| 19 এপ্রিল 2024
Categories
ইরাবতী তৃতীয় বর্ষপূর্তি সংখ্যা

তৃতীয় বর্ষপূর্তি সংখ্যা গল্প: শরীর । সিরাজুল ইসলাম

আনুমানিক পঠনকাল: 13 মিনিট
হাসপাতাল, রোগী পরীক্ষা করার ল্যাব, ডাক্তারের বসার চেম্বার সব সাদা হয়। ডাক্তার ফাহমিদার সাদা রুমটা থম মেরে আছে। যেন কেউ একটা কিছু বলবে। আমি বাইরের জানলার ফ্রেমে বা তলায় উইন্ডোজ এয়ারকন্ডিশনার খুঁজছিলাম। হয়তো ওখান থেকে কুলকুল করে ঘরে শীতল বাতাস ঢোকার আওয়াজ আসবে। কিন্তু না এখন আর আলাদা এসি ইউনিট লাগানোর প্রচলন নেই, কেন্দ্রীয় ভাবে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত। আমি একটা বিষয় জানি না ,সব ক্লিনিক ও হাসপাতালে সেন্ট্রাল এসির তাপমাত্রা এত কমিয়ে রাখে কেন? অসুস্থ মানুষের শরীরে একটু বেশি ঠান্ডা লাগার কথা। আমার ঠান্ডা লাগছে।
‘আমার অসুখটা ভালো মনে হচ্ছে না’- ডাক্তার ফাহমিদা এ রায়টা কাকে শোনালেন, আমাকে না অনি’কে? আমি বোঝার জন্য ডাক্তারের মুখের দিকে তাকালাম। অনির মুখের দিকেও।
‘কয়েকবার সময় নিয়ে অনেকগুলো টেস্ট, পরীক্ষা করলাম। অসুখটা ভালো মনে হচ্ছে না।’
আমার শরীর বলছিল, আমাকেই বলা, আমাকে জানানো।
পাশাপাশি চেয়ারে অনির বাম পাশে আমি বসা। অনি ওর বাম হাত দিয়ে আমার ডান হাতের কব্জি ধরল।
অনি তো জানে না, মাঝে মাঝে বাম হাত দিয়ে এভাবে আমি নিজেই নিজের ডান হাতের কব্জি ধরে বুঝতে চাই কতদূর শুকালাম, কতটুকু ক্ষয় হলাম।
অনি হাত দিয়ে আমার হাতে চাপ দিতে থাকে হয়তো এটা জানাতে যে, সে পাশে আছে।
আমি একটু হাসার চেষ্টা করলাম ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়ে।
‘আমার কতদিন সময়’?
ডাক্তারের সঙ্গে রোগী মনে হয় একটা টোকেন নাম্বার মাত্র, ৫৩ বা ২২। ডাক্তার ফাহমিদা একবার বসায় বা একবেলায় ক’জন রোগী দেখেন তা জানি না। আমি টোকেন নাম্বার ১৪. আমি বেরিয়ে ১৫ ঢোকার আগেই আমি ডাক্তার ফাহমিদার মাথা থেকে হারিয়ে যাব।তবে আমি মাঝে মাঝে ভাবি,ডাক্তার যে তার সামনে একজন নিয়ে বসে বা দাঁড়িয়ে যার শরীর দুর্ঘটনায় দলেমুচরে গেছে বা রোগের কামড়ে ভেতরটা ধ্বসে গেছে বা বয়স প্রাণের সব রস শুষে নিয়েছে, এখন শুধু পোশাক পালটানো; এদের সঙ্গে থেকে এদের কথা শুনে প্রকৃতই সুস্থ করার চেষ্টা করে হয়তো। যতই সাদা গ্লাভসে ঢাকা থাক দুই হাত বা মাক্স মুখে, চেহারা ভালো বোঝার উপায় নেই, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে আসা চিকিৎসা বিদ্যার অতিরিক্ত একটা কিছু তো আদান-প্রদান হয় ডাক্তার- রোগীতে। রোগীর আর কী থাকে- ডাক্তার, রোগীর কাছেও রোগীর শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছেও। জীবন মৃত্যুর মাঝখানে যে ইমিগ্রেশন এলাকা, তার একটা খোপের মধ্যে ডাক্তার ইমিগ্রেশন অফিসার সেজে বসে, কাগজপত্র ডকুমেন্টেশন পরীক্ষা চলছে; তবে এখানে উপসংহার উল্টো,পাওয়াটা হয় অফিসার যদি ফিরিয়ে দেয়, না তোমার নতুন দেশটায় ঢুকতে হবে না এখন, তোমার আরো কিছু সময় আছে হাতে ।
‘আমার কতটা সময়?’ ডাক্তারকে বললাম, ‘তিন মাস?’
কন্ঠ অনেক নিচু করে প্রায় যেন ফিসফিস করে বলল ডাক্তার, ‘অত নির্দিষ্ট করে বলছেন কেন? ওভাবে কি বলা যায়? আর আপনার হাসবেন্ড তো বসে থাকবেন না, আমরাও না‌। এখন চিকিৎসা কত এগিয়েছে, কত রকম পদ্ধতি। আপনার হাজব্যান্ড আমরা কথা বলে ঠিক করে নেব কোন প্রসিডিউর ফলো করবো।’
‘আপনাদের আলাপে আমি থাকবো না?’
‘থাকবেন।এসব রোগের ব্যয়বহুল চিকিৎসা। টাকার ব্যাপারটা আসে। কত এমাউন্ট পর্যন্ত আপনারা খরচ করবেন। এগুলো এখন থাক। পরে না হয় এগুলো নিয়ে কথা বলি।’
বুঝি যে ডাক্তার আমাকে সময় দিতে চাইছে। আমি কিছুদিনের মধ্যেই থাকবো না এই বাস্তবতাটা আমার উপলব্ধিতে ঢুকিয়ে দিতে চাইছে।
আমি নিজে কি জানতাম না আমার শরীরের ভেতর একটা ভাঙচুর হচ্ছে, পিঠে বুকে অসহ্য ব্যথা, ঘুম কমে যাওয়া, ক্ষুধা কমে যাওয়া, ওজন কমা। আমি অনিকে বলেছি, কতটা গুরুত্ব দিয়েছে সে-ই জানে। কিছু গুরুত্ব তো দিয়েছেই, না হলে কয়েক মাস ধরে তিনটা ক্লিনিক ও হাসপাতালে ঘোরাঘুরি করলাম কী ভাবে?অনির সময় গেছে, টাকা গেছে। সত্যি বলতে অনির আর আমার দুজনের তেমনভাবে নিজেরা নিজেরা বেড়ানো হয়নি। ক্লিনিক-হাসপাতালে আগ্রহ নিয়ে যাওয়া এটাই ছিল যেন আমাদের বেড়ানো। তবে অনি অফিসের জরুরী কাজ ফেলে এসেছে, ফোনে কথা বলছে, ফোনে একটা কিছু খবর পেয়ে নতুন দুর্ভাবনায় পড়ে যাচ্ছে। আমি অনিকে বুঝি, অনির কথা, শরীরের নড়াচড়া, মুখের এক্সপ্রেশন; হয়তো অনির তুলনায় অনিকে আমি বেশি দেখতে পাই।
অনি নিজেই গাড়ি চালায়। আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে অনি পার্কিং খুঁজে গাড়ি রেখে আসে। যে সময়টাই যেতাম, হাসপাতাল ক্লিনিক রিসেপশন অপেক্ষার জায়গাগুলো দেখতাম ভীড়। লোকজনে ভরে থাকত। ডাক্তার নার্স রোগীর আত্মীয়- স্বজন, ছোট বাচ্চাদের কথার আওয়াজ- কিন্তু ওগুলোতে আমার কোন খেয়াল থাকতো না। আমি ভয়ে কুকড়ে থাকতাম। ডাক্তারের কাছে যেতে আমার ভয় লাগে। ডাক্তার আমার সাথে কথা বলে, আমাকে টিপে টুপে দেখে এমন একটা রোগের কথা বলবে সেটা শুনেই আমি মরে যাব। মানুষ যা ভাবে সব সময় তা কেন সত্যি হবে?
আমিও সত্যিটা চাই না। এখন যে ঘন ঘন ডাক্তারের কাছে যাই ভয় নিয়ে না। এই যে আমাকে অপেক্ষায় দাঁড় করিয়ে অনি আসে গাড়ি পার্কিংয়ে রেখে সে যেন অনি না রূপকথার রাজপুত্র, মনে হয় আমরা এক মহাবনের ভেতর ঢুকে যাব, সে আর আমি ছোটাছুটি করে পাতায় পাতায় ফুলে ফুলে খুঁ‘জবো, একটা মৃত্যু সঞ্জীবনী পেয়ে যাব। অনিই পাবে একটা পাতা বা ফুলের পাপড়ি। সেটা চমৎকার একটি পানির জারে ডুবিয়ে রাখতে হবে। আমি সকালে বিশুদ্ধ মনে জার থেকে পানি আমার ‘ওয়ার্ল্ড’স বেস্ট মাম্মি’ লেখা মগে ঢেলে ঢেলে খাব।
ডাক্তার ফাহমিদার চেম্বার থেকে যখন ফিরছিলাম অনি আমাকে ওয়েটিংয়ের জায়গাটার দাঁড় করিয়ে রেখে গাড়ি আনতে যাবে,আজ অনির মধ্যে হতাশা ও ক্লান্তি টের পেলাম ,সঞ্জীবনী পাতা বা ফুলের পাপড়িটা আর বোধহয় পাওয়া যাবে না।
আমি প্রথম চশমা নিলাম কবে? কলেজ শেষ করে যখন ইউনিভার্সিটিতে ঢুকলাম? ইউনিভার্সিটি এডমিশনে কি স্বাস্থ্য পরীক্ষার দরকার পড়েছিল, তখন দেখলাম দেয়ালে লাগানো চোখের দৃষ্টি পরীক্ষার চার্টের লেখার তিন লাইন নিচে আর পড়তে পারছি না? নিউমার্কেট গিয়ে আবার চোখ পরীক্ষা করালাম। চশমা নিলাম। নতুন চশমা চোখে দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি সব উঁচু-নিচু লাগে। সাবধানে পা ফেলি।পায়ে একটু হিলওয়ালা স্যান্ডেল। উল্টে পড়ে যাব না তো! কী বিপদ ডেকে আনলাম চশমার কাছে ধরা দিয়ে! কিন্তু যখন আবার মুখ তুলে সামনে, উপরে তাকিয়ে, গাছের দিকে তাকিয়ে, আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সব কী সতেজ সবুজ, আকাশ কী নীল, এরকম গাছ,আকাশ কি আমি কখনো দেখেছি ?মানুষের মুখ দেখতে এতো ভালো লাগছে ।অন্য মানুষের মুখ দেখতে এত প্রশান্তি লাগে! সবাইকে আপনজন মনে হয়। চশমার বদৌলতে একটা আশ্চর্য দুনিয়া খুলে গেল আমার সামনে। কিন্তু আবার কয়েক সপ্তাহ কেটে যেতে চশমার পাওয়ারে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। আবার সবকিছু কেমন সাধারন, ধূলিমাখা, ম্লান, নিষ্প্রভ হয়ে গেল। আমি তখন ছয় মাস, এক বছরে আমার চোখ দেখাই, চোখের গ্লাস বদলাই। বাইরের বদলটা নিজের মনে ঢুকানোর চেষ্টা করি। এত কম সময়ের ব্যবধানে চোখের পাওয়ার খুব যে বদলায় তা না, তবু তার ভেতরে আমার সামনে নতুন একটা পৃথিবী ঝলসে ওঠে। বিয়ের দুবছর পার হতে হঠাৎ অনি আমাকে বলে, ‘চশমায় তোমাকে বুড়ি বুড়ি লাগে’। অনির পেশায় তখন উন্নতি হচ্ছে, নিজের একটা ফ্ল্যাট কেনার চেষ্টা করছে, ভালো জায়গায় ভালো ফ্ল্যাট খুঁজছে। তার স্ট্যাটাস পাল্টাচ্ছে, বুঝলাম এই স্ট্যাটাসের সাথে মিলিয়ে পাশে সুন্দর তেজালো চেহারার কমবয়সী দেখায় এরকম একটা বউ চায়। নিজেকে সুন্দর দেখায় এটা কোন মেয়ে না চায়। সিঙ্গাপুরে গেলাম বেড়াতে, দশ দিনের ট্রিপ। আসলে অনি খোঁজ খবর নিয়ে অ্যাপোয়েন্টমেন্ট করিয়ে রেখেছিল, সেখানে আমার দুই চোখে ল্যাসিক সার্জারি করে স্থায়ী লেন্স পরিয়ে দিল। আমার চশমার বিদায়। আমার সুন্দর চোখ দুটো ঢেকে আর চশমা পরতে হয় না বছর বছর চশমার গ্লাস বদলাতে হয় না। নতুন দৃষ্টির বদৌলতে চোখের সামনে সিল্যুয়েট বদলে যাওয়ার খেলাটা বন্ধ হয়ে গেল।
কিন্তু আমি এখন ডাক্তার ফাহমিদার কাছ থেকে ফিরছি, সে চোখের ডাক্তার না, বা চশমার দোকান থেকে নতুন চশমা নিয়ে আসিনি বা নতুন করে ল্যাসিক সার্জারিও করাইনি, কিন্তু অনি গাড়ি চালাচ্ছে তার পাশে একইভাবে আমি সামনে তাকিয়ে, আমার সবকিছু এত সুন্দর লাগছে, সুন্দর তাই অচেনাও লাগছে অনেকটা। আমরা কোন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি চিনতে পারছি না। যেন মনে হচ্ছে এ জায়গায় কখনো আসিনি।
অন্য সময় গাড়ি জ্যামে অস্থির হয়ে থাকি। আজ কিন্তু মনে হচ্ছে যারা রাস্তায় নেমেছে নিজের গাড়িতে বসা, বাসে, সিএনজিতে বা হেঁটে- সবার নিশ্চয়ই জরুরি অনেক কাজের তাড়া আছে। ইচ্ছে হচ্ছে ওদের সাহায্য করি, খাতায় অনেকগুলো সরলরেখা আঁকার মত আংগুল টেনে টেনে অনেক রাস্তা বানিয়ে দেই, অনেক নতুন বাস, ট্রেন, আরো যা যা আধুনিক যানবাহন হয় সব রাস্তায় নামিয়ে দেই। মানুষের কষ্ট কমানোর জন্য একটু কাজ করি। ইচ্ছে হচ্ছে হাঁ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি- এতো সুন্দর আকাশ, শুভ্র হালকা মেঘ উড়ে বেড়ায়। যার মুখটাই চোখে পড়ে তাকিয়ে থাকি, এত আপন মনে হয় সবাইকে খুব ভালবাসতে ইচ্ছে হচ্ছে।
মনে হয় যে আর কয়েকটা দিন, এরা সবাই থাকবে, আমি থাকবো না। এটা আবার কিভাবে হয়?
হয়। উনিশ বছর আগে আমার ছেলে জন্মেছে তার আগে তো সে ছিল না। পঁয়তাল্লিশ বছর আগে আমিও ছিলাম না।
আমার মনে হয় যে এই থাকা-না-থাকার বিভ্রমটা আমি বুঝবো না।
অনি বলল, ‘চুপ করে আছো, ডাক্তারের কথা এত সিরিয়াসলি নিও না।’
অনি ভুলে গেছে সেও চুপ করেছিল। একমনে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিল, টু শব্দটাও করেনি, হয়তো কথার খেলা খেলছিল, কথা বানাচ্ছিল, এখন হয়তো মনে হয়েছে, কিছু কথা বানানো গেছে।
‘বললাম যে ডাক্তারের কথা এত সিরিয়াসলি নিও না। এখন সব ডাক্তার, হাসপাতাল রক্তচোষার মত কামড়ে ধরে টাকা বের করে নেয়, টাকা শুধু টাকা। রোগ ডায়াগনোসিস করার আগে খোঁজ নেয় রোগীর সাথে কে? তার কত টাকা, কত টাকা বের করতে পারবে? সে হিসেবে রোগীকে নিয়ে ভয় দেখানোর খেলা শুরু করে।’
বুঝতে পারছি অনি একটু বেশি কথা বলছে, বকবক করা ওর স্বভাব না।
অনি বলল, ‘আজই অফিসে আমি তিন মাসের ছুটি নেব, তোমার সাথে থাকবো পুরোটা সময়।
‘তুমি না বলছিলে দুই সপ্তাহ আগেই, তোমার নতুন একটা কন্ট্রাক্ট পেলে, তোমার ব্যস্ততা বেড়ে যাবে, বললে, আমাকে কিছুদিন বেশি সময় দিতে পারবে না।’
‘ছুটি না দিলে চাকরিটা ছেড়ে দেবো।’
‘প্রাইভেট কোম্পানির চাকরি, ছেড়ে দিলে নতুন কোথাও ওরকম একটা জায়গা আর পাবে।’
কিছুটা গলা তুলেই বলল অনি, ‘আমি ছেড়ে দেবো চাকরি,ব্যাস।’
অনিকে গাড়ির ব্রেক চাপতে হলো জোরে, জেব্রাক্রসিং পারাপার করা লোকের ওপর উঠে পড়েছিল প্রায়।
আমি অনির এই অভ্যাসটার কথা জানি। যে কাজটা তাঁর পছন্দ না তা করতে হলে বা করতে বাধ্য করা হলে সে এরকম হঠাৎ রেগে যায়।
আমার ছেলে ও মেয়ের ঘর পাশাপাশি। ওরা দুজন যখন ছোট ছিল তখন থেকেই ওদের সবসময়ের জন্য নিজস্ব আলাদা ঘরের ব্যবস্থা করা থেকে আমি নড়তাম না। অনি বরং বলতো, যত বড়ই অ্যাপার্টমেন্ট কেনো সবার জন্য আলাদা আলাদা ঘরের ব্যবস্থা তো করতে পারবে না। কই আমাকে তো আমার কোন ঘর করে দাওনি তোমার অ্যাপার্টমেন্টের ভেতর।
আমি বলি, তুমি তো সারাদিন বাইরে বাইরে থাকো তোমার কাজে, তোমার অফিসে, তুমি আর তোমার মন, যখন এ-বাড়িতে থাকো তখনো। তোমার আর আলাদা জায়গার দরকার কেন? আসল কথাটা ওকে বলা যায়নি, ও যখন বাড়িতে থাকে বা বাসায় এসে ঢোকে তখন আমি চাই যে সে পুরোটাই আমার থাকুক, আমার কাছেই থাকুক। একটু চোখের আড়াল হলেই মনে হয় ওকে একটু কম পেলাম। অনি বাড়ির ভেতরেও যদি একটা আলাদা ঘরে পায় তাহলে এখানেও মিনি একটা অফিস বানিয়ে নেবে।
নাফিসের ঘরে ঢুকলাম। ছেলে তো এখানে না ইউনিভার্সিটির হোস্টেলে। ক্লাস, ল্যাব, লাইব্রেরী- বাড়ি থেকে গিয়ে হয় না। সময় রাখা যায় না। যাতায়াতে অহেতুক সময় নষ্ট। নাফিস বলে, ‘অনেক কাজ করতে হয় মা। আমাকে দেখতে হলে ভিডিও কল করবে।’
‘ধরিস না তো ফোন।’
‘মা এমন সময় তুমি ফোন করো।’
আমি হাসি।’পাশে মেয়ে বন্ধুরা থাকে বুঝি?’
লজ্জা পায় নাফিস।’এরকম কিছু হলে তোমাকে সব বলবো মা।’
আমার ছেলেটা একটু বোকা বেশি লাজুক,তবে আমার কাছেই। ওর বন্ধুরা,ওর টিচারেরা খুব প্রশংসা করে ওর। আমি ছেলেকে বেশি ভালোবাসি নিন্নির তুলনায়। নাফিসের ঘরটা ঘুরে ঘুরে দেখি, বিছানায় বসি,কী সুন্দর করে সে ঘর গুছিয়ে রাখে। আমার খুব ভালো লাগে যখন কেউ বলে আমার ছেলেটা আমার মত হয়েছে ,দেখতে, স্বভাব-চরিত্রে। আসলেই তাই। আমার মেয়েটা উল্টো। এত ছটফটে। রাগী। কোন কিছুতে তার মন পাওয়া যায় না। কনফিউজড।’এখন কী খাবি, কোনটা খাবি?’ বলতে পারে না। একটা কিছু বের করে দেই। সেটা খাবে না। রাগ দেখায়। ঘর ঠিকঠাক রাখতে পারে না। কাজের মেয়েরা ঘর গুছিয়ে দেয়, আমি দেই। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে দেখি, আবার যেটা সেটাই। বিছানার চাদর মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
আমার মেয়েটা দেখতেও ভাল হয়নি। মেয়েটা শুনলে কষ্ট পাবে। তাও কথাটা আমার কাছের দুয়েকজনের কাছে বলে ফেলেছি, জয়ের কাছেও।
নাফিসকে কি ফোন করব, ওকে জানাব, ডাক্তার যে বলল আমার খারাপ কিছু হয়েছে? হয়তো আমার সময় তিন মাস। অনি যেমন অফিস বাদ দিয়ে আমার সাথে থাকতে চাইছে, সেও তিন মাস থাকুক আমার কাছাকাছি। যাতায়াতে কষ্ট হলে হোক, পড়ার ক্ষতি হলে হোক। মা-ই তো থাকবে না। তখন কষ্ট হবে বেশি। ভালই হলো ছেলেটা একা একা থাকতে শিখে গেছে। মেয়েটার অসুবিধা হবে না। সে বরং আমি কাছে থাকলে বিরক্ত হয়। আমি আমার সব ইচ্ছা, পছন্দ-অপছন্দ নাকি ওর উপর চাপিয়ে দিতে চাই।ওর কোন কিছুই আমি পছন্দ করি না।
নিন্নি তো দেখবে, নিজেই বুঝে নেবে ওর মায়ের একটা কিছু হয়েছে। বাড়িতে ওষুধপত্র। হয়তো হাসপাতালে গিয়েও থাকতে হবে মাঝে মাঝে। তিনমাস সময় আমি বুঝবোও না। হঠাৎ করেই শেষ হয়ে যাবে সময়। আমি এখনই কি বুঝতে পারছি টিক টিক করে আমার শেষ সময় গোণা শুরু হয়ে গেছে?
আমি এত আমার মাথার চুল, স্কিনের যত্ন নিই। নিন্নি বাঁকা চোখে তাকায়, সে কি ভাবে তার সাথে আমি প্রতিযোগিতায় নেমেছি ?
শাওয়ার জেল, শ্যাম্পু, কন্ডিশনার, ফেসওয়াশ, নতুন সময়ের আরো কত কীতে নিন্নি তার ওয়াশরুম, মেকআপ রুম ভরে রেখেছে। কতোগুলো যেভাবে কিনেছিল প্যাকেটের ভেতর সেভাবে থেকে যায় নষ্ট হয়ে যায়। ফেলে দেয়।
আমার এতো যত্নের চুল স্কিন থাকবে না। চুল ঝরবে, স্কিন নীল, শুষ্ক,খরখরে হয়ে আসবে। আমাকে রাখা যাবে না জেনেও কত ওষুধপত্রের ভেতর দিয়ে আমাকে নিয়ে যাবে। অনির ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স নামবে। এই খরচে সে আপত্তি করবে না, তার মনে হবে বউয়ের জন্য সে একটা কিছু করছে।
গুগল ঘাটাঘাটি করলে হয়তো পেয়ে যাব আমার নির্দিষ্ট এই অসুখের শেষ পর্যায়ে কী হয়! হয়তো কারো কারো প্রত্যক্ষ স্টেটমেন্টও পাওয়া যাবে। নিজের লেখা। কীভাবে একেকটা দিন গেছে। শেষ দিনগুলি কাছে আসছে নতুন কী কী’র সামনাসামনি হতে হয়েছে। হয়তো এসব দেখে মনে হবে আমি একা না। অনেককে এসবের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। একটা গ্রুপ দেখলাম। আমি চাইলে হয়তো আমার নিজের কথাও লিখে যেতে পারি সামনে যারা আসছে তাদের জন্য। আমার কাছে সব এত স্বাভাবিক মনে হচ্ছে কেন?
নিজের মৃত্যু নিয়ে কি কখনো ভাবিনি? মৃত্যুভাবনা মানুষের থাকেই। আমি ভেবেছি, আমি রাতের মেকআপ রাতের কাপড় পরে বিছানায় শুয়ে থাকব তরতাজা তারপর একসময় বুঝতে পারব বা পারবো না যে আমি নেই, মরে গেছি। কিন্তু আমার মৃত্যু এত রোমান্টিক এক মুহূর্তের ঘটনা হবে না, তিল তিল করে আমার শরীর জীর্ণ হতে থাকবে, শিকড় ছিঁড়ে শরীরের উঠে আসা মোটেও আরামের হবে না। অনেক ব্যথা, যন্ত্রণা, অনেক ব্যাথানাশক ঔষধের প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। সবাই চাই যে কম কষ্টে মৃত্যু হোক, আবার মৃত্যু ঠেকাতে যুদ্ধে নামি। এখন মৃত্যু কোন পথ বাছবে?
অনি আজ কথা বলছে কম। ডিনারের সময় তেমন খেলো না। রাতের খাবারটা বাসায় সে আগ্রহ করে খায়। এখন ওর দেশি খাবারের উপর আগ্রহ বাড়ছে- ভর্তা ,ভাজি,ছোট মাছ‌।
অফিস থেকে অনি হঠাৎ ফোন করে বলে, আজ তোমাকে আমি নেব।
আমি তখন কোন কাজে থাকি, কোন ব্যস্ততায়, তাও ওর গলার লাজুক, নিরীহ, বোকা বোকা স্বরে বুঝতে পারি, বলি, ‘নিয়ো’।
ভিডিও কলে না তাও আমার সম্মতিতে ওর খুব খুশি ভরা মুখটা দেখতে পাই।
অনি বলে, ‘থ্যাঙ্কিউ’।
এমন হয় অফিসে বেরোবে, পর্দার আড়ালে দরজার সামনে আমাকে একটু আদর করছে, গলা নামিয়ে বলে, ‘আজ তোমাকে নেব।’
আমি বলেছি ,’আচ্ছা’।
আজ অনির ওরকম কোন সুযোগ হয়নি, অফিসে যাওয়ার সময়, ফোনে বা সামনাসামনি আমার রক্তে ঝনঝনানি তোলার , ‘আজ তোমাকে নেব’, কথাটা বলার। তাও আমি যখন বিছানায় উঠবার জন্য তৈরি হচ্ছি, মুখ পরিষ্কার করছি, রাতের পরার নাইটির রং বাছছি বা ঘরে কোন বাতিটি জ্বালিয়ে রাখবো ভাবছি তখন আমি অনেকক্ষণ ধরে মনে মনে বলেছি, আজ তোমাকে দেব অনি আমার শরীর।
আমি অনির গা ঘেঁষে শুই, ওর হাত নিয়ে খেলি ,ওর হাতটা আমার বুকে রাখি। অনি পুরো স্টিফ হয়ে আছে। শরীরের এই খেলাটায় অনি কত খুশি হয়। আজ সে চাইছে না। আমি চাইছি। আমার শরীর যেন আমার শরীর থেকে বেরিয়ে আসছে। অগ্ন্যুৎপাতের মত উত্তাপে আমি পুড়ছি। স্তন আমার অসুখের উৎস। অনি এখন সেখানে হাত রাখবে না। আমি অনির মুখ টানি,ওর ঠোঁট গুজে দিই। আমার তীব্র ব্যথার জায়গাটায় ওর ঠোঁট ছোঁয়াই।
অনি একবার বললো, থাক না।
আমার চোখে কামনা দেখল। আমার শরীর এখনো বেঁচে আছে।
সেও মেতে উঠলো।
পরিতৃপ্তির ঘুম ঘুমোচ্ছে অনি।
বেডরুমের একপাশে দেয়ালজুড়ে যে পর্দা তা সরিয়ে দিয়েছি ।আমার সব সময় মাটির লেভেল থেকে অনেক উপরে থাকতে ভালো লাগে। আমাদের এই অ্যাপার্টমেন্টটা নয় তলায়। ঢাকা শহর তো কখনো ঘুমায় না। অন্ধকার হয় না।কতো দিক থেকে আলো এসে পড়ে, বিজ্ঞাপনের নিয়ন আলো,হাইরাজবিল্ডিংয়ের কাঁচে ঘেরা অফিস সারারাত ধরে উন্নয়নের বাতি জ্বেলে রাখে, হাউজিং কমপ্লেক্সের খোপ খোপ জানালায় আলো জ্বলে,নেভে,স্ট্রীট লাইট,সাঁ সাঁ করে হেডলাইট জ্বেলে ছুটছে কার,বাস,ট্রাক।সব আলো উপরের দিকে একটা ফোয়ারার মতো উঠে আসে।
আমিও একটা আলোর ফোয়ারা?কার কার আলো মিশ্রনে আমি?
আমি যে চলে যাচ্ছি,সেটার খবর এভাবে ছড়াবে, অনির স্ত্রী মারা গেল। আমি পত্রিকার খবর হবার মত কেউ হলে আরো লেখা থাকত দুই সন্তান রেখে গেছে।
আচ্ছা জয়ের সাথে আমার একটা সম্পর্ক ছিল সে কথা কোথাও লেখা থাকবে না।
জয় একদিন করল কী, তখনতো আমি বাবা মায়ের সাথে থাকি নিকেতনে, ছাত্রী জীবন শেষ ,হলে থাকার জীবন শেষ। চাকরি খুঁজছি। আসলে বাবা মা আমার বিয়ে হওয়ার অপেক্ষা করছে। অনেক ভোরে নিচের গেটে হইচই। গেটে ধাক্কাধাক্কি। অ্যাপয়েন্টমেন্টগুলোর সিকিউরিটি গার্ড রাখাই হয় রাতে তারা যাতে নিরুপদ্রবে ঘুমাতে পারে। সেই গার্ডের ঘুম কি সহজে ভাঙ্গে? অসাধ্য কাজটি হয়। ইন্টারকমে রিং বাজে। বাবা অনেক ভোরে ওঠে। ফজরের নামাজ পড়ে একেবারে আযান দেওয়ার সাথে সাথে। তারপর ঘুম হলো তো হল না হলে নাই। সেদিন পার্কে হাঁটাহাঁটিটা বেশি সময় ধরে করে। বাবা আমাকে ডেকে তুললো, ‘জয় এসেছে।এত ভোরে কেন? দেখো কোন খারাপ খবর নিয়ে এসেছে?’
খারাপ খবরই।জয় বলল, ’স্বপ্নে দেখলাম তুই মরে গেছিস। আমার এত কষ্ট হচ্ছিল। হাউমাউ করে অনেকক্ষন কাঁদলাম। তাও আমার ঘোর কাটছিল না ।আমি স্বপ্নটা থেকে বের হতে পারছিলাম না। আমার মনে হচ্ছিল তোর কাছে আমার এখন থাকা দরকার। রাস্তায় বেরিয়ে বাস, সিএনজি, রিকশা কিছু পাই না। অনেকটা হেঁটে , রিকশা পেলে যেখান পর্যন্ত যেতে রাজি হয়। ’
আমি অবাক হয়ে জয়কে দেখছিলাম, সে আমাকে দেখার জন্য নানা রকম ছুতা করে, কিন্তু এখন মনে হলো এবারটা সেরকম কিছু না।
বাবা আমার আর জয়ের সম্পর্কের কথাটা জানে। বাবা আবার এরকম রুচির মানুষ না যে মেয়ে ও তার বন্ধুর আলাপ লুকিয়ে শুনবে। মা হলে অবশ্য ভাবা যেত।
আমি বললাম,’আমাকে ছুঁবি তো,ছোঁ। দেখ আমি বেঁচে আছি। আমি হাত বাড়িয়ে দেই জয়ের দিকে। সে আমাকে ধরে না।
একটা কোনো সহপাঠী-সহপাঠিনীর মধ্যে ছাত্র জীবনে প্রেম-ভালোবাসা হবে না এটা অস্বাভাবিক ঘটনা। জয় আর আমি সেই জোড়া। দেখতে-শুনতে আমি মন্দ না, তাই জানি একের পর একেকজন তাদের প্রেমের ডালি নিয়ে আমার কাছে আসবে, বিরক্ত করে মারবে, জান খারাপ করে দেবে। তাই আমি ইউনিভার্সিটির ক্লাস শুরু হওয়ার পরপরই জুটি বেঁধেই ফেলি জয়ের সাথে। একসাথে ঘুরি, সবার চোখে পড়ে এরকম জায়গায় গা ঘেষাঘেষি করে বসে থাকি। প্রথম থেকেই আমি তুই বলি জয়কে জয়ও আমাকে। ঈদ- পার্বনে, জন্মদিনের অনুষ্ঠানে জয়কে বাসায় নিয়ে যাই।মুশকিল হচ্ছে জয়ের সাথে আমার অমিলটা বেশি।সে রাজনীতি করা লোক, কবিতা লেখা লোক ,অন্য মানুষের কথা ভাবে, আমি শুধু নিজের কথা ভাবি। মন দিয়ে আমার ক্লাস করি, লাইব্রেরী করি, টিচারের সব কাজ সময়মতো জমা দেই। জয়ের পার্টি অফিস থাকে, লেখকদের সাথে আড্ডা, মারামারি গন্ডগোলেও থাকে। জয়ের এরকমই হওয়ার কথা। আমারও।
আমার ইউনিভার্সিটির জীবন শেষ হয়ে আসে। জয়ের না। সে ইউনিভার্সিটির এই ক্যাম্পাসের জগতটা ছেড়ে বেরোতে চায় না। বলে যে এখান থেকে আমি আমার কাজটা বেশি ভালোভাবে করতে পারব।
আমি আমার ইউনিভার্সিটির জীবন গুছিয়ে ফেলেছি। যা হয় বাড়িতে বিয়ে করার চাপ। কত যে প্রস্তাব, বাবা-মা আত্মীয়-স্বজনের ভাব-ভঙ্গিতে মনে হয় আজ বাদে কাল আমার বিয়ে, ওদের সব প্রস্তুতি শেষ। বিয়ে ব্যাপারটা ওদের। আমি এখানে নিমিত্ত মাত্র।
আমি জয়কে বলি, ‘এই আমি তো আর বেশিদিন ক্যাম্পাসে আসবো না, তোর সাথে আমার দেখা হবে না ।তুই আবার আমাকে বিয়েটিয়ে করার কথা ভাবিস না তো!’
জয় কিছু না ভেবেই বলে, ‘ভাবি’।
জয়কে বিয়ে না করার আমার হাজারো পয়েন্ট তৈরি করা ছিল। আমি কয়েকটা কয়েকদিন ধরে ওকে বোঝানোর চেষ্টা করি। সহপাঠি ও সহপাঠিনীর মধ্যে বিয়ে হওয়া ভালো না। বলে যে এক ঘর মে দো পীর চলে না। সম মেধার, একই ব্যাকগ্রাউন্ডের দুই মানুষ এক সংসারে থাকতে পারে না। নিয়ম হলো, স্ত্রী সবদিক দিয়ে ছোট হবে- বয়সে, শিক্ষায়,আরো যা যা হয়। এগুলো, এসব নিয়ম একদিনে তৈরি হয়নি। যুগ যুগের অভিজ্ঞতা থেকে শিখেছে। যেমন মেয়েরা তাড়াতাড়ি বুড়ি হয়ে যায়। স্বামীর আগে সে বুড়ি হয়ে যাবে, সেক্স আর্জ চলে যাবে। বউ আগে মারা গেলে বৃদ্ধ স্বামীর দেখাশোনার লোক থাকবে না। তাই বয়সের হিসাবে স্বামী আগে মারা যাবে তারপর স্ত্রী। স্বামীর জ্ঞানবুদ্ধি বেশি তাই সংসারের নিয়ম কানুন সে ঠিক করবে , স্ত্রী আইন, হুকুমগুলি মেনে চলবে।
আমি জয়কে বলি, ‘এসব কথা হাস্যকর শোনালেও কথাগুলো সত্যি, আমিও বিশ্বাস করি।
জয় বলল,’আমি বুঝেছি তুই বিয়ে করার জন্য পাগলা হয়ে গেছিস, কিন্তু আমি তো এখন বিয়ে করতে পারবো নারে।’
‘আমি জানি তাই তো বললাম।’
আমার বিয়ে হয় অনির সাথে। দুজনে ঘর সংসার সাজাই।
কিন্তু জয়কে দেখে মনে হয়, আমার বিয়ের ঘটনাটা তার মাথায় ঢোকেনি। সে আমাকে আগের মতোই মনে করে। হুটহাট করে বাড়ি চলে আসে, আমাকে এখানে ওখানে নিয়ে যেতে চায়। অনি একই পরিবেশের বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে আসা পুরুষ, আমার আর জয়ের সম্পর্কটা বোঝে। শুরুতে সেও মজা করে পার্টিসিপেট করত।
কিন্তু জয় মাত্রা ছাড়িয়ে যায় মাঝে মাঝে। মাঝ রাতে ফোন করে অনেকক্ষণ ধরে কথা বলতে চায়। আমি ভয়ে থাকি, আবার কোন ভোরবেলা সে হঠাৎ করে সিকিউরিটি গার্ড আর সবাইকে পাগলা নাচ নাচিয়ে হাজির হয়।’স্বপ্নে দেখলাম তুই মরে গেছিস। খুব কষ্ট হচ্ছিল। তোকে দেখতে ছুটে এলাম।’
আমি জানি যে জয় মিথ্যা কথা বলে না, অন্তত আমার সামনে বলবে না।
আমার সংসার বড় হয়। ছেলে হয়। মেয়ে হয় ।আমার জীবনের ফোকাস ঘুরে গেছে। আমার ভালো-মন্দের খোঁজ করে অসময়ে জয়ের আসা একটা ফোন অসহ্য লাগে। অনেকদিন আগে থেকেই অনি জয়কে নিয়ে আজেবাজে কথা বলা শুরু করে দিয়েছিল।
‘এই বদগুলোর আর কাজ কী পরের বউয়ের পিছনে সুযোগ খুঁজে বেড়ায়, আর বউগুলোরও কী দুর্বলতা থাকে?’
অনির খোঁচাটা আমি বুঝি।
জয়কে আমি বলি, ‘তুই আর আমার সামনে আসবি না, ফোনও করবি না।’
ঘাড় বাঁকা করে জয় বলে, ‘আমার যেটা ভালো লাগে আমি করবই।’
‘আমার সঙ্গে এরকম আর করবি না। বুঝি আমার সঙ্গে সম্পর্কটা ভুলতে পারছিস না। কষ্ট পাস। তোর বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলাম কত, করলি না। এখন যদি তুই আমার ভালো চাস তাহলে এই দেশে আর থাকবি না। দূরে গেলে তোর আমার দুজনেরই আর কোন কথা মনে থাকবে না।’
হা হা করে হাসে জয়।
‘হাসির কথা না তোর পলিটিক্সের সেই চীন, রাশিয়ায় চলে যা। না হয় আমেরিকায়।’
আমার এই কথাটা মানে জয়। ইউরোপের ডেনমার্ক, নরওয়ে , সুইডেন না কোথায় চলে যায়। আমি আর জয়ের কোনো কথা মাথায় রাখতে চাই না।
মাঝেমধ্যে জয় ঢাকা আসে। কোন বার হয়তো সে খবরটা পাই। একবার আমার সঙ্গে দেখা হয়। সে এসেছে খোঁজ পেয়ে আমিই দেখা করি। কফি শপে বসে কফি খাই।
সে ওয়েট গেইন করেছে ।বয়স অনুযায়ী ভারিক্কি দেখায়।
মেয়েদের যা স্বভাব, জিজ্ঞেস করি, ‘বিয়ে করেছিস’?
‘লিভ টুগেদার। গার্লফ্রেন্ড বদলাই। ওরাই হয়তো আমাকে বদলায়।’
‘বাহ ভালো। নানা রকম স্বাদ পাচ্ছিস‌’।
জয় বলে, এবার আসার সময় প্ল্যান করেছিলাম তোর সাথে দেখা করব।’
‘কেন রে!দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল বুঝি! আমিই তো থাকতে না পেরে এলাম।’
‘সিরিয়াসলি। একটি প্রস্তাব নিয়ে এসেছি ‌ তুই আমার সাথে চল। তিন মাস আমার সাথে থাকবি। তুই আর আমি তিন মাস ঘুরব। আমি জানি তোর অনেক গল্প জমেছে আমাকে বলার মত। তোর সব গল্প বলতে আমার হিসেবে তিন মাস লাগবে। তুই খুব ইউরোপ দেখতে চাইতি, পাহাড়, লেক, তুষার, শীতে জমে যাওয়া নদী।
আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম জয়কে, তার ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের মন মানসিকতার এখনো রয়ে গেছে। আমিও তার মতই রয়ে গেছি ভাবছে।
বললাম, ‘আমার ছেলেমেয়ে স্বামী ওরা তোর সাথে আমাকে ছাড়বেই বা কেন’?
‘তুই ওদের জন্য এত করিস, এত করলি, পুরো জীবনটাই সেক্রিফাইস করলি, তোর নিজের ইচ্ছে একটু পূরণ করতে দেবে না?’
‘তোর সাথে আমার থাকতে ইচ্ছে হয় তুই জানিস?’
জয় জোর গলায় বলল, ‘জানি’।
আসলে জয় জানে না, কত কতবার আমি মনে মনে জয়ের সাথে জলে জঙ্গলে বরফে, পাহাড়ে , সমুদ্রে,সমতলে ফল ঋতুর রং দেখতে ঘুরে বেরিয়েছি। ঘাসের উপর ঝরা পাতার বিছানায় দুজনে শুয়ে থেকেছি।
আমাকে উত্তর দিতে না দেখে, জয় বলে, ‘তিন মাস মাত্র। তোর অনিকে দেখ আমি কনভিন্স করে ফেলব।
হো হো করে হাসলাম আমি।’তুই এখন লিভ টুগেদারের দেশের মানুষ। সব সহজ লাগে।’
‘মাত্র তিন মাস রে।’
এই তিন মাস সময়টা আমার মাথায় ঢুকেছিল। না হলে আমি ডাক্তার ফাহমিদাকে তিন মাসের কথা বললাম কেন? কেন মনে হচ্ছে আমি তিন মাস সময় চেয়ে নিলাম আমার জীবনের আয়ু।
জয় আমাকে ওর টেলিফোন নম্বর দিতে চেয়েছিল বা দিয়েছিল, আমি রাখিনি।
বাইরে আলো ফুটছে। আলো ফোটার আগেই বাবা ফজরের নামাজ শেষ করে ফেলত। আমার এখন কোন একটা উপায়ে জয়কে জানাতে ইচ্ছে হচ্ছে ,আমি আর তিন মাস আছি রে।
জানলার কাঁচে মুখ চেপে নয় তালার উপর থেকে আমি শহর দেখতে থাকি। শহর হয়তো ঘুমায় না। মানুষ ঘুমায়। মাত্র দুই একটা মানুষ দেখা যায় ফুটপাতে। এই এলাকার ফুটপাতের মানুষ চলার সংখ্যা কম। সবাইতো গাড়ি নিয়ে বেরোয় আবার গাড়িতেই বাড়িতে ঢোকে।
কেন যেন আমার মনে হতে থাকে ফুটপাত ধরে সকাল হবার অনেক আগেই জয় হেঁটে হেঁটে এবাড়ির দিকে আসতে থাকবে। এসে বলবে, ‘স্বপ্নে দেখলাম তুই মরে গেছিস। কষ্ট হচ্ছিল।তোকে দেখতে এলাম।’
এবারের জয়ের স্বপ্নটা সত্যি। আমি ততক্ষণে মারা গেছি।
 
 
 
 
 
 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত