| 19 এপ্রিল 2024
Categories
শারদ সংখ্যা’২২

শারদ সংখ্যা গল্প: শিউলির ঘ্রাণ  । তসলিমা নাসরিন

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

মা তো জন্মের সময়ই মরে গিয়েছিল। বাবার আদরে বড় হয়েছে শিউলি, কিন্তু সেই বাবাই তাকে ছেড়ে চলে গেল একদিন। তখন বয়স সবে পনেরো। দুই ভাইয়ের একজন বয়সে শিউলির চেয়ে দশ বছরের বড়, আরেকজন বারো। রিয়াজ এবং সিরাজ, দু’ভাই-ই ঘরে বউ এনেছে। ঘরে বউ আনার পর দুজনই একদিন আলাদা হয়ে গেল। তাদের আলাদা ঘর, আলাদা চুলো। শিউলির কোনও ঘর নেই, কোনও চুলো নেই। শিউলি রিয়াজের ঘরে খায়, ঘুমোয়। বিনিময়ে রিয়াজ আর তার বউয়ের ফুটফরমাশ খাটে। ফুটফরমাশ আর ক’দিন, দিন দিন সে নিজেই ঠিক টের পায় না, ভারী ভারী কাজও যে তাকে দিয়ে করানো হচ্ছে। কাপড় কাচা, রান্না করা,ঘর দোর সাফ করা। শিউলি হাসিমুখেই কাজ করে। গান গাইতে গাইতে করে। এ তো আর পরের বাড়ির কাজ নয়, নিজের বাপের বাড়িতে বসে নিজের ভাই-ভাবীর কাজ। বাপের বাড়ি, ভাইয়ের বাড়ি আর নিজের বাড়ির মধ্যে তফাৎ তো কিছু নেই! ক’মাস পর রিয়াজের বউ শিউলিকে তাড়িয়ে দিলে সিরাজের ঘরে কাজ করে, সিরাজের ঘরেই খায়, ঘুমোয় সে। শিউলি এলে সিরাজের বউ শুয়ে বসে আরাম করার সুযোগ পায়। রিয়াজ এবং সিরাজ শিউলিকে আদরের ছোট বোন না বানিয়ে বানিয়েছে বাড়ির দাসি। বাবা মারা যাওয়ার পর ইস্কুলে যাওয়া বন্ধ শিউলির। ভাইদের অনুরোধ করেছিল তাকে যেন আবার ইস্কুলে পাঠায়। কেউই রাজি হয়নি। রাজি হয়নি কারণ বাড়ির কাজ তাদের বউরা একা পারবে না, শিউলিকে সাহায্য করতে হবে। আর তাছাড়া, ভাইরা জানিয়ে দিয়েছে, মেয়েমানুষের এত লেখাপড়া করার দরকার হয় না, অক্ষরজ্ঞান হয়েছে, ওটাই যথেষ্ট। এখন দেখেশুনে ভালো একখানা বিয়ে দিতে পারলেই ভাইদের দায়িত্ব ফুরোবে।

একদিন গ্রামের এক বুড়োর কাছ থেকে এক লাখ টাকা পাওয়ার প্রতিশ্রুতি পেয়ে রিয়াজ বাড়িতে জানালো সে শিউলির জন্য পাত্র ঠিক করে এসেছে। তখন সিরাজের ঘর থেকে বাসন না মেজে ঘুমিয়ে পড়ার অপরাধে ঘাড়ধাক্কা খেয়ে রিয়াজের ঘরে এসেছে শিউলি। ভাবীরা তাকে দিনভর খাটায়, ভাইদের কাছে এই অভিযোগ করে সে বিস্তর চড় থাপড় খেয়েছে। শিউলির আজকাল প্রায়ই মনে হয় ঘরে বউ আসার পর ভাইরা বদলে গেছে। এই দুনিয়াতে তার কেউ নেই আর। মাছ মাংস তার পাতে পড়ে না, ডাল ভাত আর বেগুন পোড়া বা আলুর তরকারি দিয়েই শিউলিকে খেয়ে উঠতে হয়। বিয়ে হবে শুনে শিউলির মুখে হাসি ফুটলো। হয়তো বিয়েই তাকে নতুন জীবন দেবে, ভাইয়ের ঘরে দাসিবৃত্তির ইতি ঘটাবে। হয়তো নিজেই সে একদিন দাসি পুষবে। বিয়ে তাকে মনে মনে ঘোড়ায় চড়ায়, সাত মহলা বাড়িতে নিয়ে যায়।

বুড়োর দেওয়া এক লাখ টাকা রিয়াজ পকেটে পুরলো। পঁচিশ হাজার টাকাও পেয়েছে বিয়ের খরচের জন্য। আর পেয়েছে শিউলির জন্য এক জোড়া সোনার কানের দুল। বাজার থেকে লাল একটি সার্টিন শাড়ি,রেডিমেড ব্লাউজ-পেটিকোট কিনে বাড়ি ফেরে রিয়াজ। শিউলিকে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘স্বামীর ঘরে গিয়ে বেশ ভালো হয়ে চলবি, সবাই যেন বলে মেয়েটা লক্ষ্মী। মনে থাকবে?’

শিউলি মাথা নেড়ে বলে, থাকবে। মাথায় ভাইয়ের এই হাত রাখাটি শিউলিকে বড় স্বস্তি দেয়, একঝাঁক নিরাপত্তার অনুভব দেয়। সে ভুলে যায় ভাইয়ের সংসারে সে ঠিক বোনের মর্যাদা পায় না, সে ভুলে যায় তাকে পেটে ভাতের দাসি হিসেবেই সবাই দেখে। তার ভাই মাথায় হাত রেখে আশির্বাদ করেছে, শিউলির মনে হয়েছে যেন তার মা মাথায় হাত রেখে আশির্বাদ করছে, যেন তার বাবা আশির্বাদ করছে। মা বাবার অনুপস্থিতিতে ভাইয়েরাই তো মা বাবা— এই কথাটি সে ঘরে ঘরে গিয়ে বলে আসে। নিজেদের আঙিনা পেরিয়ে পড়শিদের ঘরে ঢুকেও বলে।

বিয়ের দিন ঘর সাজানো হলো রঙিন কাগজ দিয়ে। খাট সাজানো হলো। আত্মীয় স্বজন আর বর সহ বরযাত্রীর কিছু লোককে খাওয়ানোর জন্য বাড়িতে খিচুড়ি মাংস রান্না হলো। শিউলিকে কানের দুল আর শাড়ি পরিয়ে খাটে বসিয়ে রাখা হলো। তাকে মাংস দিয়ে খিচুড়ি খেতে দেওয়া হলো। দু’দুটো রসগোল্লা দেওয়া হলো। শিউলির গোটা জীবনে বিয়ের এই দিনটিই সবচেয়ে আনন্দের। এত আদর, এত মনোযোগ, এত ভালো কাপড়, এত ভালো খাওয়া আগে পায়নি সে। অন্তত তার বাবা মারা যাওয়ার পর পায়নি।

সব খরচপাতি করেও রিয়াজের পঁচিশ হাজার টাকা ফুরোয় না। না-ফুরোনো টাকা সে নিজের পকেটে রেখে দেয়। বড় মোটর গাড়ি চড়ে পুত্র কন্যা নাতি নাতনি নিয়ে ইদ্রিস আলী বিয়ে করতে আসে। কাজিকেও সঙ্গে নিয়ে আসে। শিউলিকে কবুল বলিয়ে মিষ্টিমুখ করে কাজি বিদেয় হয়। বউ নিয়ে ইদ্রিস আলী পরিবারের লোকজনের সঙ্গে বাড়ি চলে যায়। শিউলি অবাক চোখে দেখে বরের বয়স তার বাবার বয়সের চেয়ে ঢের বেশি। জেনে শুনে ভাই তাকে এমন বুড়োর কাছে বিয়ে দিয়েছে! তার বিশ্বাস হতে চায় না। ফুঁপিয়ে কাঁদে শিউলি। তার কান্নাকে সকলে বাপের বাড়ি ছেড়ে আসার দুঃখ হিসেবেই দেখে।

ইদ্রিস আলীর বাড়ি দুটো গ্রাম পর। পাকা বাড়ি। বাড়ি ভর্তি তার ছেলে মেয়ে নাতি নাতনি। এমন কী নাতির ঘরে পুতিও হয়েছে। এই বাড়িতে কিশোরী শিউলি কী করবে? তার ইচ্ছে করে নাতনিদের সঙ্গে উঠোনে এক্কাদোক্কা খেলতে, ইচ্ছে করে নাতিদের সঙ্গে ঘুড়ি ওড়াতে, কিন্তু খেলাধূলা শিউলির জন্য বারণ। কারণ শিউলি এ বাড়ির মেয়েও নয়, নাতনিও নয়। শিউলির কী কাজ এ বাড়িতে? ইদ্রিস আলীর সেবাযত্ন করা। ইদ্রিস আলীর পুত্র কন্যার, নাতি নাতিনির ফরমাশ খাটা। ভাইয়ের সংসারে যত কাজ ছিল, বরের সংসারে তার চেয়ে অনেক বেশি কাজ। ভোর থেকে শুরু হয়, ছেলের বউ আর দাসিদের সঙ্গে রান্নাঘরের কাজ শেষ হলে ঘরদোরের বাকি কাজ সেরে শিউলি সুযোগ পায় বিছানায় যাওয়ার। এখানেও সে বিনে পয়সার দাসি, তবে এ বাড়িতে সে দাসি নয়, ক্রীতদাসী। সে যদি বেঁকে বসে, ক্রীতদাসির কাজ সে করবে না, তাহলে ইদ্রিস আলী রিয়াজের কাছ থেকে লাখ টাকা ফেরত নেবে। যদি টাকা ফেরত দিতে হয়, তাহলে শিউলির বাপের বাড়িতেই শিউলিকে আর পা রাখতে দেবে না রিয়াজ। সুতরাং তাকে মুখ বুজে মেনে নিতে হবে যে লাখ টাকা দিয়ে তাকে কেনা হয়েছে। মুখ বুজে ক্রীতদাসীর কাজ করা ছাড়া তার উপায় নেই।

ইদ্রিস আলীর ঘরে তাকে ঢুকতে হয় মধ্যরাতে। ঢোকার আগে তাকে স্নান করে পরিস্কার হয়ে ভালো কোনো শাড়ি পরতে হয়। এ ইদ্রিস আলীর হুকুম। বয়স তার সাতাত্তর। এই সাতাত্তর বছর বয়সী লোকটি প্রতি রাতে ন্যাংটো করে শিউলিকে। নিজেও ন্যাংটো হয়। তারপর শিউলির ছোট স্তন খুব জোরে পিষতে থাকে আর বলতে থাকে, পিষতে পিষতেই দেখিস এ দুটো বড় হবে। এরপর সে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে আর শিউলিকে এক বাটি নারকেল তেল দিয়ে তার সারা শরীর মালিশ করতে হয়। তার গোপন অঙ্গে মালিশ দীর্ঘক্ষণ চালাতে হয়। এরপর ওটিকে মুখে নিতে হয়। এ ইদ্রিস আলীর হুকুম। শিউলি হুকুম পালন করতে করতেই এক সময় ইদ্রিস আলী নাক ডাকতে থাকে আর মেঝেয় গুটিসুটি শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে শিউলি।

কাকডাকা ভোরে উঠে শুরু হয়ে যায় সংসারের সমস্ত কাজ। ইদ্রিস আলীর নাতনিরাই শিউলির চেয়ে বয়সে বড়। শিউলি তাদের আপনি বলে সম্বোধন করে। সম্পর্কে কারও দাদি সে, কারও নানি। কেউ তাকে অবশ্য দাদি বা নানি বলে ডাকে না, শিউলি বলেই ডাকে। ইদ্রিস আলীর পুত্রকন্যা, নাতি নাতনি সবাই এই বিয়েতে সম্মতি দিয়েছে। কারণ ইদ্রিস আলীর সেবা করার জন্য বাড়িতে কেউ ছিল না। সেবা করার লোক রাখা হলে দু’দিন পরই চলে যায়। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর লোকটি দশ বছর একা কাটিয়েছে। তার একাকীত্ব বাড়ির সকলের চোখে জল এনে দিয়েছে। সে কারণেই এই ব্যবস্থা। তার পুত্র কন্যারাই তাকে বিয়ে করার পরামর্শ দেয়। শিউলির জন্য কারও চোখে জল নেই। এ বাড়িতে সে কেমন আছে, তা, আপন কেউ নেই তার, যার কাছে মন খুলে বলবে। ভাইরা শুনবে না। হয়তো মারধোর করবে। ভাবীদের কাছে বললে ভাবীরে আহা শব্দটিও কি একবার উচ্চারণ করবে! করলে তো দুই ভাবীই যখন উঠোনে ফেলে শিউলিকে মেরে হাত ভেঙ্গে দিয়েছিল, একবার আহা বলতো। শিউলির ভয়, কেউ তার জন্য দুঃখ করবে না। চোখের জল ফেলার তো প্রশ্নই আসে না। মা হয়তো ফেলতো। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়, মার কবরে গিয়ে দু’হাতে মাটি সরিয়ে সরিয়ে মাকে তুলে আনে কবর থেকে।

বিয়ের ন’মাস পর ইদ্রিস আলী মারা যায়। বাড়ির লোকেরা রিয়াজকে খবর দেয়, শিউলিকে নিয়ে যেতে বলে। যখন নিয়ে যায় রিয়াজ, সে যে কী আনন্দ হয় শিউলির! অটোরিক্সায় ভাইটির সঙ্গে চড়ে তার ইচ্ছে হয়, এই পথ কখনও শেষ না হোক। দুনিয়াতে আপন বলতে তার দুটো ভাই-ই তো আছে। হয়তো অভাবের কারণে ইদ্রিস আলীর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে রিয়াজ কিছু টাকা পয়সা পেয়েছে, অভাব না থাকলে এ কাজটি নিশ্চয়ই করতো না। শিউলি মনে মনে ক্ষমা করে দেয় রিয়াজকে। বাড়ি ফিরে ভাবীদের জড়িয়ে ধরে খুশিতে। খুশির অশ্রু ঝরে দুচোখ বেয়ে।

রিয়াজের ঘর আলো করে নতুন অতিথি এসেছে। তাকে কোলে নিয়ে উঠোনময় নৃত্য করে শিউলি। কিন্তু রিয়াজের ঘরে নয়, ঘরে তার শাশুড়ি রয়েছে, শিউলির জায়গা হয় এবার সিরাজের ঘরে। সিরাজের ঘরের সমস্ত কাজ সে আগের মতোই একা হাতে করে। মাঝে মাঝে মধ্যরাতের দিকে দাওয়ায় শুয়ে শিউলি ফুঁপিয়ে কাঁদে। লোকে ভাবে স্বামীর মৃত্যু হয়েছে বলে কাঁদছে বুঝি। আসলে শিউলি কাঁদে তার মা’র জন্য, যে মাকে সে দেখেনি, সেই মা’র জন্য। মা বেঁচে থাকলে তাকে হয়তো এভাবে কষ্ট পেতে হতো না।

দু’তিন মাস পার হতেই সিরাজ বলে শিউলির বিয়ে সে পাকা করেছে সোনামুখী গ্রাম নিবাসী একাশি বছর বয়সী আবদুর রশিদের সঙ্গে । আবদুর রশিদ সিরাজকে দেবে দু’লাখ টাকা। রিয়াজ যেভাবে শিউলিকে পার করেছিল, একইভাবে শিউলিকে পার করে সিরাজ। আসলে পার করে না বলে বিক্রি করে বলাই ভালো। এবার সিরাজের আশির্বাদ ছিল, ‘ও বাড়িতে খাওয়া পরাটা তো ভালো পাবি, বড়লোকের বাড়ি।’ ও বাড়িতে মধ্যরাতে আবদুর রশিদ তাকে ন্যাংটো করে না, নিজেও ন্যাংটো হয় না। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে নিশ্চিন্তে কোথাও মাদুর পেতে ঘুমোতে পারে শিউলি। তবে বাড়ির কাজ সবই তাকে নিষ্ঠার সঙ্গে করতে হয়। আবদুর রশিদ অসুস্থ হয়ে বিছানায় প্রশ্রাব পায়খানা করেন, সেসব তাকেই পরিস্কার করতে হয়। স্বামীকে ওষুধ খাওয়ানো, খাবার খাওয়ানো, গা মুছিয়ে দেওয়া, মালিশ করে দেওয়া সবই করতে হয় শিউলিকে। এরপর রান্নাবান্না, ঘর দোর পয় পরিস্কারের কাজ তো আছেই। বিয়ের চার মাস পর আবদুর রশিদের মৃত্যু হয়। এরপর একই পরিণতি শিউলির। তাকে বাপের বাড়ি চলে যেতে হয়। শ্বশুর বাড়ি থেকে তাকে কোনও জমি জমা টাকা পয়সা কিছু দেওয়া হয় না।

বাপের বাড়ি ফিরলেই রিয়াজ এবং সিরাজ দুজনই বুড়ো কাউকে খুঁজতে থাকে, যে বুড়োর বউ আর ক্রীতদাসি দুটোই দরকার। শিউলির চেয়ে ভালো পাত্রী আশেপাশে কোথাও নেই। শিউলির অল্প বয়স, সংসারের কাজে সে পাকা, সেবা যত্নে পাকা। আর কী চাই? শিউলিকে তার ভাইয়েরা কোনও যুবকের সঙ্গে বিয়ে দেবে না, সে শিউলি বুঝে গেছে। দু’তিনটে প্রস্তাব এসেছিল। শিউলি চেয়েওছিল ওদের কাউকে বিয়ে করে স্থায়ী কোনও সংসারে ঢুকতে। রিয়াজ আর সিরাজ দু’ভাইয়ের এক ভাইও রাজি হয়নি। ভাইদের সংসারে অনাহুত সে, তাদের সন্তানেও ঘর ভরে গেছে। শিউলির শোবার জায়গা নেই, অনেক সময় ক্ষিধে পেটে বসে থাকতে হয়। হাঁড়িতে তার জন্য কোনও খাবার পড়ে থাকে না।

কারও সঙ্গে পালিয়ে যাবে, এমন কেউও গ্রামটিতে নেই। নিজের অস্তিত্বটি তাকে বড় পীড়া দিতে থাকে।

সিরাজ আর রিয়াজ এরপর আশির কাছাকাছি এক বুড়োকে নিয়ে এল। তার নাতিরাই নাকি তাকে বিয়ে করাবে। বুড়োর নাম সদরুদ্দিন। চাষের জমির মালিক। দুটো চাষের ক্ষেত লিখে দিল সিরাজ আর রিয়াজকে। বুড়োকে যত্ন করার কেউ নেই, সুতরাং গ্রামের সেবাদাসিটি তো তৈরিই আছে। শিউলিকে লাল শাড়ি পরিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হলো শ্বশুর বাড়িতে সেবাদাসির কাজ করতে। শিউলির আজকাল মনে হয়, এ-ই ভালো, ভালো মন্দ কিছু তো সে খেতে পায়। বুড়োদের মারধোর করারও শক্তি নেই, বিছানায় ফেলে পিষে ফেলারও শক্তি নেই। এসব শ্বশুর বাড়িকে তার আর শ্বশুরবাড়ি মনে হয় না। মনে হয় সে কোনও অচেনা বাড়িতে গতর খেটে খাচ্ছে। সে যদি সত্যিই কারও বাড়ির দাসি হতো, সে পারতো কাজ করবো না বলে কাজ না করে, মাথা উঁচু করে গটগট করে চলে যেতে! কিন্তু বিয়েটা, যতই অর্থহীন হোক, একটা শৃঙ্খল। এই শৃঙ্খল সে ছিঁড়তে পারে না।

শিউলিকে বিয়ে দিয়ে দিয়ে ভাইদের পকেটে টাকা পয়সা আসতে থাকে। শিউলির পকেট যেমন খালি ছিল আগে, এখনও তেমন খালি। তার কেউ নেই, তার কিছু নেই। ভাইদের ঘরের পাশে ঘর উঠতে থাকে, শিউলি দিন দিন গৃহহীন হতে থাকে। বুড়োদের মৃত্যু হলে তার আর জায়গা হয় না বুড়োদের বাড়িতে, ভাইদের বাড়িতেও তার জন্য আর অবশিষ্ট কিছু নেই। শুধু দুবেলা দুটো ভাতের জন্য তার দিন রাতের পরিশ্রম। দাসির কাজ করলে টাকা পাওয়া যায়, ক্রীতদাসির কাজে কোনও টাকা নেই। শিউলি হাড়ে হাড়ে টের পায় বিয়ে মেয়েদের দাসি বানায় না, ক্রীতদাসি বানায়।

কয়েক বছরে এগারোটি বিয়ে হয়েছে শিউলির। তার বয়স বাড়ছে। যৌবনের আকাঙ্ক্ষা আহলাদ পেটের ক্ষিধের সামনে বড় ম্লান। বুড়ো বর দেখে ভাইয়েরা তার বিয়ে দেবে, সে আশায় সে আধপেট খেয়ে উঠোনে বসে থাকে। যুবকেরা এখন আর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে না। যদি আসে, সত্তর আশি বছর বয়সীরাই আসে। শিউলি এখন বুড়োদের সঙ্গে জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। কী করে তাদের সেবা করতে হয়, সে জেনে গেছে। কী তারা খায়, কেমন করে তাদের দন্তহীন মুখের জন্য খাবার রান্না করতে হয়, সেও শিউলি জানে। প্রতিটি বরকেই সে বাঁচাতে চেয়েছে দীর্ঘদিন। যেন তাকে ভাইয়ের সংসারে ফিরতে না হয়। কিন্তু কপাল যার পোড়া, তার কথা শুনবে কে?

রিয়াজ আর সিরাজ ভুলেই গেছে শিউলি তাদের মায়ের পেটের বোন। দীর্ঘদিন ধরে তাকে বিক্রি করতে করতে তাকে পণ্য বলেই মনে করে। উঠোনে মাদুর পেতে দুঃখের গীত গাইতে গাইতে কাঁদে শিউলি। এই গীতগুলো সে তার বাবার কাছে শুনেছে, তার মা নাকি গাইতো। মায়ের একটি গীত শিউলি বার বারই গায়, ‘পার করো হে দয়াল চাঁদ আমারে, ক্ষম হে অপরাধ আমার, এ ভব-কারাগারে। পাপী অধম জীব হে তোমার, তুমি যদি না করো পার দয়া প্রকাশ করে, পতিতপাবন পতিতনাশন বলবে কে তোমারে।’ অর্থ না বুঝেই সে গায় এটি। গাইতে গাইতে তার চোখ বেয়ে জল ঝরে। কেন ঝরে তাও সে জানে না। এই গীতটি যখন সে গায়, তার মনে হতে থাকে দূর থেকে তার মা শুনছে, শুনছে আর চোখের জল ফেলছে। একদিন সেই দুঃখের গীত গাওয়া থামে। কারণ এক যুবকের সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে যুবকের আত্মীয়রা। যুবকের সঙ্গে বিয়ে, শিউলি বিশ্বাস করতে পারে না। যুবকের বাবার ভালো টাকাকড়ি আছে। ঘরে দাস দাসি আছে। কিন্তু যুবক পাগল। গ্রামের এক ওঝা বলেছে, বিয়ে করালেই নাকি তার পাগলামি যাবে। সে কারণেই তার সঙ্গে বিয়েতে রাজি এমন মেয়ে চাই। শিউলি জানে না ‘রাজি না হওয়া’ ব্যাপারটা কী। ভাইদের সংসারে এই কথা জেনে সে বড় হয়েছে, ভাইয়েরা যা আদেশ করবে, তাকে তা-ই পালন করতে হবে। ভাইদের আনা সব বিয়েতেই তাকে রাজি হতে হবে।

পাগলের বাবার কাছ থেকে দুই ভাই পাঁচ লাখ টাকা পেয়েছে। একেকজন আড়াই লাখ করে। বিয়ের কোনও উৎসব হয় না, কাউকে খাওয়ানো হয় না। পাগলকে টেনে নিয়ে আসে তার বাবা, এক কাজিকে ধরে শিউলিকে কবুল বলিয়ে, শিউলি যেভাবে ছিল, যে কাপড়ে ছিল, সেভাবেই উঠিয়ে নিয়ে যায়।

শিউলি বরং এই পাগলের বাড়িতে বেশ ভালো আছে। এ বাড়িতে তাকে গতর খাটতে হয় না। সে বরং ভালো শাড়ি পরে রানির মতো শুয়ে থাকে, বসে থাকে। লোকেরা তার জন্য খাবার নিয়ে আসে। এ বাড়িতে মাছ মাংস ডিম দুধ যখন যা সে খেতে চায় পায়। এমন সুখের জীবন শিউলি আর পায়নি আগে। পাগলকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য দুটো লোক আছে, তারাই পাগলকে খাওয়ায়, বাইরে নিয়ে যায়, দরকার হলে শেকলে বাঁধে। শিউলির কাজ হলো রাতে পাগলের সঙ্গে এক বিছানায় শোয়া।

যাকে শেকলে বেঁধে রাখতে হয়, তাকে নিয়ে এক ঘরে দরজা বন্ধ করে ঘুমোতে শিউলির প্রথম কয়েকদিন ভয় করেছিল। পরে নিজেই ভেবেছে, তার জীবনে ভয় ডর বলে তো কিছু থাকা উচিত নয়। এই পাগলই তার বর, এর সঙ্গেই তাকে বাস করতে হবে বাকি জীবন। অন্তত এই সুখটুকু সে পায়, যখন ভাবে এ পাগলের বয়স কম, অশীতিপর বৃদ্ধদের মতো তার সহসা মৃত্যু হবে না। সুতরাং এ বাড়িতে আমৃত্যুই হয়তো সে বাস করতে পারবে।

জীবনে সে যৌনতার স্বাদ পায়নি। পাগলই তাকে প্রথম যৌনসুখ দেয়। রাতে ঘুমোয় না পাগল। বারবার সে ঝাঁপিয়ে পড়ে শিউলির ওপর। বেদম হাসে। শিউলির শাড়ি কাপড় টেনে খুলে ফেলে। নিজে উলঙ্গ নেচে বেড়ায় ঘরময়। এই পাগল নিয়েই শিউলি অভ্যস্ত হতে থাকে। পাগলের পাগলামো তার ভালো লাগতে থাকে। দিনের বেলায় পাগল সামলানোর লোক আসে। সে সময় শিউলির অবসর, আর বিশ্রাম। রাত হলে তাকে পাগল সামলাতে হয়।

একদিন সে গর্ভবতী হয়। বাড়ির সকলে খুশি। তার আদর বেড়ে যায় শ্বশুর বাড়িতে। এমন আদর নয় যে আদর তাকে অন্য ঘরে একা থাকার অনুমতি দেবে। না, তাকে পাগলের ঘরেই রাত কাটাতে হবে। সারা রাত শরীরের ওপর পাগলের পাগলামো সইতে হবে। অগত্যা তাই করে শিউলি। কিন্তু সাত মাসের গর্ভবতী যখন সে, তখন শিউলির ঘ্রাণ শুঁকবে বলে মরিয়া হয়ে ওঠে পাগল। তাকে দলামোচা করে ঘ্রাণ শুঁকতে থাকে। পাগল জানতো শিউলি একটি ফুলের নাম। এক সময় শিউলিকে সে আর মানুষ বলে ভাবে না, ফুল বলে ভাবে। তাই ফুলকে আকাশের দিকে ছুড়ে ফেলে আবার হাতের মুঠোয় নিতে থাকে। নিতে থাকে আর শুঁকতে থাকে। শুঁকতে শুঁকতে কামড় বসাতে থাকে সারা শরীরে। পাগল জানেই না শিউলি আর তার গর্ভের না -জন্মানো সন্তান দুজনই তার পাগলামো দেখার জন্য অপেক্ষা করবে না। নাগালের বাইরে চলে যাবে। আর ফিরবে না।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত