রোনাল্ডো

ইরাবতী ধারাবাহিক:ফুটবল (পর্ব-১৮) । দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়

Reading Time: 4 minutes

অষ্টম শ্রেণির দুই বন্ধু রাজ আর নির্ঝর। রাজ আর অনাথ নির্ঝরের সাথে এইগল্প এগিয়েছে ফুটবলকে কেন্দ্র করে। রাজের স্নেহময়ী মা ক্রীড়াবিদ ইরার অদম্য চেষ্টার পরও অনাদরে বড় হতে থাকা নির্ঝর বারবার ফুটবল থেকে ছিটকে যায় আবার ফিরে আসে কিন্তু নির্ঝরের সেই ফুটবল থেকে ছিটকে যাবার পেছনে কখনো বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় নির্ঝরের জেঠু বঙ্কু। কখনো বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় বঙ্কু ও তার ফুটবলার বন্ধু তীর্থঙ্করের বন্ধুবিচ্ছেদ। কিন্তু কেন? সবশেষে নির্ঝর কি ফুটবলে ফিরতে পারবে? রাজ আর নির্ঝর কি একসাথে খেলতে পারবে স্কুল টিমে? এমন অনেক প্রশ্ন ও কিশোর জীবনে বড়দের উদাসীনতা ও মান অভিমানের এক অন্য রকম গল্প নিয়ে বীজমন্ত্রের জনপ্রিয়তার পরে দেবাশিস_গঙ্গোপাধ্যায়ের নতুন কিশোর উপন্যাস ফুটবল আজ থাকছে পর্ব-১৮।


 

 

প্রেয়ারের ঘন্টা পড়ল।  রাজ টাস্কগুলো তাড়াতাড়ি করে নিয়ে স্কুলগ্রাউন্ডে দৌড়াল।এক এক ক্লাস সারি বেঁধে। রাজ লাইনে এসে দাঁড়িয়ে দেখল  টুয়েল্ভের লাইনে ইন্দ্রদা তাকে ইশারা করে ডাকছে। ইশারায় সে জানাল  একবার যেন পরে ওর সঙ্গে রাজ   দেখা করে। সে মাথা নাড়াল। দাদাগুলোর মধ্যে ইন্দ্রদা মানুষটা ভালো। তাকেও খুব পছন্দ করে।তবে  ওর এখন খুব চিন্তা, আর বোধহয় খেলতে পারবে না!

 দুচারদিন আগে কথাটা ইন্দ্রদা তাকে বলেছিল । খেলা শেষ হবার পর ইন্দ্রদা তাকে হঠাৎ ডেকে বলছিল, “শোন সৌম্য।“

“কি?”

ইন্দ্রদা বলেছিল,-“ আমার আর খেলা মনে হয় হবে না।“

রাজ অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়েছিল।সে বলেছিল,”ধ্যাত! কি যে বল!”

“হ্যাঁরে। সত্যি বলছি।“

রাজ চিন্তায় পড়ে গেছিল। ইন্দ্রদা খেলবে না তা হয় নাকি? সে জিজ্ঞেস করেছিল, “কেন?খেলবে না কেন?”

“বাবা একটা কাজ জুটিয়েছেন আমার জন্য। কাজটা না করলে হবে না।“

“কি কাজ?”

“একটা শপিং মলে। সকাল থেকে রাত আটটা পর্যন্ত।“

“স্কুল?”

“এখন তো এইচ এস।স্কুলে মাঝেমাঝে আসব। কিন্তু  খেলতে আসব কি করে বল?”

“তাহলে  লিগটা খেলবে না?”

 ইন্দ্রদা বিমর্ষ গলায় বলেছিল, “আমি খেলবই। কিন্তু স্যার যদি না নেন?”

রাজ কিছু উত্তর দিতে পারে নি। স্যার এমনি ভাল, কিন্তু এক্টু-ওদিক হলে নিস্তার নেই।প্রচন্ড ডিসিপ্লিনড। নইলে ইন্দ্রদা প্লেয়ার হিসেবে খাঁটি, কিন্তু  তার উপর যদি ডুব দিতে শুরু করে তাহলে খেলা থেকে বাদ দিয়ে দেবে। নির্ঝর  আসছে না যেমন। সে যদি বাই চান্স ফিরেও আসে স্যার কি দুম করে তাকে খেলায় নেবেন? রাজ ভেবেছিল। তার মন কেমন করে উঠেছিল নির্ঝরের জন্য। কে জানে ও আর আসবে না বোধহয়।

ইন্দ্রদা গায়ে ঠেলা মেরে তাকে বলছিল, ”এই কি ভাবছিস?”

“না। কিছু না। বল।“

“বলছি। তুই একটু স্যারকে ম্যানেজ করবি?”

রাজ আঁতকে উঠেছিল।সে বলেছিল, “আমি!”

