| 19 এপ্রিল 2024
Categories
গীতরঙ্গ

ইরাবতী গীতরঙ্গ: লোককথা এবং গাছপালা । বোরহান মাহমুদ

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

লোককথাগুলোর বিশ্বব্যাপী একটা অদৃশ্য যোগসূত্র রয়েছে। তবে এ কাহিনীগুলোতে উদ্ভিদ এবং প্রাণীবৈচিত্র্য একেবারেই স্থানীয় পরিবেশ হতে উৎসারিত।

জনগোষ্ঠীরা তাদের আশেপাশের প্রাণী এবং গাছগাছালিকে তাদের এসব গল্পে নিয়ে এসেছে। কাজেই যে কোন লোককথায় স্থানীয় কৃষি জলবায়ুর সাথে সাথে স্থানীয় পরিবেশের একটি প্রতিচ্ছবি উঠে এসেছে। তবে লোককথার গাছ  এবং প্রাণীদের অনেক সময় কাল্পনিক অতিবাস্তব ক্ষমতার অধিকারী হিসেবেও দেখা গিয়েছে। আমরা আজ লোককথায় গাছগাছালির উপস্থিতি নিয়ে কথা বলবো। 

খেড়িয়া পুরাকাহিনীতে “আমাদের আদি সৃষ্টিকর্তা” গল্পে বলা হয়েছে– 
পৃথিবীর সৃষ্টিলগ্নে বন জংগল, গাছ, ঝোপ, লতাপাতা প্রথমে সৃষ্টি হয়েছিলো। ভগবান তারপর মাটির তাল হতে দুটি মূর্তি তৈরি করলেন। একটা পুরুষ, আরেকটা নারী। মূর্তি দুটি তৈরি করার পর তিনি তাদেরকে একটা বট গাছের কোটরে রেখে দিলেন। বটগাছের সাদা কষ-দুধ মূর্তিতে পড়লে তখন সেদুটোতে প্রাণের চিহ্ন দেখা দেয়। 

লেপচা পুরাণকথায় “আমাদের আদি মাতা” গল্পে বলা হয়েছে–
স্রষ্টা প্রথমে অনেক জীবজন্তু তৈরি করেছেন। শেষে তিনি তৈরি করলেন মানুষ। পৃথিবীর সবচাইতে ছোট ভাই “মানুষ”। তার অন্য ভাইরা হলো ঘাস, গুল্ম, গাছ, পাহাড়, ঝরনা, নদী, জীবজন্তু। সবাই মানুষের আগে জন্মেছে। সেই একই গল্পে আরো বলা হয়েছে, আদি দেবতা কচ্ছপ তৈরি করে জলমগ্ন পৃথিবীতে ছেড়ে দিলেন। তার পিঠে বসালেন মাটির পাত্র, সে পাত্রে দিনে দিনে সবুজ আস্তরণ পড়লো, সে আস্তরণে কচি ঘাস জন্মাল, ছোট ছোট লতা হলো, তারপর গুল্ম হলো, ছোট গাছ হলো, তারপর বড় বড় গাছ হলো। এদিকে মাটির পাত্র দিনে দিনে বড়ো হলো। তার উপর ছড়িয়ে পড়লো ঘাস, লতা, গুল্ম, গাছ।  

বিরহড় লোককথার “রাম সীতা হনুমান” গল্পে তেঁতুল আর খেজুর পাতার অভিযোজনের গল্প এসেছে। রাম লক্ষ্মণ সীতা বনবাসে চলে গেলো। সেখানে তারা উথ্‌লু বিরহড়দের মতো যাযাবরের জীবন যাপন করতে লাগলো। একবার তারা তেঁতুল গাছের তলায় ঘর তৈরি করলো। তখন তেঁতুল গাছের পাতা বিশাল বড় হতো। সেগুলো ভেদ করে রোদ বৃষ্টি আসতো না। রাম ভাইকে বলল, আমরা বনবাসে এসেছি। এখানে আরামে থাকা যাবে না। আমাদের কষ্টে থাকতে হবে। তুমি তীর মেরে পাতাগুলো চিরে দাও। লক্ষ্মণ তখন তীর মেরে পাতাগুলো ফালাফালা করে দিলো। সেদিন হতে তেঁতুল পাতা ছোট হয়ে গেলো। এরপর তারা খেজুর গাছের তলায় ঘর বাঁধল। তখন খেজুর গাছের পাতাও বিরাট বড় হতো। সেগুলো ভেদ করে রোদ বৃষ্টি গায়ে পড়তো না। রাম আবার ভাইকে তীর মেরে পাতাগুলো চিরে দিতে বলল। লক্ষ্মণ তীর মেরে খেজুর পাতাগুলোকে সরু করে দিলো। সেই থেকে খেজুর পাতা সরু হয়ে গেলো। 


আরো পড়ুন: ওড়িয়া মহাভারতের নবগুঞ্জর । সুকন্যা দত্ত


লোককথার একটা আশ্চর্য বৈশিষ্ট্য আছে। মানুষ লোককথাকে বিশ্বাস করে, তারা ভাবে এসব হয়ত সত্যিই ঘটেছিলো অথবা সেই সসময় এরকমই ছিলো। ব্যাপারটা অনেকটা The science of a pre-scientific age ধাঁচের। (২) 

আমাদের এ অঞ্চলের সাত ভাই চম্পা গল্পটির কথা না বললেই নয়। ছোটরাণীর সাত ছেলে ও এক মেয়েকে  বড়রাণী ছাই এর গাদায় পুঁতে ফেলে। সেখানে এক পারুল ও চাঁপা গাছ জন্মায়। আর সেখানে সাতটি চাঁপা ফুল এবং একটি পারুল ফুল ফোটে। (Folklore Motif Index – Transformation: Man to Flower: D 212) (৩)। এ গল্পের শেষ অংশের কাহিনী আমাদের সবার জানা। 

টোটো লোককথায় “মিষ্টি কুমড়ো ও রাজকন্যা” গল্পে মিষ্টি কুমড়ো চাষের কথা এসেছে। কুমড়ো গাছে কুমড়ো হলে সেটিকে কাটতে গেলে সেটি কথা বলে উঠে, আমায় কেটোনা, আমি তোমাদের দেখাশোনা করবো। পাঠক নিশ্চয়ই বুঝে নিয়েছেন এরপর সম্ভাব্য কি কি হতে পারে। এ গল্পে আমের প্রসংগও এসেছে। কুমড়ো বেশী রাজপুত্র রাজার ছোট মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছে। পথে দুজনের ক্ষুধা পেলে তারা লক্ষ্য করে পথের ধারে গাছে আম ধরে আছে। রাজকন্যা নিচে কাপড় পেতে রাখল আর কুমড়োবেশী রাজপুত্র  আম পেড়ে দিতে লাগলো ঐ কাপড়ে। সব শেষে কুমড়োবেশী রাজপুত্র ঐ কাপড়ে লাফিয়ে পড়লে কুমড়ো ফেটে যায় এবং ভেতর হতে সুদর্শন  রাজপুত্র বেরিয়ে আসে। 

এখানে ধারণা করা হয়, অঢেল ফলন, ফলন সক্ষমতা আর আমের ফলন বৈশিষ্ট্য লোকমানসের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলো।  ধারণা করা যেতে পারে এ জন্যেই প্রকৃত বিবাহের আগে আমগাছের সঙ্গে বিবাহ, আমপাতা চিবোনো, আমপাতা সজ্জিত বিবাহ মণ্ডপের প্রচলন শুরু হয়েছিলো। 

সাঁওতাল লোককথা “সাবাই ঘাসের জন্মকথা” তে বলা হয়, মানুষের চুল হতে সাবাই ঘাস এর জন্ম হয়েছে। লোককথায় তুলা গাছের কথা এসেছে, তুলসী গাছ এসেছে, কলা গাছের প্রসঙ্গও এসেছে। তুলা, তুলসী এ তিনটিই আমাদের লোকজীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। আবার পদ্মফুল এর কথাও শোনা যায় লোককথায়। 

গাছগাছালি এবং জঙ্গল সম্ভবত তাদের বিশালত্ব, দীর্ঘায়ু এবং ব্যাপকতার জন্যেই সেই সময়ের লোককথাগুলোতে বিভিন্নভাবে উপস্থিত হয়েছে। সেই সাথে এসবের মধ্যে মানুষের কল্পনাশক্তির বৈচিত্র্য আমরা দেখতে পাই। গাছপালার কথা বলার ক্ষমতা তথা আরো কিছু অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার বর্ণণাও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লোককথায় চলে এসেছে।  ঘন জঙ্গলের মধ্যে অতিপ্রাকৃত ঘটনার বর্ণণা যেমন দেখা যায়, তেমনি সেগুলোর মধ্যে লুকিয়ে থাকার কথাও এসেছে। আবার কিছু গাছ দু ফাঁক হয়ে তার ভেতর গল্পের চরিত্রকে লুকিয়ে রাখার আশ্চর্য বর্ণণাও আমরা পাই। গাছের ওষধিগুণের ক্ষমতার অভিব্যাক্তিকে কাল্পনিক রূপও দেয়া হয়েছে বিভিন্ন লোককথায়।  

রেফারেন্সঃ 
(১) মনাঞ্জলি বন্দ্যোপাধ্যায় কল্যাণ চক্রবর্তী, লোককথায় গাছগাছালি। 
(২) বৃটিশ ফোকলোরিস্ট স্যার জি এল গোম 
(৩) মোটিফ ইনডেক্স অফ ফোক লিটারেচার। 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত