খুব তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয়েছিল দৃশ্যটাকে।একদিকে প্রবল গতি, তারই পাশে স্থিতি। খুব ইচ্ছে করল, ওই দৃশ্যের ভেতর গিয়ে দাঁড়াতে।
হাইওয়ে দিয়ে হুস হুস শব্দে মাটিতে কম্পন তুলে ছুটেযাচ্ছে গাড়ির পর গাড়ি। চারচাকার অজস্র ও অনবরত লহরীর মাঝে লরী ও ট্রাকগুলোকেও গতির নেশায় পেয়েছে, তাদের নির্দিষ্ট সীমা লঙ্ঘন করতে চাইছে তারা। প্রশস্ত রাস্তায় যে যার মতো এদিক ওদিক দিয়ে এগিয়ে চলাতে কোনো বাঁধা না থাকায় দুর্বার গাড়িগুলিকে কোনো হর্ণ সাধারণত বাজাতে হচ্ছে না। কয়েক লেনের হাইওয়ের দুপাশে গাছপালা নজর বাঁধবে তেমন বালাই সুসভ্য মানুষেরা রাখেনি।মাথার উপর, হাইওয়ের দুপাশে সীমাহীন শূন্যতা, মাঠও ফসলহীন।এই আপাত নৈঃশব্দের ভেতর গতির শব্দ কেবল। সমুদ্র আপাতভাবে শব্দহীন হয়,অথচ পেটের ভেতর অপরিমেয় জীবনসত্তা নিয়ে কী ব্যাপকশব্দময় ও সবাক! বেলাভূমিতে তার উত্তাল ঢেউআছড়ে পড়ার শব্দটুকুই শুধু শুনি আমরা।
তুমুল এই গতির পাশে নীচু শুকনো পতিত জমি, সেখানে তিন চারটি গরু চড়ছে, আর এক গরুর বাগাল। ব্যস! চারপাশে আর কিছু নেই -আরকোনো জীবন্ত প্রাণ নেই। কিন্তু সত্যি কি তাই?কোথায় নেই প্রাণ?দৃশ্য অদৃশ্য জগতের সর্বত্রই তো প্রাণের চলাচল অব্যাহত। দেখার নজর থাকলে সচল এক পূর্ণমাণ জগত যে বিরাজিত তা দেখা যায়, আর তার কেন্দ্রে তুমি তুমি আর তুমি। তোমার চারপাশে সে জগৎঠিক এক প্যানোরামা চিত্র।ওই প্যানোরামার ভেতর আপাত স্থির সেই বাগাল।
আমি তাঁকে দেখতে দেখতে নেমে যাই মাঠে। তখন শুধু তিনি আর আমি, কিন্তু দ্রষ্টা হিসাবে প্যানোরামার কেন্দ্রে তিনি, আবার আমিও একইভাবে।দুজন দুজনকে দেখছি।তাঁর চোখে প্রশ্ন থাকলেও তা আমায় ঘিরে তত কৌতুহলান্বিত নয়, বরং নির্বিকার ও খানিকটা সন্দেহ জড়ানো ভয় ক্ষণিকের জন্যভেসে উঠলসে চোখে, চোখ চঞ্চল হলো।মাঝারি উচ্চতা, বয়স বুঝতে না পারলেও পঞ্চাশের বেশি নয় বলেই অনুমান করলাম।কৃষ্ণবর্ণ গায়ে খড়ি ফুটেছে, মাথার চুল সদ্য গজানো কদম ফুলের রেনুর মতো,মুঠোতে কিছুতেই ধরা যাবে না।লাঠির উপর ভর রেখে তিনি উবু হয়ে বসেছিলেনদুটো চরাটরত গাইগোরুর পাশে।
কী বলে কথা শুরু করব? তাঁকে জিগ্যেস করি, “ও দাদা, এই গরুগুলো তোমার?”
“আমার ! আমার!” বলতে বলতে তিনি উঠে পড়ে গরুগুলিকে একবার জরিপ করে নেন। তারপর এগিয়ে গিয়ে যে গরুটা সামান্য দূরে চলে গিয়েছিল সেটাকে কাছাকাছি সরিয়ে আনেন।
এই রে, এ যে গরুর রচনা হয়ে যাচ্ছে! হাসি এলেও আমি কিন্ত গরু বিষয়েই কথোপকথন চালাতে থাকি।
রোজই তুমি গরু নিয়ে আসো এখানে?
“আসি! আসি! রোজ! রোজ!” তাঁর চোখ হাইওয়ের দিকে ভেসে গিয়েআবার গুটিয়ে আসে গরুগুলোর দিকে।
গাইগোরুগুলো দুধ দেয়? সব দুধই কি তোমরা খাও? নাকি কিছুটা বিক্রি করো?
বাবুরা খায়! সবটা খায়!
তোমার নিজের গোরু নেই?
বাবুদের বাবুদের!
তুমি সারাদিনই গোরু চড়াও? এই রোদের মধ্যেও তো বসে আছো! – একথা বলতেই তিনি হাতে ধরে থাকা একটা কাপড়ের টুপি মাথায় পরে নিলেন।চোখ গরুগুলোকে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে। ডাক দিলেন, “এই এদিকে আয়, এদিকে আয় -!”
তারপর বললেন, সারাদিন চড়াই! সারাদিন চড়াই!
খাও কোথায়? কত টাকা দেয়বাবুরা?
বুঝতেপারছিলাম, একসঙ্গে একাধিক প্রশ্ন করলে দ্বিরুক্তিতেএকটারই উত্তর সীমাবদ্ধ থাকবে। তাঁর শান্তভাবের আড়ালে তাঁর কাজের প্রতি নিষ্ঠা ও কর্মচাঞ্চল্য অনুভব করি আমি। ওঁকে আবার জিগ্যেস করি,ও দাদা,কোথায় ভাত খেলে?
তিনি দূরেবাইপাসের ধারেদু-তিনটিঘরবাড়ির দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বললেন,“হোটেলে–হোটেলে”।ওখানে একটাধাবা আছেবটে!
রোজই হোটেলে খান ভেবে আমি যে একটু অবাক হই না তা নয়। -রোজই হোটেলে খাও? বাড়িতে খাও না?বাড়ি কোথায়?
বাবুদের হোটেল!অর্থাৎ গরুগুলি হোটেলওয়ালার, আর সে লোক হোটেলওয়ালার বাঁধা বাগাল। তাই হিসাব মতো মালিকের বাড়িতে না খেয়ে তাদের হোটেলে খায়। কথা বলে জানতে পারি, শক্তিগড়ে ওনার বাড়িতে কেবল মা ছাড়া আর কেউ নেই। তিনি কাজ করেন কোল্ডস্টোরে, আর ছেলে সারাদিন মাঠে গরুর রাখালী করেন।বাবুরা তাঁকে চারবেলা খেতে দেন, সে ব্যাপারে যে তিনি সন্তুষ্ট তা তাঁর কথা থেকে অনুমান করা যায়। হোটেলেরই একপাশে মালিকের গোয়াল, সেখানেই একটা ছাউনিওলা চালায় রাতে তিনি একাই থেকে যান, একেবারে একা!
এই মাঠের মাঝে একাই থাকো!–আমার গলায় বিস্ময় টের পেয়ে উত্তর এলো,“ভয় লাগে না! ভয় লাগে না! ভয় কীসের? ভয় কীসের?আমার ভালো লাগে, ভালো লাগে!”
এই বিরাট জনশূন্যতার ভেতর একা একটা লোক, প্রতি রাতে একা!ভাবলাম,এ জায়গা সাধনার উপযুক্ত পরিবেশ হলেও আধারটি কিন্তু উপযুক্ত নয়।
আমার সঙ্গে যতক্ষণ কথা বলেছেন সেইটুকুতেও তাঁর চোখ গরুগুলোর দিক থেকে সরেনি। একটা বাছুর গোঁজে বাঁধা ছিল, সেই গোঁজ তুলে পাশে ঘাসবহুল জায়গায় সরিয়ে দিলেন। কর্তব্যে তাঁর একফোঁটাও গাফিলতি নেই। অর্থাৎ আপাত ধীর ও স্থির হলেও এবংমালিক তাঁর উপর নজরদারি না করলেও তিনি কর্মের ছন্দেই রয়েছেন।
বললেন একদিন অন্তর বাড়ি যান। আর প্রতিদিন গরুচড়ানো বাবদ যে কুড়িটাকা করে পান তা মায়ের কাছে রেখে আসেন। এই তথ্যগুলো আমি অসীম ধৈর্যে পরপর প্রশ্ন করে জানতে পারি। আশ্চর্যযে,উনি নিজে উপযাচক হয়েএকটা কথাও আমার সঙ্গে বলেননি,কিছু জানতেও চাননি।অনেক সময় একেবারে চুপ মেরে যাচ্ছিলেন,কোনো কথারই উত্তর না দিয়ে সন্দেহের চোখে জরিপ করছিলেন আমায়।কিন্তু ভালো করে তাকিয়ে দেখি সে চোখ বরং নির্বিকার।আমাকে দেখছেন না, আমাকে ভেদ করে আরও দূরে ভেসে যাচ্ছে সে দৃষ্টি।