| 28 মার্চ 2024
Categories
সাক্ষাৎকার

ইরাবতীর মুখোমুখি লেখক ও গবেষক রোহিণী ধর্মপাল

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

ড. রোহিণী ধর্মপাল অধ্যাপিকা, শিক্ষা বিজ্ঞান বিভাগ, রামকৃষ্ণ সারদা মিশন বিবেকানন্দ বিদ্যাভবন। প্রাচীন ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে আগ্রহী এবং নিয়মিত লেখালেখি করেন। পৌরোহিত্য করেন, মূলত পুরো নতুন বৈদিক পদ্ধতিতে বিবাহ দেন এবং রবিগান কঠোপনিষদ ও ঋক্ মন্ত্রসহ অন্যরকমভাবে শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শৌনক দত্ত


 

 

শৌনক দত্ত: তোমার প্রথম লেখাটির কথা মনে আছে? সেই লেখার সময়টা তোমার বেড়ে ওঠা পরিবার নিয়ে জানতে চাই?

রোহিণী ধর্মপাল: আমার প্রথম যে লেখাটির কথা বলব, সেটি কিন্তু অনেক ছোটবেলায় লেখা এবং কোন পত্রিকার জন্য লেখা গল্প বা কিছু নয়। একটা প্রশ্নের উত্তর মাত্র। কিন্তু সেই অভিজ্ঞতাটা আমার কাছে এখনো সমান, সমান ভাবে স্পষ্ট। কারণ সেই লেখাটা পড়ে মায়ের চোখে জল এসেছিল। ঈশ্বরী পাটনী ও অন্নপূর্ণা, ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর এর লেখা কবিতার এই অংশটি অষ্টম বা নবম শ্রেণীতে আমাদের ছিল। প্রশ্নটি ছিল যে ঈশ্বরী পাটনীর চরিত্র। সেখানে সবশেষে আমি লিখেছিলাম ঈশ্বরী পাটনী যেন আমাদের এখনকার এই লোভী ভোগ-বিলাসী পৃথিবীর দিকে হাত জোড় করে বলছে যে এত কিছু চেওনা। চাহিদা কমাও। নিজের সন্তান যাতে মানুষ হয়ে ওঠে, শুধু সেইটুকু প্রার্থনা করো। তাহলে তোমাদের যে নৌকার পাটাতন, সেটিও সোনার হয়ে যাবে। এই যে সরল আকুতি, এটুকুই আমার মনে হয়েছিল ঈশ্বরী পাটনী চরিত্রের সবথেকে বড় বৈশিষ্ট্য। আর এই উত্তরটি পড়ে ওই যে বললাম, মায়ের চোখে জল এসেছিল, তাই প্রথম লেখার কথা বলতে গেলে আমি এই লেখাটির কথাই বলবো। আর সেই সময়ের বাড়ির পরিবেশ? সেই সময় বাড়ির পরিবেশ বলবো না। ছোট থেকেই আমার কাছে বাড়ির পরিবেশ মানে আসলে ছিল মায়ের পরিবেশ। মায়ের কথা বলা মায়ের চলাফেরা মায়ের প্রতিদিনের জীবন যাপন জীবনচর্যা জীবন চর্চা। কী চাহিদাহীন, কী অসম্ভব সহজে খুশি! সবেতে খুশি! আমার মনে হয় যখন আমি লিখেছিলাম, তখন বোধহয় ঈশ্বরী পাটনীর চরিত্রে মাকে দেখেছিলাম। যদি পরিবেশ জানতে চাও তাহলে আমি এটুকুই বলবো।

 

 

তোমার তো পারিবারিকভাবেই সাহিত্যের একটা পরিমন্ডল ছিল সেটাই কি তোমাকে সাহিত্যের প্রতি টেনে নিয়েছে নাকি অন্য কোন ভালবাসা অন্য কোন গল্প?

রোহিণী ধর্মপাল: বাড়ির পরিমণ্ডলে সাহিত্য থাকলেই যে সাহিত্য চেতনার জন্ম হবে বা লিখতে পারবে তার কিন্তু কোনো মানে নেই। তাহলে পৃথিবীর সমস্ত বিখ্যাত সাহিত্যিকের সন্তানেরা বা তাঁদের আশেপাশে দীর্ঘক্ষণ সময় কাটানো মানুষেরা সাহিত্যিক হয়ে উঠতেন। সাহিত্য চেতনা এমন একটি স্ফুলিঙ্গ আর, সেটা যে কখন কার মধ্যে কেন জন্মাবে, তা কিন্তু এত সহজে বলা যায় না। হ্যাঁ, বাড়ির পরিমণ্ডল নিশ্চয় সেটাকে সাহায্য করে। কিন্তু লেখা তৈরি হওয়ার জন্য প্রত্যেকের জীবন, জীবন বোধ কোথায় কখন কিভাবে প্রভাবিত করবে তা আগে থেকে বলা অসম্ভব। এবং ওই যে বললাম, কোন একটা মুহূর্তের স্ফুলিঙ্গ তোমাকে শিল্পী করে তুলতে পারে। তা যদি তোমার মধ্যে যদি না থাকে তুমি শিল্পী হতে পারবে না। শুধু সাহিত্যিক নয়। কোন শিল্পীই হতে পারবে না। ধরো, তুমি গান গাইতে পারো। অপূর্ব গান গাইতে পারো। হয়তো বা ব্যাকরণগত ভাবে সম্পূর্ণ শুদ্ধ গাইছ। কিন্তু তোমার গানের সুরে ভাব নেই। তা মনকে ছুঁচছে না। ওই ভাবটিই জীবন দেয়। একমাত্র জীবন।

 

ছাত্র রাজনীতি করেছ?

রোহিণী ধর্মপাল: এখন বেশ লজ্জা করে, আসলে আমরা যে প্রত্যেকেই প্রতিপদে রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে আছি, সেটা কলেজ কেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ও বুঝতাম না। নিজের পছন্দের বই পড়া, নিজের জীবনেও তখন অনেক রকম জটিলতা শুরু হয়ে গেছে, মা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, এ সমস্ত কিছু নিয়েই এমন মগ্ন ছিলাম যে কোন সচেতনতা তৈরি হয়নি। এমনকি এই মাঝ বয়সেও সচেতনতা কতটা তৈরি হয়েছে তা জানি না। বরং এখনকার প্রজন্ম অনেক বেশি সচেতন এই ব্যাপারে।

,রোহিণী ধর্মপাল

কিছুতে বিশ্বাস স্থাপন করায় কী লেখকের কোন ক্ষতিবৃদ্ধি বা চাপে থাকতে হয়?

 

রোহিণী ধর্মপাল: কোন কিছুতে আমি যদি সত্যিই বিশ্বাস করি, তা আমার ক্ষতি করবে কেন বা চাপ তৈরি করবে কেন? এমনকি আমি কোন কিছুতেই বিশ্বাস করি বলেই যদি কোন সংবাদ মাধ্যম বা যদি কোন প্রকাশক আমার লেখা আদৌ প্রকাশ না করেন, তাহলেও আমার তাতে চাপ তৈরি হবার কথা না। আবারো বলছি যদি আমি কোনো কিছুতে সত্যিই বিশ্বাস করি, তবেই। আসলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখেছি যে নিজের বিশ্বাসকে আড়ালে রেখে বাইরের পৃথিবী বা প্রকাশক বা সংবাদ মাধ্যম যা চাইছেন বহু মানুষ তাই নিয়েই লেখেন আমার মতে তারা বিকৃত এবং বিক্রীত, দুইই হয়ে যান।আমি মায়ের ক্ষেত্র কখনো তা দেখি নি আমার নিজের ক্ষেত্রেও কখনও তা হবে না বলেই বিশ্বাস রাখি। তবে হ্যাঁ তাই বলে যা বিশ্বাস করি কেউ যদি যুক্তি সহকারে বুঝিয়ে দিতে পারে তোমার এই বিশ্বাসে বা বোঝাতে ভুল ছিল, তখন নিজেকে পরিবর্তন করে না নেওয়ার মতন অনুদার নিশ্চয়ই নই। কিন্তু যুক্তি দিয়ে বোঝাতে হবে। নয়ত আমার বিশ্বাসে আমি অটল থাকব।

 

 

 

বিখ্যাত মানুষের সন্তানদের সব সময় তাদের বাবা মায়ের সাথে তুলনা করা হয়,অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই চাপটা কাটিয়ে উঠতে পারে না সন্তানরা তোমার ক্ষেত্রে সেটা কেমন?

 

রোহিণী ধর্মপাল: তুলনা! ওরেব্বাবা!! আমি অতি সাধারণ ছাত্র ছিলাম। কখনোই ভালো রেজাল্ট করিনি। এমনকি ফেল পর্যন্ত করেছি। ফলে আমাকে সর্বসমক্ষে স্কুলে এমন প্রশ্ন শুনতে হয়েছে যে আমি গৌরী ধর্মপালের নিজের মেয়ে কিনা! স্কুল ছাড়া পরিবারে তুলনা অনেকেই করেছেন। বৃহত্তর পরিবারও। ক্ষুদ্র পরিবারও। কিন্তু কখনো, কখনো মায়ের কাছ থেকে তুলনা আসেনি। বরং মা যদি কখনো কেউ এরকম তুলনা করছে বলে দেখেছে, মা যদিও অত্যন্ত শান্ত ছিলেন কিন্তু এক্ষেত্রে মা বাঘিনীর মত ঝাঁপিয়ে পড়ত। তাই শেষ পর্যন্ত আমার কোন অসুবিধা হয়নি।

 

 

গৌরি ধর্মপাল বলতেই চোখে ভেসে ওঠে মেধাবী, ধীর ও মায়াবী একটা মানুষ যার আষ্টেপৃষ্টে কেবল স্নেহ আর ভালবাসা। মা গৌরি ধর্মপাল ও লেখক গৌরি ধর্মপালকে তুমি কিভাবে দেখো?

 

রোহিণী ধর্মপাল: মাকে নিয়ে আলাদা করে বলা উচিত। আলাদা করে লেখা উচিত। এইটুকু বলি এখানে মা গৌরী ধর্মপালকে আমি ঋষি বলে মনে করি, যিনি জ্ঞান এবং সংসারের পারে যেতে পেরেছেন কোনও রকম অহমিকা ছাড়াই। ঋষি হতে গেরুয়া পরতে হয় না। ধার্মিক হতে গেলে পুজো করতে হয় না। পণ্ডিত হতে গেলে কথায় কথায় পাণ্ডিত্য দেখাতে হয় না।

আমার কাছে আমার মা-ই আমার ঈশ্বর। আমার জীবন। আমার যেটুকু ভালো, সবটাই মায়ের জন্য। আমার দেখার চোখ, শোনার কান আর মনের সৌন্দর্য অনুভব করার মন আমি উত্তরাধিকার সূত্রে মায়ের থেকে পেয়েছি। আর কী চাই!

 

রোহিণী ধর্মপাল

তোমার বাবা কেমন ছিলেন?

 

রোহিণী ধর্মপাল: বাবা সম্পর্কে আমার সেইভাবে কিছু বলার নেই।

 

 

তুমি কি নারীবাদে বিশ্বাসী? তোমার ভাবনায় নারীবাদ কেমন?

 

রোহিণী ধর্মপাল: নারীবাদে বিশ্বাসী তো বটেই। তবে দেখো নারীবাদ এবং পিতৃতন্ত্র, কথা দুটোই একটা ধারণা। অর্থাৎ একটি নারীও প্রবলভাবে পিতৃতান্ত্রিক হতে পারে, ঠিক তেমনভাবেই একজন পুরুষও নারীবাদী হয়ে উঠতে পারে।
এই মুহূর্তে অন্ততপক্ষে আমাদের দেশে নারীর ক্ষমতায়নের জায়গাটায় আমরা এতটা পিছিয়ে আছি যে নারীবাদ নিয়ে এখনো দীর্ঘ পথ হাঁটা বাকি। সুতরাং এই প্রশ্নটার উত্তর দেওয়া এত স্বল্প পরিসরে কখনোই সম্ভব নয়। কিন্তু নারীবাদ মানে মনে রাখতে হবে ওই একটি দিন নারী দিবস পালন করা যেটা আসলে আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস, যেটিকে আমরা শুধু নারী দিবসে পরিণত করেছি এবং ওই মহার্ঘ শাড়ি গয়না প্রসাধনী দ্রব্য এগুলিতে একটা বেশ বড়সড় ছাড় পাওয়া, এগুলোও ঘোর পিতৃতান্ত্রিকতা। একটি মেয়ে যখন নিজের ভাললাগার জন্য, নিজেকে দেখানোর জন্য সাজবে, তবেই সেই সাজটাও নারীবাদ। কিন্তু পুরুষকে দেখানোর জন্য, পুরুষদের চোখে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠার জন্যই তো আমাদের সমস্ত রকম বিজ্ঞাপন। তা নয়ত আমাদের এই কৃষ্ণা সুন্দরীদের দেশে ফর্সা-হওয়ার-ক্রিম এমন বিক্রি হতো না!
নারীবাদ মানে কিন্তু যে মেয়েটি মাঠে-ঘাটে কাজ করে, রাস্তায় থাকে, কাগজ কুড়োয়, তাদেরকেও মর্যাদা দেওয়া। নারীবাদটা না কিরকম একটা একটা শহুরে ভাষা, বেশ বড়লোকি পরিবেশে আলোচনার বিষয়বস্তু অথবা আর একটু ভালো করে বললে বিদ্যা চর্চার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ওই একটি বিশেষ দিনে তাই নিয়ে সেমিনার করা, প্রতিবাদী হতে বলা, নাটক করা এরকম জায়গায় আটকে আছে বলে আমার মনে হয়। নারীবাদীতার মানে কিন্তু প্রতিটা দিন প্রতিটা মুহূর্ত নিজেকে আরো ভেতর থেকে শক্ত করে তোলা। তোমার চারপাশে যে কজন মানুষ আছেন সমস্ত দুর্বলতা কে জয় করে তাদের শক্ত করে তোলা। প্রেমে ভালোবাসায় পৃথিবী কে আরো সুন্দর করে তোলা।

 

 

লেখালেখি নিয়ে তুমি কী কোন সময়সূচী মানো?

 

রোহিণী ধর্মপাল: না। লেখালেখি নিয়ে সময়সূচী একেবারেই আমি মানি না। প্রকৃতপক্ষে আমি কোন কিছু নিয়েই সময়সূচী মানিনা। আমি বড্ড অগোছালো মানুষ। কিন্তু কেমন ভাবে যেন পরপর কাজ হয়ে যায়। তাই দেখে হয়তো বাইরের মানুষ মনে করেন আমি গোছানো। আর সময়সূচী মেনে সৃষ্টির কাজ হয় কি আদৌ? জানি না। অন্তত আমার সে ক্ষমতা নেই। সময়সূচী মেনে পড়তে বসা যায়। সময়সূচী মেনে প্রশ্নোত্তর তৈরি করা যায়। কিন্তু দেখো এই যে তোমার পাঠানো প্রশ্নগুলি, তার উত্তর দিচ্ছি, তার জন্যও আমি কোন সময় সূচি মানিনি। আমার যখন ইচ্ছে করে তখনই আমি কোন কাজ করতে পারি। হয়ত বাধ্যতামূলক কিছু কাজ থাকে, যেগুলো করতেই হয়। আর লেখালেখির ক্ষেত্রে তো এক্কেবারে যতক্ষণ না আমার ভেতর থেকে জিনিসটা বেরিয়ে আসছে, আসতে চাইছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি কিচ্ছু পারি না। যখন বেরিয়ে আসে, তুমি বোধহয় একজন অন্যতম সাক্ষী যে যখন ইরাবতীতে নারী পুরুষের মিলন কাহিনী শুরু হচ্ছে, তখন কিরকম ভাবে আমি তোমাকে পরের পর পর্ব পাঠিয়ে গেছি। তখন আমাকে একেবারে যেন লেখায় পেয়েছিল। আমি নিজেকে আটকাতে পারছিলাম না। ঝর্ণাধারার মতন অবিরল গতিতে অবিশ্রান্তভাবে সেই লেখা বেরিয়ে এসছে। কিন্তু আবার দীর্ঘদিন হয়ত কিছুই লেখা হয়ে ওঠে নি। এটা বোধহয় সব সৃষ্টির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষেরই হয়। আর যেহেতু ফরমায়েশি লেখা ব্যাপারটাতে আমি খুব একটা বিশ্বাসী নই, যাঁরা লেখাকেই উপজীব্য করে রয়েছেন অর্থাৎ লেখা যাঁদের পেশা, তাদের কিছু করার থাকেনা। এড়ানোর থাকেনা। কিন্তু আমাকে তো এখনো পর্যন্ত কেউ সেভাবে বাধ্য করেননি কারণ লেখার ওপর ভিত্তি করে আমি বাঁচি না। আর্থিকভাবে অন্তত না। তবে মানসিকভাবে তো এই আমার আনন্দের অন্যতম উৎস। কিন্তু এর কোন নির্দিষ্ট সময় সূচি আমার দরকার হয় না।

 

 

 

লেখালেখিকে কী তুমি পরিশ্রমসাধ্য বলে ভাবো?

রোহিণী ধর্মপাল: পরিশ্রমসাধ্য বলতে তুমি কি বলতে চাইছ? মাল বইবার মতন পরিশ্রমসাধ্য তো অবশ্যই নয়। তবে মস্তিষ্কের খাটুনি তো হয় খানিকটা। বিশেষ করে যদি কোন তথ্য দিতে হয়। সেই প্রতিটি তথ্য যেন ঠিক থাকে, লেখার পারম্পর্য যাতে ঠিক থাকে, ধারাবাহিকতা যাতে ঠিক থাকে এবং অবশ্যই যাতে লেখার মান বজায় থাকে– এই সমস্ত ব্যাপারগুলোকে ঠিক রাখতে গেলে পরিশ্রম হয়। কিন্তু পরিশ্রমসাধ্য বলতে আমরা যা বুঝি লেখালেখি ঠিক সেইরকম বলে আমি মনে করি না। এখানে আনন্দটা অনেক অনেক বেশি।

 

একজন শিক্ষক হিসেবে তুমি নিঃসন্দেহে জানো আমাদের স্কুল পর্যায়ে শিক্ষা ব্যবস্থার কী হাল হয়ে আছে। উত্তর প্রেদেশে ইতিহাসের বইয়ে বাবরের রাজ্যনীতি নিয়ে ইতিহাস অনেকটা পরিবর্তন করা হয়েছে? 

 

রোহিণী ধর্মপাল: শিক্ষাব্যবস্থার বর্তমান অবস্থা শুধু এখন কেন! বহু বছর ধরেই যা হাল হয়ে আছে এবং প্রতিদিন যেভাবে গড়গড়িয়ে তা নিচে নামছে তা নিয়ে বলতে গেলে তো একেবারে গবেষণাপত্র নামাতে হয়! ইতিহাস বিকৃতি আমাদের একটা কেমন যেন স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে! যে শাসকদল রাজ্য বা দেশ চালাবেন, তাঁদের ইচ্ছামত ইতিহাস তৈরি করবেন, এটা চিরকালই হয়। কিন্তু বিকৃত করবেন একটা তথ্যকে, একটা ঘটনাকে সম্পূর্ণভাবে দেখাবেন না, নিরপেক্ষ থাকবেন না, এটা হচ্ছে এবং খুব দুঃখের বিষয় শিক্ষকদের একাংশও এর সঙ্গে যুক্ত। সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত যাঁরা, তাঁরাও তাঁদের দায় একেবারেই এড়াতে পারেন না। কিন্তু এটা নিয়ে খুব দীর্ঘ আলোচনায় আমি এই মুহূর্তে যেতে চাইনা কারণ তোমার অন্য প্রশ্নগুলির সঙ্গে এই প্রশ্নটার ঠিক সাদৃশ্য নেই এবং ওই যে বললাম এটা নিয়ে বলতে গেলে শুধু এটা নিয়ে বলতে হয়।

 

তুমি কি মনে কর সমাজের একটি নির্দিষ্ট অংশ হিন্দু জাতীয়তাবাদের সাথে ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে এক করে দেখার চেষ্টা করছে?

 

রোহিণী ধর্মপাল: হিন্দু জাতীয়তাবাদ আর ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে এক করে দেখানোর কথা যেটা বলছ, সেখানে আমার উত্তর একটাই হবে। যেকোনো মৌলবাদ সবসময় বিপদজনক। যে কোন ধর্মের মূল কথা মানুষের মঙ্গল অথচ প্রতিটি ধর্ম এখন পৃথিবীর অকল্যাণের দিকে, মানুষের ক্ষতি করার দিকে, নিষ্ঠুরতার দিকে, নির্মমতার দিকে, প্রেমহীনতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

 

 

তুমি ও তোমরা কজন মিলে বৈদিক বিয়ে দাও। শুরুর দিনের গল্পটা শুনতে চাই। তোমাদের কি কোন আদর্শ বা পৌঁচ্ছানোর ব্যাপার আছে? আসলে বলতে চাইছি কাজটা কেন করছো?

        

রোহিণী ধর্মপাল: বৈদিক বিয়ের গল্পটা এবার বলি। শুধু বৈদিক বিয়ে বললে কিন্তু একেবারেই চলবে না। কারণ সারা ভারতবর্ষজুড়ে যে ক’টি হিন্দু বিবাহ হয় তার প্রত্যেকটিতেই কিছু-না-কিছু বৈদিক মন্ত্র বলা হয়। মা এই পদ্ধতির নাম দিয়ে গিয়েছিলেন পুরোনোতুন বৈদিক বিবাহ। আমরা প্রতিমুহূর্তে সেটাকে যুগোপযোগী করে তোলার চেষ্টা করছি। মা কিছুটা করেই গেছিলেন। সত্যি বলতে কি বিয়ের মন্ত্র সংস্কৃতের সঙ্গে মাতৃভাষায় উচ্চারণ করা হচ্ছে, এটাই নিজের মধ্যে একটা বৃহত্তর বিপ্লব। তাছাড়া কিছু শব্দের পরিবর্তনও করে গেছিলেন। আমরাও সেটা করছি। সব থেকে বড় কথা কন্যাদানের মতোই অসম্ভব পিতৃতান্ত্রিক একটি প্রথা সেটা তো উঠানো হয়েছে ১৯৯৫ সালে আমার বিয়েতে। আমরা সিঁদুর পরানোও তুলে দিতে চাইছি। চাইছি উভয় উভয়ের কপালে টিপ পরাবে। বধূর সিঁথিতে কিন্তু কোনোরকম লাল চিহ্ন পড়বে না। কারণ সিঁদুর যদি শুভ হয় এবং তা প্রতিদিন পরার হয়, তাহলে ছেলেটিই বা পরবে না কেন? আর তার থেকেও বড় কথা সিঁদুরের ইতিহাসটা তো খুব সুন্দর নয়। এটা একটি মেয়েকে ‘তুমি শুধু আমার’ এই বলে চিহ্নিত করে দেওয়া। ঠিক যেরকম ওই যে ভেড়া বলি দেওয়া হলে তার কপালে একটা লাল টিপ পরিয়ে দেওয়া হয়, সেই রকম। আমরা কিন্তু পুরুষ পুরোহিতদের মতন করেই বিয়ে দিচ্ছি নারী-পুরোহিত, এমনটা একেবারেই নই। আমাদের কাজ সমাজে বদল আনা। এই বিয়ের পদ্ধতিতে, শ্রাদ্ধ ইত্যাদি পদ্ধতিতে যা যা কিছু এমন আছে যা গ্রহণীয় নয় অথবা অবমাননাকর, তার সবটাই আমরা বাদ দিচ্ছি। আমাদের ঐতিহ্যের শোভন দিকটি বজায় রেখে যা কিছু অসুন্দর, তা বাদ দিচ্ছি।

এই কাজের শুরুটা যদিও হয়েছিল অন্যভাবে। মায়েরই দুই ছাত্রী মায়ের বিবাহ পদ্ধতি অনুসরণ করে, মায়ের বই অনুসরণ করেই বিয়ে দিত এবং হঠাৎ করেই তারা বলতে শুরু করে সমস্ত অনুবাদ থেকে শুরু করে সমস্ত পরিকল্পনা, সবটা তাদেরই করা এবং সেই মিথ্যা বহু সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয় এবং আমার প্রতিবাদ সেখানে সত্যিই কোন জায়গা পায়না। এই ফেসবুক আর সোশ্যাল মিডিয়া কিন্তু আমাকে সেই প্রতিবাদ করার জায়গাটা করে দিয়েছিল এবং সেই মায়ের অপমানের প্রতিবাদ হিসেবে আমার এই কাজে আসা এবং শুরু।

তবে এখন লক্ষ্য হল সমাজের সব স্তরে এই নতুন ভাবনাটা ছড়িয়ে দেওয়া এবং অবমাননাকর সমস্ত পদ্ধতি, এমনকী অবমাননাকর শব্দগুলিরও পরিবর্তন করা।

রোহিণী ধর্মপাল

তোমার বাড়িতে বিশাল একটা বইয়ের সংগ্রহ ছিল, ভিন্ন বিষয়ের এবং অনেক দুস্প্রাপ্য বই। তোমার পঠন পাঠনের সময়গুলো কেমন ছিল আর কী পড়েছিলে? সেগুলো তোমার লেখালেখিতে কাজে লাগে?

 

রোহিণী ধর্মপাল: হ্যাঁ। আমাদের বাড়িতে লাইব্রেরীটি বেশ সমৃদ্ধ। কারণ দীর্ঘদিন ধরে বাড়ির প্রত্যেক সদস্য তার পছন্দের বই সংরক্ষিত করে আসছে সেখানে। বিশেষ করে লাইব্রেরির ভীমভাগ জুড়ে আছে মায়ের সংগ্রহীত বইগুলি। পড়াশোনার সময় খুব একটা কাজে না লাগলেও আমার পিএইচডির সময়ে এবং এই মুহূর্তে আমার অধিকাংশ লেখালেখির সময় সবটাই প্রায় আমি বাড়িতে বসেই পেয়ে যাই।

 

 

নারী মুক্তি প্রসঙ্গে কারো কারো মন্তব্য ধর্মীয় অনুশাসনই নারী মুক্তির প্রধান বাধাতুমি কিভাবে দেখো?

রোহিণী ধর্মপাল: দেখো, নারীমুক্তির ক্ষেত্রে বাধা কিন্তু অনেকগুলো। শুধুমাত্র ধর্মীয় অনুশাসনকে ধরলেই হবে না। কারণ সারা পৃথিবীতেই যে কোন ধর্মেই মেয়েদেরকে খানিক ছোট করা হয়েছে বরং বলতে পারো আমাদের ধর্মে শুরুতে মেয়েদের যথেষ্ট স্বাভাবিক স্থান দেওয়া হয়েছিল কিন্তু পরবর্তীকালে সেখানেও স্খলন শুরু হয় এবং যুগের পর যুগ ধরে মেয়েদের বলা হয়েছে যৃ তোমরা আসলে পুরুষেরই অধীনে। প্রতিটা বয়সে। জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে । মেয়েদের উপর যে বহুবিধ অত্যাচার হয়ে এসছে সে গুলির বর্ণনাতে আর যাচ্ছি না। আমরা সবাই মোটামুটি জানি। বাল্য বিবাহ থেকে সতীদাহ থেকে বৈধব্য থেকে আরম্ভ করে কোন ক্ষেত্রে কোন স্বাধীনতাই মেয়েদের ছিল না এবং তার সঙ্গে আর্থিক স্বাধীনতাও। এটা একটা বড় কথা কিন্তু। মনে রাখতে হবে এই বর্তমান সময়ও আর্থিক স্বাধীনতা পাওয়ার পরেও এখনো বহু মেয়ে মানসিকভাবে নয় পিতৃতান্ত্রিক অথবা নিজের শক্তি সম্পর্কে, অধিকার সম্পর্কে অচেতন। মেয়েদের এগিয়ে নিয়ে আসার লড়াইটা কিন্তু অনেকখানি জায়গা জুড়ে বিস্তৃত।

 

 

তোমার প্রিয় বই? যা সব সময় কাছে রাখতে চাও?

রোহিণী ধর্মপাল: আমি জানিনা আদৌ এরম কোন প্রিয় বই হয় কিনা যা সব সময় কাছে রাখতে ইচ্ছে করে! প্রিয় বই অনেকগুলি। তাই সবসময় কাছে রাখা সম্ভবই না। তবে হ্যাঁ, আমি যে ঘরে সবথেকে বেশি সময় কাটাই, সেই ঘরে আমার প্রিয় বই গুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা থাকে।

 

প্রিয় কবি?

রোহিণী ধর্মপাল: আমি জানিনা এই উত্তরটা হয়তো অনেকেরই অপছন্দ হবে। কিন্তু তাতে আমার খুব একটা কিছু এসে যায় না। আমি কবিতা ভালোবাসি না। কারণ খুব বেশি বুঝি না।

 

প্রিয় ব্যক্তিত্ব? প্রিয় লেখক?

রোহিণী ধর্মপাল: প্রিয় ব্যক্তিত্ব প্রিয় লেখক অবশ্যই মা।

 

প্রিয় গল্প?

রোহিণী ধর্মপাল: মায়ের প্রায় প্রতিটি ছোটগল্প বিশেষ করে প্রথমদিকের লেখা ছোটদের গল্প অসম্ভব প্রিয়। মনে করি, অমন লেখা আর কেউ লিখতে পারবেন না। বিভূতিভূষণ ও শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কিছু লেখা প্রিয়। মাসী বাণী বসুর লেখা অধিকাংশই অত্যন্ত পছন্দের। আর রূপকথা পড়তে এখনও ভালোবাসি।

 

 

প্রিয় উপন্যাস?

রোহিণী ধর্মপাল: প্রিয় উপন্যাস একটা মাত্র নাম যদি করতেই হয়, তবে তা মৈত্রেয় জাতক

 

ভবিষ্যতে কি মানুষ সাহিত্য লিখবেপড়বে? সাহিত্যের কি আর প্রয়োজন হবে ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে?

রোহিণী ধর্মপাল: দেখো আমার কেমন যেন মনে হয় সাহিত্য গান নাচ এই সমস্ত মানুষের প্রবৃত্তিও। সুতরাং এ না থাকলে মানুষও থাকবে না। পৃথিবীও থাকবে না।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত