Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,শিল্পী

ভারত গৌরব জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা (পর্ব-২৭) । বাসুদেব দাস

Reading Time: 4 minutes

‘তোরে মোরে আলো করে যাত্রী’ চন্দ্রপ্রসাদ শইকীয়ার জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা কে নিয়ে রচিত একটি জীবনী মূলক উপন্যাস। মাতৃপ্রেম, স্বদেশ প্রেম এবং সাহিত্য প্রেম এই তিন মানবীয় গুণের আধারে উপন্যাসটি গড়ে উঠেছে। উপন্যাসটিতেজ্যোতিপ্রসাদের আলোক মন্ডিত জীবনকে সম্পূর্ণ ঔপন্যাসিকের দৃষ্টিতে দেখার প্রয়াস করা হয়েছে। এই উপন্যাসে কল্পনার স্থান এতটাই প্রবল যে জ্যোতিপ্রসাদের জীবনী মূলক বাস্তব উপাদান এখানে সন্ধান করা বৃথা,যদিও জীবনবৃত্তান্তের আধারেই রচিত এই উপন্যাস। ইংরেজিতে একটি কথা আছেঃGreatest writer can see through brickwalls. জ্যোতি প্রসাদের ক্ষেত্রেও এই কথা সম্পূর্ণ প্রযোজ্য। তিনি কালের প্রাচীর ভেদ করে ভবিষ্যৎ সমাজের একটি ছবি দেখতে পেয়েছিলেন,যেখানে সুবিচারেরপ্রতিজ্ঞা, বুদ্ধিরকীর্তিমান বিচার নির্ভয়ে বিরাজমান। জ্যোতিপ্রসাদ জীবন নাটকে অভিনয় করেছিলেন সেই অভিনয়ে ছিল যথার্থই হাসি- কান্না, রাগ- অনুরাগ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, আনন্দ- বেদনা, শ্রদ্ধা-ভালোবাসা সমস্ত কিছুই। তিনি ছিলেন জীবন শিল্পী। ডিকেন্স বলেছিলেন I live with everyone of my characters. জ্যোতিপ্রসাদ সম্পর্কেও বলা যায় যে সমগ্র রচনায় তিনি নিজেকে প্রতিবিম্বিত করেছেন।তাঁর গীতে, কবিতায়, নাটকে এবং অন্যান্য প্রবন্ধে নিঃসন্দেহেজ্যোতিপ্রসাদেরছায়া আমাদের চোখে ধরা পড়েছে।

জ্যোতিপ্রসাদের মাতা কিরণময়ীর প্রভাব পুত্রের ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলায় অন্যতম ভূমিকা গ্রহণ করেছে। উপলক্ষ থেকে লক্ষ্যে পৌঁছাতে জ্যোতিপ্রসাদের মাতা কিরণময়ী তাঁর সমস্ত সত্তা অধিকার করেছিল । এই মাতৃপ্রেমের প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই জ্যোতিপ্রসাদের পরবর্তীকালের সাহিত্যের অন্তরঙ্গতার মধ্য দিয়ে। এই প্রসঙ্গে আমাদের মনে পড়তে পারে জয়মতীরজীবনচিত্ররূপায়নের কথা,কারেঙরলিগীরীতে রাজা মাওয়ের চরিত্রের কথা। প্রতিটি নাটকে তিনি নারী চরিত্রের ভেতরে মাতা কিরণময়ীর উজ্জ্বল মানবীয় ছবি বর্ণাঢ্য রূপে দেখতে পেয়েছেন। জ্যোতিপ্রসাদ এই ত্রিমাত্রিক প্রেমই পরবর্তীকালে স্বদেশপ্রেম এবং সাহিত্যপ্রেমে প্রতিফলিত হয়েছিল। ঘরোয়া পরিবেশে জ্যোতি প্রসাদের জীবনে প্রভাব বিস্তার করেছিল দাদু হরিবিলাস, পিতা পরমানন্দ এবং কাকা চন্দ্রকুমার।

উপন্যাসটির একটি বিস্তৃত অংশ জুড়ে রয়েছে জ্যোতিপ্রসাদের স্বদেশপ্রেমের উপকরণ। জ্যোতিপ্রসাদের জীবনে গান্ধীজীর বিশাল প্রভাব ছিল।১৯২১ সনে গান্ধীজির অসম ভ্রমণের সময় জ্যোতিপ্রসাদের বয়স ছিল আঠারো। গান্ধীজি তেজপুর গিয়েছিলেন,জ্যোতিপ্রসাদের পরিবারের অতিথি হয়েছিলেন। মহাত্মার সান্নিধ্যে এসে জ্যোতিপ্রসাদ উপলব্ধি করেছিলেন দেশ প্রেম এবং মানবপ্রেমঅভিন্ন।তাঁর মনে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতিভূরূপে গান্ধীজির অহিংস নীতি দেশ উদ্ধারের প্রশস্ততম পথ এই দৃঢ়প্রত্যয় জন্মেছিল। এর পরিণতি স্বরূপ জ্যোতিপ্রসাদের চিন্তা ধারায় কীভাবে মুক্তি চেতনা জায়গা করে নিয়েছিল তা উপন্যাসটিতে উল্লেখিত হয়েছে ।

ঔপন্যাসিক চন্দ্রপ্রসাদ শইকীয়া জ্যোতিপ্রসাদের জীবনের যে উপাদানের উপর ভিত্তি করে উপন্যাসটি রচনা করেছেন তাতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে একজন জীবন শিল্পীকে অনুভূতি,আস্বাদ,বিচারবুদ্ধি এবং রসিকতায় উপস্থিত করার জন্য উপন্যাসটিতে অনেক সার্থক উপাদান আছে। উপন্যাসটির পাতায় পাতায়, প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত জুড়ে রয়েছে জ্যোতিপ্রসাদ। জ্যোতিপ্রসাদের গতানুগতিক জীবন এবং চিন্তাই কেবল নয়,এতে রয়েছে নায়কের বাল্য বেদনা, যৌবনের স্বপ্ন, পারিপার্শ্বিক ঘটনার অসংখ্য দৃশ্য। আছে অন্ধকারে প্রজ্বলিত অফুরন্ত আশার আলো, পরাধীন জীবনের বন্ধ দরজা ভেঙ্গে ফেলা বিপ্লবের গান। বলা যেতে পারে, জ্যোতিপ্রসাদ নিজেই নিজের জীবনের উপকরণ। চন্দ্রপ্রসাদের এই উপন্যাস জ্যোতিপ্রসাদের আত্মপ্রকাশ মাত্র। 


আরো পড়ুন: ভারত গৌরব জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা (পর্ব-২৬) । বাসুদেব দাস


শিল্পী- সংগ্রামী হেমাঙ্গ বিশ্বাস অসমিয়া সংস্কৃতির এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের প্রধান সূত্রধর এবং জীবন শিল্পী জ্যোতিপ্রসাদ ছিলেন এই অধ্যায়ের সবচেয়ে নিপুন শিল্পী কারিগর। দুজনেই স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়েপড়ে কারাবরণ করেছিলেন। শিল্প-সংস্কৃতি দুজনের কাছে রাজনীতি– বিবর্জিত বিষয় ছিল না। শিল্প সাধনা এবং রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্যে তাদের মনে কোনো বিরোধ ছিল না। চল্লিশের দশকের মধ্যভাগে কংগ্রেসের প্রতি হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মোহভঙ্গ ঘটেছিল এবং সিলেট জেলায় সেই সময় গড়ে উঠা কৃষক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক গড়ে উঠে। জ্যোতি প্রসাদের মনেও বিয়াল্লিশের আন্দোলনের পর থেকে কংগ্রেসের প্রতি তাঁর সমালোচনাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেতে শুরু করেছিল। স্বাধীনতার মুহূর্তে তিনি যেন পুরোপুরি কংগ্রেস থেকে সরে আসার যুক্তি খুঁজে পেয়েছিলেন। এমনই একটা সময়ে ১৯৪৬ সনের এপ্রিল-মে মাসে জ্যোতিপ্রসাদের সঙ্গে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের তেজপুরে সাক্ষাৎ হয়। হেমাঙ্গ বিশ্বাস তখন ‘সুরমা উপত্যাকা কালচারাল স্কোয়াড’ নামে একটি ভ্রাম্যমান সাংস্কৃতিক দলের নেতৃত্ব নিয়ে বিভিন্ন জায়গা ঘুরে এসে তেজপুরে উপস্থিত হয়েছিলেন । প্রথম সাক্ষাতে হেমাঙ্গ বিশ্বাস জ্যোতিপ্রসাদকে সাংস্কৃতিক বাহিনীর কার্যসূচির কথা বলেছিলেন। রোগ শয্যাশায়ী জ্যোতিপ্রসাদ বেরিয়ে একটা ছোট পালঙে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কাছে বসে সেই কাহিনি শুনছিলেন। রোগশীর্ণ জ্যোতিপ্রসাদের মুখে, চোখ দুটিতে হেমাঙ্গ বিশ্বাস সেদিন দেখতে পেয়েছিলেন প্রতিভার দীপ্তি। পরের বছর শিলচরে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে গঠিত ভারতীয়গণনাট্য সংঘের অসম শাখার প্রথম সভাপতি নির্বাচিত করা হয় জ্যোতি প্রসাদ আগরওয়ালাকে। স্বাস্থ্যজনিত কারণে জ্যোতিপ্রসাদ সম্মেলনে যোগ দিতে পারেননি, কিন্তু তিনি এই নির্বাচনকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছিলেন। হেমাঙ্গ বিশ্বাস সংঘের সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ছেচল্লিশ সন থেকে একান্ন সন পর্যন্ত ছয় বছরের সান্নিধ্যের অভিজ্ঞতায় হেমাঙ্গ বিশ্বাস বলেছিলেন যে তিনি জীবনে অনেক বিখ্যাত শিল্পী সাহিত্যিকের সান্নিধ্য লাভ করেছেন, কিন্তু জ্যোতিপ্রসাদেরমতো জীবন এবং সংস্কৃতির সমন্বয়ের জন্য এই ধরনের অবিচ্ছিন্ন সংগ্রামশীল শিল্পীকে তিনি কমই দেখেছেন। জ্যোতিপ্রসাদের কাছে জীবন ছিল একটি সামগ্রিক স্ফুরণ। জ্যোতিপ্রসাদের চিন্তা ধারায় বুদ্ধিজীবীর ভাব বিলাস ছিল না। হেমাঙ্গ বিশ্বাস জ্যোতিপ্রসাদকে অনেক কমিউনিস্ট বুদ্ধিজীবীর চেয়ে উঁচু স্থান দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন নি। তিনি লিখেছেন–’ অনেক কমিউনিস্ট বুদ্ধিজীবীকে দেখেছি কত অহমিকাপূর্ণ এবং সমালোচনা কাতর। তারা তাদের শিল্পীসত্তাকে রাজনৈতিক সত্তার ওপরে স্থান দিয়ে জনতার কাছে এক বিশেষ flavoured position বা পদমর্যাদা প্রতিনিয়ত পেতে চান। অথচ জনতার শিল্পী হিসেবে মার্ক্সবাদের প্রতি আকৃষ্ট এই মহান শিল্পী কত সহজে তখন জনসাধারণের সংগ্রামী নেতৃত্বের প্রতি আস্থা প্রকাশ করেছিলেন।’ জ্যোতিপ্রসাদ সম্পর্কে হেমাঙ্গ বিশ্বাস বেশ কিছু রচনা লিখেছিলেন। সেগুলি হল যথাক্রমে ‘মই নিজিরাও’,’ অসম জ্যোতি জ্যোতিপ্রসাদ’,’ জ্যোতিপ্রসাদআরুগণনাট্য আন্দোলন’,’ লভিতার প্রথম নিশা’,’ আমার চোখে জ্যোতিপ্রসাদ’,’ জ্যোতিপ্রসাদেরঅবিস্মরণীয় শিক্ষা’,’ চীনের চিঠি’,’ জ্যোতিপ্রসাদআরু সাম্যবাদ’,’ প্রবাদ পুরুষ জ্যোতিপ্রসাদ’,’ জ্যোতিপ্রসাদ মহান’। এই প্রবন্ধগুলি’ প্রবাহ’,’আমার প্রতিনিধি’,’নতুন অসমীয়া’,’ নক্সা’,’ প্রকাশ’ এবং’ সম্প্রতিকসাময়িকী’তে প্রকাশিত হয়েছিল। প্রকাশকাল ১৯৫৫-১৯৮০। বেশিরভাগ রচনাই আমার প্রতিনিধিতে প্রকাশিত হয়েছিল। জ্যোতিপ্রসাদ কে জনমানসে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে ‘ আমার প্রতিনিধি’র ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।

জ্যোতিপ্রসাদের সাংগীতিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে হেমাঙ্গ বিশ্বাস বলেছেন–’ অজ্ঞাত অসমীয়া-লোকসঙ্গীতের পুনরুদ্ধারের প্রথম প্রদর্শক হলেন জ্যোতিপ্রসাদ।’আইনাম’,’ বিয়া নাম’,’ ‘টোকারী’ ইত্যাদি অসমীয়া লোকসংস্কৃতিকে নাগরিক মঞ্চে উপস্থিত করে তদানীন্তন শিক্ষিত সমাজে তিনি এক যুগান্তরএনেছিলেন।

… জ্যোতিপ্রসাদ পাশ্চাত্য সুর, ভারতীয়রাগসংগীত এবং অসমীয়া লোকসংগীতের মধ্যে এক সার্থক সমন্বয় সাধন করেছেন যার মৌলিক অসমীয়া বৈশিষ্ট্য কোথাও পথ হারায় নি। এই নিজস্ব বিশেষ ভঙ্গির সৃষ্টির জন্য এই গীতগুলিকে  অসমে জ্যোতি সংগীত আখ্যা দেওয়াহয়েছে।।… অসমে তিনিই প্রথম Thematic music সৃষ্টি করেন।’

কবি জ্যোতিপ্রসাদের  কাব্য প্রতিভা সম্পর্কে হেমাঙ্গ বিশ্বাস বলেন–’ জ্যোতিপ্রসাদের  কবিতার যে বলিষ্ঠ সোচ্চার ভঙ্গি তা আমাদের সহজেই বিদ্রোহী কবি নজরুলের কথা  মনে পড়িয়ে দেয়। যদিও পরবর্তী জীবনে তিনি কয়েকটি অপূর্ব লিরিক লিখেছিলেন। তথাপি তার যৌবনের কবিতাগুলি সংগ্রামী চেতনার সার্থক প্রতিধ্বনি হয়ে রয়েছে।’

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>