আর যখনই তাঁর নাম জানতে চাইছিলাম, তখনই কোন অজ্ঞাত কারণে আমার কাছ থেকে অনেকটা দূরে সরে যাচ্ছিলেন। দূর থেকে জুলজুল করে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকছিলেন।অদ্ভুত, সবই অদ্ভুত!শেষে আমাকে আর কাছে মোটেই ঘেঁষতে দিলেন না, গোরুগুলির সঙ্গে ক্রমাগত দূরে সরে যেতে যেতে পতিতজমির একেবারে শেষ প্রান্তে পড়ন্ত সূর্যকে পিছনে রেখে মাটিতে উবু হয়ে বসে পড়েছিলেন।
আমার রামকিঙ্করের কথা মনে পড়ল। গতকাল অন্নদাশঙ্কর রায়ের ‘পথে প্রবাসে’বইটা হাঁটকেপাঁটকে কোত্থাও খুঁজে পেলাম না, তার বদলে দেখি রামকিঙ্করের ‘মহাশয় আমি চাক্ষিক, রূপকার মাত্র’বইটা মুখ বাড়িয়ে টুকটুক করে হাসছে, যিনি নিরুদ্দিষ্ট ছিলেন কিছুকাল। যাক,অন্য বই খুঁজতে গিয়ে নিশ্চয় একইভাবে ‘পথে প্রবাসে’মিলে যাবে কোনো সময়। আসলে চোখের সামনে থাকলেও সবকিছু চোখের বা মনের পর্দায় ধরা পড়ে না।চারপাশে সবই থাকে, রূপ রস গন্ধমগ্ন এক চরাচর,তারইভেতরগতিশীল এক স্পর্শময়জগত।কী যেন ছুঁয়ে যায়, কীসের যেন স্পর্শ ঘটে বাতাসের বয়ে আনা কত কিছুর;কিন্তু পাঁচমিশেলি সব ছোঁয়ার ভেতর তা জড়িয়েমড়িয়ে থাকেতারের তালগোল পাকিয়ে।
রামকিঙ্করের সাক্ষাৎকারের এই লাইনগুলো মগজের কোণে ঘাই মারতে লাগলযে, “ওরা শ্রমিকের দল —ওরা কাজ করে — ওদের হাত আছে —ওরা অনেক সক্রিয় —কর্মসক্রিয়তা ভালো লাগে আমার। — ললিত সক্রিয় জীবন(দূরের বসত বাড়ি, অফিসবাড়ির দিকে ইঙ্গিত করে) dull life — যাদের প্রকৃত সক্রিয়তা আছে —তাদের এঁকেছি”।
কিন্তুওই যে মানুষটি স্থির হয়েবসে আছেন, ওঁকে কি রামকিঙ্কর আঁকতেন না? তিনি যে প্রখরভাবে কর্ম সক্রিয় নন! ওঁর পেশির সঞ্চালন নেই, শরীরে অন্তত এই মুহূর্তে দোলায়মান ছন্দ নেই! রামকিঙ্কর কীভাবে দেখতেন সে সম্বন্ধে আমি নিশ্চিত নই, কিন্তু আমি দেখছি এক ছন্দময় স্তব্ধ সমুদ্র।তীব্র সক্রিয় না হলেও শিল্পোকরণ হতে কোনো বাঁধা নেই তাঁর।
ও মানুষ আক্ষরিক অর্থে হাটের নন,তবে বাটের বটে এবং ভীড়ের বাইরের লোক।অথচ সব বিকিকিনির বাইরে হয়েও চলমান জীবনের হাটে এক কর্মচঞ্চল মানুষ হিসাবেতিনি এক চিরহাটুরে। যতটুকু কর্ম আর দায়িত্ব বিক্রি করেনতিনি, সে কাজে কোনো ফাঁকি নেই।আবার একথাও ঠিক, আমার খোঁজা আর পাঁচজন হাটুরে মানুষের সহজ-কঠিন জীবনযুদ্ধের আঁচ ওই মানুষের গায়ে লাগে না।কেমন সহজ করে নিয়েছেন জীবনের গতিকে! প্রবহমান চরাচরে জীবনের স্রোতে নিজেকে কেবল বয়ে যেতে দিচ্ছেন বলে অনুভব করলাম।
রামকিঙ্কর কথিত“অভিব্যক্তির জন্য বোধ ও অনুভূতি” ঘুম থেকে জেগে উঠতে থাকল আমার মধ্যে। একবার মনে হলো, ওই লোকটির ভেতর অতলান্ত এক দুঃখের ঢেউ নিরন্তর ভেঙে পড়ছে।পরেই মনে হয়, সমস্ত বোধের বাইরে থাকা, এক চিরনির্বোধ চক্ষুসর্বস্ব হয়ে অস্তিত্বময় ওই গরুর বাগাল। কিন্তু তাও সত্যি নয়, কারণ তিনি তো তাঁর বোধকে অভিব্যক্তির দ্বারা তাঁর মতো করেব্যক্ত করেন!নির্বোধ এক দর্শক হয়ে, গরু চড়াতে চড়াতে শুধু ঘাস খাওয়াই দেখে চলেছেন একথা বলা যাচ্ছে না।
তাই তিনি হলেনই বাকিছুটা ‘ধীর’ মস্তিষ্কের,আমি কোনো ‘জাজমেন্টে’যাব না।আমার অদ্ভুত এক অনুভূতিতে মন ছেয়ে যাচ্ছিল তখন।গোটা মাঠেই জলজ লতা, কলমির শুকনো ডালজুতোর নীচেমটমট করে ভেঙে পড়ছিল প্রতি পদক্ষেপে। বসে পড়লামসেই নীচু পতিত জমির শুকনো কলমিদামের উপর।আমিও তাঁর দিকে অপলক তাকিয়ে থাকি। আচমকা মনে হয়,দুটো মানুষের জগৎ দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেছে।আমি তাঁকে যেভাবে ভাবছি তিনি আমাকে সেভাবে নয়,তিনি আমাকে বুঝতে পারছেন না, আমিও তাঁকে সবটা নয়।
মাটির তলা থেকে উত্থিত এক কান্নার সুর আমাকে গ্রাস করছে তখন। মনে হলো আদিজননী কাঁদছে, তার বুকচাপা কান্নার সুর উঠে এসে আমাকে আমূল জড়িয়ে ধরছে! এক সন্তানের কন্ঠ উঠে আসছে, মা! মা! মা —! দু’ধরণের ডাক মিলেমিশে গিয়ে ইথারে ছড়িয়ে পড়তে থাকল।বাচ্চাদের যেভাবে দু’বগলে হাত রেখে ঘুরিয়ে একসময় দাঁড় করিয়ে দিলে সবকিছুঘুরছে বলে মনে হয়, আমার এখন সেরকম ভাবেই মনে হলো চারপাশের আদিগন্ত চরাচর সবকিছু নিয়ে ঘূর্ণমান। পায়ের তলার মাটি ভূমিকম্পে যেভাবে কাঁপে, সেভাবে কম্পমান।
আমি বিভ্রমে পড়ে যাই। এসবের অর্থ কী?ওই লোকটির সঙ্গে এসবের কী সম্পর্ক?ভূমিকম্প হচ্ছে? সত্যিই কি এসব ঘটছে,নাকি সবই আমার কল্পনাপ্রবণ মনের বিভ্রম?কিন্তু কেনই বা এই বিভ্রম, এর অনুঘটকই বা কী?
ধীরে ধীরে সব থেমে যায়, আর আমার কানে আসে হাইওয়ে দিয়ে বয়ে যাওয়া ছুটন্ত গাড়ির শব্দ ও হর্ণ। তখনই হাইওয়ের পাশে অপেক্ষারত আমার গাড়িটি থেকে চালক ডাকতে থাকেন। তাকিয়ে দেখি গরুগুলি সেই হোটেলের দিকে চলেছে, আর তাদের বাগাল প্রবহমান চেতনা নিয়ে স্থির ভাবে তখনও দূরে বসে আছেন স্থির ভাস্কর্যের মতোই।
আমি ফিরে আসি তাঁকে আর বিরক্ত না করে। সাধারণের চোখে হতে পারেনকিছুটা ‘অস্বাভাবিক’।আমার চোখে তিনি না সংসারী, না সাধক, তবু নির্বোধ নন। কারণ তাঁর ভেতর চেতনার ধারা বহমান না হলেএই একাকী নির্জনতা তাঁর ভালো লাগত না।বিশ্বসংসারের সঙ্গে মানুষ কোন্ গভীর বাঁধনে কীভাবে বাঁধা পড়ে থাকেন তা বোঝা সহজ নয় এটুকু বুঝতেপারি।
কেবলতাঁর নামটি আমার এ জীবনে আর জানা হলো না।
পূর্ব বর্ধমানের দক্ষিণ দামোদর অঞ্চলের অজ পাড়াগাঁয়ের ধুলোবালিতে জীবনের অনেকটা। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর। শিক্ষকতার বৃত্তি। কবিতা প্রথম প্রেম। প্রকাশিত কবিতার বই এখনও পাঁচটি। গদ্যের বই তিনটি গদ্যগ্রন্থের মধ্যে ‘দক্ষিণ দামোদর জনপদ’ উপন্যাস, যেটি সাম্প্রতিক কালে ‘সাজি’ পত্রিকা কর্তৃক অজিত রায় স্মৃতি সম্মাননা লাভ করেছে।