Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,শিশিযাপন

পাঠপ্রতিক্রিয়া: ‘শিশিযাপন’ পাঠান্তে । সাদিয়া সুলতানা

Reading Time: 4 minutes
জাপানি বংশোদ্ভূত নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ব্রিটিশ কথাসাহিত্যিক কাজুও ইশিগুরোর কাছে স্মৃতি সবসময়ই মূল্যবান। তার ভাষ্যে, ‘স্মৃতি হচ্ছে এমন এক ছাঁকনি যার মাধ্যমে আমরা জীবনটাকে একেবারে নিঙড়ে গভীরে গিয়ে দেখতে পারি। স্মৃতি ঝাপসা, কুয়াশাচ্ছন্ন, অন্ধকারময়। এখানে আত্মপ্রতারণার সুযোগ রয়েছে।’ উপলব্ধি করি, এই অনুভব থেকেই গল্পকারেরা স্মৃতির দিকে ধাবিত হন। একজন গল্পকার একটা আখ্যানকে স্মৃতি, কল্পনা আর বাস্তবতার ছাঁচে ফেলে নতুনভাবে নির্মাণ করেন যা পাঠকের কাছে হয়ে ওঠে গল্প। তাই একটা গল্প লেখকের নিজ হাতে তৈরি বা বানানো হলেও গল্পকে কিন্তু পাঠক সরাসরি বানোয়াট বলে আখ্যায়িত করতে পারেন না। 
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের অন্যতম কথাসাহিত্যিক ওয়াসি আহমেদের গল্প সংকলন ‘শিশিযাপন’ এর মুখবন্ধে উল্লিখিত কিছু কথা উদ্ধৃত করছি; ওয়াসি আহমেদ গল্পের কাছে তার চাওয়া প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘গল্প যেহেতু একটা শিল্প এবং অন্য সব শিল্পের মতোই বানানো, একজন পাঠক জেনে-বুঝেই সেই বানানো চালচিত্রে ঢুকে পড়েন। ফলে কাছের বা দূরের ঘটমান অথবা ঘটে যাওয়া নানা বিষয়-আশয় নিয়ে গল্পকারের বয়ান তার কাছে আর বানোয়াট ঠেকে না। এখানে পাঠক তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে লেখকের বয়ানকে বিচার করবেন এ-ই স্বাভাবিক। আর গল্পকারও চাইবেন, তাঁর চিন্তাভাবনা ও কৃৎকৌশল দিয়ে সেই বয়ানকে নিজের মতো করে বলার।’ 
এভাবে স্বকীয় কৌশলে নিজের মতোই গল্প বলেন গল্পকার ওয়াসি আহমেদ। ‘শিশিযাপন’ বইয়ের গল্পগুলো পড়তে পড়তে মনে হয় তিনি আসলে গল্প লেখেন না, বলেন। তাই পাঠক হিসেবে খুব সহজেই তার গল্পের স্রােতে একাত্ম হওয়া যায়। 
‘শিশিযাপন’ গল্প সংকলনে মোট তেরোটি গল্প সংকলিত হয়েছে। এই গল্পগুলোর মধ্যে নামগল্পটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই গল্পটি সত্যি সত্যি আমাদের জীবনের ‘অতিরিক্ত’ অনেক কিছুই দেখায়। অভিনব কৌশলে গল্পকার গল্প শুরু করে প্রথমেই পাঠককে বিচলিত করে তোলেন, ‘চকমধুরার ধু-ধু প্রান্তর চিরে রাস্তা হবে বলে সেদিন ইটবোঝাই প্রথম ট্রাকটা এলো, দুর্গম এ গ্রামের লোকজন চৈত্র মাসের গা-পোড়ানো গরমেও একটা হিম শিউরানি টের পেয়েছিল।’ এই শিউরানি বাড়তে থাকে যখন পাঠক আবিষ্কার করে ঐ গ্রামের লোকেরা কেন শিশি খায়। এই শিশির অভাব নেই ঐ গ্রামে। হরেক মাপের বড় ছোট শিশি পাওয়া যায় চকমধুরার হাট-বাজার থেকে শুরু করে গায়ের ছোটোখাটো একচালা মুদি দোকানেও। এরপর কী হয় কে কে মরে, বাঁচে, কে কে বেহুঁশ হয় তা খুঁজে পেতে হন্যি হয়ে পাঠক গল্পের সমাপ্তিতে পৌঁছে বিমূঢ় হতে বাধ্য হয়।
‘মিহি-মসৃণ প্রহেলিকা’ গল্পটি উন্নয়নের জোয়ারের রেশ লাগা এক গাঁয়ের সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে। এই দুর্ঘটনাকে শুধু দুর্ঘটনা বললে চলবে না। উন্নয়ন শব্দটির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলতে হবে রোড অ্যাক্সিডেন্ট। বিটুমিন মোড়া সলিড পাকাপোক্ত রোড হওয়ার পড়েও এদিকে মানুষ মরছে, ঘন ঘন মারা পড়ছে মানুষ। ‘বিশেষ করে শিববাড়ির কোণে যেখানে রাস্তাটা যেখানে ঢালু হয়ে ঝড়ের বেগে বাঁক নিয়েছে ওখানে।’ এই বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে এলাকার মানুষ পরিশেষে অভিনব এক সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। সরস ঢঙে লেখা গল্পটি আদতে এই উন্নয়নের দেখা অদেখা জোয়ারের প্রতি কটাক্ষ করে কিনা তা বুঝতে হলে গল্পটি পড়া চাই।

এই গল্পের মিহি-মসৃণ প্রহেলিকা পাঠককে নিবিড় মনোযোগী আর কৌতূহলী করে তুললেও ‘মেহেরজানের পদ্মসুনা’ পাঠককে করে তোলে ধীর স্থির। এই গল্পের বর্ণনা রীতি অপেক্ষাকৃত সরল, সোজাসাপটা। মা-মেয়ের জীবনের সবকিছুর ফয়সালার মাধ্যম যখন হয় অর্থ তখন বাৎসল্যবোধ ছাপিয়ে আরও কিছু বিষয় মূর্ত হয়ে ওঠে। অবশ্য এই গল্পটিতে আমি ঠিক আমার চেনা আখ্যানকার ওয়াসি আহমেদকে পাইনি। লেখার অভিনবত্বে বরাবরের মতো খেই হারাবো ভেবে বসেছিলাম বলেই হয়তো এমন অতৃপ্তি জেগেছে। 
‘মানুষের বাচ্চা’ গল্পটি পাঠ করেও একই ধরনের অনুভূতি হয়েছে। আসলে প্রিয় কথাকারের ওপরে এতই প্রত্যাশা যে প্রাপ্তি আর প্রত্যাশার মাঝে সামান্য তারতম্যও মন খারাপ করে দেয়। তবে অস্বীকার করবো না, গতানুগতিক প্লটকেও ভাষাশৈলীর গুণে অনন্য করে তুলতে এই গল্পকারের কোনো তুলনা নেই।  এই যেমন মাতৃত্বের হাহাকারকে মূর্ত করে তুলতে ‘মানুষের বাচ্চা’ গল্পে তিনি লিখেছেন, ‘কাঁচা রাস্তার ধুলো উড়িয়ে গাড়ি দুটোর গোঁ গোঁ আওয়াজে পেছন থেকে তার কথা কেউ শুনতে পেলো না। তবে গাড়ির ভিতরের তিনজন হয়তো পেল, না পাওয়ার কারণ নেই, জানালার কাছে মুখ নিয়ে গলা চড়িয়ে বলেছে। কিন্তু একে তো কাচের ওপাশে অন্ধকার, বাইরে থেকে কিছু দেখা যায় না, আর কথা কানে গেলেও ভেতর থেকে যদি কেউ কিছু বলেও থাকে, ঝিলমির মা শুনবে কী করে! নাকি শুনেছে?’
ওয়াসি আহমেদের গল্প বলার এই ভঙ্গি নিজস্ব। ‘কার্নিভাল’ গল্পটিতে এই ভঙ্গি যেন আরো স্বকীয়, আরো আসামান্য হয়ে ওঠে। এই গল্পে সালাম মিরধা কিছুতেই বুঝতে পারছিল না, সে নিজে না পুলিশ ফাঁড়ির চ্যাংড়া দুজন পুলিশ কে বেশি বেকায়দায় পড়েছে। তার কেইসটা কী সেটাও সালাম মিরধা বুঝে উঠতে পারছিল না। একটা সময়ে তার বিস্ময়ের সীমা থাকে না, কারণ সে টের পায় তার নিজের পকেটের খবর সে না জানলেও পুলিশসহ রাস্তাঘাটের মানুষ ঠিকই জানে। পুলিশের কাছে ধৃত হয়ে ‘কেইস খায়’ সালাম মিরধা; এ এক আশ্চর্য কার্নিভাল। গল্পটি পড়তে পড়তে পরিষ্কার বুঝতে পারি, এদেশের কিছু মানুষ একপ্রকার উৎসবই পালন/যাপন করে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা নিয়ে। 
‘নতুন খেলা’ গল্পে বাচ্চাদের সঙ্গে ভিন্নধর্মী এক খেলায় অংশ নিতে গিয়ে মোর্শেদ অদ্ভুত এক বিভ্রমের ভেতরে পড়ে যায়। এই খেলার খেলোয়াড়েরা লুকোচুরিতে অংশ নিলেও খেলার নিয়মকানুন বুঝে উঠতে মোর্শেদকে বেগ পেতে হয়। শেষ পর্যন্ত কী হয়, কীভাবে পরিত্রাণ পায় সে তা পড়তে গিয়ে শিউরে উঠতে হয়। 
এই বইয়ের উল্লেখযোগ্য আরও দুটি গল্প হলো ‘সহচর’ ও ‘হত্যাকাণ্ড যেভাবে ঘটার কথা সেভাবেই।’ ‘সহচর’ গল্পে পথ চলতে চলতে জামিলের মনে হয় কেউ তার পিছু নিয়েছে, আবার এক ব্রিফকেসওয়ালাও তাকে দেখে ছুটতে থাকে। কে কাকে কেন তাড়া করছে তা খুঁজতে গিয়ে জামিলের মতো ধাঁধায় পড়তে হয়। ‘হত্যাকাণ্ড যেভাবে ঘটার কথা সেভাবেই’ গল্পে হত্যাকাণ্ডটি আদৌ কীভাবে ঘটে, স্বপ্নে নাকি বাস্তবে তা নিয়ে পাঠককে ধন্দে পড়তে হয়।
নির্লিপ্ত আর কিছুটা একরোখাভাবে মানুষের জটিল মনস্তত্ত্ব, সামাজিক অসঙ্গতি আর ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমকে কটাক্ষ করে গল্প বলে গেলেও গল্পকার ওয়াসি আহমেদ গল্পের ভেতরে পাঠককে ঢোকাতে থাকেন সুকৌশলে, এমনকি তিনি পাঠককে দম নেওয়ার জন্য গল্পের ফাঁকে অনেকটা ‘স্পেস’ দেন তাই ‘সহচর’ কিংবা ‘হত্যাকাণ্ড যেভাবে ঘটার কথা সেভাবেই’ গল্পে অনায়াসেই লিখে ফেলেন এমন বাক্য-‘কাঁচির কিচকিচের সাথে তারা নিজেদের সঙ্গে বেদম বাতচিত চালায়’, ‘আগে ফুলকপি দেখলেই মনে হইত শীত আইসা পড়ছে। আইজকাইল আগাম ফলায়, শীতের সোয়াদ ফুলকপিতে মিলে না। শুনে সাইফুল ভাবল শীতের স্বাদ কী জিনিস, আবার ফুলকপিতে!’
এই যে সরল, সরস বাক্য নির্মাণ করছেন গল্পকার, এর মাধ্যমে তিনি কিন্তু পাঠককে তার লেখার সঙ্গে একাত্ম করে তুলছেন আর পাঠক নিজের অজান্তেই গল্পের জটিল সব মোড়ে ঢুকে পড়ে ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠছেন আখ্যানের সঙ্গে তার সকল ‘অন্তরঙ্গ দূরত্ব।’
‘অন্তরঙ্গ দূরত্ব’ গল্পে সাজ্জাদ আর তমাল কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেদের মধ্যকার দূরত্বটা ঠিকঠাক কাটিয়ে উঠতে পারে না। দুই বন্ধুর জটিল মনস্তত্ত্ব সম্পর্কের দূরত্ব ছাপিয়ে পরস্পরের অন্তরঙ্গতাকে নিগুঢ় করে তোলার বদলে কোথায় যেন অনেকটা ফাঁক রেখে দেয়। হয়তো দুজনের সামাজিক অবস্থান এই দূরত্ব পরিমাপের নিয়ামক হয়ে ওঠে। তবে গল্পের অভ্যন্তরে ঢুকতে ঢুকতে পাঠক ধরতে পারেন শুধুমাত্র দুই বন্ধুর মধ্যকার অন্তরঙ্গ দূরত্বের গল্প নয় এটি, এই গল্পের ভেতরেও ভিন্ন এক গল্প আছে। 
‘শিশিযাপন’র গল্পগুলো পড়তে পড়তে আবিষ্কার করি, গল্প বলার কায়দা অনেক। শ্লেষাত্মক ঢঙেও খুব জটিল কোনো বিষয়কে গল্পের ছকে বেঁধে ফেলা যায়। এসব গল্প আদতে পাঠককে স্বস্তি দেয়ার জন্য লেখা না, পাঠকের বরফজমাট ভাবনায় চির ধরাতেই যেন গল্পকার এক একটি গল্প ফেঁদেছেন।
বই: শিশিযাপন
ধরন: গল্পগ্রন্থ
প্রচ্ছদ শিল্পী: সব্যসাচী হাজরা
প্রকাশনী: কথাপ্রকাশ
মলাট মূল্য: ২০০
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১২৬
প্রকাশকাল: ২০২২

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>