তেলেগু অনুবাদ: ভগবানের সন্ধানে । রাবুরী ভরদ্বাজ
লেখক পরিচিতিঃসাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার বিজেতা ডঃরাবুরি ভরদ্বাজ তেলেগু সাহিত্যের একজন প্রতিষ্ঠিত লেখক। লেখকের রচনায় গভীর অনুভূতি,ব্যাপক জীবন দর্শন, সততালেখককে এক বিশেষ মাত্রা দান করেছে। লেখকের ‘কৌ্মুদী’উপন্যাসটি হিন্দিতে অনূদিত হয়েছে।আলোচ্য গল্পটি ডঃ কে রামানায়ডুর হিন্দি থেকে বাংলায় অনূদিত।
তেলেগু থেকে অনুবাদ- বাসুদেব দাস
আমি প্রতিজ্ঞা করে বলছি। আমার কথায় বিশ্বাস করুন। গত চার-পাঁচ বছর থেকে, যদি ঠিক ঠিক বলা হয় তাহলে পাঁচ বছর থেকে ভগবানকে দেখার জন্য আমার মনে প্রবল ইচ্ছা জেগেছে। এতক্ষণে আপনি নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন আমি একটু জেদি ধরনের। আমার জন্ম কুণ্ডলীই কিছুটা বাঁকা ধরনের।আমার কোনো কাজ সহজে এগোয়না।কাজকে খোঁড়াতে দেখেও আমি চুপ করে বসে থাকি না। হয় কাজ আমার শেষ দেখবে নয়তো আমি কাজের শেষ দেখে নেব। প্রতিটি কাজের মাঝখানে কিছু কিছু জটিলতার সৃষ্টি হয়। আমি প্রাণপণ চেষ্টায় তার সমাধান করি।একটি সমস্যার সমাধান হতে না হতে অন্য সমস্যার সৃষ্টি হয়। সেটার সমাধান প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ক্রুদ্ধ হলে কাজ হয়না।ধীরে ধীরে যতক্ষণে একটা গিঁটকে ঠিক করে আনি ততক্ষণে পুরো সুতোটাই পেঁচিয়ে যায়। সেটাও এতটাই যে তার আদি-অন্ত কোনোটাই খুঁজে পাওয়া যায়না। যতক্ষণে তার সন্ধান পাই,ততক্ষণে সুতো থেকেই মন উঠে যায়। অথবা তার প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়।
সম্ভবত এর আগে ভগবানকে দেখার আমার ইচ্ছাটা আমার মনের কোণে সুপ্ত হয়েছিল। সেই সম্পর্কে আমি জানতাম না যদি থেকেও থাকত তাহলে অন্যান্য ইচ্ছার নিচে চাপা পড়ে গিয়েছিল। প্রথমে এই ইচ্ছাটা এতটা শক্তিশালী ছিল না। যখন মনে হল তখন থেকে আমি চুপ করে বসে ছিলাম না।
৫জুলাই ১৯৭৮সনের বুধবার ছিল। সেদিনই আমি ভগবানকে দেখার নিশ্চয় করে নিয়েছিলাম। এটা নিশ্চয় শুধু আমার দিক থেকেই হয়েছিল একথা বলা যায় না। আজকাল আমার অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু আত্মীয় এবং হিতৈষী ব্যক্তি মিলেমিশে সম্ভবত আমাকে ঠিক করার সংকল্প গ্রহণ করিয়েছে। বোধহয় এটা এই সংকল্পের একটি ছোটো অংশ যা আমাকে ভগবানের কাছে নিয়ে যাচ্ছে ।আমি আপনাদের কাছে প্রথমেই নিবেদন করেছি যে ভগবানকে দেখার ইচ্ছা আমার ক্ষেত্রে অনেকদিন থেকে সুপ্ত অবস্থায় ছিল। সেই ইচ্ছাকেই আমার এই সমস্ত হিতৈষীরা জাগিয়ে দিয়েছে। আমিও বলেছি ঠিকই আছে।
আমি কোন তারিখের কথা বলেছিলাম জুলাই পাঁচ না নয়। সম্ভবত এটাও বলেছি যে সেদিন বুধবার ছিল। আমার ভালো করে মনে আছে। সেদিন সকাল থেকেই গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। দুপুর হতে হতে বর্ষার ঠান্ডা হাওয়া কাবু করে ফেলেছিল। বিশাল গাছগুলি ঠান্ডায় কাঁপছিল। সারা আকাশ মেঘের ভারে পীড়িত হয়ে আর্তনাদ করছিল। যখনই আর্তনাদ কমে আসছিল তখনই বিদ্যুতের ঝলসানি আকাশকে চমকে দিচ্ছিল।
বিকেল চারটে বাজে। আমার সমস্ত বন্ধুরা সম্ভবত আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। তাছাড়া ততক্ষণে বৃষ্টিও থেমে গিয়েছিল। রাস্তায় হাঁটু পর্যন্ত নোংরা জল জমে গিয়েছিল। জলের ওপর দিয়ে গাড়ি বাস এবং লরি দ্রুতবেগে পার হয়ে যাচ্ছিল । জলের ছাঁট থেকে পরনের কাপড়কে বাঁচানোর চেষ্টা করতে করতে আমার মতোই কোনো একজন পথিক আমার আগে আগে যাচ্ছিল।
আকাশবাণী ভবন থেকে আমার বাড়ি যাবার জন্য দুটি রাস্তা আছে। তার মধ্যে একটি রাস্তা আমার খুব প্রিয়। যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো অপ্রিয় কিছু না ঘটে, আমি এই রাস্তা দিয়েই যাওয়া-আসার অভ্যাস করে নিয়েছি ।
কেন জানেন কি ?
