| 29 মার্চ 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা : আজকের প্রেক্ষিতে । শাঁওলী মিত্র

আনুমানিক পঠনকাল: 10 মিনিট

উপস্থিত সকলকে নমস্কার জানিয়ে বলি—আমরা যারা ঠিক নিয়মমাফিক পঠন-পাঠনের সঙ্গে যুক্ত নই, অর্থাৎ সেই অর্থে এই জাতীয় কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা বিদ্যালয়েও শিক্ষকতা করিনি—তারা এমন আমন্ত্রণ পেলে, স্বভাবতই, বেশ শ্লাঘা বোধ করি। তাই যাঁরা আমাকে প্রায় জোর করে আজ এই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন তাঁদের আন্তরিক ধন্যবাদ।

শুরুতেই একটি গল্পের একটি ছোটো অংশ পাঠ করতে চাই, মনে করি তাতে প্রথাগত শিক্ষা এবং আমাদের এই শ্লাঘার বিষয়ের উৎসকথা প্রকাশিত হবে। রবীন্দ্রনাথ ‘অসম্ভব কথা’ শিরোনামে একটি গল্প লিখেছিলেন ১৩০০ সালে। সেই গল্পের শুরুতে আছে—

অসম্ভব কথা

“এক যে ছিল রাজা। তখন ইহার বেশি কিছু জানিবার আবশ্যক ছিল না। কোথাকার রাজা, রাজার নাম কী, এ-সকল প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়া গল্পের প্রবাহ রোধ করিতাম না। রাজার নাম শিলাদিত্য কি শালিবাহন, ….অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গের মধ্যে ঠিক কোনখানটিতে তাঁর রাজত্ব, এ-সকল ইতিহাস-ভূগোলের তর্ক আমাদের কাছে নিতান্তই তুচ্ছ ছিল; আসল যে-কথাটি শুনিলে অন্তর পুলকিত হইয়া উঠিত এবং সমস্ত হৃদয় এক মুহূর্তের মধ্যে বিদ্যুদ্‌বেগে চুম্বকের মতো আকৃষ্ট হইত সেটি হইতেছে—এক যে ছিলো রাজা।

এখনকার পাঠক যেন একেবারে কোমর বাঁধিয়া বসে। গোড়াতেই ধরিয়া লয় লেখক মিথ্যা কথা বলিতেছে। সেইজন্য সেয়ানার মতো মুখ করিয়া জিজ্ঞাসা করে, লেখক মহাশয়, তুমি যে বলিতেছ এক যে ছিলো রাজা, আচ্ছা বলো দেখি কে ছিলো সেই রাজা!’ লেখকরাও সেয়ানা হইয়া উঠিয়াছে; তাহারা প্রকাণ্ড প্রত্নতত্ত্ব-পণ্ডিতের মতো মুখমণ্ডল চতুর্গুণ মণ্ডলাকার করিয়া বলে, ‘এক যে ছিলো রাজা, তাহার নাম ছিলো অজাতশত্রু।’

পাঠক চোখ টিপিয়া জিজ্ঞাসা করে, ‘অজাতশত্রু! ভালো, কোন অজাতশত্রু বলো দেখি।’

লেখক অবিচলিত মুখভাব ধারণ করিয়া বলিয়া যায়, ‘অজাতশত্রু ছিলো তিনজন। একজন খৃষ্টজন্মের তিন সহস্র বৎসর পূর্বে জন্মগ্রহণ করিয়া দুই বৎসর আট মাস বয়োঃক্রম কালে মৃত্যুমুখে পতিত হন। দুঃখের বিষয়, তাঁহার জীবনের বিস্তারিত বিবরণ কোনো গ্রন্থেই পাওয়া যায় না।’ অবশেষে দ্বিতীয় অজাতশত্রু  সম্বন্ধে দশ ঐতিহাসিকের দশ বিভিন্ন মত সমালোচনার করিয়া… যখন গল্পের নায়ক তৃতীয় অজাতশত্রু পর্যন্ত আসিয়া পৌঁছায় তখন পাঠক বলিয়া ওঠে, ‘ওরে বাস্‌ রে। কী পাণ্ডিত্য। এক গল্প শুনিতে আসিয়া কতো শিক্ষাই হইল, এই লোকটাকে আর অবিশ্বাস করা যাইতে পারে না। আচ্ছা লেখক মহাশয়, তার পরে কী হইল?’

হায় রে হায়, মানুষ ঠকিতেই চায়, ঠকিতেই ভালোবাসে, অথচ পাছে কেহ নির্বোধ মনে করে এ ভয়টুকুও ষোলো আনা আছে। এইজন্য প্রাণপণে সেয়ানা হইবার চেষ্টা করে। তাহার ফল হয় এই, যে সেই শেষকালটায় ঠকে, কিন্তু বিস্তর আড়ম্বর করিয়া ঠকে।”

এইটকু অংশতেই বেশ বোঝা যায় শুকনো পাণ্ডিত্যের প্রতি কী তির্যক ইঙ্গিত। ‘ডাকঘর’ নাটকটিতেও আছে অমল ‘পণ্ডিত’ হতে প্রবল আপত্তি জানায়। সে কাজ খুঁজে বেড়াতে চায়। জেনে নিতে চায় কোন কাজটি বেছে নিলে সে সার্থকতার অনুভব লাভ করবে। ‘কাজ’ সম্পর্কে এই ধারণাটি আমাদের মধ্যে নেই। আমাদের বিবেচ্য হোল ‘পদ’, ‘বেতন’, ‘উন্নতির সম্ভাবনা’ ইত্যাদি ইত্যাদি।

তাই প্রথমেই প্রশ্ন করতে হয় ‘শিক্ষা’ সম্পর্কে আমাদের নিজেদেরই কী ধারণা? শিক্ষিত বলতে এ-যুগের ধারণা কী? আমরা তো বুঝি শিক্ষালাভ করা মানে একটি ভালো চাকুরি, সুন্দর বাড়ি, সুন্দরী স্ত্রী বা স্বামী, একটি সুন্দর অ্যাপার্টমেন্ট, একটি বা বড়োজোর দুটি বাচ্চা। যৌথভাবে বাঁচার অভ্যাস আমাদের মঞ্চে অবশিষ্ট নেই।

শিক্ষাগ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবার যে কর্তব্য আছে তা আমরা গ্রাহ্য করি না। সহস্রের একাংশও সমাজকে ফিরিয়ে দিই না। এই ফিরিয়ে দেওয়ার কর্তব্য কেউ মনে করালে তাকে উপহাস করি। চালু আছে সেইসব সাধারণ লব্জ যা ব্যবহার করাকে আমরা স্বাভাবিক মনে করি। ঠিক যেমন শিক্ষাস্থলে কোনো পডুয়া নিজের পড়া নিয়ে আগ্রহী হলে তার বিরুদ্ধে সেসব প্রয়োগ করি, কর্মস্থলে কেউ মন দিয়ে তার কর্তব্য করলে তাকে িতরবিদ্ধ করি সেই ভাষা অবলম্বনে।

আর রবীন্দ্রনাথ? তাঁর ভাবনা ছিল এসবের বিপরীত। তাঁর মনে ছিল দেশের প্রতি অঢেল ভালোবাসা, দেশের নাগরিকদের জীবনবোধ গড়ে তোলা। পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসার আবেগ জাগিয়ে তোলা। আর একই সঙ্গে দেশের গ্রামের গরিব মানুষের কাছে শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়া, তাদের স্বাভাবিক শিল্পবোধকে জাগিয়ে তোলা।

১৯০৫ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ-এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উত্তীর্ণ ছাত্রদের উদ্দেশে তিনি বলেছিলেন, “পরীক্ষাশালা হইতে আজ তোমরা সদ্য আসিতেছ, সেইজন্য ঘরের কথা আজই তোমাদিগকে স্মরণ করাইবার যথার্থ অবকাশ উপস্থিত হইয়াছে—সেইজন্যই বঙ্গবাণীর হইয়া বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ আজ তোমাদিগকে আহ্বান করিয়াছেন।’’ বলেছিলেন, ‘কলেজের বাহিরে দেশ পড়িয়া আছে তাহার মহত্ত্ব একেবারে ভুলিলে চলিবে না। কলেজের শিক্ষার সঙ্গে দেশের একটা স্বাভাবিক যোগ স্থাপন করিতে হইবে।”

মনে রাখতে হবে তখন তিনি নিজস্ব শিক্ষাপ্রণালী নিয়ে চর্চা ও নিরীক্ষা শুরু করে দিয়েছেন। ১৯০১ থেকে ১৯০৫-এর মধ্যে বহু বিঘ্ন সত্ত্বেও আশ্রমের কাজ অগ্রসর হয়ে চলেছে। বহু জ্ঞানী-গুণী সেখানে স্বার্থ ভুলে সেই কাজে তাঁর সাথী হয়েছেন। ১৯০৮-এ যা আরও বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। ‘শান্তিনিকেতন’ বক্তৃতামালায় পৌষ উৎসব উপলক্ষ্যে তিনি ছাত্রদের বলেছিলেন, ১৩২১-এর ৭ পৌষে, (১৯১৪, ডিসেম্বর) অনুমান—সে বোধহয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমসময়ে—“একবার ভেবে দেখো দেখি, এই মুহর্তে যখন এখানে আমরা আনন্দোৎসবের অয়োজন করছি তখন সমুদ্রের পারে মানুষের সঙ্গে মানুষের কী নিদারুণ যুদ্ধ চলেছে সেখানে এই বিভীষিকার উপর দাঁড়িয়ে মানুষ তার মনুষ্যত্বকে প্রচার করছে”—

তাঁর কাছে তাই বড়ো ছিল মনুষ্যত্বকে প্রমাণ করবার তাগিদ, অন্যায়কে অস্বীকার করবার সাহস আর সত্যকে নিজের অন্তরে গ্রহণ করবার ব্রত।

যে ‘সম্ভাষণ’ আজ এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য, এবং আজকের আলোচনার কেন্দ্র, তা নিয়ে নিশ্চয়ই এখানকার অধ্যাপক-অধ্যাপিকারা অনেক বেশি বলতে পারবেন। আমার মনে খালি এর কয়েকটি কথা বড়ো দাগ কাটে, যার সঙ্গে তাঁর ৩১ বছর আগেকার কথনের কোনো বৈপরীত্য নেই। তাই, বোঝা যায় যে-শিক্ষার সার্থকতার পথ খুঁজেছিলেন রবীন্দ্রনাথ তা তাঁর মনে কত সত্যস্বরূপ ছিল।

অথচ, আজ আমরা, বেশির ভাগ বাঙালিরা, ঠিক এর বিপরীত পথে চলেছি, এবং স্বাধীনতালাভের ৭০ বছর পরেও কী ভয়ংকরভাবে আমরা বিদেশি ভাষার অধীন হয়ে পড়ছি। এবং তাতে অহংকার বোধ করছি আমরা অনেকেই। আমরা অনেকেই একটি পুরো বাক্য কেবল বাংলা শব্দ ব্যবহার করে বলতেও অক্ষম। আর তা নিয়ে আমাদের লজ্জাবোধ নেই। গর্ববোধ আছে। যে-বক্তৃতাটি এখানে পাঠ্য—তাতেও উনি বলেছেন, ‘যারা এই শিক্ষায় পার হোল তারা যা ভোগ করে তা উৎপন্ন করে না। পরের ভাষায় পরের বুদ্ধির দ্বারা চিন্তিত বিষয়ের প্রশ্রয় পেয়ে স্বাভাবিক প্রণালীতে নিজে চিন্তা করবার, বিশ্লেষণ ও সংশ্লেষণ করবার আন্তরিক প্রেরণা ও সাহস তাদের অত্যন্ত দুর্বল হয়ে আসে। পরের কথিত বাণী যতোই মন্ত্রের মতো অবিকল হয় ততোই তারা পরীক্ষায় কৃতার্থ হবার অধিকারী বলে গণ্য হতে থাকে। বলা বাহুল্য এই পরাসক্ত মনকে এই চিরদৈন্য থেকে মুক্ত করবার একটা প্রধান উপায়, শিক্ষণীয় বিষয়কে শিশুকাল থেকে নিজের ভাষার ভিতর দিয়ে গ্রহণ করা ও প্রয়োগ করার চর্চা।”

কাজেই আজ, কীরকম মনে হয়, তাঁর শিক্ষাভাবনা নিয়ে আলোচনা করা বাতুলতা। তবু আয়োজন হয় আলোচনার। আমরা গম্ভীর-গম্ভীর কথা আলোচনা করি, তাঁর সম্পর্কে ভালো-ভালো কথা বলি, তারপরে বাড়ি ফিরে গিয়ে আমাদের মূল্যবোধহীন জীবনযাপন করি অক্লেশে। এসব আমরা খুব ‘স্বাভাবিক’ বলেই মনে করি। এর মধ্যেকার দ্বিচারিতার ভাগটুকু আমরা গ্রাহ্য করি না।

আর ঐ মানুষটি বিশ্বাস করেছেন লক্ষ্মীর ভাণ্ডার দান করলে ক্ষয় হতে পারে, সরস্বতীর ভাণ্ডার থেকে যত বিতরণ হয় তত তার সম্ভার বৃদ্ধি পায়। এই সংস্কৃতিতেই কি আজ বিশ্বাস করি আমরা?

তাঁর বিবিধ রচনা পড়লে আমরা সম্ভবত সকলেই এটুকু বুঝতে পারি—রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনার মূলে ছিল সকল ‘মানবক’-এর মধ্যে জীবনবোধ গড়ে তোলা। এই ‘মানবক’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছিল এই আশ্রম প্রতিষ্ঠার দিনে—‘কয়েকটি বালক ক্ষৌমবস্ত্র পরিধান করিয়া বিনীত ভাবে উপবিষ্ট। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানবকদিগকে ব্রহ্মচর্যে দীক্ষিত করিলেন।’

কী সুন্দর বর্ণনা সেই দিনটির।

পৌষের রোদ গায়ে মেখে সেই ব্রতের আরম্ভ, কটি মাত্র মানবককে সঙ্গে করে!

কিন্তু জোড়াসাঁকো বা কলকাতা শহর থেকে, তাঁর জন্মভিটে থেকে এত দূরে, এই গ্রামীণ পরিবেশে, তিনি আশ্রম খুলে বসলেন কেন?—আমি একদিন এক বৃদ্ধা আশ্রমিককে এ কথা জিজ্ঞাসা করেছিলাম। (আমরা তখন আশ্রম গড়ে তোলা নিয়ে এক গবেষণামূলক কাজ করছিলাম।) তিনি উত্তর করেছিলেন—‘শুনি তো নিজের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখাবার জন্য।’—খোদ আশ্রমের প্রবীণ মানুষের মুখে যদি এমন অসম্মানজড়িত মন্তব্য শোনা যায়, তাহলে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে কিছু বলবার চেষ্টা করা কীরকম অকিঞ্চিৎকর বলে মনে হয় না?—

তবে এই আলোচনায় এই প্রশ্ন ওঠা বোধহয় অনিবার্য। কারণ তিনি তখন খ্যাতির মধ্যগগনে, তেজস্বী সূর্যসম জাজ্বল্যমান, এই বাংলার সাহিত্যক্ষেত্রে। সেই সময়ে এই কলকাতা নগরী থেকে, সংস্কৃতিচর্চার কেন্দ্র এই কলকাতার সাহিত্য-সমাজ থেকে,—দূরে চলে যাবার সিদ্ধান্ত খুব বিস্ময়কর নয় কি? তাতে তাঁর নিজের অবস্থানের চ্যুতির আশঙ্কা হয় নি?

প্রশ্ন হয়—তিনি কি নিজের সঙ্গেই এক লড়াইয়ে নেমেছিলেন?—নাকি, তৎকালীন সমগ্র সমাজ ব্যবস্থার বিপ্রতীপ কোণটিতে দাঁড়িয়ে—এ এক অসম্ভব অসম যুদ্ধের আরম্ভ করেছিলেন তিনি তাঁর দেশকে ভালোবেসে? দেশের প্রতি কর্তব্যবোধে?

আমরা যেটুকু জানতে পারি, তাঁর কলকাতার বাসস্থান পরিত্যাগ করে যাবার পিছনে যেসব কারণ আছে তার মধ্যে—

একটি কারণ হলো—জোড়াসাঁকো-বাড়ির পরিবেশ তখন তাঁর ভালো লাগছিল না। ভালো ছিল না সে-পরিবেশ। মহর্ষি নিজেও তখন সে-বাড়িতে বেশি সময় কাটাচ্ছিলেন না। তাই জোড়াসাঁকোর বাড়ি থেকে বেশ কিছু দূরে গিয়ে, শান্তিনিকেতনকেই, রবীন্দ্রনাথ তাঁর আশ্রয়স্থল বলে মনে করলেন। সেখানে শৈশবাবস্থা থেকে বালকদের প্রকৃত মানুষ করে তোলবার প্রয়াস যে কত কঠিন ছিল সে তো আমরা বুঝতেই পারি। দ্বিতীয় কারণটি হলো—তাঁর মনে হচ্ছিল দেশের মুক্তি যদি দেশের মানুষকে প্রয়াস করতে হয়, তবে সর্বপ্রথমে আপন দেশের গ্রামের। দিকে নজর দেওয়া জরুরি। তার আগে তিনি জমিদারি দেখভাল করবার জন্যে গ্রামের সান্নিধ্যে কাটিয়েছেন। তখন তিনি বাংলার গ্রামের মানুষের অ-শিক্ষা ও প্রভূত দুঃখ-দারিদ্র্য-বেদনা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তাই হয়তো গ্রামের কাছাকাছি শান্তিনিকেতনের, মহর্ষির সেই ‘প্রাণের আরাম’-এর স্থানটি তিনি নির্বাচন করে নিলেন। যা প্রকৃতির কাছাকাছি। তিনি যে মনে করতেন প্রকৃতির ভাষা থেকে শিশুকে বিচ্ছিন্ন করলে তার শিক্ষার প্রধানতম অঙ্গকে ছেদ করা হয়! মহর্ষির আনুকূল্যেই সেই জমিতে তাই আশ্রম প্রতিষ্ঠা হলো, আর সে আশ্রম এক শিক্ষালয়—তাঁর সেই কঠিন ব্রতের আরম্ভ। তৃতীয়, এ-ও আমরা জানি যে ইংরেজ শাসনের শিক্ষা ব্যবস্থা তাঁর একেবারেই পছন্দ ছিল না, রথী ও বেলার লেখাপড়ার জন্য তিনি গৃহশিক্ষকের ব্যবস্থা করেছিলেন শিলাইদহতেই। আর এখন তিনি ব্রহ্মচর্যাশ্রমের স্থাপনায় সর্বশক্তি প্রয়োগ করতে প্রস্তুত হলেন।

আশ্রমের স্থাপনা হলো ৭ পৌষ, ১৩০৮। ইংরেজির ১৯০১ সালের ২২ ডিসেম্বর তারিখে।

পারিবারিক জীবন

এর মধ্যে, খুব তাড়াতাড়িই, তাঁর পারিবারিক জীবনে যে অন্ধকারময় সময় নেমে এলো, তার ভার বহন করার সাহস থাকে ক-জন মানুষের? আশ্রম-প্রতিষ্ঠার পরে এক বছরও পেরোলো না, মৃণালিনী অসুস্থ হলেন। তাঁকে নিয়ে যেতে হলো কলকাতায়। আশ্রমের শুরুর সময়েই এই বিপর্যয়। ১৯০২-এর নভেম্বরের ২৩ তারিখে পত্নী প্রয়াত হলেন। এরই মধ্যে, ১৯০১-এই, পিতার কর্তব্য পালন করতে তাঁকে মাধুরীলতার বিবাহ দিতে হয়েছে। এবং স্ত্রীর একান্ত অনুরোধে মধ্যমা কন্যা রেণুকারও বিবাহ হয়েছে। স্ত্রীর প্রয়াণের পরে এক বছর পুরোতে-না পুরোতে নিতান্ত বালিকা রেণুকার মৃত্যু হলো।

আচ্ছা, কল্পনা করি যদি—তারই মধ্যে একজন মানুষ বিরামহীন চেষ্টা করে চলেছেন আশ্রমটিকে দাঁড় করাবার, আশ্রমটিকে তাঁর স্বপ্নের শিক্ষালয়ে পরিণত করবার! এ এক অসম লড়াই নয় কি? সেই প্রায় একক যোদ্ধার লড়াইয়ে ছিল সত্যের প্রতি চরম নির্ভরতা। লক্ষ্যে পৌছোবার একাগ্রতা। বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে একলা চলার জোর।

আশ্রমের গোড়ার কথা

১৯০১-এ আশ্রম প্রতিষ্ঠিত হবার সময়ে অনেক কষ্টে জোগাড় হয়েছিল রথীন্দ্রনাথ-সহ মাত্র পাঁচ জন ছাত্র। রবীন্দ্রনাথ-সহ তিন জন শিক্ষক। তবে এই কাছাকাছি সময়েই এসেছিলেন সংস্কৃতজ্ঞ শিবধন বিদ্যার্ণব, এসেছিলেন বিজ্ঞানসাধক জগদানন্দ রায়।

ভাবতে কষ্ট হয়—যে-বছর তিনি স্ত্রী ও কন্যার অসুস্থতা এবং মৃত্যু নিয়ে এক দুঃসহ অবস্থার মধ্যে দিয়ে চলেছেন, আশ্রম থেকে দূরে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন, সেই বছরেই—ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, তাঁর শিষ্য রেবাচাঁদ ও তাঁদের ছাত্ররা আশ্রম ত্যাগ করে চলে যান। সে ১৯০২-এ। অর্থাৎ ছাত্র ও শিক্ষকের শূন্যতায় সেই প্রথম বছরেই এক মস্ত ধাক্কা। ব্রহ্মবান্ধবকে তাঁর বিপুল জ্ঞানের ভাণ্ডারের জন্য তিনি কতই না শ্রদ্ধা করতেন।

পুনরুচ্চারণ হলেও আরও একবার বলতে হয়—

১) রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় শিশুর শিক্ষা প্রকৃতির কাছাকাছি হওয়া বাঞ্ছনীয়। প্রকৃতির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধ তাদের মনকে উদার করে, সমগ্র বিশ্ব সস্পর্কে তার কৌতূহল জাগ্রত করে, জীববেচিত্র্য ও সবুজ প্রাণের প্রতি তার মনে আগ্রহ তৈরি হয়, সেই সঙ্গে সে তার সতীর্থদের মতোই এই প্রাণপ্রবাহকে ভালোবাসতে শেখে। ইট-কাঠের শহরে এই জাগরণ সম্ভব নয়।

২) তিনি বিশ্বাস করতেন বিলাসবহুল জীবনযাপন—শিক্ষা-গ্রহণ ও জীবনবোধ গড়ে তোলার অন্তরায় হয়। তাই ব্রহ্মচর্যের কষ্ট স্বীকার করা আবশ্যিক। তাই প্রাচীন ভারতবর্ষের শিক্ষাগ্রহণের এই ধারাটিকে আপন করে নিয়েছিলেন তিনি। সেই শিক্ষাভাবনার প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ছিল।

৩) সেই তপোবনে একত্র দিনযাপনে যে ছাত্র ও শিক্ষক একে অপরের কাছাকাছি চলে আসে তা অতি প্রয়োজনীয় বলে তিনি অন্তর থেকে মানতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন—দিনরাত গুরু তথা শিক্ষকের সঙ্গে অতিবাহিত করার ধারণার মধ্যে এক মহৎ উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে। তাতে পারস্পরিক সম্পর্কের যে নিবিড়তা তৈরি হয় তা শিক্ষালাভের ক্ষেত্রে অতীব মূল্যবান।

তিনি অন্তর থেকে বিশ্বাস করতেন, শিক্ষা প্রকৃতপক্ষে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আদান-প্রদানের মাধ্যম। প্রত্যহ, প্রতিমুহূর্ত—শিক্ষার সঙ্গে উভয়েরই সম্পৃক্ত থাকা চাই। তাতে শাসন ও ভালোবাসা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত থাকে। যে-মানের শিক্ষকেরা এখানে এসে শিক্ষকতার দায়িত্ব নিতেন তাঁরা মূলত রবীন্দ্রনাথের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েই এই কাজে যোগ দিতে আসেন। তাঁদের জীবনধারণেও ছিল সেই বিনয়ের প্রতিফলন।

এই প্রসঙ্গে আরও একটি কথা বোধহয় আমাদের স্মরণ করা উচিত যে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন স্বরাজের বুনিয়াদ আত্মশাসনে। এ-বিশ্বাস যেন বহুদিনই অন্তর্হিত এই সমাজ থেকে। আত্মশাসনে তখনো কম লোক বিশ্বাস করতেন। কারণ সে-পথে চলা শক্ত। আর ক্রমশ তা বিলীন হতে হতে আজ উপহাসের বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। সকলেরই ধারণা ‘যা-ইচ্ছে-তাই’ করবার অধিকার তাঁদের আছে। বর্তমানের অধিকাংশ মানুষ স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতার পার্থক্য বোঝেন না।

অন্য দিকে, রবীন্দ্রনাথের ভারতবর্ষে স্বাধীনতা আনয়নের নামে সেই আবেগসর্বস্ব পদ্ধতির সম্পর্কে শ্রদ্ধা ছিল না, তাঁর মনে হতো তা অগভীর। তার মধ্যে যুক্তির অভাব। সংগ্রামের জন্য আবেগের চেয়ে আত্মপ্রস্তুতিকে বেশি মূল্য দিয়েছেন তিনি। তাঁর নিজের যুক্তি তিনি ব্যাখ্যা করেছেন তাঁর পত্রাবলীতে, প্রবন্ধে, তাঁর ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে। অনেক পরে পুনরায় ‘চার অধ্যায়’-তেও। আর কলকাতায় তো তখন আন্দোলনের হুজুগ চলেছে। সেই আঁচ তাঁর আশ্রমে এসে এই শিক্ষাক্ষেত্রকে নষ্ট করুক তা তিনি চাননি।

তবুও কি ঠেকাতে পেরেছিলেন? তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁর অনাকাঙ্ক্ষিত বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছিল তিলে তিলে গড়ে তোলা তাঁর সন্তানসম আশ্রমে। তখন কতই না যন্ত্রণা হয়েছিল তাঁর।

‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাস কিন্তু তখন প্রকাশিত। তা পাঠ করলেই আমরা বুঝতে পারি কী তীব্র প্রতিক্রিয়া ছিল তাঁর এইসব হঠকারিতায়। স্থিতধী হয়ে মানবজমিনকে প্রস্তুত না করে হঠকারী বিপ্লব ঘটিয়ে, সুফল ফলে না।

আর সেই ঘটনাই তাঁর শান্তিনিকেতনে ঘটেছিল তাঁর পক্ষে কী মর্মান্তিক সেই খবর, যে-খবরে তিনি জানছেন, তাঁর মতামতকে উপেক্ষা করে তাঁর আশ্রমে এমন সব ঘটনা ঘটেছে ‘দেশাত্মবোধ’-এর নামে!

এদিকে, সেই শতকের প্রথম দশকেই, পর পর স্বজন হারানো। ১৯০৪-এ প্রয়াত হন যুবক শিক্ষক সতীশচন্দ্র রায়। ১৯০৫-এই প্রয়াত হন তাঁর প্রধান পৃষ্ঠপোষক মহর্ষি, তাঁর পিতা। ১৯০৭-এ মৃত্যু  হয় তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথের। তখন সে মাত্র কৈশোর ছুঁই-ছুঁই।

এর পরে ‘গোরা’ উপন্যাস, ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্য, ‘রাজা’ নাটক প্রকাশিত হয়েছে একই বছরে। নোবেল পুরস্কার এসেছে, এসেছে বিশ্বের  অভিবাদন।

আর তারই সঙ্গে সঙ্গে এসেছে আরও কত বিচ্ছেদবেদনা, মৃত্যুর আঘাত, আপন লোকের কাছে, এবং সাহিত্য-সমাজের কাছেও কত না ব্যঙ্গ, কত অন্যায় অপমানের জ্বালা, আর সেই সঙ্গে কত প্রকারের বিশ্বাসঘাতকতা।

এই এতগুলো আঘাত বহন করছিলেন রবীন্দ্রনাথ নামক ঐ ব্যক্তি, যখন তিনি আশ্রমস্থাপনাকে জীবনের ব্রত হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন।

তাঁর ভাষণে, তাঁর প্রবন্ধে, তাঁর জীবনযাপনে তিনি প্রমাণ করেছিলেন তিনি একটি মানুষ গড়ার প্রাণকেন্দ্র তৈরি করতে চেয়েছিলেন, কোনো ডিগ্রি প্রদনের কারখানা বানাতে চাননি তিনি। আর তাই বিশ্বের জ্ঞানপিপাসু মানুষের তীর্থস্থান গড়ে তুলতে চাইছিলেন তিনি। আর সেই বিন্দুতে পৌঁছোতে তাঁর কুড়ি বছর সময় লেগেছিল।

তাঁর জীবনভর পরিশ্রমের দ্বারা, নিজস্ব প্রজ্ঞার দ্বারা, এবং আর্থিক অনুদান সংগৃহীত করবার আয়োজন করে, তাঁর আদর্শের বীজ তিনি বপন করে গিয়েছিলেন। আমরা যদি তার মূল্য না দিতে পেরে থাকি তার দায় আমাদের।

তাই এই সভাস্থলে উপস্থিত বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে কেউ কেউ যদি তাঁর ‘শিক্ষা-ভাবনা’-কে আলোচনার বিষয়ে সীমাবদ্ধ না রেখে তাকে রূপ দিতে পরিকল্পনা করেন, নিজের নিজের সীমিত ক্ষমতার মধ্যেই, তাহলে সেখানেই তবু সার্থকতা খুঁজে পাবে আমাদের সন্তান-সন্ততি।

এদিকে জীবনযাপন ভীষণভাবে বদলে গিয়েছে। ভোগবাদের চেহারা সারা পৃথিবী জুড়ে। দরিদ্র পচিমবঙ্গও তা থেকে রেহাই পায়নি। এমনকী গ্রামের মানুষেরও আজ সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যমে পড়াবার সিদ্ধান্ত। শহরে, বা শহরের কাছাকাছি, শীতাতপনিয়ন্ত্রিত পাঠশালা, তৈরি হয়েছে একাধিক। সে কী দারুণ কারখানা। কৃত্রিম বাগান, কৃত্রিম জন্তু-জানোয়ার, আরও কতরকমের ম্যাজিক পরিক্রমা।—তার মধ্যেও কেউ যদি রবীন্দ্রনাথের অন্তরের শুদ্ধ বাসনার প্রতিরূপ স্থাপনা করতে পারি, তাঁর ভালোবাসার আদর্শে আজকের শিশুদের অনুপ্রাণিত করতে পারি—তাহলেও হয়তো এই ধরনের আলোচনা অর্থবহ হয়ে উঠবে।

শেষ করবার পূর্বে তাঁর একটি ইংরেজি ভাষায় লিখিত বক্তব্যের অনূদিত রচনা থেকে সামান্য কটি অংশ পড়ি। অধ্যাপক অভীক মজুমদার এই অনুবাদ করেছেন। এই লেখটি জাপানে একটি সভায় পঠিত হয়েছিলো ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে। তাতে উনি বলছেন—‘যখন আমি কর্তব্যের টানে শিশুদের উপযোগী একটি বিদ্যালয় শুরু করলাম, শিক্ষা বিষয়ে আমার প্রায় কোনো অভিজ্ঞতাই তখন ছিল না। সম্ভবত, তার ফলে আমার (অসুবিধা না হয়ে) সুবিধাই হয়েছিল। চলতি ছাঁচের বাঁধাবাঁধি আর শিক্ষাতত্ত্বের নীরস কাঠামোর বাইরে গিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে আমাকে নিজস্ব অভিজ্ঞতারাজি খুঁজে নিতে হয়েছে।”

‘নীরস কাঠামো’ বলতে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, ‘‘বিদ্যালয়ে বিস্ময়ের কোনো স্থান নেই, সেখানে নিখুঁত প্রতিসাম্যের রাজত্ব যা কেবল নিষ্প্রাণের পক্ষেই সম্ভব। প্রতিদিন সকালে, ঘড়িঘণ্টা ধরে, ছাত্রকে উপস্থিত হতে হয় বিদ্যালয়ে, …নিয়ম করে একই প্রহরে তার মুক্তি। ক্যালেন্ডারে উল্লিখিত পূর্বনির্ধারিত ছুটির তালিকা আর সব কিছুই যান্ত্রিক ভাবে নিখুঁত, এবং অভ্রান্ত।”

তারপর আবার, তাঁর মতে, সেখানে—‘‘বৎসরান্তে সে মুখোমুখি হয় পরীক্ষা নামক এক ভীতিপ্রদ বিচারের। এরপর আসে অবিচারের পালা, যে ছাত্ররা খেটেছিল খুব, পুরো নম্বর থেকে তাদের বঞ্চিত করা হয়, তাদের শ্রমের পুরস্কার জোটে না, জোটে গুরুর সান্ত্বনা। এ এক নির্মম দাসত্ব, যেখানে শিশুমনকে বলিতে চড়ানোই রেওয়াজ।” বলেছেন, “ক্রমে এই শিক্ষা ব্যবস্থা ব্যর্থ হতে থাকে, (আর) তখন বিবেকের জায়গা নেয় পুলিশ। আমরা জেলখানার জন্য বন্দি জুটিয়ে আনি, পাগলাগারদের জন্য রোগী শিশুদের মনগুলিকেও (ঠিক) সেই ভাবে ফাটকে সীমাবদ্ধ করে তুলছি তাদের অন্তর্লীন ক্ষমতাকে ভেঙেচুরে দিয়ে। অথচ ঐ ক্ষমতাবলে তারা নিজেরাই তথ্য সংগ্রহ করে, সাধারণীকরণ আর বিশ্লেষণে প্রবৃত্ত হয়, নানা জিনিসপত্র ভেঙেচুরে দেখে, আর দুষ্টুমিতে মন দেয়। দুষ্টুমির শক্তি হলো সেই মহত্তম উপহার, যা মানবশিশু জন্মের সঙ্গে নিয়ে আসে।

আমি যখন বিদালয় শুরু করি, আমার সৌভাগ্য, যে আমার আশে পাশে যত দুষ্টু ছেলেকে, এমনকী দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও এরকম দুষ্টু যারা ছিল, তাদেরই সকলকে পেয়েছিলাম। আমাদের অভিভাবকরা যেহেতু আবাসিক-বিদ্যালয়ে তাঁদের ছেলেদের পাঠাতে অভ্যস্ত ছিলেন না, আসতো কেবল দুষ্টু শিরোমণিরা।”

“…ছেলেদের অবাধ ছুটোছুটিতে। সম্পূর্ণ অনুমোদন ছিল, আয়াসসাধ্য গাছে চড়ায় কোনো বাধা ছিল না, যদিও তার ফলে প্রায়শই পতনজনিত বেদনা ছিল অবশ্যম্ভাবী। তারা বাইরে বৃষ্টিতে ভিজতো আপাদমস্তক, পুকুরে সাঁতার দিতো অবলীলায়, প্রকৃতির নিজস্ব প্রক্রিয়ায় এই বালকদের এক ধরনের আরোগ্যলাভ হতো। যাদের মনে করা হতো মন্দগোত্রের, তারা বাড়ি ফেরার পর তাদের অভিভাবকরা অবাক হয়ে দেখতেন, কত গভীর পরিবর্তন ঘটে গেছে।”

আর এই প্রসঙ্গে আরও একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা তিনি মনে করিয়েছেন—যে,—শুধু শিক্ষা-পদ্ধতি বা শিক্ষকের উপর দোষ দিয়ে ছাত্ররা যেন তাদের কর্তব্য সমাপন না করেন। যা আমরা হামেশা করছি তার পরিণাম সুখের হয়নি।

ছাত্র-প্রতিবাদের লাগাম ছেড়ে, তাদের স্বাধীনতার নামে যে-অরাজকতা শুরু হয়েছিল, আমি যতদূর স্মরণ করতে পারি, সেই গত শতকের ৬০-এর দশক থেকেই, তা এক ভয়ানক রূপ নিয়েছিল সেই সময় থেকেই। তা স্বাধীনতা নয়, লাগামহীন এক প্রকার উচ্ছৃঙ্খলতা। যেন বলপ্রয়োগে নিজেদের অন্যায়কে গ্রাহ্য করতে কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করা।—অসুস্থ রাজনীতিকে আশ্রয় করে শিক্ষাস্থলকে অ-সুস্থ করে তোলা।

ছাত্র এবং শিক্ষক উভয়ে পরস্পরের পরিপূরক হয়ে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের যে-মর্যাদা রক্ষা করতে পারতো তা হয়নি বলেই সমাজে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলো আপন সম্মান হারাচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেই আমরা-তোমরার বিভেদ শিক্ষাস্থানকে কলুষিত করছে। এমন শিক্ষকও আছেন যাঁরা সেই কলুষকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন। ময়লা জলের নিষ্কাশন জীবনকে সুস্থতা দেয়। মনে স্বস্থ হবার শক্তি দেয়। —অসুস্থ রাজনীতিকে হাতিয়ার করে নিজেদের অ-সুস্থ করে তুলি কেন?

আজ যদি রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা-ভাবনা নিয়ে পুনরালোচনার প্রয়োজন পড়ে থাকে তাহলে তাঁর সেই উপদেশও আমাদের মাথায় রাখতে হবে। তিনি বলেছেন, তাঁর এই (The Schoolmaster তথা) ‘ইস্কুলমাস্টার’ প্রবন্ধেই—“আমি শিশুদের বোঝাতে চেয়েছিলাম যে, এ-বিদ্যালয় কোনো খাঁচা নয়, বরং নীড়—অর্থাৎ, তাদেরই একে গড়ে নিতে হবে। শিক্ষার ইমারত আমাদের উভয়ের সৃষ্টি। শুধুমাত্র শিক্ষক বা শিক্ষাসংগঠকের নয়, তার দায় সমানভাবে ছাত্রদেরও। ছাত্ররা তাদের প্রাণ দিয়ে একে শরিক হিসেবে গড়ে তুলবে আর অনুভব করবে এমন এক ভুবনে তারা বেড়ে উঠেছে যা তাদের নিজেদেরই সৃষ্টি। আর সে-ই হলো মানুষের শ্রেষ্ঠ মুক্তি। আমি বোঝাতে চেয়েছি যে এই বিদ্যালয় আমার নয়, তাদের‌;—বিদালয় অসম্পূর্ণ—সে অপেক্ষা করে আছে শিক্ষার্থীদের সহযোগে সর্বাঙ্গীণ অবয়বে বিকশিত হতে, শিক্ষার্থীরা এসেছে শিক্ষকদের সঙ্গে একত্রে অধ্যয়নে ব্যাপৃত হতে।”

আজ যদি রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা-ভাবনাকে, ছাত্রদের প্রতি উচ্চারিত তাঁর সম্ভাষণকে, শিক্ষা-ক্ষেত্রে, এবং জীবনচর্যার ক্ষেত্রে স্মরণ করতেই হয় (কারণ জীবনচর্যাকে শিক্ষাদানের অঙ্গ বলেই তিনি মনে করতেন) তাহলে এই সবকটি কথা স্মরণ করা এবং স্মরণে রাখা আমাদের পক্ষে অত্যাবশ্যক। তা নইলে এ-আয়োজনের কোনো মানেই হবে না। এ কেবল নিয়ম-মাফিক স্মরণে পরিণত হবে।

আমার একান্ত কামনা সেই অর্থহীন ‘স্মরণ’ এই আলোচনা সভার উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়াবে না।

আজকের সকল ধৈর্যবান শ্রোতাকে আমি আরও একবার আমার আন্তরিক নমস্কার জানাই।

 

 

 

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক দিবস উপলক্ষ্যে ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬ সালে পঠিত।

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত