ফিচার: যা-কিছু পায় হারায়ে যায়, না মানে সান্ত্বনা । নাহার তৃণা
শিরিন আবু আকলেহ( Shireen Abu Akleh) দু’দিন আগে, ১১ মে খুন হলেন। খুনটা সংঘটিত হয়েছে কোনো এক ঘাতক গুলিতে। সপাটে সামনে আসেনি এখনও সেই ঘাতকের পরিচয়। এর আগে একই গোষ্ঠীভুক্ত ঘাতকের হাতে ৩৯জন খুন হওয়া সাংবাদিকের মতো এই হত্যাকাণ্ডও হয়ত বিচারহীন থেকে যাবে। প্যালেস্টাইন-আমেরিকান করসপন্ডেন্ট শিরিন প্যালেস্টাইন শরণার্থীশিবিরে ইসরায়লি সেনাবাহিনী এবং নিরাপত্তা ফোর্সের অভিযানের খবর পরিবেশনের সময় বুলেটবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু বরণ করেন। বরাবরের মতো তিনি তাঁর সেই পরিচিত ‘প্রেস’ লেখা ভেস্ট পরে ছিলেন; মাথায় ছিল হেলমেট। নিরাপত্তার এই আবরণ তাঁকে রক্ষা করতে পারেনি। সুনিপুণহাতেই ঘাতক তাঁকে ধরাশায়ী করেছে। দীর্ঘদিনের প্রতিক্ষা ছিল হয়ত এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে। চিরদিনের মতো থামিয়ে দেওয়া গেল আরববিশ্ব ও তাঁর জন্মভূমি প্যালেস্টাইন নিয়ে সোচ্চার কণ্ঠস্বরটিকে।
শিরিন আবু আকলেহের মৃত্যুর ঘটনা স্মৃতি উজিয়ে আরো এক খুনের গল্প মনে করালো। তিনিও ছিলেন এক কন্যা সাহসিকা। নাম ম্যারি কোলভিন। আমেরিকান ওয়ার করসপন্ডেন্ট ম্যারি কোলভিনকে নিয়ে সিনেমাও তৈরি হয়েছিল। বছর কয়েক আগে দেখেছিলাম। নাম ‘অ্যা প্রাইভেট ওয়ার’। ‘অ্যা প্রাইভেট ওয়ার’ দেখবার আগে মাঝে মধ্যে ম্যারির নামটা চোখে/কানে এসেছে। টিভি পর্দায় কিংবা ম্যাগাজিনের পাতায় তাঁর একচোখে পট্টিবাঁধা ছবি দেখেছি। জীবিত ম্যারির বাম চোখের পট্টি নিয়ে সেরকম আগ্রহ হয়নি। তাঁর মৃত্যুর পর শোরগোল ওঠেছিল, মনে আছে। ওইটুকুই। ২০১৮-১৯ এর দিকে ওর জীবনী ভিত্তিক মুভিটা দেখে ম্যারি কোলভিনের বামচোখে থাকা কালো পট্টির রহস্য খোলাসা হয়।
২০০১ এ শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের সময় সরকারি নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে তামিল টাইগার্স অধ্যুষিত এলাকায় গিয়ে তামিল নেতার সাক্ষাৎকার নেন। ফিরে আসবার সময় সরকারি বাহিনী তাঁদের উপর হামলা চালায়। নিজের পরিচয় দেওয়া সত্ত্বেও সরকারি বাহিনী তাঁর উপর গ্রেনেড এবং বুলেট হামলা চালায়। তিনি বামচোখের দৃষ্টি হারান। তারপর থেকেই তিনি চোখে কালো পট্টি বা আইপ্যাচ ব্যবহার করতেন। ডাকাবুকো স্বভাবের ম্যারিকে তাতে দিব্যি মানিয়ে যেত। এক চোখ হারিয়ে ফেলার খামতি তাঁর মনে একটুও ভয় জাগাতে পারেনি। যদিও যুদ্ধের নানান রক্তাক্ত স্মৃতিভার তাকে প্রায় তাড়িয়ে বেড়াত। কিন্তু জীবনের অধিকাংশ সময় যুদ্ধের ময়দানে কাটানো ম্যারিকে মৃত্যুভয় কাবু করতে পারেনি কখনও।
দুঃসাহসী, একরোখা ম্যারি সানডে টাইমসের সাংবাদিক ছিলেন। যুদ্ধক্রান্ত বিপজ্জনক বহু দেশে গিয়ে তিনি যুদ্বের খবরাখবর সরবরাহের কাজ করতেন। ব্যক্তিগত জীবনে অসুখী মানুষটা যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার জন্য যে কোনো ঝুঁকি নিতে পিছুপা হননি কখনও। ২০১২ সালে যুদ্ধক্রান্ত সিরিয়ার হোমস শহরের পরিস্হিতি স্বচক্ষে দেখা এবং খবর সংগ্রহের জন্য সেখানে চলে গিয়েছিলেন। আরো অনেক অভিযানের মতো সানডে টাইমসের প্রধান কর্মকর্তার অগোচরে ব্যক্তিগত উদ্যোগে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে গোপনে স্যাটেলাইট টেলিফোনের মাধ্যমে সাধারণ জনগণের উপর আসাদ বাহিনীর যথেচ্ছা আক্রমণের খবর বিশ্বকে জানাতে থাকেন। বিশ্ববাসীকে যুদ্ধক্রান্ত সিরিয়ার খবর জানানোর এক পর্যায়ে সরকারি বাহিনীর বোমা হামলায় বহু হতাহতের সাথে ম্যারি এবং তাঁর এক সহকর্মী মৃত্যু বরণ করেন। মুভির সেখানেই ইতি ঘটে।
বাস্তবে ম্যারি কোলভিনের খুন হওয়ার ঘটনা মোটেও থেমে থাকেনি। আমেরিকার মতো ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রের একজন নিবেদিত প্রাণ সাংবাদিককের প্রাণ বিদেশের মাটিতে ঝরে পড়বে আর দেশটা বা তাঁর পরিবার চুপচাপ মেনে নেবে এঘটনা বিরল। ২০১৬ সালে ম্যারির পরিবার সিরিয়ান আরব রিপাবলিকের বিরুদ্ধে এই মর্মে মামলা করেন, যে ম্যারি কোলভিনকে (Marie Colvin) হত্যার পেছনে সিরিয়ান সরকার সরাসরি জড়িত। ২০১৯ সালে ম্যারির পরিবার ৩০২ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ পান।
প্যালেস্টাইন-আমেরিকান নাগরিক শিরিন দীর্ঘ ২৫ বছর আল জাজিরার সাংবাদিক হিসেবে যুক্ত ছিলেন। যে ভূখণ্ড নিয়ে তিনি সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন সেটি পৃথিবীর একিলিস খ্যাত প্যালেইস্টাইন রাষ্ট্র। যে দেশের জনগণ শক্তিহীন, পায়ের নিচের মাটিও খুব শক্তপোক্ত নয়। শিরিনের মৃত্যু নিয়ে মৃদুমন্দ আহাজারি উঠেছে– ক্ষতিপূরণ চাইবার ঔদ্ধত্য দেখানোর অবস্হান তাঁর জনগোষ্ঠীর নেই। ভুল জায়গায় জন্ম নেওয়ার খেসারত হয়তবা। কিন্তু প্যালেস্টাইনি হওয়ার পাশাপাশি তিনি আমেরিকান নাগরিকও বটে। সে পরিচয়ের ধারে ঘাতকের টিকিটাও যে কাটা পড়বে এমন সম্ভাবনা ক্ষীণ। এমন মৃত্যুগুলো বিশেষ কোনো ভূখণ্ডের জন্য শুধুমাত্র ক্ষতির তা তো নয়, বরং ক্রমশ ক্ষয়ে যাওয়া মানবিক পৃথিবীর জন্য অপূরণীয় ক্ষতির। সেখানে বিভেদের পাঁচিল তুলে ‘কিচ্ছু জানিনা’ ভাব ধরা ভণ্ডামিই শুধু না গুণ্ডামিকে আশকারা দেওয়ার মতো অপরাধ। ম্যারি কোলভিন, শিরিন আবু আকলেহ, এঁরা একেকজন সংশপ্তক। হিংসায় উন্মত্ত এই পৃথ্বীতে সংশপ্তকের বড় খরা। খরাক্রান্ত সময় ছাপিয়ে পৃথিবী নিঃশব্দে কেবলি তাই বুঝি কেঁদে যায়। ছিটকে আসা সে কান্নার সুর– ‘যা-কিছু পায় হারায়ে যায়, না মানে সান্ত্বনা’ আমাদের বোধের ঘরে ঢোকার পথ খুঁজে পায় না…
নাহার তৃণা। জন্ম ২ আগস্ট ঢাকায়। বর্তমানে ইলিনয়ে বসবাস। মূলত গল্প লেখায় ঝোঁক। পাশাপাশি অনুবাদ, প্রবন্ধ, সিনেমা, সাহিত্য সমালোচনা লিখে থাকেন। দুই বাংলার বিভিন্ন সাহিত্যপত্রিকা এবং ওয়েবজিনে নিয়মিত লিখছেন। একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০-এ ‘পেন্সিল পাবলিকেশনস প্রতিভা অন্বেষণে তার ‘স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট’ সেরা গল্পগ্রন্থ নির্বাচিত হয়। একই বছর অন্বয় প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় ‘এক ডজন ভিনদেশি গপ্পো’। সম্পাদিত গ্রন্থ: ‘গল্পের পুষ্পিত কুঞ্জ’(২০২১, বইয়ের হাট প্রকাশনী), ‘গল্পপাঠ নির্বাচিত জাপানি গল্প সংকলন’(যৌথ সম্পাদনা, ২০২২, কবি প্রকাশনী)। প্রকাশিতব্য অনুবাদ গল্প সংকলন, ‘দূরদেশের গল্প(২০২২, চৈতন্য প্রকাশনী)’।