“হ্যাঁ। স্যার তোকে খুব  পছন্দ করে। তুই যদি আমার সমস্যাটা বুঝিয়ে বলিস।“

  ইন্দ্রদা তার দিকে করুন চোখে তাকিয়ে ছিল। রাজ মাথা নাড়িয়ে বলছিল,- “আচ্ছা বলব। কিন্তু আমার কথা স্যার শুনবেন কিনা তা জানি না।“

ইন্দ্রদা বলেছিল,” তুই বললেই হবে। স্যার তোর খুব প্রশংসা করেন।“

“আমার?”

“হ্যাঁ। স্যার বলেন সৌম্য পড়াশুনো খেলাধুলাতে যেমন ভাল তেমনই  ওর মনও খুব ভাল।“

“তাই! আমি কি করলাম?“

“ তা জানি না। স্যার নিশ্চয় বোঝেন।“

রাজ মাথা নেড়েছিল। কেন জানে না  স্যার তাকে প্রথম থেকেই পছন্দ করেন। স্যারকেও তার ভাল লাগে। একটু-আধটু বকেন, কিন্তু তা তেমন গায়ে লাগে না। সে বলেছিল, “আচ্ছা।“

স্যার বোধহয় নিশ্চয় কিছু একটা বলছেন তাই ইন্দ্রদা তাকে ডাকছে।প্রেয়ারলাইন থেকে সে ইশারা করে   সে হাত নেড়ে বলে দিল টিফিনে দেখা করবে। এখন যদি রাজ ইন্দ্রদার  দেখা করতে চায় তাহলে স্যারদের চোখে পড়ে গেলে মুসকিল।


আরো পড়ুন: ফুটবল (পর্ব-১৭) । দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়


 প্রেয়ার হয়ে গেল। রাজ ক্লাসে ফিরল। স্যার কখন আসবেন তার ঠিক নেই। মাইকে অ্যানাউন্স করা হয়েছে ক্লাসে হইহট্টগোল না করে চুপ করে বসে থাকতে। মনিটরদের বলা হয়েছে ক্লাস কন্ট্রোল করতে। হীরক আর নীলেশ মনিটর দুজনেই বুদ্ধিমান। তারা জানে আজ কেউ তাদের কথা শুনবে না। তাছাড়া রোজ রোজ পাহারাদারের কাজ কি ভাল লাগে? তারা প্রথমে দু-একবার সবাইকে হইচই করতে বারণ  করল তারপর তারা নিজেরাও হইচইতে মেতে উঠল।

কিছুক্ষন পরে  অবশ্য সরোজস্যার এলেন।তিনি গম্ভীরমুখে ছাত্রদের গুনে দুই সেকসনকে জুড়ে দিয়ে গেলেন। বলে গেলেন,” আজ  সেকশন শুধু এ  চলবে।“

রাজদের ঘরে পাশের ছাত্ররা এল। তার পাশেই বসল একটা ছেলে। তার মুখ চেনা। সে নাম জানে না ওর। ছেলেটা বসেই বলল, “তুই সেদিন বনামালী রোডে গেছিলিস না? তুই আর তোর মা?”

রাজ বলল, “হ্যাঁ। তুই?”

“আমার ওদিকেই বাড়ি। তোকে দেখলাম গলির মধ্যে ঢুকতে।“

রাজ বলল, “ ও।“

ছেলেটা বলল, “  ওখানে কে থাকে তোদের?”

রাজ বলল, “ ওই যে নির্ঝর থাকে না ওদের বাড়ি গেছিলাম।“

ছেলেটা বলল,- “বুঝেছি। গতবছর এক ক্লাসে ছিলাম। এবছর পালটে গেছে। তবে ও নাকি স্কুল ছেড়ে দিয়েছে শুনলাম। সত্যি রে?”

রাজের  আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।  প্রায় পনেরদিন হয়ে গেল। নির্ঝর এল না!মায়ের কথা শুনেও ওর জেঠু  ওকে আনলেন না। সে অন্যমনস্কও হয়ে মাথা নাড়ল।

ছেলেটা বলল, “কালকে ওকে  রাস্তায় দেখলাম।“

রাজ চমকে উঠে বলল, “ দেখেছিস ওকে?”

“হ্যাঁ।“

“ভাগ! কি করে হবে নির্ঝর এখানে নেই।“

“বললেই হল! আমি দেখেছি।“

 এ সময়  শুভেন্দু স্যার হেলতে দুলতে ক্লাসে  এলেন। রাজদের কথাবার্তায় ছেদ পড়ে গেল। রাজের মাথায় শুধু ঘুরে গেল ছেলেটার কথা। নির্ঝরকে নাকি ও দেখতে পেয়েছে। তাই কখনও হয়? যদি  ও ফেরে তবে কি স্কুলে আসবে না? নাকি  সত্যি সত্যি বাড়ি ফিরে এসে স্কুলে আসবে না?

 টিফিন পিরিয়ডে ইন্দ্রদার খোঁজে রাজ  টুয়েলভএর ঘরে গেল। এখন তার সঙ্গে আছে বর্নিক।ইদানিং ওর সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়েছে। বর্নিকের চেহারা গোলগাল, খেলার সাতে-পাঁচে নেই।কিন্তু সে সব খেলা সম্পর্কে উৎসাহী।ওর কাছে একটা ডায়েরী আছে। তাতে বিখ্যাত খেলোয়াড়দের ছবি সাঁটা।ওর বাড়ি এখনো যায় নি রাজ।  কিন্তু বর্নিক বলেছে ওর বাড়িতে নাকি একটা বিরাট সাইজের  রোনাল্ডোর ছবি আছে। সে তার বিরাট ভক্ত। তবে ওর একটা ব্যাপক দক্ষতা আছে। সে গড়গড় করে খেলোয়াড়দের রেকর্ড বলতে পারে। ওর হেভি ফান্ডা। একবার ওর বাড়ি যাবার ইচ্ছে আছে রাজের।

বর্নিকযেতে যেতে  বলল,“কাল ইউটিউবে একটা রোনাল্ডোর একটা পুরানো খেলা দেখলাম। উফ! কি গোল করল রে রোনাল্ডো!”

রাজ বলল,“ তাই?

 “হ্যা, দুটো প্লেয়ারকে কি কাটল রোনাল্ডো।একদম হিলিয়ে দিল “।বর্নিক ভঙ্গী করে দেখাল। কিন্তু ওর চেহারায় তা ফুটল না। তবু ওর উৎসাহে ভাঁটা পড়ল না। সে বলল,” রোনাল্ডোর হাইট জানিস । ছয় ফুট দুই। ওয়েট  চুরাশি কেজি।“

 অন্যসময় রাজ মেসির হয়ে একটু গলা ফাটাত। মেসি সম্পর্কে সে অনেককিছু জানে। কিন্তু এখন  তার মাথায় নির্ঝর ঘুরছে।সে তবু ঠাট্রার স্বরে বলল, “তোর ওয়েটও তো রোনাল্ডোর কাছাকাছি।“

বর্নিকের রাগ নেই। সে তার গায়ে ঠ্যালা মারল একটা।

 ইন্দ্রদা  করিডোরে  বন্ধুদের সাথে দাঁড়িয়ে ছিল। সে তাকে দেখে এগিয়ে এল। রাজ বর্নিককে বলল, “ তুই একটু দাঁড়া। ইন্দ্রদা কি বলে শুনে আসি।“

 ইন্দ্রদা কাছে এল। তার কাঁধে হাত রাখল।তারপর বলল, “স্যার কাল কিছু বলল নাকি?”

গতকাল ইন্দ্রদা মাঠে আসে নি।স্যার যদিও ওর কথা আলাদা করে তোলেন নি। শুধু একবার সবার উদ্দেশ্যেই কথাটা তুলেছিলেন। অনেকের  ফাঁকি দেবার কথা তিনি বলেছিলেন।এমন করলে চান্স না দেবার কথাই স্যার বললেন।এরমধ্যে নিশ্চয়ই ইন্দ্রদাও আছে। রাজ এখন সেকথা জানিয়ে বলল,“তুমি কাজ শুরু করেছে নাকি?”

“হ্যাঁ। দুদিন গেছি।আজ ভাবছি মাঠে আসব।“

“আচ্ছা।“

“শোন না। তোকে যে জন্য ডেকেছি?“

 এ ব্যাপারে তাকে ডাকে নি ইন্দ্রদা।ভেবে নিশ্চিত হল রাজ। যাক, তাকে স্যারকে কিছু বলতে হবে না। স্যার ভালমানুষ, তবু স্যারের সামনে কিছু বলতে ভয় হয়। সে বলল, “ কি গো?”

“নির্ঝরের  খবর জানিস?”

রাজ মাথা নাড়িয়ে বলল, “কি জানি ও বোধহয় স্কুল ছেড়ে দিয়েছে। দিনপনের হল আসে না।“

“ আমি ওকে কাল দেখলাম তো!”

রাজ অবাক হয়ে চেয়ে রইল। তাহলে ওই ছেলেটা সত্যি কথাই বলেছে। সে বলল, “ তাই! তুমি দেখেছ?”

“হ্যাঁ। আমি গতকাল বিকেলে বাড়ি ফিরছিলাম। তখন।“

“কোথায়?”

“ওদের এলাকায়। ওখান দিয়েই তো আমাকে যেতে-আসতে হয়।আমি একটা দোকানের কাছে নির্ঝরকে দেখলাম।“

“তারপর?”

“ ওর সঙ্গে আমার  কথা হয় নি। যাই হোক ও এসে গেছে স্বস্তি। আমাকে  দুর থেকে ইশারা করে জানাল আগামীকাল স্কুলে আসবে।এই খবরটার জন্যই তোকে ডাকলাম।“

মায়ের  কথা ভেবে রাজের আনন্দ হল। সেদিন বঙ্কুজেঠুর ফোন নাম্বার নিয়ে এসেছিলেন। মাঝেমধ্যেই তাকে বলেছেন নির্ঝরকেফিরিয়ে আনার জন্য।মায়ের কথা শুনেই বঙ্কুজেঠু  ওকে ফিরিয়ে আনলেন।আগামীকাল স্কুলে ও এলে সবকিছু জানা যাবে।

ইন্দ্রদা বলল, “দেখিস।পরের ম্যাচ আমরা জিতব।“

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>