ইরাবতী ধারাবাহিক: খোলা দরজা (পর্ব-৯) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
সেই সময়ে ছোটরা ছিল যেকোন ঘটনার নীরব দর্শক।তাদের সব বক্তব্যই মনে মনে রাখতে হত।মুখে কিছু বলার মত দুঃসাহস দেখালে পাকা, দুর্বিনীত, ওস্তাদ, অসভ্য,এইসব ভয়ংকর বিশেষণে বিশেষিত হওয়ার ভয় !তাই মনে অনেক কথা এলেও বোবা সেজে থাকাটাই রেওয়াজ ছিল।
লাভ ম্যারেজের অনেক রঙবেরঙ আমার নিজের চোখে দেখা।মুখে টুঁ শব্দ না করে নীরব দর্শক হয়েই থেকেছি। তার থেকে দু একটা বলাই যায়।
তখন স্কুলে আমরা নাইনে পড়ি বোধহয়।টিফিনের সময় হঠাৎ দেখি ক্লাস ইলেভেনের ইন্দ্রাণীদি বড়দির ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, সঙ্গে এক ভদ্রলোক।দেখেই মনে হচ্ছে তার বয়স ইন্দ্রাণীদির থেকে বেশ খানিকটা বেশি।ইন্দ্রাণীদির পরিবর্তন লক্ষ করার মত। মাথায় লাল টকটকে সিঁদুর, শরীরে জড়ানো একটা সাধারণ লাল তাঁতের শাড়ি ।তাতেই অসাধারণ দেখাচ্ছে!
শুনলাম ইন্দ্রাণীদি বাড়ির অমতে গানের মাষ্টারমশাইকে বিয়ে করেছে।ধনীর দুলালি। উঁচু ক্লাসের দিদি হলেও তাকে আমরা প্রতিদিন দেখেছি স্কুল গেটের সামনে বিশাল বড় একটা গাড়ি থেকে নামতে, টিফিনে বাড়ির কাজের লোকের হাত থেকে দুধের গ্লাসে দুধ খেতে।তাই তাকে আমরা বিশেষভাবেই চিনি। সেই ইন্দ্রাণীদিকে ওভাবে দেখে আমরা হতবাক।বড়দির ঘরের সামনে কৌতুহলী মেয়েদের ছোটখাটো একটা ভিড় জমেছে।ইন্দ্রাণীদি ফাইনাল পরীক্ষার আগে ফর্মে অভিভাবক হিসাবে স্বামীর নাম ঢোকানোর জন্য বড়দির সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।বড়দিকে আমরা তাঁর বিক্রমের জন্য ‘রয়াল বেঙ্গল টাইগার’ নাম দিয়েছিলাম।সাক্ষ্যাৎকার পর্ব কেমন উৎরেছিল জানিনা।কিন্তু ভালো ছাত্রী ইন্দ্রাণীদি যে সব হার্ডল পার করে আমাদের পাশের শহরের মেয়েদের কলেজের লেকচারার হয়েছিল , সেও স্বচক্ষে দেখা।
আরো পড়ুন: ইরাবতী ধারাবাহিক: খোলা দরজা (পর্ব-৮) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
আর একটা উলটো ছবি দেখেছিলাম। সেখানে লাভ ছিল ম্যারেজ হয়নি।কিন্তু ছেলেটির বিয়ে করতে যাবার দিন তাকে চন্দন পরিয়েছিল সেই পরিত্যক্ত প্রেমিকাটি।কেননা বর বউ সাজানোতে আমাদের অঞ্চলে তার ছিল ভালোরকম নামডাক।নিজের প্রেমিককে বিয়ের চন্দন পরানোর সময় তার গাল বেয়ে জলের ধারা গড়াচ্ছিল। ছেলেটির চোখও শুকনো ছিলনা ।চারপাশে ভিড় করে বর সাজানো দেখার সময় আমরা খুব অবাক হচ্ছিলাম।পরে কিছু অকালপক্ক বন্ধুর সাহায্যে কার্য কারণ খুঁজে পাই। জাতপাতের কারণে তাদের অভিভাবকরা বিয়ে দেননি।তারাও বিদ্রোহ করার সাহস দেখাতে পারেনি।
এখনও সেই ছবিটি আমার মনে পড়ে।আর ভাবি, মেয়েটির সেদিন চন্দন না পরালেই কী চলছিল না? ওইটুকু বিদ্রোহ তো সে করতেই পারত।
কবির কথামত “সে কি কেবলি যাতনাময়?” পঙ্ক্তিটি বেশিরভাগ প্রেমের ক্ষেত্রেই সত্যি হত অভিভাবকদের নিষ্করুণ হস্তক্ষেপে।আসলে তখন অভিভাবকদের পাহাড়ের মত প্রতিবন্ধকতাকে ডিঙিয়ে যাবার সাহস খুব কম যুগলেরই হত।
ক্রমে ক্রমে পট পরিবর্তন।এখন অন্য গান (এটাও রবিঠাকুরের) অহরহ বাজছে।
“প্রেমের জোয়ারে,ভাসাবে দোঁহারে -বাঁধন খুলে দাও, দাও দাও দাও।”
প্রেম কী অপ্রেম জানিনা নিজের পছন্দ না হলে অভিভাবকের কথা নতমস্তকে মেনে নিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসার দিন ফুরিয়েছে।একেবারে হচ্ছেনা বলব না।গ্রামে ,গঞ্জে এমনকি শহরেও এমনটা দিব্যি হয়।তবে হতেই হবে এমন ভাবটা নেই। অভিভাবকদেরও সুর পাল্টেছে।তারা বলছেন “নিজেরা করলেই ভাল।আমাদের দোষ দিতে পারবে না।”
বা সম্বন্ধ করে বিয়ে দিলেও ফতোয়া জারি করছেন, “মিলেমিশে বুঝেসুঝে নাও বাপু।পরে ঝামেলা হবার থেকে আগেই যা হওয়ার হয়ে যাক।”
লাভ ম্যারেজ হচ্ছে।তবে আগেকার মত একটি লাভ,তাতেই ম্যারেজ। এ ঘটনা কমই ঘটছে।মানে লাভে যাতে ঘাটতি না থাকে,অর্থাৎ লাভের পরিমাণ যথাযথ হয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অন্ততঃ দুটি তিনটি সম্পর্কের পর একটিতে বিয়ে হচ্ছে। এখন সেই লাভ ম্যারেজের পরিসরও বেড়েছে।আগে জাত না মিললেই হই হই হত। এখন জাত তো দূরস্থান প্রদেশের মিলও ঘটছে না।রবীন্দ্রনাথের জনগণমন গানে যে জাতীয় সংহতির কথা বলা হয়েছিল,সেই “পঞ্জাব সিন্ধু গুজরাট মরাঠা দ্রাবিড় উৎকল বঙ্গ” যেন আমাদের ঘরেদোরে সানাই বাজিয়ে ঢুকে পড়েছে।আর অভিভাবকদের দর্শক করে তেলে জলে,দুধে অম্বলে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে।

ঐতিহ্যময় শহর চন্দননগরের স্থায়ী বাসিন্দা সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায় বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির স্নাতক।১৯৯৬ সালে প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়’দিবারাত্রির কাব্য’ পত্রিকায়।২০০১ সালে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়।‘আনন্দবাজার’, ‘বর্তমান’, ‘আজকাল’, ‘প্রতিদিন’, ‘তথ্যকেন্দ্র’, ‘উত্তরবঙ্গ সংবাদ’ ছাড়াও, ‘অনুষ্টুপ’, ‘কুঠার’, ‘এবং মুশায়ারা’-র মতো বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনেও তার কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ প্রকাশের ধারা অব্যাহত। প্রকাশিত উপন্যাস পাঁচটি, গল্পগ্রন্থ চারটি, এবং কবিতার বই একটি।