেয়, আর সে ধামা ফেলে দৌড়ে গিয়েছিল। চিল্লান দিয়েই কোহিনূর বেগম দাওয়ায় বসে হরহর করে বমি করে, আর সুন্দরজানের ঘরের দিকে বিচ্ছিরি ভাষায় গালিগালাজ করে। এতক্ষণে রাফিজা বেগমও মেঝজার বমির গন্ধের সঙ্গে অন্য একটা তীব্র গন্ধ পায়। সে আসলে অপক্ক ধানের সোঁদা গন্ধে মজে ছিল। তাই বুঝি এতক্ষণ তার পর্যন্ত এ কটু গন্ধ পৌঁছায়নি। পচা মাংস পোড়ার গন্ধে তার তখন পেট মোচড়ায়।
হাওর জুড়ে হাহাকার। যে যা পারছে ক্ষেতের ধান ধরে রাখার দৌড় ঝাঁপে ব্যস্ত ছিল। তা কি আর তেমন ধরতে পারছে নাকি? পানির বাড় বাড়ন্তে মানুষ দাঁড়াইতেই পারে না। বাঁধ তো সব সময়ই ডোবে, তা এখন না। তারও তো একটা হিসাব আছে। কবে ধান নিতে হয়, তারা কি তা জানতো না। কিন্তু এবার অকালে পানির ঢল নামছে, ধানের যেমন ঠাঁয় মেলেনি তেমনি মানুষের মনের মধ্যে আচমকা ঢলের কারণ মেলে না। তাই বিপদে সবাই দিশেহারা।
জহরত আলী তো মরার আগেই যা একটু জমি ছিল, তা বেঁচেছে। সব তো ভাই ইজ্জত আলী কিনল। তার ছেলে সৌদি থাকে। টাকার সমস্যা নাই। যদিও ধান টুকানির সময় সুন্দরজান নাকি সেই জমিতেই হাতরায়। তা নিয়ে কোহিনূর বেগমের রাগ ছিলই, কিন্তু ইজ্জত আলী তেমন একটা গুরুত্ব দেয় নাই। সে বলে-থাক পানিতেই তো তলাছে.. নিলে নিক। সুন্দরজানের অবশ্য তখন বড় পোয়র কথা মনে পড়ে, গঞ্জে আরতদারের বাড়ি থিকে আসলে, সে কিছু ধান তুলতে পারতো। নয় বছরেরই সে লম্বা পোয়া, বাকীগুলো তো এখনও বাড়ে নাই। নিজে আর কতটুকু পারছে, জলের দেশে জন্ম হলেও ডুবসাঁতারে সে তেমন পটু নয়। ডুব দিতে গেলেই ভেসে উঠে!
কোহিনূর বেগমের বিষয়টা ভালো লাগে নাই, সে সুন্দরজানের দিকে নজর রাখছিল। এবং সে এতও জানায় ভাইজানের কথা অমান্য করে অভাগীর বিটি আবারও হাসনাহেনা লাগাইছে! পরিবারের বাকী সদস্য সেখানে ইতিমধ্যে উপস্থিত। শরীকজনেরাও আছে, যেন এতদিনে সবাই একটা সুযোগ পেল সুন্দরজানকে এক হাত দেখে নেওয়া।
বড়ই কাটা সরিয়ে সবাই দেখে সত্যি সত্যি হাসনাহেনা গাছ! কিন্তু তাতে কারো বমি হওয়ার কথা না। সে কারণ অন্য। সকালে সুন্দরজান পানিতে মরে আসা হাঁস চুলায় রান্না করছিল, সেই গন্ধে কোহিনূর বেগমের বমি হয়। সে চিৎকার চ্যাঁচামেচি করে পাড়ার মানুষ জড় করে। তার স্বামী ইজ্জত আলী নিজে হাতে এবার শাবল দিয়ে গোড়াসহ হাসনাহেনা গাছ উপড়ে ফেলে।
ফজল আলীও আপত্তি স্বামী খাওয়া বিটি, এই বংশের পোলাপাইনরে বিষে মরা হাঁস খাওয়াবে! এমনিতেই তারা কেউ নিশ্চত নয়, এত হাঁস আর মাছের মরার বিষয়ে। ভারতীয় বিষ না পঁচা ধানের গ্যাস তা নিয়ে শহরে মাতামাতি চলে। আর সেই হাঁস তালুকদার বংশের সন্তানদের জন্য সুন্দরজান পাখালে তুলছে! কিসমত আলীরও তাতে ঘোর আপত্তি। তারা সুন্দরজানকে কামলা হাটি, বাপের ভিটায় ফিরতে বলে। তখন সুন্দরজানও সবার পায়ে পড়তে যায়। কিন্তু তার হাত কোন পা ছুতে পারে না, সব দূরের সরে। সে তো অজাত, কিন্তু তাদের জাতের পোলাপাইন না খায়ে থাকলে কেউ তো চিল্লায় না? মাটিতে উবু হয়ে থেকে তালুকদার বংশের এক মুঠো মাটি হাতে সহসা উঠে দাঁড়ায় সুন্দরজান।
উঁচু মাথায় দাঁড়ায়, বলে- এইটা আমার স্বামীর ভিট, আমি ছাড়ব না। সে কথার উত্তর দিতে সবাই বেশ অস্বস্থিতে পরে, পরিবারের বিষয় নিয়ে যেন তালুকদার পরিবারের বাকী ভায়েরা বিব্রত তখন।
তবে পাড়া-পড়শির সঙ্গে তারা সবাই মিলে সারাদিন বেশ কাও-কেওয়াজ করে। তা বিগত তালুকদার বংশের সম্মান আর অভাবের আখ্যানে পরিণত কিন্তু মানুষ তাও ভাবে না। তখন সুন্দরজানের মতো ক্ষুদ্র মানুষের কথায় বসে থাকে না কেউ। কেননা এবারের দুঃখ আরও বড়। সারা হাওরে এবার ধানের জন্য যে দুঃখ অপেক্ষা করে, তা হাওরের মতোই ক‚লহীন। হাওরের এবারকার দুঃখে মানুষ গল্প করতেও ভুলে যায়।
৮.
রাফিজা ধান ফেলে মেঝ বউকে সেবা যন্ত্র করতে হলো। অনেক চেঁচামেচির ফলে দূর্বল কোহিনূর বেগম বড় জার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়তে থাকে, তখনও তার কথা শেষ হয় না। সে ঘুমিয়ে যাবার আগে ফিসফিস করে বলে- ও বুজি, ভিটায় আবার বাস্তুসাপ।
রাফিজার বুকটা কেঁপে যায়। সে তার শাশুড়ির কাছ থেকে শুনেছে এই বা¯তুসাপের চিন্তায় তার দাদী শাশুড়ি সারা জীবন কেঁদেছে। ফজল আলীর কাছ থেকে শোনা সে কিস্সায় তখন তার চোখের সামনে ঝলক মারে।
দুপুরেই আবার মেঘ আর বাদলা শুরু হলে, সুন্দরাজানের বিষয়টা অমিমাংসিত রেখে সবাই যার যার ঘরে ফেরে। রাফিজা বেগম ধানগুলো গোলা ঘরে তুলতে তুলতে ক্লান্ত। মনের মধ্যে বাস্তুসাপের কথা, সাপের খোলস কি সেও দেখেছে!
রাতে সে আবার গোলাঘরের যায়। ভ্যাপসা ধানের গন্ধে তার দুঃখ বাড়ে। জহরত আলীর বৌ-এর জন্য একবেলার রৌদও সে হারালো। অপক্ক ধানের গন্ধে তার কেবল মৃত শিশুটির কথা মনে হয়। চারপাশে মরা জীবের সঙ্গে এবার ধানের গন্ধ মিশে যায়!
গোলাঘরের পাশেই জহরত আলীর ঘর। হঠাৎ কেমন শব্দ শোনা যায়। সারাদিন সুন্দরজানের আর কোন ভাজ কেউ পায় নাই। কেমন খসখস শব্দে রাফিজা বেগমের মনে হয় বাস্তুসাপের কথা। আজ তো মাইজা আলী হাসনাহেনা উপড়ে ফেলছে, তাইলে?
রাফিজার মনে হয় সাপটা যেন সুন্দরজানের ঘরে ঢুকছে! বাস্তুসাপ নাকি ধানেরগোলা খোঁজে! কিন্তু জহরত আলী তো কোন গোলাঘরই নাই! রাফিজার কেমন ভয় ভয় লাগে, সে দ্রæত ঘরে ফিরে এসে ফজল আলীকে ডাকে, বউ এমন অস্থির দেখে ফজল আলী বিরক্তÑ চিল্লাইছো ক্য?
রাফিজা কিছু বলতে পারে না, সে ফ্যালফ্যাল করে স্বামীর দিকে চেয়ে থাকে। আর তার মনেহতে থাকে সুন্দরজান ধানের দাসীর বংশ। বাস্তুসাপের বংশ।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত