| 20 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প পুনঃপাঠ সাহিত্য

পুনর্পাঠ গল্প: সেই চিঠি । সৈয়দ শামসুল হক

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

অবশেষে সেই চিঠি, যার অপেক্ষা এবং আশঙ্কায় ছিলেন কবি লুৎফর রহমান, আজ এলো। বহুদিন থেকে কেউ তাকে আর ‘কবি’ বলে না; কেবল তার চিঠির কাগজেই উপাধিটি নিজের অস্তিত্ব নীরবে ঘোষণা করে আসছে প্রায় কুড়ি বছর ধরে। কুড়ি বছর আগে লুৎফর রহমানের কয়েকটি কবিতা ইতস্তত প্রকাশিত হয়েছিল। আর বছর পনেরো আগে তার এক প্রেস-মালিক বন্ধু, রাতারাতি পাঁচখানা স্কুল পাঠ্যবইয়ের প্রুফ দেখে দেওয়ার বিনিময়ে ছেপে দিয়েছিল তার একটি কবিতার বই।

বইটি এক অচল শিলাখণ্ডের মতো কাজ করেছে। কবি লুৎফর রহমান অতঃপর আর কোনো কবিতা লেখেননি। জীবিকার খোঁজে অচিরেই তিনি নোঙর ফেলেন পরিচিত বন্দরে; তার মুদ্রাকর বন্ধুর প্রেসেই চাকরি লাভ করেন, যে চাকরির শর্ত এবং দ্বায়িত্বসীমা প্রথম থেকেই স্পষ্ট নয়। চল্লিশ পেরিয়ে যাওয়ার পর, নিজে কোনো সংসার না হওয়ার কারণেই সম্ভবত লুৎফর রহমান নিজেকে ওই প্রেসের বাইরে আর কোথাও, এমনকি কল্পনাতেও স্থাপিত করতে পারেননি। তিনি এখন প্রেসেরই লাগোয়া এক চালাঘরে বাস করেন এবং সেখানে পাড়ার দুটি তরুণ মাঝে মধ্যেই আসে।

কবি লুৎফর রহমানের চালাঘরটিকে তারা নানা কাজে ব্যবহার করে। কোনোদিন, পুরো দুপুরজুড়ে, তারা গাঁজা খায় এবং ঊর্ধ্বনেত্র হয়ে কবির চৌকির ওপর বসে থাকেন। লুৎফর রহমান প্রেস থেকে আসেন, গায়ে-মাথায় তেল মাখেন, ভাত চাপিয়ে গোসল করতে যান, এসে ডালে সম্ভার দিয়ে, পিঁড়ি পেতে খেতে বসেন–সমস্তটাই অখণ্ড নীরবতার ভেতরে। ওই তরুণ দুটি আছে কি-না, আছে, কোনো ব্যাঘাত বা ব্যত্যয় সৃষ্টি হয় না।

আবার কখনও সেই দুটি তরুণ আরও দুটি বা তিনটিকে ধরে আনে। লুৎফর রহমানের চৌকির ওপর তারা গোল হয়ে তাস খেলে। খুচরা পয়সার ঝনৎকার কবির ঘুমে বিঘ্ন সৃষ্টি করে না। তিনি মেঝের ওপর পাটি বিছিয়ে অন্ধকারলোকে বিহার করে চলেন প্রশান্ত মনে। জেগে ওঠে নগ্ন পিঠের ওপর পাটির দাগগুলো চড়িয়ে প্রেসে চলে যান। তরুণরা তাকে ঘরের আরও একটি দেয়াল বলেই গণ্য করে।

কখনও তারা সূরা এবং সঙ্গিনীসহ দেখা দেয়। কবির সঙ্গে তাদের সংক্ষিপ্ত একটা বাক্যবিনিময় হয় এ ধরনের দিনগুলোতে। তারা জানিয়ে দেয় ক’টা পর্যন্ত থাকবে। তাদের দেওয়া সময়সীমারও দু’ঘণ্টা বা তিন ঘণ্টা পর লুৎফর রহমান ফিরে আসেন। তিনি ফিরে আসেন সদরঘাট থেকে। এসব দিনে হাঁটতে হাঁটতে সদরঘাট তিনি যান, একটি অপেক্ষাকৃত ফাঁকা জায়গা নির্বাচন করতেই ব্যয় করেন অনেকক্ষণ, তারপর বসে বসে নদীর অপর তীরে ঘরবাড়ি এবং গাছপালা দেখেন, দেখেন আলো কীভাবে ক্রমেই মরে যায় এবং সব কিছুকে অস্পষ্ট করে দিয়ে যায়। বস্তুর এই ক্রমেই অস্পষ্ট হয়ে আসাটি তার কাছে কোনোবারই পুরনো কিংবা উত্তেজনাবর্জিত বলে মনে হয় না। কবি লুৎফর রহমান তার চালাঘরে ফিরে আসেন, চাদর ওয়াড় পালটান, মেঝেতে ঝাড়ূ দেন এবং হাঁক দিয়ে এক পেয়ালা চা আর মালপো আনিয়ে রাতের আহার শেষ করেন। পরে অম্ল উদগার তুলে মাথার বালিশ বুকে জড়িয়ে নিজের দেহ নিজেই দোলাতে দোলাতে ঘুমের ভেতরে চলে যান।

তরুণদের সঙ্গে তার কথা হয় না, তা নয়। কোনো কোনো দিন তরুণরা আসে বিশেষভাবে, শুধু তারই সঙ্গে কথা বলতে। হয়তো সেদিন তাসপ্রিয় বন্ধুর অভাব অথবা শৃংগারপ্রিয় সঙ্গিনীর অভাব, কিংবা কোনো কারণে গাঁজাও তাদের আর টানে না; তারা আসে এবং কবি লুৎফর রহমানের সঙ্গে কথা বলে। পনেরো বছর আগেকার সেই কবিতার বইয়ে যে প্রিয়তমার সূক্ষ্ম উল্লেখ ছিল, তাকেই বাস্তবে টেনে নামাতে চায় তারা। তরুণেরা কিছুতেই বিশ্বাস করে না যে, ব্যক্তিটির ঠিকানা ছিল নিতান্তই লুৎফর রহমানের তরুণ করোটির ভেতরে।

কিন্তু এইসব দিনগুলোতে অভাবিত এক রসায়নের পরিচয় পেয়ে শিউরে উঠতেন লুৎফর রহমান। মাথার ভেতরে ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠতে চাইত এক তরুণীর মুখ, অথচ হতো না; কোমল মাংসের একটা পিণ্ডের মতো অধরা সেই উপস্থিতি সেইসব সারারাত লুৎফর রহমানকে তাড়িয়ে বেড়াতো। একপ্রকার কষ্ট হতো; সেই কষ্টকেই অসীম সুখদায়িনী বলে মনে হতো তাঁর।

কবি লুৎফর রহমান মাঝে মাঝেই চাইতেন সেই কষ্ট, সেই সুখ; মাঝে মাঝেই চাইতেন, আজ যদি ওরা আসতো, ওদের কোনো আমোদ নিয়ে নয়, শুধু তাঁরই সঙ্গে কথা বলার জন্য, তাঁকে সেই ইঙ্গিতের বর্শায় বিদ্ধ করবার জন্য, আর কিছু নয়। কিন্তু মুখ ফুটে এ কথা বলা যায় না। বলার সম্ভাবনাটুকু মনে আসবার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে মনে হয়, একপাল এয়োর মাঝখানে গায়ে হলুদের বর হয়ে বসে আছেন তিনি।

এমনকি, এই মাস তিনেক আগে, নীল কাগজে প্রথম যেদিন চিঠি এলো, সেদিন কতবার মনে হলো ওদের তিনি দেখান, ওই চিঠিটা দেখান; তবে এও মনে হয়েছিল, এই প্রথম তিনি নিজেকে নিজের ভেতরে পেতে শুরু করলেন, এই প্রথম অনেক দিন পরে নিজের নাম মনে করতে পারছেন, এই প্রথম নিজেকে অপরের সমুখে সাজিয়ে রাখবার মতো ঝকঝকে বোধ করছেন।

চিঠিটা তিনি ইচ্ছে করেই ফেলে রেখেছিলেন বিছানার ওপরে; যেন সেই তরুণেরা দেখে। ভাত চাপিয়ে গোসল করতে যখন গিয়েছিলেন, তখন তাঁর মনে হচ্ছিল, এই যে তিনি ঘর থেকে বেরিয়েছেন আর কখনও ফিরবেন না; যে ফিরবে, সে ভিন্ন এক মানুষ, যে মানুষের একটা সম্পূর্ণ বিশ্ব আছে, যে বিশ্ব এতকাল স্বেচ্ছায়, হ্যাঁ স্বেচ্ছায় ছিল গোপন, আজ একটা বিরাট চাদর একটানে ফেলে দিয়ে নিজেকে দেখাবার জন্য সে দৃপ্ত হাত উদ্যত করে আছে।

তরুণদের সেই উল্লাস, সেই বরাভয় দান, সেই স্নেহশীল কৌতুক উচ্চারণ এখনও তিনি ভোলেননি। কবি লুৎফর রহমান জানেন, আজও এই নীল চিঠি সেই একই আলোকসম্পাতে তাঁকে উদ্ভাসিত করে তুলবে।

কিন্তু প্রতিক্রিয়া হলো ভিন্ন রকম। দুই তরুণ অত্যন্ত গম্ভীর মুখে চিঠি পড়ল; সেই মহিলা যে ‘হাসিনা’ বলে স্বাক্ষর করেছে তার লেখা নীল চিঠি। তারা যুগলে পড়ল, আলাদা আলাদা পড়ল, আবার যুগলে পড়ল। তারপর মেঝেতে পাটির ওপরে খালি গায়ে তেলমাখা লুৎফর রহমানের দিকে এক সঙ্গে তাকাল। এবং বলল, আপনার যাওয়া উচিত।

খুব উদ্বিগ্ন চোখে তাকালেন কবি লুৎফর রহমান। কিছু বলবার চেষ্টা করেও বলতে পারলেন না। একপ্রকার ‘কিন্তু’ তার ঠোঁটের কিনারায় শিলীভূত হয়ে রইলো।

তরুণেরা একযোগে বলে উঠলো, ‘যাবেন না মানে? আপনার সঙ্গে সে দেখা করতে চায়। আর, কখন একটি মেয়ে একটি পুরুষের সঙ্গে দেখা করতে চায়?’

সহজ এই প্রশ্নটিরও কোনো উত্তর দিতে পারলেন না কবি লুৎফর রহমান। তিনি শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন।

তরুণেরা নিজেরাই উত্তর সরবরাহ করল। একটি মেয়ে একটি পুরুষের সঙ্গে তখনই দেখা করতে চায়, যখন সে তাকে ভালোবাসে।

চোখ নামিয়ে নিলেন লুৎফর রহমান। তাঁকে ভালেবাসে? তরুণেরা প্রায় এক সঙ্গেই বলে উঠল, ‘আপনার উচিত তার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া। যাচ্ছেন কি না বলুন? যাচ্ছেন?’

‘হ্যাঁ যাবো। ডেকেছে যখন, কি বলো?’

স্খলিত পায়ে কবি লুৎফর রহমান গেলেন গোসল করতে। আজ সময় নিলেন অন্যান্য দিকের চেয়ে কিছুটা বেশি। দু’দুবার সাবান মেখে ঝরঝরে করলেন নিজেকে। মুখের ভেতরে আঙুল দিয়ে ঘষে ঘষে তুললেন জিহ্বার ময়লা। নতুন ডাল ভেঙে দিনের দ্বিতীয়বার দাঁত মাজন করলেন। তারপর জামা চাপিয়ে প্রেসে গেলেন। তাড়াতাড়ি সমস্ত প্রুফ দেখে দিলেন, প্রেসের কালি থেকে সযত্নে জামার হাতা বাঁচিয়ে তারপর, ‘আমার-একটা-কাজ-আছে’ বলে একবারও পেছনে না তাকিয়ে বেরিয়ে পড়লেন পথে।

হাসিনা তার চিঠিতে লিখেছে, ‘বিকেল ঠিক সাড়ে পাঁচটায় গুলিস্তান সিনেমার সামনে কামানের পাশে যদি দাঁড়িয়ে থাকেন তাহলে আমি আপনাকে ঠিক চিনে নেবো। সঙ্গে আপনার নতুন কবিতা আনবেন কিন্তু।’

নতুন কবিতা? কতকাল কোনো কবিতা লেখেননি কবি লুৎফর রহমান। যে হাসিনাকে তিনি কখনও চোখে দেখেননি, একখানা চিঠি প্রেসের ঠিকানায় এসে পৌঁছুবার পূর্ব পর্যন্ত লুৎফর রহমান যার অস্তিত্ব সম্পর্কে আদৌ কোনো ধারণা রাখতেন না, সেই অচেনা ব্যক্তিটিকে নিয়ে গত রাতে, আবার বহু বছর পরে, তিনি কবিতাকে, কোনো প্রকারে কোনো একটি কবিতাকে, কলমের মুখে ধরতে চেয়েছিলেন। বইরে শোনা যাচ্ছিল নিশিপ্রহরী পুলিশের পদশব্দ, পেয়ারা গাছে বাতাসের থেকে থেকেই লাফিয়ে ওঠার শব্দ, আর শোনা যাচ্ছিল বহুদূর থেকে মন্থর বহমান এক প্রকার স্তব্ধতা। প্রায় সারাটা রাত কবি লুৎফর রহমান একটি কবিতা লেখার মল্লযুদ্ধে যাপন করেছিলেন। তারপর ঘুমের ভেতরেও অস্পষ্ট এবং দ্রুত খণ্ডিত স্বপ্নচিত্র দেখেছেন বিছিয়ে থাকা শেফালীর, দাঁড়িয়ে থাকা যুবতীর, চলতে থাকা নক্ষত্রের।

কিন্তু কবিতাটি আসেনি। সেই জন্য বেরোতে গিয়েও কুণ্ঠায় এখন কাতর হয়ে যান তিনি। এমনও মনে হয়, হয়তো এই অভিসার হবে ব্যর্থ, হাসিনা করবে প্রত্যাখ্যান। শুধু একটি কবিতা, নতুন একটি কবিতা না লিখতে পারার জন্য নির্মমভাবে বাতিল হয়ে যাবে একটি প্রত্যাশা, অসম্পূর্ণ থাকবে একটি প্রতীক্ষা।

কবি লুৎফর রহমান পথচারী একজনের কাছ থেকে সময়টা জেনে নিলেন। না, সাড়ে পাঁচটা এখনও বাজেনি। এখনও পুরো পনেরো মিনিট বাকি।

প্রথমে, তিনি পথ পেরিয়ে একেবারে কামানের পাশে এসে দাঁড়ালেন। এবং সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো শহরের তিনি প্রধান একটি দ্রষ্টব্যে পরিণত হয়ে গেছেন। লাফ দিয়ে আবার ফুটপাতে এলেন লুৎফর রহমান। একেবারে প্রান্ত ঘেঁষে ঠাঁই নিলেন। কিন্তু এক জায়গায় একঠায় দাঁড়িয়ে থাকাটাও সুসাধ্য হলো না। তার জন্য যে মাত্রায় সাহসের দরকার, লুৎফর রহমানের করতল তার চেয়ে অনেকখানি ক্ষুদ্রাকার।

অতএব, তিনি একটা আপোস করলেন। লম্বমান কামানের দিকে দৃষ্টি স্থির নিবদ্ধ রেখে, কামান এবং নিজের মধ্যে সুপ্রচুর দূরত্ব রেখে কবি লুৎফর রহমান চক্রাকারে হাঁটতে লাগলেন।

আশঙ্কাটি সত্যি হয়ে গেল। ঘরে ফিরে দেখেন তরুণরা তাঁরই অপেক্ষায় বসে আছে। তবে অপেক্ষার এই সময়টুকু আদৌ তারা অপচয় করেনি। পদ্মাসনে উপবিষ্ট দুই তরুণের মাঝখানে গাঁজার কলিকা শায়িত রয়েছে ক্ষুদ্র এক দাতার ভঙ্গিতে, যে বিশ্বকে সর্বস্ব দিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে। মাথার ওপরে সটান নেমে আসা তারের ডগায় নেশানিমীলিত রুদ্র চোখের মতো ন্যাংটো একটা বাল্ব জ্বলছে।

তার পায়ের শব্দে তরুণরা চোখ মেলে তাকালো; প্রায় একই সঙ্গে এবং একই মাত্রায়। লুৎফর রহমান সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে রইলেন নিশ্চল হয়ে। তারপর, নদীর বুকে ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়ার মতো তরুণ দু’জনের নিচের ঠোঁটে দেখা দিল এক প্রকার স্মিতদ্যূতি। প্রায় একই সঙ্গে দু’জনের কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হলো, দেখা হলো?

হ্যাঁ হলো, হলো বৈকি! বলে, চৌকির কোনায় বসে পড়লেন লুৎফর রহমান। লজ্জার ভারে অবনত হলো তার মুখ, শার্টের খোলা কলারের ভেতরে প্রায় অন্তর্হিত হলো তার চিবুক।

অনেকক্ষণ পর চোখ তুলে দেখলেন তরুণরা তখনও সেই একই দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন কবি লুৎফর রহমান। উঠে দাঁড়ালেন কখনোই না দেওয়া এই প্রতিশ্রুতিকে হঠাৎ চোখের সমুখে দেখতে পেয়ে যে, তার ব্যক্তিগত এই অভিজ্ঞতা তরুণ দু’জনকে অবশ্যই জানাতে হবে।

দেখা হলো বৈকি। ঠিক সাড়ে পাঁচটা তখন, একেবারে কাঁটা মিলিয়ে সে এলো। সেই হাসিনা। বললে বিশ্বাস করবে না, আমার যেন মনে হলো, ও একটা উদ্ভিদ, কে-কবে বপন করেছিল পথের ওই বিশেষ বিন্দুটিতে, আজ আমার চোখের আলোয় নিমেষে মাথা তুলে দাঁড়াল, সতেজ সবুজ পাতাপত্তর বিস্তার করে মুহূর্তেই একখণ্ড বাগান রচনা করল জনারণ্যের ভেতরে।’

কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠতে লাগল, ধীরগতিতে কপাল বেয়ে নামতে শুরু করল তারা। কিন্তু সেদিকে ভ্রূক্ষেপ মাত্র না করে কবি লুৎফর রহমান তাঁর চালাঘরের ভেতরে পায়চারী করে চললেন। বাল্বের আলোয় একবার তাঁর সর্বগ্রাসী ছায়া এদেয়ালে একবার ওদেয়ালে দৌড়ে বেড়াতে লাগল।

নেশা কখনও করিনি, তবু তখন মনে হলো, তীব্র একটা রস আমি একঢোকে হঠাৎ পান করে ফেলেছি। চোখের সমুখে হাসিনা ছাড়া আর সমস্ত কিছু, সমস্ত যান, সমস্ত দালান-দেয়াল, আকাশ অতি ধীর দোলায় পদার্থের প্রথম অবস্থা থেকে দ্বিতীয় অবস্থায়, অর্থাৎ তরলে রূপান্তরিত হয়ে যেতে লাগল। নিজেকে মনে হলো তরুণ এবং অস্থির এক মাছ, যে মাছ একখণ্ড বিদ্যুৎ দিয়ে তৈরি।

কবি লুৎফর রহমান পায়চারী থামিয়ে শিউরে উঠলেন হঠাৎ। এই বৈশাখেও অনুভব করলেন মাঘের প্রহার। কিন্তু তা ক্ষণিকের জন্য। দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার পথে যাযাবর পাখি বিশ্রাম নিয়ে আবার যেমন দুই পাখা বিস্তার করে স্বচ্ছন্দে ধাবিত হয়, তিনিও তেমনি আবার পায়চারী করতে লাগলেন।

সমস্ত জল ভেদ করে আমি জেগে উঠলাম; যেন উত্তাল বিশাল একবৃত্তের ভেতর। আমার চারদিকে যেন তরল জল নয়, চাঁদের আলো ছলছল করে বয়ে চলেছে। আমি এগিয়ে গেলাম সেই উদ্ভিদের দিকে, সারাবিশ্বে উদ্ভিদ একক সেই বৃক্ষের দিকে। আর আমি যতই যাই, ততই সরে যায় সেই গন্তব্য।’

চৌকির ওপর ধপ করে বসে পড়লেন লুৎফর রহমান। অনুভব করলেন শ্রোতারা তাঁর সঙ্গে নেই। সমুখেই আছে, অথচ তারা উধাও। দৃষ্টি মুদিত শ্রুতি রুদ্ধ। দেহ দুটো প্রায় দেখা যায় না এমনভাবে ডানে-বাঁয়ে দুলছে। মাঝখানে ক্ষুদ্র সেই দাতা, সেই কলিকা পড়ে আছে, যেন পাপড়ি ছিঁড়ে নেওয়ার পর একটি ফুল।

কবি লুৎফর রহমান আবার তাঁর সারা দেহে প্রবল কিন্তু ক্ষণিক এক কম্পন অনুভব করলেন। সে কম্পন কান্নার নাভির মূল থেকে ছিন্ন শিকড় একটি শূন্যতার সেই কম্পন।

তরুণ দু’জনকে ঠেলে জাগিয়ে দিলেন তিনি। একেবারেই আকস্মিকভাবে। বিহ্বল চোখে ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিল তারা, প্রবল শক্তিতে তাদের টেনে বসিয়ে দিলেন তিনি। শুধু জিজ্ঞেস করলেন, আর আছে?’

মধ্যরাতে, পদ্মাসনে উপবিষ্ট তিনজন। কবি বললেন, ‘সে আসেনি রে।’

প্রথম তরুণ বলল, ‘আসবে কী করে?’

দ্বিতীয় তরুণ যোগ করল, ‘দরদী, তোমার দুঃখে চিঠি লিখতাম আমরাই।’

কবি লুৎফর রহমান মাথার ভেতরে মাছের মতো তখন সাঁতার দিচ্ছেন। মাছেরা মানুষের ভাষা বোঝে না বলে তিনি অত্যন্ত নিরাপদ বোধ করলেন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত