| 20 এপ্রিল 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প

অনুবাদ গল্প: স্মৃতিফলক کتبہ : গুলাম আব্বাস । শুভময় রায়

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

 [গুলাম আব্বাসের (১৯০৯-৮২) ‘কত্‌বাহ্‌’ গল্পে ফুটে উঠেছে অল্প মাইনের এক কেরানির জীবন। অতি সাধারণ কোনও চাকুরের জীবনে পদোন্নতির আকাঙ্ক্ষা, আরেকটু স্বচ্ছন্দ জীবনের অভিলাষ আর শেষ পর্যন্ত হতাশা ও মোহভঙ্গের এ কাহিনী। সে কেরানির জীবন যেমন ঘটনাবিহীন, মরণেও তিনি রইবেন তেমনই বিস্মৃত। সাধারণ মানুষের ভয়-উদ্বেগ-হতাশা লেখক যে সংবেদনশীলতার সঙ্গে অনুধাবন করেছেন, তেমনই নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন জীবনের ছোটখাটো আবিষ্কারের আনন্দ।

অনুবাদের জন্য নাদিম আহমদ সম্পাদিত ‘কুল্লিয়াত-এ গুলাম আব্বাস’-এ মুদ্রিত গল্পটি ব্যবহার করেছি।

—অনুবাদক]


শহর থেকে দেড়-দু মাইল দূরে ফুলবাগিচা আর ফলের বাগানে ঘেরা এলাকায় অনেকটা একই রকম দেখতে এক সারি বাড়ি। অমন বাড়ির সারি বেশ খানিক দূর পর্যন্ত চোখে পড়ে। এই বাড়িগুলোতে ছোট-বড় অফিস আছে; কম-বেশি হাজার চারেক মানুষ সেখানে কাজ করে। দিনের বেলায় এ এলাকার কর্মব্যস্ততা আর তাড়াহুড়ো যা কিছু ওই বাড়িগুলোর চার দেওয়ালের মধ্যেই আটকে থাকে। শহরের বড় দরওয়াজা থেকে যে চওড়া ও শক্তপোক্ত সড়কটি সে পাড়া পর্যন্ত গেছে, সকাল সাড়ে দশটার আগে আর বিকেল চারটের পরে সেটি যেন পাহাড়ি নদীর রূপ ধরে। আর সে নদীর জলস্রোতে কত খড়কুটো আর মাটি-পাথর যে ভেসে যায় তার ইয়ত্তা নেই।

গরমের সময় বিকেলের দিকে সড়কের ওপরে গাছের ছায়া লম্বা হতে শুরু করে। অথচ মাটি তখনও এত গরম যেন জুতোর সুখতলা গলিয়ে দেয়। এই সবে একটা জলের গাড়ি বেরিয়ে গেল। রাস্তার ওপর যেখানেই জল পড়ল, মুহূর্তেই বাষ্প হয়ে মিলিয়ে গেল। শরিফ হোসেন রোজের তুলনায় আজ একটু আগেই অফিস থেকে বেরিয়ে শহরে ঢোকার বড়ো গেটের নিচে টাঙা-স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়েছে একটা টাঙা ধরার আশায়।

ঘরে ফেরার সময় অর্ধেক পথ টাঙায় চড়ার এই যে বিলাস, তা মাসের গোড়ায় চার-পাঁচ দিনই বড়োজোর দ্বিতীয় শ্রেণির কেরানি শরিফের সামর্থ্যে কুলোয়। আজকের দিনটা একটু অন্যরকম, কারণ শরিফের পকেটে একটা পাঁচ টাকার নোট আর কয়েক আনা পয়সা এখনও পড়ে আছে। মাইনে পাওয়ার আট দিন পরেও। আসলে বিবি মাসপয়লায় বাচ্চাদের নিয়ে বাপের বাড়ি গেছে। ঘরে সে একলা। দিনের বেলায় দফতরের হালুইকরের কাছ থেকে দু-চারটে পুরি আর ঢক-ঢক করে অনেকটা জল খেয়ে পেট ভরিয়ে রেখেছে। রাতে শহরের কোনও সস্তার হোটেলে গিয়ে খাওয়া সারবে। একদম দুশ্চিন্তামুক্ত জীবন। ঘরে মূল্যবান এমন কিছুই নেই যে পাহারা দিতে হবে। আছে যখন খুশি ঘরে ফেরার স্বাধীনতাও। সারা রাত রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ালেই বা কী?

