ধারাবাহিক: শ্রাবন্তীদের দিনরাত্রি (পর্ব-৭) । ইকবাল তাজওলী
১৪
আজ মঙ্গলবার। আন্দালিব সাহেব অফিসে এসেছেন। গত রবিবার তাঁর ছোটোচাচার চল্লিশা ছিল। সেরে এসেছেন। দুইদিন লেট হয়ে গেছে। ইচ্ছে সত্ত্বেও আসতে পারেননি। ঝামেলায় জড়িয়ে ব্যস্ত সময় পার করেছেন।
আনিকা সম্পত্তির ভাগবাটোয়ারা দাবি করছে। বলেছে,‘ভাইয়া, আমি যতটুকু পাই, আমার অংশ দিয়ে দাও।’ আসমাও সায় দিয়েছে। বলেছে,‘আপা যখন চেয়েছে, কাজেই ওরটা দিয়ে দেয়াই ভালো।’
আন্দালিব সাহেব কিছুই বলেননি, কেবল বলেছেন,‘বড়চাচা আর মেজচাচাকে বল।’ আসলে তাঁর বলার কিছুই নেই। তারুণ্যের শুরুতেই বাড়িঘর ছেড়েছেন। সহায় সম্পত্তির ব্যপারে তাঁর কোনো ধারণা নেই, লোভও নেই। তাছাড়া বিষয়টা জটিল।
‘ভাইয়া, কথা বলছ না যে। পৈত্রিক সম্পত্তিতে আমার কি কোনো হক নাই? ’
আন্দালিব সাহেব চুপ করে গেলেন। তারপর বললেন,‘ সহায় সম্পত্তির আমি কী জানি! বড়চাচা, মেজচাচা আছেন। তাঁরাই সবকিছু দেখে শুনে রেখেছেন। সেই পনেরো-ষোল বছর বয়সে বাড়ি ছেড়েছিলাম, আর এত বছর পর ফিরেছি। কী আছে, কতটুকু আছে, কার কী পাওনা, আমি তো কিছুই জানি না। বলেছিস যখন পাবি।আমি পেলে তুইও পাবি। তবে সময় লাগবে।’
দুদিন ব্যস্ত সময় পার করে আসমাকে সঙ্গে নিয়ে আন্দালিব সাহেব সকালে শহরে ফিরেছেন।
আসমা গেছে ইউনিভার্সিটিতে আর তিনি অফিসে। আন্দালিব সাহেব এমডি বরাবর দুদিনের নৈমিত্তিক ছুটি মঞ্জুর করার জন্যে আবেদন করেছেন। এমডি স্যার ভ্রমণে বিদেশে ফলে হেডক্লার্ক নাজমুল হুদা সাহেবের কাছে দরখাস্ত দিতে গেছেন।
হেডক্লার্ক নাজমুল হুদা দরখাস্ত রাখলেন না।
বললেন,‘আমি দরখাস্ত রাখতে পারব না। আপনি বড়সাহেব এলে দরখাস্ত দেন।’
‘রাখতে অসুবিধা কোথায় ?’
‘আমি রাখতে পারব না, ব্যস।’
আন্দালিব সাহেব কথা বাড়ালেন না। চেম্বারে গিয়ে বসলেন। তারপর শ্রাবন্তীকে বললেন,‘হেডক্লার্কের বড় বাড় বেড়েছে। দরখাস্ত রাখল না। অথচ এটা ওর দায়িত্ব। রাগে আমার পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে। ব্যাটা ফাজিল।’
শ্রাবন্তী শুনলো কিন্তু কিছুই বললো না।
ইদানীং শ্রাবন্তী অফিসে কথাবার্তায় বেশ সতর্ক। আন্দালিব সাহেবের সঙ্গে প্রয়োজন ছাড়া তেমন কথাবার্তা বলে না। তাছাড়া, প্রথম থেকেই আন্দালিব সাহেবের ব্যাপারে তার তেমন আগ্রহ নেই। আন্দালিব সাহেবকে ভালো লাগে বটে, তবে সেটা ওই ভালো লাগা পর্যন্ত ; এর অতিরিক্ত কোনদিন ভাবেনি। তবে অনুভব করে আন্দালিব সাহেবের হৃদয়ের আবেগ। নেহাত ভদ্রলোক বিধায় সরাসরি কোনো প্রস্তাব দেননি, আকারে-ইঙ্গিতে বুঝিয়েছেন। শ্রাবন্তী নির্বিকার থেকেছে।
তারপরও অফিস জুড়ে কানাঘুষা। সুযোগ বুঝে একদিন হেডক্লার্ক বড়সাহেবকে বিস্তারিত বললেন। আর একদিন সময় পেয়ে বড়সাহেব জিজ্ঞেস করেই বসলেন,‘কী ব্যাপার, তোমরা কবে এক হচ্ছ ?’ লজ্জায় শ্রাবন্তী মাথা নিচু করে ফেলল। বড়সাহেব আর কিছু বললেন না।
লাঞ্চের সময় আন্দালিব সাহেব বের হওয়ার মিনিট দশেক বাদে শ্রাবন্তী বের হলো। নাজমুল হুদা নির্ণিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন,‘বুঝলা আব্দুল করিম, মান-অভিমান পর্ব চলিতেছে।’
‘মান- অভিমান না, বড়বাবু স্যার।’
‘পিরিত তো কর নাই আব্দুল করিম। তাছাড়া, তুমার যে চেহারা-সুরত, পিরিতি তো হয় নাই। তাই বুঝতে পারতেছ না, মান-অভিমান কাহাকে বলে?’
‘বড়বাবু স্যার তাইলে পিরিতি হাইস্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন।’
পিনাক চক্রবর্তী বললেন,‘আব্দুল করিম সাহেব, আপনার বড়বাবু স্যার পিরিতি হাইস্কুলের হেডমাস্টার হইলে হের পয়লা বউ পিরিত কইরা দুসরা আদমির লগে ভাগল কেমনে!’
নাজমুল হুদা চুপ করে গেলেন। আর একটিও কথা বললেন না। বাইরেও গেলেন না। পিনাক চক্রবর্তীকে একহাত দেখে নেয়ার জন্যে সুযোগের অপেক্ষায় থাকলেন।
১৫.
শুক্রবারে স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে শ্রায়ন্তী বাড়িতে এসেছে। আরজুমান্দ বানু দাওয়াত দিয়ে নিয়ে এসেছেন। শাহেদ-শ্রায়ন্তী আরজুমান্দ বানুকে কদমবুচি করল। তিনি শাহেদকে একটি সোনার আংটি ও একটি খাম ধরিয়ে দিলেন।
শাহেদকে তাঁর বড় পছন্দ হয়েছে। রাজপুত্র! সারাক্ষণ তার মুখে হাসি লেগে আছে। মনে মনে তিনি মেয়ের পছন্দের প্রশংসা করলেন। আজ ওদের বাবা আহমদ আলি থাকলে বলতেন,‘দেখ, আমার মেয়ের পছন্দ!’ পরক্ষণেই তাঁর মন শঙ্কায় ভরে উঠল। তিনিও তো পছন্দ করে বিয়ে করেছিলেন।
অনেকদিন পর বাড়িটা আজ আনন্দে ভরে উঠেছে। পাখ-পাখালিও যেন আনন্দে গুঞ্জন করছে। চারদিকে ফুলের সৌরভ। গাছে গাছে মুকুল এসেছে। উঁচু মগডালে বসে কোকিলটা একনাগাড়ে ডেকে যাচ্ছে। বসন্ত যেন এই তল্লাটে এসেছে।
আজিজের মা সকালেই এসেছে। সময়ের কোনো হেরফের হয়নি। আজিজের মা আরজুমান্দ বানুকে বলল,‘ খালাম্মা, বড় আনন্দ লাগতাছে। মনে হয়, আনন্দে একটা গীত গাই। সংগ্রামের পর থনে আর কুনু গীত গাওয়া হয় নাই।’
‘গাও নাই কেন, আজিজের মা?’
‘সংগ্রামের বছরই আজিজের বাপ শহিদ হইল। মুক্তি আছিল। যুদ্ধে গেছিল, আর ফিরা আয় নাই। পরে হুনছি, শহিদ অইছে। হেরপর থেইকা আমার আনন্দ নাই, গীতও নাই।’
‘সরকার থেকে কোনো সাহায্য পাও নাই,আজিজের মা?’
‘শেখ সাহেবের সময় তিনহাজার টেকা পাইছিলাম। তারপর আর পাই নাই। জানোয়ারেরা তো শেখ সাহেবরে মাইরা ফালাইল। শেখ সাহেব বাইচ্চা থাকলে দেশের এই হালত অইতো না; আমারও তো এই হালত অইত না, খালাম্মা।
শাওন বাই কই?’
‘শাওন বাজারে গেছে। এসে পড়বে।’
আরজুমান্দ বানু শ্রায়ন্তীকে বললেন,‘পাশে বস মা।’ তিনি মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন।’
শ্রায়ন্তী বলল,‘কী দেখ মা?’
‘তোকে দেখি মা রে। কতদিন তোকে দেখি নাই। তোর শ্বশুর- শাশুড়ি কেমন?’
‘ভালো।’
‘আর ননদ?’
‘ননদ একটা। ও ইন্টারমিডিয়েটে পড়ে।’
‘শ্বশুর-শাশুড়ির কথা শুনিস। সেবা করিস। একছেলের বউ তুই। কখনও অবাধ্য হইস না। দোয়া পাবি। শাহেদের কথা শুনিস। মেয়েদের স্বামীই সব। স্বামী ছাড়া কোনো গতি নাই।’
শাওন বাজার থেকে ফিরল।
শাওন বাজার থেকে ফেরার ঘন্টা দেড়েক বাদে কাজ-টাজ শেষ করে আজিজের মা শাওনকে বলল,‘শাওন বাই, গান লাগাও, হুনি।’
শাওন টেপরেকর্ডারে গান লাগাল। ‘মেলায় যাইরে। বসন্তের …।’
‘শাওন বাই, এইডা আবার কেমুন গান! মমতাজের গান নাই?’
শাওন হেসে দিল।
‘তাইলে পল্লীগীতি লাগাও হুনি।’
ওয়াহিদ সাহেবকে আসতে দেখা গেল। সঙ্গে অর্ণবও।
‘কী রে শাওন, এত হৈচৈ কীসের? পিকনিক করছিস নাকি?’
‘না, দুলাভাই। আজিজের মা গান শুনছে। মণিবু এসেছে।’
ওয়াহিদ সাহেবের সঙ্গে শাহেদের পরিচয় হলো। শ্রায়ন্তী নিজে পরিচয় করিয়ে দিল। বলল,‘আমাদের দুলাভাই। ওই তো বাড়ি।’
ওয়াহিদ সাহেব হ্যাণ্ডশেক করলেন। তারপর কুশলাদি জিজ্ঞেস করলেন। মিনিট বিশেক সৌজন্যমূলক কথাবার্তা হলো। চা-নাস্তা খেলেন। তারপর উঠলেন।
শ্রায়ন্তীকে বললেন,‘ তোর সাহেবকে নিয়ে আসিস বাসায়।’
তারপর বিদায় নিলেন।
ওয়াহিদ সাহেব আসায় আজিজের মায়ের আর গান শোনা হলো না।
সে স্বগতোক্তি করল,‘এরা কেমুন গান শুনে। গাও-গেরামের মাইনষের গান নাই। খালি চিক্কুর পাড়ে। একটা বেডির গান শুনা গেল। শাওন বাই কয়, হেইডা বুলে বেডা। বেডির গলা মানাইছে! কিয়ামতের আর বেশি দেরি নাই । আলামত শুরু অইয়া গেছে । বেডা বেডি অইতাছে, বেডি বেডা অইতাছে । বগুড়া না কুনহানে একবেডা বুলে বেডি অইয়া হের বন্ধুরে বিয়া করছে ! সংগ্রামের পরই তো হুনলাম । আরেক আবুইদ্দায় ( শিশু ) বুলে শিয়ান মাইয়া দেখলেই লাফ দেয় । বুনি ধরবার চায় । কী কলিকাল আইল !’
বিকেলবেলা শাহেদ-শ্রায়ন্তী চা-নাস্তা সেরে বিদায় নিল । যাওয়ার আগে শ্রাবন্তী, অবন্তী শাহেদের হাতে থ্রিপিচ আর একটি মূল্যবান ঘড়ি তুলে দিল ।
শাহেদ-শ্রায়ন্তী আবার মাকে ও শ্রাবন্তীকে কদমবুসি করল । অস্বস্তিতে পড়ে অবন্তী দ্রুত সরে গেল ।
শ্রায়ন্তী গত শুক্রবারে এসেছিল । আজ আরেক শুক্রবার । শুক্রে শুক্রে আটদিন । শ্রায়ন্তীর আর কোনো খবর নেয়া হয়নি ।
আজ শাওন শ্রায়ন্তীর বাড়ি যাবে।
পুকুরে মাছ বেশ ঘাই দিচ্ছে । গতকাল আজিজের মাকে বলে দেয়া হয়েছে, আজ মাছ ধরা হবে । আজিজের মা আজ সাত-সকালে লোক-লস্কর নিয়ে হাজির হয়েছে ।
পুকুরে জাল ফেলা হয়েছে । প্রচুর মাছ জালে উঠছে । রুই-কাতলা-মৃগেল ।
আজিজের মায়ের আনন্দের সীমা-পরিসীমা নেই ।
‘এই মিয়া কর কী ! ছুডুগুলান ছাইড়া দাও । ছুডুগুলান বুঝ না । জাকটা ( জাটকা ) । জাকটা । ছাড় । ছাড় । বিবিসাবের নির্দেশ ।
শ্রাবন্তী- অবন্তী-শাওন হাসতে লাগল ।
দুপুরবেলা খেয়েদেয়ে বেশ বড়ো-সড়ো একটি রুইমাছ নিয়ে শাওন বোনের বাড়ি গেল । শ্রাবন্তী বলল,‘ আজিজের মা, সাথে যাও । তোমার মাছ তো আছে, পরে এসে নিয়ে যাবে ।’
বিকেলবেলা শ্রাবন্তী অবন্তীকে সঙ্গে নিয়ে চোখের ডাক্তারের কাছে গেল । ইদানীং তার চোখেও সমস্যা হচ্ছে । ছোটো ছোটো লেখা স্পষ্ট হচ্ছে না । ডাক্তার প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে +১.২০ চশমা দিয়ে দিলেন ।
শ্রাবন্তী চোখে চশমা লাগিয়ে ফিরল ।
যাক, শাওন তাহলে বাল্ব লাগিয়েছে । বাড়িতে ঢোকার রাস্তা ফকফকা হয়ে গেছে।
জন্মঃ ১লা জানুয়ারি, সিলেট শহর। ছোটোগল্পে হাতেখড়ি ২০০৯ সালে একটি জাতীয় দৈনিকে লেখার মাধ্যমে। তারপর আর থেমে থাকেননি। অবিরাম লিখেই চলেছেন। তাঁর গল্পে বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চল সিলেটের জনমানুষ, প্রকৃতি ধরা দেয় নির্মোহ ভঙ্গিতে।