খোঁপায় বেলিফুলের মালা আজকাল তেমন কোনো তরুণীকে পড়তে দেখা যায় না। কিন্তু এই তরুণী গ্রীষ্মের এই ভরদুপুরের বীভৎস গরমে এতো সুন্দর করে বেলিফুলের মালায় খোঁপা সাজিয়েছে যা বলার অপেক্ষা রাখে না। ছিপছিপে গায়ের গড়নের সাথে পরিপাটি করে পরা শাড়িটিও বেশ, রাসবেরি কালারের। চোখমুখে ভীষণ খুশির উজ্জ্বল আভা। তরুণীটি যার হাতে হাত রেখে সামনে হাঁটছে সেই তরুণের চোখেমুখেও চাপা উচ্ছ্বাস। ঢাকা জজ কোর্ট এলাকায় ওরা বুঝি নতুন জীবনের শুরু করলো! চারপাশে আইনজীবীদের ব্যাপক আনাগোনা। পুরাণ ঢাকার ঘিঞ্জি গলিতে মানুষ হাঁটার সুযোগ না থাকলেও হকাররা কীভাবে যেন নিজেদের জায়গা করে নেয়। পসরা বসায়। এখানে হকাররাই গলির দুইপাশের অধিকাংশ জায়গা দখল করে নিয়েছে। মাঝের সরু পথ দিয়ে হাঁটছে ওই তরুণ-তরুণী। ওরা আজ বিয়ে করেছে। নতুন জীবনের শুরু করেছে। দূর থেকে রুদ্রনীল ওদেরকে দেখছে। আর মাথার ভেতরে ফ্ল্যাশব্যাকে একের পর সেইসব ঘটনা ভাসছে। রুদ্রনীল একদিন রূপকে নিয়ে ঠিক এভাবেই জীবন শুরু করেছিল। সেইসব স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠছে।
আজ এক বিশেষ কাজে ও আজ আদালত পাড়ায় এসেছে। আইনে মাস্টার্স অধ্যয়নকালীন সহপাঠী, আইনজীবী পান্না লালের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলতে বলতে ওই তরুণ-তরুণীকে দেখে নস্টালজিক হয়ে পড়েছে। আহ্ জীবন! সেইসব প্রেমকথা, আনন্দ, খুনসুটি, সোহাগ কোথায় হারিয়ে গেলো? পান্না লালের একটা মামলার শুনানি আছে বলে তড়িঘড়ি চলে গেলো।
গরমে মানুষ ঘেমেঘেটে একাকার হয়ে যাচ্ছে। সামনেই এক সবজি বিক্রেতা জল ছিটিয়ে ঝাঁকার ঝিঙে-পটল-বেগুন-ঢেঁড়সগুলোকে একটু তাজা করার চেষ্টা করছে। রুদ্রনীলের চারপাশ দিয়ে কতশত মানুষ হেঁটে যাচ্ছে, সবার মধ্যেই অদ্ভুত তাড়াহুড়ো। হাঁটতে হাঁটতে ও জেলা জজ আদালত ভবনের দিকে যায়। নিচতলায় পারিবারিক আদালতের এজলাসের দিকে চোখ যায়। ভেতরে বিচার কাজ চলছে। ওর চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেইসব দুর্বিষহ স্মৃতি। রূপের বাবার করা মামলায় কী ভোগান্তিই না পোহাতে হয়েছিল! আচ্ছা, রূপ এখন কোথায় আছে? কেমন আছে? নিশ্চয়ই স্বামী সংসার নিয়ে দিব্যি ভালো আছে!
কোর্টে সদ্য বিবাহিত এই তরুণ-তরুণীকে দেখে জীবনের ফেলে আসা দিনের কথাগুলোকে ভীষণ মনে পড়ছে। এই তো জীবন! সমুদ্রের মতো। কখনো উত্তাল, কখনো শান্ত শীতল সৌম্য। কখনো থম ধরে থাকে। কখনো প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে সবকিছু ওলটপালট হয়ে যায়। আবার একসময় সব শান্ত হয়ে যায়। থাক, ওসব কথা আর মনে করতে চায় না রুদ্রনীল। একপাগল এসে ওর সামনে হাত পাতে। হাসি দেয়। পানের রসে পাগলের হলুদ দাঁতগুলো খুব বিশ্রীরকমের দেখাচ্ছে। রুদ্রনীল পকেটে হাত দিয়েছে এমন সময় পান্না লাল চলে আসে।
-কী? পাগলের প্রতি মায়া লাগছে?
-তেমন কিছু না। মনে হলো দশটা টাকা ওকে দেই, এই আরকি।
-জনশ্রুতি আছে, এই পাগলের বউ তাকে তালাক দেওয়ার পর পাগল হয়ে গেছে।
– তালাকের কারণ কী ছিল?
-শুনেছি, ওর বউ আরেকজনের সাথে প্রেমে মজে ছিল, সেই দিকেই চলে যাবে বলে তালাক দেয়।
রুদ্রনীল আর কোনো কথা বলে না। এসব শুনতে ভালোও লাগছে না।
ওরা হাঁটতে হাঁটতে চলে আসে জনসন রোডে। সারাদিনই এই রাস্তায় জ্যাম লেগে থাকে। একেবারে সদরঘাট থেকে শুরু করে বংশাল হয়ে গুলিস্থান পর্যন্ত এই জ্যাম বিস্তৃত হয়। এখনও তেমন জ্যাম। প্রিজন ভ্যানের ভেতর থেকে বন্দিদের কয়েকজন চিৎকার করে করে কী যেন বলার চেষ্টা করছে। সবাই একসাথে বলছে বলে কারো কথাই বোঝা যাচ্ছে না। এর মধ্যেও একজনের কথা বোঝা যাচ্ছে।
-তুই আমার মাইয়ারে লইয়া বাইত্তে যা। ট্যাকা পয়সা যহন যা লাগে, লতিফ কাকার কাছ থিকা নিবি। আমি বাইর হইয়া সব শোধ দিয়া দিমু। আমার মাইয়ারে কষ্ট দিবি না।
ওই আসামীর স্ত্রী আর পাঁচ-ছয় বছর বয়সী মেয়ে প্রিজন ভ্যানের সমান্তরালে হাঁটছে। ঠিক হাঁটা নয়, দৌঁড়াচ্ছে বললেও ভুল হবে না। হঠাৎ প্রিজন ভ্যান কিছুটা ফাঁকা পেয়ে জোরে টান দিলো। মেয়েটি কেঁদে উঠলো।
-আব্বা…
মেয়ের কান্না দেখে আসামীর স্ত্রীও ফুটপাতে বসে কেঁদে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। আদালত পাড়ায় এমন ঘটনা রোজই ঘটে। ফলে কেউ তেমন বিষয়টিকে আমলে নিচ্ছে না। যে যার মতো হেঁটে চলে যাচ্ছে। রুদ্রনীলও ঘটনাটা দেখেও না দেখার ভান করছে। কিন্তু ভেতরটা কেমন যেন করে ওঠে।
-কী রুদ্রনীল, আপনার খুব মায়া হচ্ছে বুঝি ?
-নাহ, আপনি যা ভাবছেন তেমনটা নয়।
রুদ্রনীলরা বিউটি লাচ্ছিঘরের সামনে চলে এসেছে। গরম আর ঘামে ভীষণ তেষ্টা পেয়েছে। দোকানটার ভেতরে বাইরে কোথাও বসা তো দূরের কথা, দাঁড়ানোরও সুযোগ নেই। অগত্যা ওরা ফুটপাত থেকে নেমে রাস্তায় দাঁড়ায়। চারপাশে হার্ডওয়ারের দোকানপাট ভরা। সে কারণে এদিক থেকে ওদিক থেকে লোহালক্কড়ভরা বস্তা নিয়ে ছোট ছোট ঠেলাগাড়ি সদৃশ বাহন এলোমেলোভাবে ওদের সামনে দিয়ে, পেছন দিয়ে চলে যাচ্ছে। আবার খুব সাবধানেও থাকতে হচ্ছে, কোথাও লাগলেই জখম। টিটেনাস ভ্যাকসিন ছাড়া গতি নেই। একঝাঁক মানুষ একসাথে দোকানের ভেতর থেকে বের হতেই ওরা ভেতরে গিয়ে বসলো। এই দোকানের আইটেম বলতে পাওয়া যায় ফালুদা, লাচ্ছি আর লেবুর শরবতের কয়েক প্রকার। ভিড় সামলাতে অনেকের সাথে একজন বয়স্ক ব্যক্তিও ঝুঁকে বসে লাচ্ছি বানাচ্ছে। অর্ডার করার দুইমিনিটের মাথায় বরফকুঁচিভরা লাচ্ছি চলে এলো। রুদ্রনীলের মাথার ভেতরে তখনও ওই শিশুটি ও তার মায়ের কান্নার অনুরণন হচ্ছে। জীবনের এতো এতো হিসেব মেলানো কারো পক্ষেই কি সম্ভব? আর সেইসব হিসেবের শেষই বা কোথায়? মুহূর্তেই ওদের লাচ্ছি শেষ।
বাইরে এসে অনলাইন রাইড শেয়ারিং অ্যাপসে কল করে পান্না লাল। ওরা খুব কাছাকাছি এলাকাতে থাকলেও দেখা সাক্ষাৎ খুব কম হয়।
-তা আপনার আর কি খবর?
-চলছে, চলে যাচ্ছে।
-চললেই তো সাইকেল পড়ে না, থেমে গেলেই ধপাস।
-তা ঠিক।
রাইড-শেয়ারিং প্রাইভেট কারটি চলে আসতেই ওরা উঠে পড়লো। ভেতরে এসি থাকায় বাইরের গরমের অসহ্য ভাবটা মুহুর্তেই হাওয়া হয়ে গেলো। জ্যাম ঠেলে গাড়ি এগুতেই নয়াবাজার মোড় থেকে পুরো রাস্তা ফাঁকা পেলো। রুদ্রনীল গাড়িতে ঘুমিয়ে গেলো। যারা প্রতিদিন ঢাকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে জজ কোর্ট এলাকায় যাতায়াত করেন তাদের কাছে, এইসব জ্যাম, ভোগান্তি অনেকটা সয়ে গেছে।
গাড়িটি চলতে চলতে একসময় ধানমন্ডি চলে আসে। রুদ্রনীলের ঘুম ভেঙে যায়। স্টারকাবাবের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, সেই সদ্য বিবাহিত তরুণ-তরুণী। কারণে কিংবা অকারণে ভীষণ হাসাহাসি করছে। নতুন জীবন শুরু করে হয়তো সেলিব্রেট করছে। তরুণীর খোঁপার বেলিফুলের মালা তখনও উজ্জ্বল। রুদ্রনীল অপার মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে থাকে ওদের দিকে। মুহুর্তেই ওদের পেছনে ফেলে গাড়িটি ছুটে চললো।
কবি
জন্ম ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪, সাঁথিয়া, পাবনা, বাংলাদেশ। কবি, কথাসাহিত্যিক, আলোকচিত্রী ও আইনকর্মী।
পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর। এমবিএ করেছেন হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট (এইচ.আর.এম) (প্রথম মেজর) এবং মার্কেটিং (দ্বিতীয় মেজর) বিষয়ে। আইনবিজ্ঞানে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাতকোত্তর (এলএল.এম)। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে বর্তমানের একাডেমিক ব্যস্ততা। পদার্থবিজ্ঞানের স্নাতকোত্তর করার সময় অসামান্য ফলাফলের কারণে অর্জন করেছেন উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টি বোর্ড অ্যাওয়ার্ড এবং সর্বোচ্চ একাডেমিক সম্মান The Summa Cum Laude অ্যাওয়ার্ড। ফটোগ্রাফিতে বেসিক, ফাউন্ডেশন ও ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জনের পাশাপাশি ফটোগ্রাফি বিষয়ে বহু উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। বিভিন্ন সময় আলোকচিত্র প্রতিযোগিতায় স্বীকৃতি স্বরূপ পেয়েছেন অনেক পুরস্কার। প্রতিনিয়ত বর্ণিল কর্ম-অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জকে অতিক্রম করে নিজেকে তিনি করে তুলেছেন অনন্য। বর্তমানে বাংলাদেশের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা পিপলস ওরিয়েন্টেড প্রোগ্রাম ইমপ্লিমেন্টেশন (পপি)-এর মানবসম্পদ ও প্রশাসন বিভাগে কর্মরত। সৃজনশীল কাজগুলো সবসময় তাঁকে তাড়া করে বেড়ায়। সেই তাড়ণ থেকে লিখে চলেছেন কবিতা-গল্প-উপন্যাস-গান। সম্পাদনা করছেন শিল্প ও সাহিত্যের কাগজ ‘সমরাত্রদিন’। আইন বিষয়ে সাধারণ মানুষের সচেতনতা বাড়াতে ও সহযোগিতা করতে পরিচালনা করছেন স্বেচ্ছাশ্রম প্ল্যাটফর্ম ‘ইভোকেটিভ লিগ্যাল সার্ভিসেস’।
লেখকের প্রকাশিত বইয়ের তালিকায় রয়েছে :
প্রায়ান্ধকারের ফুটনোট (কথাকবিতা)
প্রায়শ্চিত্তের অর্কেস্ট্রা (গল্পগ্রন্থ)
স্বীকৃতিহীন অপরাজিতা (উপন্যাস)
দেবতার সাথে ছলচাতুরী (উপন্যাস)
নিঃশব্দে অপরাহ্ণের মৃত্যু (উপন্যাস)
ভূত ও গোয়েন্দা মুখোমুখি (থ্রিলার উপন্যাস)
অথচ আছি নিখোঁজের বেশে (কবিতা)
দৈবযোগে বেঁচে আছি (কবিতা)
অজানা (কবিতা)
সুবর্ণ জন্মজয়ন্তী : সুব্রত কুমার দাস (সম্পাদনা)
মাহফুজা খানম সম্মাননা গ্রন্থ (যৌথ সম্পাদনা)
E-mail : [email protected]