শালা

আহাম্মকের গদ্য (চব্বিশ) বহনই । গৌতম মাহাত

Reading Time: 2 minutes

শালা গলার মালা”-প্রবাদ

“শালা শব্দটির অর্থের অবনতি কম হয়নি। শালা শব্দের মূল সংস্কৃত ‘শ্যালক’ এবং উভয় শব্দইই স্ত্রীর ভ্রাতাকে নির্দেশ করত। বর্তমানে শ্যালক-ভগ্নিপতির সম্পর্কের অবনতির কারণে অথবা অন্য কোন পারিপাশ্বিক কারণে শালা শব্দটি পরিহাস বা গালি অর্থে বহুল প্রচলিত। মজার ব্যাপার হচ্ছে প্রকৃত শ্যালক বা শালাও শব্দটিকে সহজে মেনে নিতে চায় না। সোজা কথায়, সামাজিক দিক থেকেও শালা শব্দটি শালীনতার সনদ পায়নি।
বাংলা সাহিত্যের আনাচে কানাচে এই শব্দের প্রয়োগ আধিক্যও নেহাত কম নয়। শরচ্চন্দ্র থেকে হালের সঞ্জীব চাটুজ্জের ধার সকলকেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে বহন করতেই হবে।
মহাভারত থেকে পুরাণ কিম্বা রামায়ণ থেকে গল্প সাহিত্য সবকটাতেই এই শ্যালক জামাতার দুর্দান্ত নজির সামনে উঠে আসে। ধৃতরাষ্ট্র শকুনির সম্পর্কের কথা তো মোটমুটি সবারই জানা। কখনও সে সব নিয়ে আলোচনা করা যাবে তবে আজ অন্য কিছু মাথায় ঘুরছে।


আরো পড়ুন: আইসছ্যে মকর দু’দিন সবুর কর । গৌতম মাহাত


অন্যদিকে শালী শব্দটি দুভাবে গঠিত হতে পারে। যেমন শালা (গৃহ) + ইন = শালী অথবা শাল্ (শ্লাঘা করা) + ইন = শালী। বিশেষণে এ শালী অর্থ শোভামান, যুক্ত, বিশিষ্ট। কিন্তু বিশেষ্যে কালোজিরা অর্থেই মুলত ব্যবহৃত হয়।
আবার সংস্কৃত ‘শ্যালিকা’ থেকে উদ্ভূত ‘শালী’ শব্দটির অর্থ স্ত্রীর ছোট বোন। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস এই ‘শালী’ শব্দটির বিবর্তন দেখিয়েছেন এভাবে : শ্যালিকা > শ্যালী > শালী।
শালি বানানভেদে
(আপনার পানে চায় না শালি
পরকে বলে টোবা গালি – প্রবাদ)।”

তবে যতই যাই বলুন শ্বশুরবাড়িতে শালা না থাকলে সুখ নেই। এবং শালা বহনই-র মধ্যে যে অম্লান অম্ল-মধুর খুনসুটি সে সব বাঙালি চৌহদ্দির এক উপাদেয় প্রসাদ। আমার জ্ঞানতঃ আমি বাবা আর ছোটমামার এমন বহু ঘটনার মধ্যস্থতা করতে গিয়ে বেশ বিব্রতই হয়েছি। তারপর থেকে নাক কান মুলে স্থির সিদ্ধান্তে এসে উপনীত হয়েছি যে — ওদের বিষয়ে না নাক গলানোই শ্রেয়। অ্যামোনই একটি ঘটনার কথা আজ খুব মনে পড়ছে। বাবা আর ছোটমামা সন্ধ্যের দিকে চক থেকে তাস খেলে ফেরার সময় হঠাৎ ছোটমামার পান খাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করায় বাবা বলে– চল তবে! যথারীতি পান খাওয়ার পর বাবাও এক প্যাকেট চার্মিনার কিনে দুজনেই দাঁড়িয়ে রইল বেশ খানিকক্ষণ। টাকাটি দেবার কেউ কোনও রূপ সদিচ্ছা দেখানোর কোনও কৌতুহল প্রকাশ করল না। আগডুম বাগডুম নানা গল্প হতে লাগল কিন্তু টাকা!! ওতে দুজনেই নিশ্চুপ। রাত গড়াতে লাগল ক্রমশ, দোকানদার যুগল মামারও ধৈর্যের বাঁধ ভাঙতে ভাঙতে একসময় প্লাবনের রূপে কথাটা বেরিয়ে এলো। ছোটমামা বলল- দাও হে টাকাটা! বাবা বেশ পাংশু মুখেই পাঞ্জাবির পকেটে হাত চালালো। ছোটমামার মুখে তখন খেলে ব্যাড়াচ্ছে যুদ্ধ জয়ের অমোঘ প্রশান্তি। কারণ সে জেনে গেছে শ্বশুরবাড়ির পাড়ায় পয়সা নেই একথা আর যেই বলে বলুক বহনই অন্তত তার পরিপাটি আত্মসম্মানের তাগিদে বলতে পারবে না।
কিন্তু যুদ্ধের ভবিতব্য ময়ানে রাখা মসি নির্ধরণ করে না নির্ধারণ করে এক সপ্রতিভ আত্মবিশ্বাস। আর ছোটমামা বোধহয় সেই খেলাটা নিজেও ঠাহর করতে পারেনি। ঠহর করতে পারেনি পরমুহূর্তে সেই তাৎক্ষনিক প্রশান্তি ধুলিস্যাৎ হয়ে যেতে বসেছে। ছোটমামা কিছু আঁচ করার আগেই পকেট থেকে সড়াৎ করে একটা পাঁচ’শ টাকার নোট বারকরে যুগলমামা দিকে বাড়িয়ে দ্যায়। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে সে তার পান খাওয়া কালো দাঁত মেলে বলল– বহনই খুচরা ত অত হবেক নাঞ!! তুমি উটা রাখ ন হে, হামি ছুটুর কাছের লে পরে লিঞে লিব!!
ছোট মামার মুখটা হঠাৎ ফিউজ উড়ে যাওয়া ১০০ ওয়াটের বাল্বের মত হয়ে গ্যালো। হঠাৎ ভোল্টেজের তারতম্যে হাল্কা গরম হতে হতেও হল না বোধহয়। জ্বলল কিন্তু আলোটা স্থায়িত্ব পেল না। ছোটমামা পানের অবশিষ্ট সুপুরির টুকরো দাঁতের ফাঁক দিয়ে টেনে নিতে নিতে অস্ফুট স্বরে বলল– হ্যাঁ হে!! তুমার এই পাঁচ’শ টাকাটা সেই পঁচিশ বছরের লে এখনঅ ভাঙায় নাঞ!!

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>