কিছুক্ষণের মধ্যেই অফিস থেকে কেরানিরা দল বেঁধে বেরোতে শুরু করল। টাইপিস্ট, রেকর্ড-কিপার, ডেসপ্যাচার, অ্যাকাউণ্টেণ্ট, হেড ক্লার্ক, সুপারিনটেনডেন্ট আর নানা পদমর্যাদার অফিস কর্মী – কে নেই সে দলে? তাদের চেহারা, পোশাক-আশাক থেকে সামাজিক অবস্থান আর পদমর্যাদা কিছুটা আন্দাজ করা যায়। এদের মধ্যে কাউকেবা অন্যদের থেকে বেশি চোখে পড়ছে। হাফ-হাতা জামা আর খাকি রঙের নিকারবোকার, পায়ে চপ্পল পরা বাবুরা সাইকেলে সওয়ার হয়ে মাথায় ছাতা নিয়ে ভুঁড়ি বাগিয়ে চলেছে। তাদের মুখে বিড়ি, বগলে ফাইল, মাথায় শোলার টুপি, কব্জিতে ঘড়ি, চোখে রংবেরঙের চশমা। অফিসের শোরগোলের মধ্যে যে সমস্যার সমাধান করা গেল না, সেগুলো ঘরে বসে শান্তিতে নিষ্পত্তি করার আশায় প্রায় রোজই ফাইলগুলো তাদের সঙ্গে যায়। কিন্তু ঘরে পৌঁছোনো মাত্রই পারিবারিক দায়দায়িত্ব এমন চেপে বসে যে ফাইল খুলে দেখার সময়ও জোটে না। সে ভারি বোঝা যেমন এসেছিল পরদিন তেমনই ফেরত যায়।

দুঃসাহসী দুয়েকজন টাঙা-সাইকেল বা মাথার ওপরে ছাতার ধার ধারে না। তাদের টুপিটি হাতে আর কোটটি কাঁধেই থেকে যায়। জামার গলা খোলা, বোতাম ভাঙা। সেফটি পিন দিয়ে আটকে রাখার চেষ্টা সত্ত্বেও ঘামে ভেজা লোমশ বুক উন্মুক্ত হয়ে আছে। নতুন ছেলেছোকরার দল সস্তায় সেলাই করানো বেঢপ স্যুট পরে বেরোয়। এই গরমেও তাদের গলায় নেকটাই, কলার আর ওয়েস্টকোট। কোটের ওপরের পকেটে দু-তিনটে ফাউন্টেন পেন আর পেন্সিল।

এই কেরানিরা একই ভাষাভাষী হলেও বিদঘুটে উচ্চারণে নিজেদের মধ্যে বিদেশি ভাষায় কথা বলে। এর কারণ এই নয় যে বিদেশি ভাষায় তারা বেশ সড়গড়। বরং এই যে অফিসে ঊর্ধ্বতন অফিসারদের সঙ্গে দিনভর তারা ওই ভাষায় কথা বলতে বাধ্য হয়। আর অফিসের বাইরে নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতায় বাক্‌পটু হওয়াই যেন তাদের লক্ষ্য।


আরো পড়ুন: ভারত থেকে একটি চিঠি : ইনতেজার হুসেইন


এই কেরানিদের মধ্যে আছে সদ্য যুবক থেকে ঝানু প্রবীণ। আছে এমন অনভিজ্ঞ তরুণ যাদের ঠোঁটের ওপরে গোঁফের রেখা স্পষ্ট হয়নি। স্কুল পাশ করার পর তিন মাসও হয়ত কাটেনি। আবার বিশ্বপর্যটক, পোড় খাওয়া, কূটবুদ্ধি অভিজ্ঞেরও অভাব নেই। বহু বছরের চশমার ভারে তাদের নাকের দুধারে গভীর দাগ। তিরিশ বছর ধরে এই সড়কের ওপর দিয়ে পাশাপাশি চলতে চলতে প্রতিদিন এর চড়াই-উৎরাইয়ের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে। এরা পিঠ বেঁকিয়ে একটু ঝুঁকে চলে। বহুদিন ধরে ভোঁতা ক্ষুর দিয়ে দাড়ি কাটায় গালে আর থুতনিতে অসংখ্য ছোট ছোট জড়ুল আর আঁচিল। যারা পায়ে হেঁটে দফতরে আসে, তাদের অনেকেরই মুখস্থ বাড়ি থেকে অফিসে আসতে কত হাজার বার পা ফেলতে হয়। তবে একটা ব্যাপারে সকলেই বিরক্ত: ঊর্ধ্বতন অফিসারদের খারাপ ব্যবহার আর অধস্তন কর্মীদের অযোগ্যতা।

টাঙায় একজনের বসার জায়গা আছে দেখে শরিফ হোসেন এক লাফে চড়ে পড়ে। টাঙা কিছুক্ষণের মধ্যেই শহরের প্রধান ফটকের কাছে পৌঁছোলে শরিফ পকেট থেকে এক আনা পয়সা বার করে কোচোয়ানকে দিয়ে বাড়ির বদলে শহরের জামা মসজিদের পথ ধরে। প্রতি সন্ধ্যায় এই মসজিদের সিঁড়িতে মনিহারি জিনিস আর সস্তার মাল বিক্রেতারা দোকান লাগিয়ে মেলা বসিয়ে দেয়। দুনিয়ার সব জিনিস সেখানে মেলে। সব ধরনের মানুষের দেখা পাওয়া যায়। কেনাকাটার ইচ্ছে না থাকলেও বেচাকেনা আর দরদামের হুড়োহুড়ি তামাশা দেখার আনন্দ দেয়।

লেকচারবাজ হাকিম, তাবিজ-মাদুলি বেচা যোগী-সন্ন্যাসী, তাৎক্ষণিক ছবি তুলে দেয় এমন ফোটোগ্রাফারদের ভিড়ের মধ্যে শরিফ দুয়েক মিনিট দাঁড়ায়। তারপরে মজা দেখতে দেখতে রদ্দি মালের কারবারিদের দিকে চলে আসে। এদের দোকানে অসংখ্য নানা কিসিমের জিনিস দেখা যায়। এমনও আছে যেগুলো একসময় নিঃসন্দেহে উচ্চমানের হস্তশিল্পের নিদর্শন ছিল। কিন্তু যতদিনে সেগুলো রদ্দিমাল-বিক্রেতাদের হাতে পৌঁছোয়, ততদিনে তারা অতীতের সৌন্দর্যের ছায়ামাত্র। অথবা এমন ভেঙেচুরে গেছে যে কোনও কাজেই আর লাগবে না। চিনদেশে তৈরি পাত্র আর ফুলদানি, টেবিল ল্যাম্প, ঘড়ি, জ্বলে যাওয়া ব্যাটারি, গ্রামোফোনের অংশবিশেষ, শল্যচিকিৎসার সরঞ্জাম, সেতার, খড়-ভরা হরিণ, পিতলের সারস পাখি, বুদ্ধের আবক্ষ মূর্তি।

এমনই এক দোকানে মার্বেল পাথরের টুকরোটার ওপর চোখ আটকে গেল। পাথরটা যেন মুঘল বাদশাহদের কোনও স্মৃতিসৌধ অথবা বারদুয়ারি থেকে ভেঙে আনা হয়েছে। জিনিসটা লম্বায় সওয়া ফুট, চওড়ায় এক ফুটের মত। শরিফ সেটাকে হাতে নেয়। পাথরটা এত সুন্দরভাবে কাটা হয়েছে যে রদ্দিওয়ালা কত দাম হাঁকতে পারে শুধু সেই কৌতূহলেই যেন দাম জানতে চায়।

‘তিন টাকা!’

রদ্দিমাল-বিক্রেতা দাম মোটেই খুব বেশি চায়নি, কিন্তু এটা কিনে তার হবেই বা কী? শরিফ হোসেন চলতে শুরু করে।

‘আরে চলে যাচ্ছেন কেন, বাবু? আপনিই বলুন না কত দেবেন।’

শরিফ দাঁড়িয়ে গেল। এটা জানাতে লজ্জা পেল যে তার ওই পাথরের টুকরোটার কোনও প্রয়োজনই নেই। নিছক কৌতূহলের বশেই দাম জিগ্যেস করেছিল। ভাবল দাম এতটাই কম বলা যাক যাতে রদ্দিওয়ালা রাজি না হয়। অন্তত দোকানি এমন তো ভাববে না যে এ একটা নিঃস্ব, কপর্দকশূন্য মানুষ। দোকানদারের সময় নষ্ট করতে আর নিজের লোভ মেটাতে এসেছে।

‘আমি তো এক টাকা দেব।’

শরিফের ইচ্ছে ছিল দ্রুত পা ফেলে রদ্দিওয়ালার নজরের বাইরে সরে পড়বে। কিন্তু দোকানদার সে সময় দিল না।

‘জি, সুনিয়ে তো! কুছ জ়েয়াদা নহিঁ দেঙ্গে? সওয়া রুপিয়া ভি নহিঁ? ঠিক আছে, নিয়ে যান।’

শরিফের নিজের ওপরেই রাগ হল। বারো আনা কেন বললাম না! এখন দোকানে না ফিরে আর উপায় কী? দাম চোকানোর আগে শরিফ মার্বেল পাথরের টুকরোটা আবার হাতে নিয়ে দেখল। এই আশায় যে যদি কোথাও কোনও দাগ পাওয়া যায় তা হলে সওদা বাতিল করা যাবে। কিন্তু প্রস্তরখণ্ডটায় কোনও ত্রুটি পাওয়া গেল না। রদ্দিওয়ালা জলের দরে সেটা কেন বেচে দিল কে জানে!

রাতে বাড়ির ছাদে খোলা আকাশের নিচে বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করতে করতে শরিফ ভাবে এখন এই পাথরটাকে নিয়ে করব কী। আজব জায়গা বটে খোদার এই কারখানা! তিনিই সর্বশক্তিমান, দয়ালুও বটেন। হতেও তো পারে যে তার ভাগ্য খুলে যাবে! সেকেন্ড ডিভিশন ক্লার্ক থেকে সুপারিনটেনডেন্টে পদোন্নতি হবে। মাইনে চল্লিশ থেকে চার শো হয়ে যাবে…….তা যদি নাও হয়, হেড ক্লার্কই সই! তবু তো অন্য কারও সঙ্গে ভাগাভাগি করে একবাড়িতে থাকতে হয় না। একটা ছোটখাটো বাড়িই খুঁজে নেবে আর দরজার বাইরে এই মার্বেল পাথরের টুকরোটাতে নাম খোদাই করে লাগিয়ে দেবে। ভবিষ্যতের এই খেয়ালি তসবির শরিফের মনের আকাশ ছেয়ে দিল। নচেৎ সে তো পাথরটাকে একেবারই অকেজো বলে ধরেছিল। এখন যেন মনে হচ্ছে অনেক দিন ধরেই সে এমন একটা পাথরের টুকরোর খোঁজে ছিল। আর সেটা না কিনলে বড় ভুলই হত।

চাকরি জীবনের গোড়ায় কর্মোদ্যম ছিল। চাকরিতে উন্নতি করার ইচ্ছে তো প্রায় পাগলামির পর্যায়ে পৌঁছেছিল। কিন্তু দুবছর বেকার খাটনির পরে সেই উদ্যম হারিয়ে গেল, মেজাজ শান্ত হয়ে এল। কিন্তু এই পাথরের টুকরোটা আবার তার মনের মধ্যে উথাল-পাথাল শুরু করেছে। ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা প্রত্যাশা রোজ মনে উদয় হয়। উঠতে-বসতে, নিদ্রায়-জাগরণে, দফতরে যাওয়ার সময়, কুঠিবাড়ির বাইরে মালিকদের নেমপ্লেট দেখতে দেখতে। মাসের শেষে মাইনে হাতে আসতেই শরিফ তুরন্ত ছুটল শহরের এক বিখ্যাত খোদাইকারের দোকানে। খোদাইকার সযত্নে পাথরের টুকরোয় শরিফ হোসেনের নাম লিখে চার কোণে ছোট ছোট বেলফুলের নকশা এঁকে দিলে। মার্বেলের ওপরে নিজের নাম খোদাই হয়েছে দেখে শরিফের মনে আনন্দ আর ধরে না। জীবনে সে এই প্রথম দেখল নিজের নামটি উজ্জ্বল হরফে লেখা, যেন জ্বলজ্বল করছে।

পাথর খোদাইকারের দোকান থেকে বেরিয়ে বাজার পর্যন্ত আসতে আসতে কতবার যে মনে হল খবরের কাগজের প্যাকেটটা খুলে নামটা আরেকবার দেখে! কিন্তু প্রতিবারই কী এক অজানা লজ্জার অনুভূতি হাত দুটোকে পাকড়ে ধরে প্যাকেট খুলতে বাধা দেয়। হয়ত পথচারীদের নজরকে ভয়। তারা যদি পাথরের টুকরোয় নাম দেখে শরিফের মনের ভাব আন্দাজ করে নেয়? বেশ কিছুদিন ধরেই তো সে যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছে।

ঘরের সিঁড়ির প্রথম ধাপে এসেই শরিফ কাগজের প্যাকেটটা ছিঁড়ে ফেলল। সিঁড়ি দিয়ে যখন উঠছে তখনও পাথরের ট্যাবলেটের ওপরে নিপুণ হাতে খোদাই করা নামটি থেকে তার দৃষ্টি সরছে না। ওপর তলায় ঘরের দরজায় পৌঁছে পকেট থেকে চাবি বার করে তালা খোলার পর গত দুবছরের মধ্যে এই প্রথম তার মনে হল যে বাড়ির বাইরে এমন কোনও জায়গা নেই যেখানে একটা নেমপ্লেট লাগানো যায়। জায়গা যদি বা মেলে, এই ধরনের নামফলকের পক্ষে তা বেমানান হবে। এসব বড় বাড়ির প্রধান ফটকের বাইরে লাগানো হয়। যাতে আসতে যেতে মানুষের চোখে পড়ে।

তালা খুলে বাড়ির ভেতরে ঢুকে শরিফের চিন্তা হল এখন এই নামফলকটিকে কোথায় রাখি। বাড়ির যে অংশে সে বাস করে, সেখানে দুটি ছোট ঘর। আর আছে স্নানের ঘর, রান্নাঘর। আলমারি ঘরে একটাই, কিন্তু সে আলমারির আবার কোনও দরজা নেই। শেষমেশ সেই দরজাবিহীন আলমারিতেই প্রস্তরখণ্ডটির জায়গা হল।

রোজ শ্রান্তক্লান্ত হয়ে ফিরে শরিফ হোসেনের নজর প্রথমেই পড়ত মার্বেল পাথরের টুকরোটার ওপর। মনের আশায় সে সবুজ বাগানের বাহার দেখত, অফিসের কঠোর পরিশ্রমের ক্লান্তি কিছুটা হলেও দূর হত। দফতরের সহকর্মীদের পরামর্শ আর নির্দেশের জন্য উৎসুক দেখলে নিজের পদোন্নতির কথা ভেবে শরিফের চোখদুটি চকচক করে উঠত। আর কোনও সাথীর প্রোমোশন হবে জানলে তার মনে আকাঙ্ক্ষা আর অভিলাষের ঝড় বইত। কখনও কোনও ঊর্ধ্বতন অফিসারের দয়ালু দৃষ্টি মনে নেশা ধরালে সপ্তাহখানেক সেই নেশার ঘোর থেকে যেত।

বউ-ছেলেমেয়ে না ফেরা পর্যন্ত শরিফ নিজের খেয়ালে মগ্ন রইল। বন্ধুদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ, খেলাধুলো-তামাশায় অংশ নেওয়া বন্ধ হয়ে গেল। রাতে তড়িঘড়ি হোটেলের খানা খেয়ে ঘরে ফিরত। শোওয়ার আগের কয়েক ঘণ্টা অদ্ভুত সব চিন্তা ভিড় করে আসত। কিন্তু পরিবার ফিরে আসতেই অবসর আর শান্তি যেন উবে গেল। গার্হস্থ্য জীবনের দুশ্চিন্তা এমন চেপে বসল যে ভবিষ্যতের সেই সুমধুর ছবিটি ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হয়ে গেল।

পাথরের ফলকটি বছরভর দরজাবিহীন আলমারিতে পড়ে রইল। সেই এক বছরে শরিফের কঠোর পরিশ্রম চলল। অফিসারদের খুশি রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করে গেলেও অবস্থার বিশেষ উন্নতি ঘটল না। ইতিমধ্যে ছেলের বয়স চার, তার হাত এখন খোলা আলমারির তাক পর্যন্ত সহজেই পৌঁছোয়। শরিফের ভয় বেটা পাথরটাকে ফেলে ভেঙে দেবে।আলমারি থেকে সরে পাথরটার জায়গা হল সিন্দুকে – জামাকাপড়ের নিচে।

সারা শীতকাল নামফলকটি সিন্দুকেই পড়ে রইল। গরম পড়ে গেলে শরিফের বউ সিন্দুক থেকে সব ফালতু জিনিস হঠাতে চাইল। এবারে অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে পাথরটার জায়গা হল কাঠের একটা পুরোনো বাক্সে। সেখানে প্রস্তরফলকটির সঙ্গী হল ছবির ভাঙা ফ্রেম, ব্যবহারে জীর্ণ বুরুশ, কাজে লাগে না এমন সাবানদানি, ভাঙা খেলনা আর ওই ধরনের আরও বাতিল জিনিস।

নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে আরও চিন্তাভাবনা শরিফ হোসেনের মনে জড় হতে থাকে। দফতরের ধরনধারণে মনে হচ্ছিল যে ভাগ্য নিতান্ত সুপ্রসন্ন হলেই পদোন্নতি হওয়া সম্ভব। কঠোর মেহনত আর কাজের জন্য জান কবুল করে কোনও লাভ হবে না। মাইনে দুবছর অন্তর তিন টাকা করে বাড়াতে বাচ্চাদের পড়াশুনোর খরচ ইত্যাদি জোগানো সম্ভব হত। অতিশয় দারিদ্রের সামনে পড়তে হত না। বারবার হতাশ হতে হতে চাকরি জীবনের বারোটি বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। প্রোমোশনের সব উচ্চাশা জলাঞ্জলি গিয়েছে। এমনকী প্রস্তরফলকটির স্মৃতিও যেন ম্লান। এমন সময় শরিফ হোসেনের ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিরা তার সততা আর সুদীর্ঘ চাকরি জীবনের কথা মনে রেখে তাকে পুরস্কার দিলেন। তিন মাসের জন্য ছুটিতে যাওয়া এক প্রথম শ্রেণির কেরানির জায়গায় শরিফের সাময়িক নিয়োগ হল।

নতুন পদে যোগ দেওয়ার দিন শরিফের আনন্দ আর ধরে না। টাঙার অপেক্ষা না করে জোরকদমে পা ফেলে চলল। ইচ্ছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিবিকে পদোন্নতির খবরটা দেওয়া। টাঙায় বসলেও এত তাড়াতাড়ি ঘরে পৌঁছোনো যেত কি?

পরের মাসে নিলামঘর থেকে ঘরে এল সস্তার একটা লেখার টেবিল আর রিভলভিং চেয়ার। টেবিলে বসেই মনে পড়ল পাথরটার কথা। পুরোনো মনোবাঞ্ছাগুলোও আবার জেগে উঠল। খুঁজে পেতে কাঠের পেটি থেকে ফলকটি বার করে সাবান দিয়ে ধোওয়া-পোঁছা হল। দেওয়ালে ঠেস দিয়ে সেটা টেবিলের ওপর বসেও গেল।

সে বড় কঠিন সময়। শরিফ ছুটিতে যাওয়া কেরানির দ্বিগুণ পরিশ্রম করছে। অফিসারদের কাছে নিজের যোগ্যতা সে প্রমাণ করবেই। অধস্তনদের খুশি রাখতে তাদের অনেক কাজও করে দিত। ঘরে এসেও মাঝ রাত পর্যন্ত ফাইল থেকে মাথা তোলার অবসর না মিললেও শরিফ হোসেন খুশি ছিল। শুধু কভু-কখনও ছুটিতে থাকা কেরানি ফিরে আসবে বলে মনে হলেই হতাশা ঘিরে ধরত। কখনও এমনও চিন্তা করত যে হতেও তো পারে সেই লোকটা ছুটির মেয়াদ বাড়িয়ে নিল। অসুস্থও হতে পারে। এমনও হওয়া কী অসম্ভব যে সে কখনই আর ফিরে এল না?

কিন্তু তিন মাস পেরোলে সেই কেরানি ছুটির মেয়াদ বাড়ালো না, অসুস্থও হল না। শরিফ হোসেনকেই নিজের পুরোনো চেয়ারে ফিরে আসতে হল। কী বিষণ্ণ আর কষ্টের সে দিনগুলো! একটু খুশির ঝলক দেখার পর পুরোনো জীবন যেন আগের তুলনায়ও দুর্বিষহ লাগে। শরিফের মন কিছুতেই আর কাজে বসতে চায় না। অলস মেজাজ তার, চলাফেরায় শ্লথগতি। প্রতি মুহূর্তে মুখ বেজার। কখনও হেসে কারও সঙ্গে কথা বলে না। খুব বেশিদিন এমন চলল না। অফিসার রুষ্ট হতেই শরিফ আবার যে কে সেই। এখন বড় ছেলেটা ষষ্ঠ, ছোটটা চতুর্থ ক্লাসে পড়ে। মাঝের মেয়েটা মায়ের কাছে পবিত্র কোরান-মজিদ পড়ে, সেলাই-ফোঁড়াই শেখে, ঘরের কাজকর্মে মাকে সাহায্যও করে। আব্বার পড়ার টেবিল আর চেয়ারের দখল নিয়েছে বড় বেটা। সেখানে বসে সে ইশকুলের পড়া করে। টেবিল নড়ে গেলে পাথরের ফলকটি পড়ে যাওয়ার ভয় ছিল। টেবিলের অনেকটা জায়গা ছেলের দখলেও চলে গেছে। শরিফের বেটা প্রস্তরফলকটি সরিয়ে আবার সেই আব্রুহীন আলমারিতেই রেখে দিল।

বছরের পর বছর যায়। এই বছরগুলোতে পাথরটি কতবার যে ঘর বদল করল! কখনও খোলা আলমারিতে, তো কখনওবা কোনও টেবিলের ওপর। এই সিন্দুকের ওপরে, তো পরদিন চারপাইয়ের নিচে। বস্তার ভেতরে অথবা কাঠের বাক্সের মধ্যে। একবার কেউ সেটাকে উঠিয়ে নিয়ে রান্নাঘরের সেই বড় তাকটার ওপরে রেখেছিল যেখানে রোজকার ব্যবহারের বাসনপত্র রাখা হয়।

শরিফ হোসেনের যখন নজর পড়ল তখন ধোঁয়া লেগে লেগে সাদা মার্বেল পাথরটা হলুদ হয়ে গেছে। সে সেটাকে ধুয়ে-পুঁছে আবার সেই দরজা-খোলা আলমারিতে রাখলেও কিছু দিনের মধ্যেই পাথরটা সেখান থেকে আবার গায়েব হয়ে গেল। তার জায়গা নিল বড় ছেলের কোনও বন্ধুর উপহার দেওয়া কাগজের ফুলওয়ালা ফুলদানিটি। হলুদ হয়ে যাওয়া সেই পাথরটি আর কেমন করেই বা খোলা আলমারিতে রাখা যায়? কাগজের ফুলের উজ্জ্বল লাল রঙের শোভায় আলমারিতে যেন প্রাণ ফিরে এল। ছোট ঘরটার রূপই বদলে গেল।

এর মধ্যে শরিফ হোসেনের চাকরির বিশ বছর পূর্ণ হয়েছে। তার মাথার চুল ধবধবে সাদা, একটু কুঁজো হয়ে চলে। এখনও কখনওবা সমৃদ্ধি আর সব দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত এক জীবনের উজ্জ্বল আলোর ঝলকানি দেখা দেয়। কিন্তু পরিস্থিতি আর ঠিক আগের মত নেই। মনে হয় না যে সে এখন তেমন কোনও কাজই আর করতে পারবে। আর তাই কল্পনার জগতটা উবে যায়। বেটির শাদি, বেটাদের তালিম, সংসারের ক্রমবর্ধমান ব্যয় আর পুত্রদের জন্য চাকরির চেষ্টা এই সব মনের মধ্যে ভিড় করে। এসব চিন্তাভাবনা এমন নয় যে এক মুহূর্তের জন্যও মনকে অন্য দিকে চালনা করা যায়।

পঞ্চান্ন বছর বয়সে যখন পেনশন মিলল, তখন শরিফের এক ছেলে রেলের মালগুদামে কাজে ঢুকে গেছে। মেজ ছেলেটাও কোনও অফিসে টাইপিস্টের কাজ জুটিয়ে নিয়েছে। সর্বকনিষ্ঠটি এখন এন্ট্রান্স পড়ছে। নিজের পেনশন আর বেটাদের বেতন মিলিয়ে মাসে প্রায় দেড়শ টাকা আমদানি হয়ে যায়। মোটামুটি ভালোভাবেই জীবন চলে। শরিফের যদিও ইচ্ছে ছিল ছোটখাটো একটা ব্যবসা শুরু করার, কিন্তু মন্দার বাজারে সে ইচ্ছাপূরণের সাহস তার হল না।

নিজের সাবধানি, মিতব্যয়ী জীবন আর বিবির নিখুঁত গৃহিণীপনার কারণে বড় ছেলে আর মেয়েটার বিয়েও বেশ ধুমধাম করে দেওয়া গেল। এই গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্যগুলো মিটিয়ে শরিফের মক্কায় হজে যাওয়ার ইচ্ছে হলেও তীর্থযাত্রা সাধ্যে কুলোল না। কিছুদিন প্রায়ই মসজিদে যাওয়া শুরু করলেও খুব তাড়াতাড়ি বৃদ্ধ বয়সের কমজোরি আর অসুস্থতায় জেরবার শরিফ হোসেনের দিন চারপাইয়ে শুয়েই কাটতে লাগল।

তিন বছর ধরে পেনশন পেয়ে চলেছে শরিফ হোসেন। শীতের এক রাতে কোনও কারণে বিছানা ছেড়ে উঠেছিল। লেপের উষ্ণতা ছেড়ে বেরোতেই শেষ প্রহরের হাড়-কাঁপানো ঠাণ্ডা আর কনকনে বাতাস যেন বুকে তিরের মত বিঁধল। সেই এক চোটেই ধরল নিউমোনিয়া। ছেলেরা সাধ্যমত ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা করল। বিবি-বউমা দিনরাত তার বিছানার পাশ ছেড়ে নড়ল না। কিন্তু রোগের উপশম হল কোথায়? চার দিন বিছানায় পড়ে থেকে শরিফ মারা গেল।

শরিফ হোসেনের ইন্তেকাল হলে তার বড় ছেলে ঘরবাড়ি পরিষ্কার করার ব্যবস্থা করেছিল। পুরোনো আসবাবপত্র দেখতে দেখতে একটা বস্তার মধ্যে থেকে বেরোল সেই পাথরের টুকরোটা। বেটা বাপকে খুবই ভালোবাসত। ফলকের ওপর বাপের নাম লেখা দেখে ছেলের চোখের জল আর বাঁধ মানে না। অনেকক্ষণ আচ্ছন্নের মত নামফলকটির হস্তলিপি আর আঁকা নকশার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎই মনে কী একটা ভাবনা এল। শরিফের বেটার চোখদুটি উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

পরদিন বহুকাল অব্যবহৃত পড়ে থাকা সেই পাথরের টুকরোটা আবারও গেল এক খোদাইকারের দোকানে। খোদাই করা লেখার অল্পবিস্তর পরিবর্তন-পরিমার্জন হল। আর সেই সন্ধ্যায় স্মৃতিফলকটি চিরকালের জন্য বেটার বাপের কবরের ওপর বসে গেল।

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত