| 29 মার্চ 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প ধারাবাহিক

অসমিয়া অনুবাদ: রক্তের অন্ধকার (পর্ব-৪) । ধ্রুবজ্যোতি বরা

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,শব্দডক্টর ধ্রুবজ্যোতি বরা পেশায়  চিকিৎসক,অসমিয়া সাহিত্যের একজন স্বনামধন্য লেখক ২৭ নভেম্বর ১৯৫৫ সনে শিলংয়ে জন্মগ্রহণ করেন। শ্রীবরা ছাত্র জীবনে অসম্ভব মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ‘কালান্তরর গদ্য’ ,’তেজর এন্ধার’ আরু ‘অর্থ’ এই ত্রয়ী উপন্যাসের লেখক হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত। ২০০৯ সনে ‘ কথা রত্নাকর’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য আকাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। বাকি উপন্যাসগুলি ‘ভোক’,’লোহা’,’যাত্রিক আরু অন্যান্য’ ইত্যাদি। ইতিহাস বিষয়ক মূল‍্যবান বই ‘রুশমহাবিপ্লব’দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ’,’ফরাসি বিপ্লব’,’মোয়ামরীয়া বিদ্রোহ’। শ্রীবরার গল্প উপন্যাস হিন্দি, ইংরেজি, বাংলা, মালয়ালাম এবং বড়ো ভাষায় অনূদিত হয়েছে।আকাডেমিক রিসার্চ জার্নাল’যাত্রা’র সম্পাদনার সঙ্গে জড়িতরয়েছেন।’ কালান্তরর গদ্য’ উপন্যাসের জন্য ২০০১ সনে অসম সাহিত্য সভার ‘ আম্বিকাগিরিরায়চৌধুরি’ পুরস্কার লাভ করেন।শ্রীবরা অসম সাহিত্য সভার প্রাক্তন সভাপতি।


অনুবাদকের কথা

আলোচ‍্য উপন্যাস ‘রক্তের অন্ধকার'(তেজরএন্ধার) একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ উপন্যাস। এটি লেখার সময় কাল ২০০০-২০০১ ছিল অসময়ের ক্ষেত্রে অত্যন্ত দুর্যোগের সময়। সেই অশান্ত সময়ে, আমাদের সমাজে, আমাদের জীবনে এক দ্রুত অবক্ষয়ের স্পষ্ট ছাপ পড়তে শুরু করেছিল। প্রতিটি অসমিয়াইমর্মেমর্মে   একথা উপলব্ধি করে ভেতরে ভেতরে শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। রাজ্যের চারপাশে দেখা দেওয়ানৈরাজ্যবাদী হিংসা কোনো ধরনের মহৎ রূপান্তরের সম্ভাবনাকে বহন করে তো আনেই নি, বরঞ্চ জাতীয় জীবনের অবক্ষয়কে আরও দ্রুত প্রকট করে তুলেছিল। আশাহীনতা এবং অনিশ্চিয়তায় সমগ্র রাজ্য ক্রমশ ডুবে যাচ্ছিল। এই ধরনের পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই যেন থমকে যেতে চায় কবির  কবিতা , শিল্পীর তুলি, লেখকদের কলম। তবে একথাও সত্যি যে শিল্পী-সাহিত্যিকরা সচেতন ছিলেন যে সমাজ জীবনের ভগ্নদশা’ খণ্ডহর’এর মধ্যে একমাত্র ‘সৃষ্টি’ই হল জীবন এবং উত্তরণের পথ। এই বিশ্বাস হারানোর অর্থ হল মৃত্যু । আর এই বিশ্বাস থেকেই সেই সময় লেখক লিখেছিলেন কালান্তর ত্রয়ী উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্ব – রক্তের অন্ধকার ।

এবার উপন্যাসটির বাংলা অনুবাদ নিয়ে এলাম। আশা করি ইরাবতীর পাঠকেরা এই ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত অসাধারণ উপন্যাসটিকে সাদরে বরণ করে নেবেন ।নমস্কার।

বাসুদেব দাস,কলকাতা


 

ছেলের উপরে উঠা রাগ তার অনেকখানি কমে গেল । ‘আজ সে নিশ্চয় পাকা খবর নিয়ে আসবে। ‘ -–- নিজেকেই নিজে কথাটা শুনিয়ে  বলল।’ টাকাটা নিশ্চয় রাজধানী থেকে এসে জেলা সদরে পৌঁছেছে। পেয়েছে, পেয়েছে ডিসির কাছে টাকাটা এসে গেছে। সরকারের দেওয়া টাকা না এসে  থাকবে কীভাবে? আজ কয়েক মাস হয়ে গেল ঘোষণা করা হয়েছে। তিন থেকে চার পাঁচ মাস। টাকা নিশ্চয় এসেছে । প্রেমই আজ টাকা কবে দেবে সেই বিষয়ে সঠিক খবর নিয়ে আসবে।’

বুড়োরকণ্ঠস্বরউৎফুল্ল হয়ে উঠল।

‘ প্রেমের মা’– পরিবারকে সে বলল। ‘সে আজ সঠিক খবরই আনবে।’

মানুষটা হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠল।

দরজার খুঁটিতে হেলান দিয়ে সে ফুঁপিয়ে উঠল। খুটিটাতে হেলান দিয়ে মানুষটা যেন ক্রমান্বয়ে ছোট এবং বেঁটে হয়ে যেতে শুরু করেছে– সেরকমই যেন মনে হল রতিকান্তের।

সে পরিবারের দিকে তাকাল। সবুজ সুতোর পার দেওয়া একটি বিবর্ণ, প্রায় ধূসর হয়ে যাওয়া একটা চাদর পরে  আছে মানুষটা। সংসারের দুঃখ-কষ্টের অজস্র দাগ নিয়ে রোদ-বৃষ্টিতে পচে যাওয়া কাপাসের  চাদরটা,একহাতে দরজার চৌকাঠ ধরে অন্য হাতে সেই বিবর্ণ চাদরটার আঁচল দিয়েমানুষটা চোখের জল মুছে ছিল। এখন ফোঁপানির শব্দ হচ্ছে না। নীরবে ফুঁপিয়ে কান্নার মতো মানুষটা কাঁদছে।

মেখেলাটা এক সময় কমলা রঙের উল দিয়ে বোনা হয়েছিল তা বুঝতে পারা যায়। এখন রংটা ধূসর হয়ে প্রায় বিবর্ণ হয়ে পড়েছে। রতিকান্ত মনে পড়ে তাকে বেশ কয়েকদিন বলে-কয়ে অনেকঅনুরোধ করে মানুষটা সেই মেখেলায়দেওয়া কমলা রঙের সুতো আনিয়েছিল। সংসারের খরচ থেকে অনেক দিন ধরে দু পয়সা,সিকিটা বাঁচিয়ে রেখে একমুঠো খুচরো পয়সা এনে মানুষটা তার হাতে দিয়েছিল। সেই পয়সার মধ্যে কয়েকটি অচল দু আনার মুদ্রা ও ছিল। সে দিন সেবাড়ি ফেরার সময়মানুষটাগিয়ে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল।

খবরের কাগজে মুড়ে কয়েক লেছা সুতো দেখে মানুষটার মুখ কীভাবে আলোকিত হয়ে উঠেছিল। রতিকান্তের মনে হল যেন অস্পষ্ট ধোঁয়াশার মধ্যে দিয়ে সে যেন অতীতের সেই ছবি দেখতে পাচ্ছে । কানে এসে পড়ছে ঘরের সামনের উঠানে ছোট বোন আর তার থেকে হাতের লাটাইয়ে সুতো গোটানো এবং তাঁত বোনা আনা মা মেয়ের সেই আনন্দ উচ্ছল উল্লাসের  শব্দ!

শব্দ! শব্দ! 

স্মৃতির কুয়াশার মধ্য দিয়ে সেই শব্দ-গুলি তার কাছে ফিরে আসছে।

হ্যাঁ মানুষটা সত্যিই বেঁটে এবং ছোট হয়ে যেতে শুরু করেছে। দরজার নিচে ফাঁক দিয়েমানুষটা যেন একদিন নাই হয়ে যাবে।

রতিকান্তের বুকের ভেতরে কোনো একটি জায়গায় যেন একটু মোচড়দিয়ে উঠল।

অন্য সময়ের মতো সে রেগে উঠল না।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে ধীরে ধীরে বেশ কোমল ভাবে স্ত্রীকে বলল–’ কাঁদিস না। যা হয়ে গেছে তাকে তো আর না-হওয়া করা যায় না প্রেমের মা। কানা বিধাতা একটা ছেলে কেড়ে নিল, একটাকে খোঁড়া করে রেখে দিয়ে গেল। আমাদেরই ভাগ্য। আমি হলাম বিছানায়পড়ে থাকা রোগী। কাজকর্ম কিছুই করতে পারি না। হাঁপানির চাপে প্রাণটা প্রতিমুহূর্তেবেরিয়ে যাবে বলে মনে হতে থাকে। একটা কুট গাছকেও ফলা করার ক্ষমতা রইল না। খোঁড়া ছেলেটা আর তুই কতো কষ্ট করবি বল তো?’


আরো পড়ুন: রক্তের অন্ধকার (পর্ব-৩) । ধ্রুবজ্যোতি বরা


সে একটা দীর্ঘশ্বাস বুকের মধ্যে ঢুকিয়ে নিতে চেষ্টা করল। নিশ্বাস নেবার সময় খুলে থাকা মুখটারঠোঁটজোড়া এবং গলার পেশীগুলি কেঁপে উঠল। কিছুক্ষণ বিশ্রাম করার মতো চুপ করে থেকে তিনি পুনরায় ধীরে ধীরে কথা বলতে আরম্ভ করলেন-সরকার উপযাচক হয়ে দিতে চাওয়া টাকা। তুই তো আর নিবি না বলতে পারবি না।ফিরিয়েদিতেও পারবি না। সেটা মূর্খামি আর পাপ হবে।’

তিনি আবার কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন।

‘আমাদের এখন সেই টাকাটাই অবলম্বন। আর তো কিছু নেই। যার যা যেখানে ছিল,সব শেষ হয়ে গেছে।বাগানের কাঠ বাঁশও শেষ।সেই টাকাগুলি দিয়েই বেঁচে থাকা দিনগুলি চলতে হবে।দুই বিঘা জমি এখনও বন্ধকে রয়েছে। সেটা মুক্ত করে নিতে হবে।আরও দুই চার  বিঘা জমি কিনতে পারলে খোঁড়া ছেলেটা কোনো রকমে খেয়ে পড়ে বাঁচবে।’বুড়ো কথাটা যেন নিজেকেই শুনিয়ে বলল।‘সেও  তো যুবক হয়ে উঠেছে প্রেমের মা,দেখে শুনে ওর জন্য কাউকে নিয়ে আসতে হবে না কি? ঘরটা কীভাবে খসে পড়তে শুরু করেছে। বৃষ্টি তো বাদেই ,জায়গায় জায়গায় শিশিরের জলও ভেতরে পড়ে। ঘরটাতেও মেরামতির কাজ করাতে হবে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত