Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,শিবুদা

ইরাবতী ধারাবাহিক: কদমতলি (পর্ব-১৬) । শ্যামলী আচার্য

Reading Time: 4 minutes

  

 অ শিবুদা…

বাইরে কেউ শিবপদকে ডাকছে। খুব বিরক্ত হলেন অনঙ্গবালা। কোনও সময়-অসময় নেই? জানল কী করে শিবু আপিস যায়নি?

শিবপদ’র বদলে অনঙ্গবালাই সাড়া দেন।

বাসায় নাই শিবু।

কোথায় গেছে শিবুদা?

অনঙ্গবালা ছোট একটা লোহার বালতিতে জল ভরে নিয়ে দুটো শুকনো গামছার জোগাড় করছিলেন। একটা পলিথিন হলে ভালো হত। বাড়িতে বাচ্চাকাচ্চা থাকলে চট করে একটা অয়েলক্লথ পাওয়া যেত। সেসব বালাই তো নেই। অতএব মীটসেফের ওপর পাতা পলিথিনের টুকরোটাই নেন। কাজ মিটলে আবার জায়গামতো রেখে দিলেই চলবে। বউমার জ্বর নামেনি। ঘটিতে করে তার মাথায় জলের ধারা দেবেন। একটু যদি তাপ নামে। মিষ্টু কিংবা খোকন বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত সে ডাক্তারের কাছেও যাবে না। ততক্ষণ ওর কষ্ট লাঘব।

বিশাখাকে উঠে মাথা ধুতে বলতে তার ঘরে গিয়েছিলেন। অচেতন হয়ে শুয়ে আছে সে। কপালে হাত দিয়ে দেখেন আগুনের হলকা। অনেক কষ্টে চোখদুটি মেলে বলে, মা আপনি খেয়েছেন? অনঙ্গবালা তখনই জলপটি দেওয়ার তোড়জোর করেন। বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ বসে ন্যাকড়া ভিজিয়ে কপালে দিতে দিতেই ঠিক করলেন বালতি করে জল এনে মাথাটাই ধুয়ে দেবেন একবার। সেই সব কাজের মধ্যেই বাইরে হাঁকডাক।    

বিরক্তই হলেন অনঙ্গবালা।

আ মোলো যা। অত ব্যাখ্যান দিতে পারিনে বাপু।

না মানে, শিবুদা দু’দিন অপিসে আসেনি। শরীর খারাপ বলছিল… তাই আর কি।

অনঙ্গবালা উঁকি দেন একবার। একটা ছেলে বাইরে দাঁড়িয়ে। বয়স তিরিশ পঁয়ত্রিশ হবে বড় জোর। উঠনে ঢুকে পড়েনি। বাইরে থেকেই ডাকছে।

কে বাছা তুমি? এই দুপুররোদে…

আমি হারুন মাসিমা। আপনি আমায় চিনবেন না। আমি শিবুদা-র অফিসে চাকরি করি।

শিবু নাই ঘরে।

ও আচ্ছা। ছেলেটি উসখুস করে। শিবুদা ডাক্তার-টাক্তার দেখিয়েছিল তো? ওর শরীরটা কিন্তু… সেইজন্যেই খোঁজ নিতে আসা মাসিমা…

দ্যাখো বাছা, তারা এখন অনেক বড়। ছেলেকালেই বা কত কথা শুনত! শরীরের কথা এখন সে আর তার মায়েরে কইবে ক্যান… আমার তিন কাল গিয়া ঠেকসে এককালে… সংসারের কীই বা সংবাদ রাখি আমি? যে সব আগলাইয়া রাখে, সেই তো কয়দিন ধইরা জ্বরে শয্যা নিসে…

দীর্ঘশ্বাস ফেলেন অনঙ্গবালা। সকালে পর পর ছেলেমেয়েদুটো কলেজে বেরিয়ে গেল। অফিস যাবে না বলে শিবু সকাল থেকেই ঘরে শুয়েছিল। কখন কোন ফাঁকে উঠে সে চুপচাপ স্নান-খাওয়া সেরেছে অনঙ্গবালা জানেন না। টের পেলেন, যখন ঘরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে অভ্যাসবশত বলে, ‘মা, আসি’ আর মা বলেন, ‘দুগ্‌গা দুগ্‌গা’। কোথায় যাচ্ছে, কখন ফিরবে, এসব প্রশ্ন তাদের মা-ছেলের মধ্যে মুছে গেছে বহুকাল। ছেলের বিয়ের অনেক আগেই। ফেলে ছড়িয়ে খেয়ে পরে থাকা জীবন হঠাৎ ভিটেছাড়া হলে যেরকম লড়াই শুরু হয়, সেই লড়াইয়ে একেবারে একা পড়ে গিয়েছিল তাঁর মেজ ছেলেটা। তাঁর শিবপদ। শ্বশুরমশাইয়ের দেওয়া নাম।


আরো পড়ুন: কদমতলি (পর্ব-১৫) । শ্যামলী আচার্য


 

বিষ্ণুপদ, শিবপদ আর কৃষ্ণপদ। তিন ছেলে। আর শান্তি। তিন ভাইয়ের এক বোন। নরম মাটিতে সবুজ গাছের অফুরন্ত ছায়ায় নিস্তরঙ্গ জলধারার পাশে বয়ে চলছিল তাদের সকলের জীবন। হাসিখেলা পড়াশোনা আর বেঁচে থাকার অঢেল উপাদানে পুষ্ট হওয়া। দুঃখ কি ছিল না? ছিল তো। দুঃখ ছিল, কষ্ট ছিল, অভাব ছিল আবার আনন্দ ছিল। সবথেকে বড় কথা মিলেমিশে থাকার স্বস্তি ছিল। নিরাপত্তা। নিশ্চিন্ত বোধ। দেশটা টুকরো করার আগে কেউ একবার জানতে চাইল না, ওগো তোমরা কে কোথায় থাকতে চাও গো? ভারত না পূর্ব পাকিস্তান? আমরা আসলে ভাবছি একবার সব ভাগাভাগি করে আবার নতুন কিছু বানাব। তা’ তোমরা বরং এবার বেছেবুছে নাও। এখানে যদি থাকো, তো ক্ষতি নেই। আর যদি ওই দেশে চলে যেতে চাও, তাহলে বুঝেশুনে দেখে নাও। আগে ঘরবাড়ি দেখো, তারপর এদিককার ঘরবাড়ি বিষয়সম্পত্তি বেচে বিলিয়ে ধীরেসুস্থে যেও এখন। কে কোথায় পড়বে, কে কী কাজকর্ম করবে, কোথায় থাকবে। ওদিককার কেউ কেউ নয় এদিকে এসে বাসা বাঁধবে। একটু সময় লাগবে হয়ত, তা’ লাগুক। নতুন জিনিস গড়তে একটু সময় লাগবে না? একটা ঘর গড়তে কত সময় লাগে। সে ঘর সাজাতেও সময় দিতে হয়। যত্ন করতে হয়। আদর যত্ন আর মমতা ছাড়া কোনও গড়াপেটার কাজ সুন্দর করে করা যায় নাকি!

আর এ তো একটা গোটা দেশ ভেঙে তিন তিন খানা দেশ। এ কী চাট্টিখানি কথা।

আচ্ছা, যে তুচ্ছ কথা অনঙ্গবালার মতো কম-পড়া কম-বোঝা মেয়েমানুষও দিব্যি বোঝে, যে অনঙ্গবালা তেমন লেখাপড়া শেখেননি, ইস্কুল-কলেজ তো দূরস্থান, বাইরের জগত সম্বন্ধে প্রায় কিছুই ধারণা ছিল না যার, শুধু ওই নদীর ধার, পুকুরঘাট, চাষের ক্ষেত বাঁশবন ঝোপঝাড় আর যৌথ পরিবারের রান্নাবান্না খাওয়াদাওয়া পুজোআচ্চা লোক-লৌকিকতা নিয়েই অনেকগুলো বছর কাটিয়েছেন একটানা একইভাবে, সেই অনঙ্গবালাও যদি এত কিছু ভাবতে পারেন, তাহলে একটা দেশকে যেমন তেমন টুকরো করে দুদিকে নতুন দুখানা দেশ বানানোর আগে মন দিয়ে ভাববে না কেউ?     

একটা কোনও আইন থাকবে না? একটা কোনও নিয়ম?

হঠাৎ চোখ তুলে দেখেন ছেলেটি কখন চলে গেছে। আহা! শিবু কেমন আছে জানতে এসেছিল। একটু জল-বাতাসা পর্যন্ত দেওয়া হল না। এই ভরদুপুরে কোত্থেকে তেতেপুড়ে এসেছে। এই দুপুরে এসো জন-বসো জনকে পাতপেড়ে না খাইয়ে কবে ছেড়েছেন অনঙ্গবালা? কবে… কবে… সে বোধহয় আগের জন্মের কথা।

জলের বালতি, ছোট একটি ঘটি আর একটি শুকনো গামছা নিয়ে বিশাখার খাটের পাশে একটি মোড়া টেনে বসলেন অনঙ্গবালা। ফর্সা গালদুটি জ্বরের তাতে লাল। বিশাখার চোখের পাতায় আগে একটু ঠাণ্ডা জলহাত বুলিয়ে দিলেন। কপালে রাখলেন হাতের পাতা। একটা অস্ফুট শব্দ গড়িয়ে এল বিশাখার ঠোঁট বেয়ে। আরামের শব্দ। কপালের কাছে লেপটে থাকা অগোছালো চুলের গুছিগুলোকে বাঁহাত দিয়ে যত্ন করে পেতে নিলেন অনঙ্গবালা। সামান্য কোঁকড়া চুলের ঢাল বিশাখার। অযত্নে সেই গোছ আর নেই। রুক্ষ, তেলহীন। হাতখোঁপার জড়িয়ে থাকা জট খুলে সরিয়ে দিলেন বালিশের একপাশে। সব চুল না ভেজে। শুধু মাথাটুকু। ঘটি করে ব্রহ্মতালুতে জল ঢালার আগে মনে মনে স্মরণ করলেন অজানা অদেখা ঈশ্বরকে। যেমন করেন। যেমন করে এসেছেন বরাবর। ঈশ্বর বলে কেউ নেই জেনেও অভ্যাসবশত একবার তাঁর কাছে নতজানু হয়ে শরণ নেওয়া। সব ভালো হোক। সব সুস্থ  হোক। সব শান্ত হোক। কমে যাক উত্তাপ। মুছে যাক আগুনের আঁচ। ওঁ শান্তি ওঁ শান্তি ওঁ শান্তি।

ঘটির মধ্যে থেকে গড়িয়ে পড়তে লাগল জলধারা। যেভাবে সমতলে বয়ে চলে পরিণত নদী। পাড়ের মাটি ছুঁয়ে তিরতির স্রোত। সিদ্ধপুর ঘাট। সোনাধান পথ। চড়ায় কোঁচবক। সোনালি রোদের আঁকিবুঁকি ঝোপের ছায়ায়। নদীজল কখনও দেখে গৃহস্থের আটচালা, মাটির উনুন, বুড়ো লাঙল, ধানী সবুজ ক্ষেতের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া আলপথ, সতেজ গাছে ধরে আছে ফল, পাখিদের খড়কুটো ঘরবাড়ি, তাদের কয়েকদিনের দাম্পত্য, সন্তানসন্ততি, এক বাঁকে নিরাপদ ডোবায় গেরস্থের ছেড়ে রাখা হাঁসের পাল দেখে দূরে আ চই চই করা ডাক, অশ্বত্থের ডালে বাঁধা দড়ির দোলনা থেকে ঝাঁপ দিয়ে পড়া দস্যিপনা, কাঁথা-বালিশের সম্পন্ন সংসার, বাতাবি গাছের ফল নিয়ে ছুটে চলা শৈশব… দেশের মধ্যে গেঁথে রাখা কাঁটাতারও বাঁধতে পারে না যে জলকে।                     

       জল ঢালতে থাকেন অনঙ্গবালা। ধুইয়ে দেন বিশাখার গ্লানি অভিমান ক্লেদ কষ্ট। যেন সব কালি নিয়ে যন্ত্রণা গড়িয়ে মিশে যায় মোহনায়। অভাবের সংসারে স্বেচ্ছায় এসে যে মেয়ে অন্নপূর্ণা হয়ে উঠেছে, তাকে মনে মনে জড়িয়ে রাখেন অনঙ্গবালা। মায়ের বাপের বাড়ির সেই ধলেশ্বরী ফিরে আসে ডান হাতে ধরা ঘটির অন্দরে। দুই গালের কুঁচকে যাওয়া চামড়ায় সেই জলের ছাপ।

       আঃ। খুব আরাম লাগছে মা।

       বিশাখার ক্ষীণ কণ্ঠস্বরে আশ্বস্ত হন অনঙ্গবালা।

       শুকনা করে আগে মাথাটা মুছি বউমা। তারপর উইঠ্যা একটু কিছু মুখে দ্যাও।

       মুখ পুরো তেতো মা। খাব না কিছু।

       অমন কইলে হয় না। তুমি না উঠলে চলব কী কইরা? না খাইলে উঠবা ক্যামনে?

       আজকের দিনটা উপোস দিই না মা। কাল খাব।

       অমন কইও না মা। রান্ধিয়া রাখসে মিষ্টু। আইয়া যদি দ্যাখে মা কিছু খায় নাই, কত কষ্টটা পাইব বলো দেখি। তোমার উঠতে লাগব না বউমা। আমি এইখানেই নিয়া আসি। এইখানেই বইস্যা মুখে দ্যাও।

       বিশাখা আধবোজা চোখে দেখেন দেওয়ালে ক্যালেণ্ডার থেকে কেটে নেওয়া ছবি থেকে চেয়ে আছেন মা মেরি। স্মিত প্রশান্ত স্নিগ্ধ মুখ। আয়ত চোখ। করুণাঘন। লক্ষ্মীর পটে যেমন নিখুঁত মুখশ্রী আঁকা থাকে।     

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>