খুরমা আমার খুব পছন্দের । মুনিয়াকে আমি গত চার-পাঁচ বছর থেকে জানি। এর আগে সে অন্য কোথাও ছিল, কীভাবে ছিল, তা আমি জানিনা।পাঁচ বছর আগে নতুন নতুন শুরু হওয়ার সময় স্কুলের গেটের সামনে সে তেঁতুল গাছের নিচে একটা ছোটো বস্তা বিছিয়ে মনোহারি দোকান খুলেছিল। এই ধরনের কিছু লোককে আমি জানি, যারা পাঁচ বছর আগে ছোটোছোটো দোকান নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিল, কিন্তু আজ হাজার টাকা কামাচ্ছে। কিন্তু মুনিয়ার দোকান না বেড়েছে, না কমেছে, যেরকম ছিল এখনও তেমনই রয়েছে।
খুরমা আমার খুবই প্রিয়, আমি বলেছিলাম। মুনিয়া বেলুন, রবার এবং পেন্সিলের টুকরো, ভেঁপু, আঁখের টুকরো ইত্যাদির সঙ্গে খুরমা বিক্রি করত। আমি রোজ মুনিয়ার ওখানে খুরমা কিনতাম। যদি কোনো কারণে সঠিক সময়ে আমি মুনিয়ার ওখানে যেতে পারতাম না, তাহলে সে খুব অধীরতার সঙ্গে আমার জন্য অপেক্ষা করত।
একবার হঠাৎ আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। অফিস যেতে পারছিলাম না। মুনিয়া আমার খো়ঁজে অফিসে গিয়েছিল। সেখানেই সে জানতে পারে যে আমি অসুস্থতার জন্য ছুটি নিয়েছি। সে কাউকে সঙ্গে নিয়ে দ্রুত আমার বাড়িতে চলে এসেছিল। হাসপাতালে ছিলাম। আমার দ্বিতীয় ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে মুনিয়া হাসপাতালে পৌঁছে গিয়েছিল। আমাকে দেখেই সে জোরে জোরে কাঁদতে শুরু করে। আত্মীয়ের মতো সে আমার সমস্ত শরীরে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। সঙ্গে আনা পুঁটলি থেকে সে দুটি খুরমা বের করে আমাকে খাইয়ে দেয়। এরপর থেকে মুনিয়ার সঙ্গে আমাদের পরিবারের প্রতিটি সদস্যের একটি বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।
আসল কথায় আসছি। সেদিন আমি ভগবানের খোঁজে যাচ্ছিলাম। তাই সকাল সকাল বেরিয়ে ছিলাম। এরমধ্যেই জোরে জোরে বৃষ্টি হতে লাগল এবং ভয়ানক তুফান শুরু হয়ে গেল। তবু মুনিয়ার খুরমার প্রতি আমার মোহ কাটল না। সড়কে উঠে আমি স্কুলের দিকে ফিরে তাকালাম । সবগুলি ঝুপড়ি পড়ে মাটির সঙ্গে মিশে গিয়েছিল । সড়কের পাশের গাছ শিকড় শুদ্ধ উপড়ে স্কুলের স্কুলগেটের উপরে ঝুঁকেছিল।
গাছটার নিচে বসত মুনিয়া। সে কোথায় গেল।
আমার রক্তের চলাচল দ্রুত বেড়ে গেল। আমি ডালপালায়,গেটের সামনে ঝুপড়িতে মুনিয়াকে খুঁজতে লাগলাম।
মুনিয়া ছাদের নিচে জড়োসড়ো হয়ে বসে কাঁপছিল।
‘ মা ,চলবাড়ি যাই।’
‘ ঝড় বৃষ্টি থেমে গেছে?’ মুনিয়া জিজ্ঞেস করল।
মুনিয়ার সমস্ত জিনিসপত্র ভিজে গিয়েছিল। সেসব দেখে মুনিয়া কেঁদে ফেলেছিল।
জিনিসপত্রের পুঁটলি সহ আমি যখন মুনিয়াকে বাড়িতে নিয়ে গেলাম, ততক্ষনে রাত হয়ে গিয়েছিল। মুনিয়াকে বারান্দায় বসিয়ে আমি মাঝখানের রুমে ঢুকে ছিলাম।
আমাকে দেখেই গোপী চিত্কার করে উঠল,’ বাবা, আপনাকে ভগবানও ঠিক করতে পারবে না। না আপনি নিজে বুঝতে পারেন, না অন্য কারও কথা শোনেন। এতক্ষণে তারা আপনার জন্য অপেক্ষা করে করে চলে গিয়েছে। যাতে আপনি না ভেজেন সেই ভয়ে তারা অফিসে গাড়িও পাঠিয়েছে, কিন্তু শুনলাম আপনি সেখানে ছিলেন না।’ গোপী বেশ ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে উঠল।
আমি বললাম ভগবানের প্রতি আমার মনে কোনো অনাদর নেই। পবিত্র হৃদয়ে চারটার সময়ই অফিস থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম। দেরি হওয়ার কারণটাও আমি বুঝিয়ে বলেছি।
গোপী ক্ষণিকের জন্য চমকে উঠল আর পরের মুহূর্তেই তার চোখ অশ্রু সজল হয়ে উঠল। বারান্দায় গিয়ে সে মুনিয়াকে দেখল, তারপর আমার দিকে তাকাল।
‘ দিদিমা, ভেতরে আসুন!’ চোখ মুছে গোপী বলল।
মুনিয়া কিছু বলল না। থর থর করে কেঁপে উঠল। ঠান্ডায় বেঁকে যাওয়া দুই হাতে সে আমার মাথা জড়িয়ে ধরে, চুমু খেতে খেতে বলল,’ আমার আয়ু নিয়ে বেঁচে থাক,বেটা!’
মুনীয়ার মুখ থেকে যখন এ কথা বের হল, তখন তার চোখ থেকে জলের ফোঁটা গাল হয়ে নিচে ঝরে পড়ছিল। সেই জলের ফোঁটায় চোখের জল ছিল না বৃষ্টির জল এটা আমি বুঝতে পারছিলাম না।
বলতে চাইছি যে ভগবানকে দেখার আমার প্রথম ইচ্ছা বিফল হল।
‘গত তিনদিন থেকে আপনি কি করছেন? এদিকে সাহিত্য গোষ্ঠীদের দ্বারা রবীন্দ্রভারতীর কলা ভবন মুখরিত হয়ে উঠছে আর এদিকে আপনার কোনোরকম ধ্যান নেই!’
রঙ্গনাথ রাও উঁচু স্বরে বলল।
‘আপনাদের সাহিত্য গোষ্ঠীতে হতে চলা কার্যকলাপের খবরা খবর দেশের আপামর জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দেবার কাজে মগ্ন হয়ে রয়েছি, জনাব!’
কৈফিয়ত দেওয়ার সুরে আমি বললাম।
‘আরে ,সেই কাজটা তো আটটার পরে। এখনই তার জন্য তাড়হুড়ো কিসের। তাছাড়া ওই কাজটা তো ভীমরাও দেখছে। আপনি আর কিছু না হোক অন্তত মনোরঞ্জনের জন্যই, কিছু সময়ের জন্য আসতে পারতেন।’ রঙ্গনাথন বেশ নালিশের সুরেই কথাটা বলল।
আমি কথাটাকে সেখানেই শেষ করতে চাইলাম। বললাম,’ ভেবেছিলাম কি তুমি ওর সম্পর্কে নিশ্চয় বলবে, সেজন্য এড়িয়ে গিয়েছিলাম। এখন আর আমাকে বিরক্ত কর না!’
দুই-তিন বার এদিক ওদিক তাকিয়ে, গলা ঠিক করতে করতে রঙ্গনাথ দুই হাত জোড় করে বলল–
‘ঠিক আছে, কোনো ব্যাপার না। আজ বিকেলে আরও একটি বড়ো গোষ্ঠীর অনুষ্ঠান হতে চলেছে। দুই তিনজন মন্ত্রী আসবে। কয়েকজন প্রসিদ্ধ সাহিত্যিক– যাদের প্রচুর খ্যাতি এবং জনপ্রিয়তা রয়েছে– তাদেরকে সম্মানিতও করা হবে। আজ কিন্তু অবশ্যই আসবেন! এই ধরনের গতানুগতিক কাজ তো সবসময়ই থাকবে।’ বলে রঙ্গুনাথরাও চলে গেলেন।
পাঁচটা বাজার আগে কেউ চেয়ার ছেড়ে নড়তে পারবেনা। ভাবছিলাম সভা যদিও পাঁচটার সময় বলা হয়েছে, কিন্তু মন্ত্রীরা এসে পৌঁছানোর আগে তার শুরু হবে না আর মন্ত্রীরা যেহেতু দেরি করে আসবে, সভা দেরি করেই শুরু হবে। তবুও আমি সেখানে তাড়াতাড়ি পৌঁছে যেতে চেয়েছিলাম।
হায়দরাবাদে রাস্তা পার হওয়া কত কঠিন কাজ, তা কেবল ভুক্তভোগীরাই জানেন। অটোরিক্সার নিচে পড়তে পড়তে কোনো রকমে বেঁচে বিধানসভা ভবনের ফটকের সামনে উপস্থিত হলাম। আমার সামনে একটি পুরোনো রিক্সা দাঁড়ানো ছিল, যা কাঁচকলার ভাঁড় দিয়ে পরিপূর্ণ ছিল। কাঁচকলার ওজনে রিক্সার চাকা মাটিতে বসে গিয়েছিল। চড়াইয়ের সামনে রিক্সাটা মাটিতে আটকে ছিল। রিক্সাওয়ালা রিক্সা যাতে পেছন দিকে গড়িয়ে না যায় সেজন্য রিক্সাটাকে রাস্তার কিনারে টেনে নিয়ে গিয়ে সামনের হ্যান্ডেল দু হাতে চেপে রেখেছিল।
‘কোথায় যাবে?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।
রিক্সাওয়ালা কিছুই বলল না, বলতে পারছিল না। মাথার চুল থেকে গড়িয়ে পড়া ঘামের ফোঁটা গাল বেয়ে বুক হয়ে নিচে খসে পড়ছিল।। ঘামে ভিজে এবং রোদে শুকিয়ে নিঃসঙ্গ হয়ে যাওয়া গেঞ্জি, গোড়ালির উপরে এবং হাঁটুর নিচে ঝুলে থাকা নোংরা কাপড়, যা দেখে বলা কঠিন কি এটা হাফপ্যান্ট না ট্রাউজার?
আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রিক্সাওয়ালাকে দেখছিলাম, পাঁচ মিনিট ,দশ মিনিট।
সে একবার দীর্ঘশ্বাস নিল এবং রিক্সাটাকে সামনের দিকে টানলো। মালপত্রে পরিপূর্ণ রিক্সাকে চড়াইয়ের দিকে টানার চেষ্টা করায় তার পা দুটি মাটিতে থাকছিল না। রিক্সার সামনের চাকা দুটি উপরের দিকে উঠে যাওয়াকে বাঁধা দেবার জন্য সে রিক্সাটিকে সামনের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। রিক্সার চাকা গড়িয়ে যাচ্ছিল। রিক্সাওয়ালার পায়ের শিরা গুলি প্রকট হয়ে উঠছিল। সে পায়ের সমস্ত শক্তিকে হাতে পুঞ্জিভূত করে রিক্সাটাকে সামনের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। আমি আমার হাতে থাকা ব্যাগটা কলার স্তূপের উপরে রাখলাম। ধুতিটাকে আঁটো করে কোমরে বেঁধে নিলাম। মাথাটাকে কলার স্তূপের মধ্যে ঠেকিয়ে কিছুটা ঝুঁকে রিক্সাটাকে সামনের দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়ায় সাহায্য করলাম।
‘নাও, এখন জোর দিয়ে টানো!’ রিক্সাটাকে সামনের দিকে ঠেলতে ঠেলতে আমি বললাম।
রবীন্দ্র ভারতী, আইজি দপ্তর এবং পেট্রোলপাম্প হয়ে চড়াইটা অতিক্রম করতে করতে আমরা দুজনেই খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম।
‘এটা কী হচ্ছে, এতগুলি কাঁচাকলা আপনি কি নিজের জন্য নিয়ে যাচ্ছেন? নাকি, মেয়ের বিয়ে আছে? যার জন্য আপনি নিজে সঙ্গে থেকে এগুলি নিয়ে যাচ্ছেন? ঠিকই আছে। আজকাল যা তা লোকের উপর ভরসা করতে নেই! একজন সাহিত্য উপাসক আমাকে হিতোপদেশ দিল।
ক্লান্তি জনিত কারণে আমি কোনো কিছু বললাম না। কিন্তু আমার মৌনতাকে সেই মহাপুরুষ হয়তো নিজের অপমান বলে মনে করে নেবে, তাই আমি আমার নিজের হাত দুটো তার সামনে জড়ো করলাম।
আর ও কিছুক্ষণ সেখানে অপেক্ষা করার পরে, আমরা রিক্সাটাকে’ কাঠের সেতু’ অতিক্রম করে’ থিয়েটার হল’ পর্যন্ত ঠেলে ঠেলেনিয়ে গেলাম।
রিক্সাওয়ালা মহাবীর হাসপাতালের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। রিক্সাটাকে সে রাস্তার পাশে দাঁড় করাল। আমিও তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।
প্রায় পনেরো মিনিট ওভাবে দাঁড়িয়ে থেকে ক্লান্তি দূর করে আমি বললাম,’ এখন চল!’
সাহেব। আপনি এখন যান। আগের রাস্তা সহজ- সরল। রিক্সাটাকে আমি নিজেই চালিয়ে নিয়ে যেতে পারব।
সাহেব, আপনি এখন যান! আজ আপনি আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন, ভগবান আপনাকে সুখী রাখবে! আমার দুটি হাত নিজের দুই হাতের মধ্যে নিয়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে সে বলল।
ও হো, হ্যাঁ আসল কথাটা আমি বলতে ভুলে গেছি। সেদিন আমি ভগবানকে দেখার কথা ভাবিনি। ভেবেছিলাম কি সাহিত্যিক গোষ্ঠীতে অংশগ্রহণ করব এবং জ্ঞান অর্জন করে জীবন সার্থক করব। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমি কিছুই করতে পারলাম না!
২৬ অক্টোবর ১৯৮০ রবিবার সকাল বেলা সাতটারসময় আমাকে বিশাখাপত্তনম থেকে অর্কু ঘাটে যাওয়ার কথা ছিল। এর জন্য প্রয়োজনীয়ব্যবস্থাদিআমার বন্ধু তেলেগু শিক্ষক করে দিয়েছিল। আসলে আমাদের গাড়িরড্রাইভার রূপে গুরু মূর্তির যাবার কথা ছিল। কিন্তু সেদিনেই হায়দ্রাবাদ থেকে চেয়ারম্যান আসছিলেন। সেজন্য গুরু মূর্তিকে তাকে নিয়ে আসার জন্য পাঠানোর বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। সেজন্য আমার জন্য অপ্পারাও অন্য একটি গাড়ি এবং তার ড্রাইভারের ব্যবস্থা করেছিল।
বিশাখাপত্তনম এবং শ্রীকাকুলম জেলা আমার কার্যক্ষেত্রের মধ্যে পড়ে না। ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত আমি ওই জেলার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছি, কিন্তু এবারের যাওয়াটা ছিল অন্যরকম। সেই সময়ের বৈশিষ্ট্যের কথা মনে করে আমি কথা বলছি। ঠিক তখনই গাড়ি এক জায়গায়হঠাৎ দাঁড়িয়েপড়ল।
‘ কী হয়েছে?’
‘টায়ারপাংচার হয়ে গেছে। আমরা একটুর জন্য বেঁচে গেছি, গ্রামের কাছাকাছি এসে খারাপ হয়েছে। না হলে…।’ ড্রাইভার ফিসফিস করছিল।
ড্রাইভারগাড়িটাকে দশ গজ দূরে সাইকেলের দোকান পর্যন্ত এবং দোকানদারকেগাড়িতে নতুন টায়ার লাগানো এবং পুরোনোটাকে মেরামত করার জন্য নির্দেশ দিয়েস্বয়ং গ্রামের দিকে চলে গেল।
আমার স্ত্রী এবং ছেলে পাশের শৃঙ্গর প্রাচীর দেখতে চলে গেল।
‘ এই যে ভাই, এখানে চা পাওয়া যাবে?’ আমি দোকানদারকেজিজ্ঞেস করলাম।
‘ আরে, শিবা!’ দোকানদার রাস্তায় গিয়ে চিৎকার করে ডাকল,’ শোন, সাহেবের জন্য গরম এবং কড়া করে চা বানিয়ে দে। চায়ের মধ্যে মালাই দিয়েনিবি !’
কিছুক্ষণের মধ্যেই দশ বছরের একটি ছেলে এক হাতে চায়ের দুটো গ্লাস জলের দুটো গ্লাস নিয়ে এল।
‘কী রে, চা এত কম কেন?’ দোকানিছেলেটির দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল।
ছেলেটিঘাবড়েগিয়েদোকানদারের দিকে এবং আড়চোখে আমাকে দেখতে লাগল।
‘ চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, খেয়ে নিন বাবুজী!’ দোকানদার আমাকে বলল এবং নিজে গাছের নিচে গিয়ে চা খেতে খেতেটায়ার মেরামতির কাজে নজরদারি করতে লাগল।
এরই মধ্যে ওই ছেলেটির সঙ্গে কথাও বলতে লাগল।
দশ বছরের ওই ছেলেটির আসল নাম ব্রহ্মাজি। তার শরীরে কোনো জামা ছিল না। চুলে তেল না থাকায় চুলগুলি ছিল উশকো খুশকো। হাফপেন্টটা কোমর থেকে খসেপড়ছিল। হাতে তেল কালি লেগেছিল। দ্বিতীয়ছেলেটির নাম ছিল অপ্পারাও। তার পরনে ছিল ছেঁড়া গেঞ্জি। সমস্ত মুখে কালিঝুলি মাখা ছিল। দুজনেরই মাতা পিতা জীবিত ছিল। দুজনের ভাই বোনও ছিল। দুজনেই সকাল সাতটার সময় দোকানে চলে আসত। রাত নটা পর্যন্ত সেখানেই থাকত। দোকানদার দুজনকে কাজ শেখাত এবং প্রতিদিন দুজনকেই আট আনা করে দিত। দুটি ছেলেই নিজের নিজের বাড়িতে গিয়ে খাওয়া দাওয়া করে নিত। যখন অতিরিক্ত কাজ হত, তখন দুজনকেই চার আনা করে বেশিদিয়ে দিত।
‘ শার্ট পরনি কেন? নোংরা হয়ে যাবে, এইজন্য?’ আমি আস্তে করে বললাম।
দুজনেই অনিচ্ছুক ভঙ্গিতে আমার প্রশ্নের জবাবে মাথা নাড়ল। তারা যে মিথ্যে কথা বলছে সেটা আমি বুঝতে পারলাম।
আমি দোকানদারের নজর বাঁচিয়ে দুজনকে পঞ্চাশ টাকার দুটো নোট দিলাম। দুটি ছেলেই ভয়েভয়ে নোট দুটি দেখতে লাগল।
‘ আমি অর্কু ঘাটে যাচ্ছি। বিকেলবেলা ফিরব। তার মধ্যে তোমরা দুজন ট্রাউজার এবং শার্ট কিনে আমার জন্য এখানে অপেক্ষা করবে।
আধঘন্টা পরে গাড়ি রওনা হয়ে গেল। শৃঙ্গর প্রাচীর অতিক্রম করার পরই ঘাঁটি শুরু হয়ে গেল। জঙ্গলের সবুজসুগন্ধ, জংলিফুলবাগান এবং চাঁদ তারায় পরিপূর্ণ পাহাড়ি ঝরনা। এদিক-ওদিক ছড়িয়ে থাকা পাহাড়ি লোকদের কুঁড়েঘর – তবে এসব আমার দৃষ্টিকে খুব একটা আকর্ষণ করতে পারছিল না ।
রোগা পাতলা দেহ এবং ঘাবড়ানোর দৃষ্টির দশ বছরের ছেলে ব্রম্মা এবং থর থর করে কাঁপতে থাকা অপ্পারাও, তার গরিবি… এটা আমার মনকে পুরোপুরি অধিকার করে রেখেছিল। ঘাটি থেকে আমাদের ফিরতে ফিরতে প্রায় সাতটা বেজে গিয়েছিল। তখন পর্যন্ত কয়েকজন লোক দোকানটির আশেপাশে অপেক্ষা করছিল ।
গাড়িদাঁড়াতেই সবাই আমাদের কাছে দৌড়ে এল। ব্রহ্মা এবং অপ্পারাও ভালো করে স্নান করে চুল আঁচড়ে নতুন করে কেনা শার্ট আর ট্রাউজার পরেছিল।
‘ আমরা আপনার জন্য পাঁচটা থেকে অপেক্ষা করছি…?’
ওদের দুজনকেই নতুন কাপড়ে কত সুন্দর লাগছিল।
কিছুক্ষণ নানা ধরনের কথাবার্তা বলে যখন আমাদের চলে আসার সময় হল, ছেলে দুটি লজ্জিত মুখে আমার কাছে এল এবং আমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। দুজনকেই বুকে জড়িয়ে ধরলাম, চুমু না খেয়ে পারলাম না। আমার চুমুখেয়ে, ওদের চোখ দুটি জান কীভাবে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল?… এরপরে আমি না ভগবানকে দেখতে চাইলাম না সাহিত্য গোষ্ঠীতে ভাগ নিতে।
জানতে ইচ্ছুক ব্যক্তি যেমন জানার জন্য পেটুক যেমন খাবার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে আমারও ঠিক তেমনই লেখার প্রতি দুর্বলতা রয়েছে। দুর্বলতার শুরু তো রয়েছে কিন্তু শেষ নেই। গত চল্লিশ বছরে আমি অনেক আবর্জনা সঞ্চয় করেছি। এখন চাইলেচুপচাপ ঘরে বসে থাকতে পারি। কিন্তু কী করব, চুপ করে বসে থাকতে পারিনা। এটা চুলকানিরমতোবেমার। একবার যদি অভ্যাস হয়ে যায়, তাহলে তার হাত থেকে মুক্তি পাওয়া মুশকিল। আর ও কিছু করার, কিন্তু কিছু না কিছু করতে থাকার ইচ্ছেটা ক্রমশ বেড়ে যেতে থাকে। এই অভ্যাস থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আমি একটি বড়ো উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা গ্রহণ করলাম। এই উপন্যাসের মোট তিনটি খন্ড থাকবে। প্রথম খন্ডের নাম হবে’ ‘নোংরা গলি’, দ্বিতীয় খন্ডের নাম ‘হাট’ এবং তৃতীয় খন্ডের নাম ‘ সোনার গদি’। এই উপন্যাস ১৯৪২ থেকে শুরু হয়ে ১৯৮২ সালে এর সমাপ্তি ঘটবে।
চল্লিশ বছরের জীবনকে,দেশের সামাজিক এবং রাজনৈতিক জীবনকে এই উপন্যাসের মাধ্যমে রূপায়িত করে তুলব বলে আমি পরিকল্পনা করলাম। আমার এই পরিকল্পনাকে রূপদানের জন্য কেবল সাহিত্যিক জ্ঞানই যথেষ্ট ছিল না। অনুভব দরকার, জীবনের অনুভব। ভিন্ন ভিন্ন প্রান্তের লোকদের রীতিনীতি এবং তাদের আর্থিক সামাজিক গতিবিধি সম্পর্কে ধারণা থাকা প্রয়োজন। এই জানার জন্যই আমাকে দেশের নানা প্রান্তে গ্রামে গঞ্জে ঘুরে বেড়াতে হয়েছিল।
এই উপন্যাসে একটি পিছিয়ে পড়া গ্রামের লোক তথা তাদের শোষণ করে বেঁচে থাকা শহরবাসী ব্যবসায়ীদের বিবরণ রয়েছে। এর সঙ্গে সম্বন্ধিত সামগ্রীর সংকলনের জন্য আমি শ্রীরামসাগর’ প্রজেক্ট ‘এর নিকটবর্তী প্রদেশ কে ঠিক করে রেখেছিলাম।
আরো পড়ুন: অসমিয়া অনুবাদ: কাফকা বাইলেন । সৃঞ্জনা শর্মা
১৯৮২ সালের ১০ এপ্রিল ছিল শনিবার। শ্রী রামসাগর প্রজেক্ট দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম। প্রকৃতিকে বশ করার জন্য মানুষের দ্বারা তৈরি বিভিন্ন কৌশল এখানে দেখা গিয়েছিল। উচু বাঁধ এবং তার পেছনে গোদাবরী নদীর জল খাল দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চাষের জমিতে চলে যাচ্ছিল। খালের তীর ধরে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে আমরা স্বর্ণ নদী পর্যন্ত পৌঁছেছিলাম। সেখানেও একটি ছোটো বাঁধ তৈরি হচ্ছিল। আমি সেখানকার কুলিদের সঙ্গে দেখা করলাম। ধীরে ধীরেওদের সঙ্গে কথা বলতে লাগলাম। ওখানকার ঠিকাদার এবং মিস্ত্রিরা আমার দিকে ফিরে তাকাচ্ছিল।
কুলিরা যা বলল তার সারাংশ এইরকম।
ওরাপালমের অধিবাসী। পুরুষানুক্রমেমজদুরি করে জীবন ধারণ করে এসেছে। ওদের খেত নেই। যদি থেকেও থাকে সেখানে ফসল হয় না। একটু আধটু ফসল হলে মালিকের লোকরা ছিনিয়েনিয়েযায়। ওদের ভয় যে যদি ফসল কৃষকের হাতে পড়ে, তবে তারা মালিকের কথা শুনবে না। বছরে একবার ঠিকাদার বা তাদের মিস্ত্রি কৃষক- মজদুরের কাছে যায়। সেখানে গিয়ে মজদুরদের হাজার-দেড় হাজার টাকা ধার দেয়। এই ধার সারা বছর মাসিক পঞ্চাশ বা একশ টাকা করে শোধ করতে হয়। শোধ করার উপায়টাও ঠিকাদার বলে দেয়। নিজেদের ওখানে কাজের ব্যবস্থা করে দিয়ে। এই কাজ সকাল ছটা থেকে সন্ধে ছটা পর্যন্ত করতে হয়। এর জন্য তাদেরকে আলাদা কোনো মজুরি দেওয়াহয় না। ধারের পরিমাণ হিসেবে কেটে নেওয়াহয়। কিন্তু, হ্যাঁ সকাল দশটারসময় একবার এবং বিকেল চারটারসময় একবার ঘোড়াকেদেওয়া দানা–যেমন খাবার ওদের একবার দেওয়াহয়। এছাড়া আর কোনো সুবিধা ওদেরথাকেনা। এরমধ্যে যদি কেউ দশ পাঁচ টাকা ধার নেয়, তাহলে কোনো অতিরিক্ত কাজ করে সেই ধার শোধ করতে হয়। বাচ্চারা যদি খেতে কাজ করে তাতে ঠিকাদারদের কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু তাদের কোনো মজুরি দেওয়া হবে না। খাবার জন্য দু একটি বিস্কুট দেওয়া হতে পারে। যদি একটি পরিবারের চারজন চার হাজার টাকা ধার নেয় তাহলে এমন কোনো গ্যারান্টি নেই যে এই চারজনকে এক জায়গাতেই কাজ দেওয়া হবে।
লচ্ছাম্ভারের ক্ষেত্রে ও এই একই কথা প্রযোজ্য। নরসিংহ, হায়দ্রাবাদে রাস্তা বানানোর ক্ষেত্রে কাজ করছিল। লচ্ছাম্ভা অবিকলেরুতে বাঁধ তৈরির কাজে লাগানো হল। লচ্ছাম্ভা যখন এই কাজে যোগদান করেছিল তখন তার চার মাস চলছিল। তার এখানে আসার চার মাস হয়ে গিয়েছিল। এই চার মাসে লচ্ছাম্ভা স্বামীর কোনো খোঁজ খবর পায়নি। যদি সে কোনো চিঠি লিখতে ও চায়,তো তার স্বামীর ঠিকানা জানা নেই। ঠিকাকয়জন এবং মিস্ত্রি ঠিকানা জানে, কিন্তু ওকে বলে না।
যে আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা, সে কড়া রোদে পাথর ভাঙ্গা এবং ভাঙ্গা পাথর বস্তায় ভরার কাজ কীভাবে করবে? ক্ষণিকের জন্য বিশ্রাম নিতে চাইলে অশ্রাব্য ভাষায় ঠিকাদারের গালি গালাজ এবং তার ইশারায় নাচা, তার অনুকূলে কাজ করা মিস্ত্রি লচ্ছাম্ভার মত অবলাদের প্রতি কড়া নজর রাখে। জানেন কি কিসের জন্য! তার নাক মুখ সুন্দর এই জন্য।
‘আমি হাজার টাকা ধার নিয়েছিলাম। চার মাস পার হয়ে গেছে এবং চার মাস পর্যন্ত ওর কাছে কাজ করেছি। আমাকে যা যা বলা হয়েছে সেসব করেছি। কিন্তু এই পাপী পেটের জন্য না আমি দাঁড়াতে পারি না বসতে পারি। ঝুঁকে কীভাবে কাজ করব বেটা!’ বলতে বলতে লচ্ছাম্ভার গলা ধরে এল।
‘বেটা,আমাদের কাছে কত টাকা আছে?’
আমার ছেলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল এবং বলল,’ সাতশো টাকার মতো।’
আমি ঠিকাদারকে গিয়ে বললাম’ লচ্ছাম্ভা কে আপনি এক হাজার টাকা দিয়েছিলেন। সে চার মাস কাজ করেছে, আরও চার মাস তাকে আপনার কাছে কাজ করতে হবে। কিন্তু তার অবস্থা তো দেখতে পাচ্ছেন। বাকি পাঁচশত টাকা আমি দিয়ে দিচ্ছি। তাহলে আপনি ওকে যেতে দেবেন তো?’
বলা হয়ে থাকে যে এই ধরনের শর্ত ঠিকাদার কখন ও মানতে চায় না। কিন্তু এই ব্যক্তি রাজি হয়ে গিয়েছিল। আমি পাঁচশো টাকা তার হাতে দিয়েদিয়েছিলাম। পরে শুনতে পেয়েছিলাম আমি লচ্ছাম্ভা-কে এখান থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসার ব্যাখ্যা ভিন্ন ভিন্ন লোক ভিন্নভাবেদিয়েছিল। সেখানকার লোকদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে লচ্ছাম্ভা আমাদের সঙ্গে চলে এসেছিল।
লচ্ছাম্ভা দুদিন আমাদের সঙ্গেই ছিল। দ্বিতীয় দিন দুপুর বেলা লচম্ভা নিজামাবাদ যাওয়ার ইচ্ছা জানাল। বলল কি ভাইয়ের ওখানে দু-তিন দিন থেকে তারপর হায়দরাবাদ চলে যাবে।
আমি ওকে সঙ্গে নিয়ে বাসে বসিয়ে দিলাম। ওর হাতে পঁচিশটা টাকাও রেখে দিলাম।
‘বেটা, আগামী বার আমি তোমার সন্তানরূপে জন্ম নেব।’লচম্ভাআমার হাত দুটি তার চোখে লাগাতে লাগাতে বলল।
আমি পুনরায় আরম্ভ করলাম এবং আসছি। চার -পাঁচ বছর থেকে, যদি ঠিকঠাক বলতে হয়, তবে পাঁচ বছর থেকে আমার ভগবানকে দেখার ইচ্ছা রয়েছে কিন্তু আজ পর্যন্ত তা পূর্ণ হয়নি । এতে দোষটা পুরো ভগবানের আমি সে কথা বলছি না । সম্ভবত আমিও সঠিকভাবে চেষ্টা করিনি।যদি করতাম তাহলে নিশ্চয় ভগবানকে দেখতে পেতাম।
একবার রাতে আমি ঘুমিয়েছিলাম।কোনো চিৎকার শুনে উঠে বসলাম। দরজার সামনে কাউকে এদিক ওদিকে ঘুরে বেড়াতে দেখলাম।
‘ কে?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।
‘আচ্ছা ফলানা কি আপনার নাম? আমরা আপনার খোঁজেই এসেছি। আচ্ছা আপনিই কি ভগবানকে দেখতে চেয়েছিলেন? তিনি জিজ্ঞেস করলেন।
‘ হ্যাঁ।’ আমি বললাম।
‘আপনি পাগল নন তো! ভগবানকে কি কেউ চোখের সামনে এভাবে দেখতে পায়? বেটা, আমাদের কথা শোনো। এই ধরনের ইচ্ছা মন থেকে বাতিল করে দাও।’
‘ এটা তো আগে বলুন যে আপনারা কে?’ সন্দেহ এবং উৎসুকতামিশিয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম।
‘ আমরা দেবদূত।’ তারা দুজন বলল।
‘ আপনারা এখানে কেন এসেছেন?’
‘ আপনাকে এই কথা বলার জন্য।’ দ্বিতীয় ব্যক্তি বলল।
‘যদি ভগবান-কে দেখা না যায়, তাহলে নাই দেখা গেল। কিন্তু ভগবানের কোনো না কোনো রূপ বা অংশতো দেখা যায়। বলা হয়ে থাকে কি’ অন্নংপরমব্রহ্মরুপম কিন্তু সব সময় সব লোকের কাছে এই নারায়ণ‐পরমব্রহ্ম রূপের দর্শন পর্যাপ্ত পরিমাণে হয়, এটাই আমার ইচ্ছা। ভগবান-কে দেখার আমার ইচ্ছাও এই জন্যই। আমার মনে হয় না কি এটা কোনো অনুচিত বা অবাঞ্চিত ইচ্ছা।’ দেবদূতদের আমি বললাম।
‘ দেখুন জনাব! আজেবাজে কথায় আপনার দরকার কি? আপনি আপনার কথা বলুন! যদি আমার পেট ভরে,তাহলে কি আপনার ক্ষুধা মিটবে? যদি আমি ওষুধ খাই তাহলে আপনার অসুখ কীভাবে ঠিক হবে?’ প্রথমে দেবদূত আমাকে উচিত জবাব দেওয়ার চেষ্টা করল।
তার তর্কের কথা শুনে আমার মাথা গরম হয়ে গেল। তার বলার কায়দা কানুন দেখে আমার আশঙ্কা বেড়ে গেল । এই দুজন কি সত্যিই দেব দূত না নকল ! সন্দেহ হল কি এই পৃথিবীর রাজনৈতিক নোংরামি এই দেবদূতদের কাছেও পৌঁছে গেছে । এই ধরনের শঙ্কা মনের মধ্যে নিয়েওদের সঙ্গে কথা না বলাই ঠিক হবে বলে মনে করলাম।
‘ শুনুন জনাব, আমি শুধু ভগবানকে চাই, ভগবানের প্রতিনিধিদের নয়। আপনাদের সঙ্গে অনেক কথাবার্তা হয়েছে। আমাকে আর বিরক্ত করবেন না। আমার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাবেন না। এখন আপনারা আসুন!’
যে দেবদূতদের আমি উপদেশ দিয়েছিলাম, তাদের কথা না শোনায় আমার উপরে অসন্তুষ্ট হবে না তো। আমার মনে হল।
দেবদূতরা চলে যাবার পরে দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিন আমার এক বিচিত্র অনুভূতি হল। যেন এক ধরনের মিষ্টি মিষ্টি সুগন্ধ আমার চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল, যেন সুন্দর কিরণ আমার আপাদমস্তক ঘিরে ধরল, যেন নানান ধরনের শব্দহীন আওয়াজ সুন্দরভাবে বিকাশিত হয়েছে, যেন কোনো প্রশান্ত…
‘কে!’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।
‘আমি।’
‘ আমি বলতে কে!’
‘ আরে, আমাকে চিনতে পারছ না? আপনি কি আমাকে কখন ও দেখেননি? আমাকে কি একেবারেই চিনতে পারছেন না? এই ধরনের অনুভূতি কি আপনার আগে কখন ও হয়নি?’
‘ হয়েছে, এই মিষ্টি গন্ধের অনুভূতি আমার সেদিনই হয়েছিল, যেদিন বৃষ্টিতে ভিজে পুনিয়াদাদি আদর করে আমার মাথাটা দু হাতে ধরে চুমুখেয়েছিল, যেন নিজের সন্তানের মস্তকে চুমু খাচ্ছিল! যেদিন রিক্সাওয়ালাআত্মীয়তার সঙ্গে আমার হাত স্পর্শ করে, আমার দিকে মমতাময়ী দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল, সেদিন এরকমই আলোর শিখা আমি তার চোখে দেখেছিলাম!! যখন ব্রহ্মাজী এবং অপ্পারাওআমাকে স্পর্শ করার ইচ্ছা মনের মধ্যে চেপে রাখতে না পেরে সাহস সংগ্রহ করে আমার জামার মূল অংশ স্পর্শ করে নেয় ,তখন আমি ওদের নিজের বাহুপাশে নিয়ে চুম্বন করার সময় নীরব শব্দের সুন্দর রুপেরূপায়িত হওয়ার ব্যাখ্যা অনুভব করেছিলাম।প্রশান্ত,সুখান্তনক্ষত্রমণ্ডলী থেকে নেমে ধীরে ধীরে পলকের জন্য চুম্বন করার এই ধরনের সুখদ অনুভূতি আমার তখন হয়েছিল ,যখন লচম্ভা আমার হাত দিয়ে নিজের বন্ধ চোখ স্পর্শ করে ,কোনো অব্যক্ত এবং অতীন্দ্রিয় আনন্দের অনুভূতি পেয়েছিল।শুধু তাই নয়,মমতা,করুণা,নির্মলতা,লালিত্য,সততা আদি ভাবনা যখন যখন এবং যে স্থানে প্রকট হয়,সেই সেই সময়ে এবং স্থানে এই ধরনের সংবেদনারসুখানুভূতি পাই।
‘এখন তুমি ঠিক রাস্তায় এসেছ,আমাকে সব জায়গায় এবং কালে দেখতে পেয়েও বল কি তুমি আমার খোঁজে রয়েছ?এটা তো বল তুমি আমাকে কেন দেখতে চাও,আমাকে দিয়ে তোমার কী কাজ?’
‘তুমি ভগবান কিনা আমি জানি না!’বলে আমি তার দিকে ভালো করে তাকালাম।এর আগে আমি তোমাকে কখনও দেখিনি।কিন্তু তুমি বলছ যে আমি তোমাকে সব জায়গায় দেখতে থাকি।সম্ভবতদেখছিও।আচ্ছা,ছেড়ে দাও এসব কথা।যদি তুমি সত্যিই ভগবান হতে,তাহলে এতদিনে বুঝে যেতে কি আমি কী চাই।যদি তুমি ভগবান না হও,তবু আমার ইচ্ছা তোমাকে জানাতে কোনো আপত্তি নেই।আমার ইচ্ছা-
ন কাময়েহংগতিমীশরাণাঅষ্টর্থিযুক্তাম পুনর্ভব বা।
আর্তি প্রপদ্যে খিল দুঃখ ভাজা মন্তঃস্থিতোযেন ভবন্ত্যদুঃখা।।
পুণ্য পুরুষ সম্রাট হয়ে যে অষ্টোশর্য ভোগ করে ,আমি তা কামনা করি না।আমার মুক্তিও চাই না। আমার ইচ্ছা কেবল এটাই পৃথিবীর সমস্ত দুঃখীর হৃদয়ে বসবাস করি।প্রয়োজনে তাদের ব্যথা আমি অনুভব করি ,কিন্তু ওদের দুঃখ দূর করি।
এইজন্যই, এটা করার জন্যই,এটা করার শক্তি লাভ করার জন্যই আমি ভগবানকে দেখতে চাই।
অনুবাদক