| 20 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক

ইরাবতী ধারাবাহিক: কদমতলি (পর্ব-২০) । শ্যামলী আচার্য

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

 

       “চাঁদা তুলে বই ছাপালেই সেটাকে মুভমেন্ট বলে না। লিটল ম্যাগাজিন একটা অন্য আবেগ। যা বুঝিস না, তা’ নিয়ে এত কথা বলিস কেন?”

       শুভ্রাংশু অনেকক্ষণ তর্ক করেছে। রজতের শেষ কথাটির পরে থেমে গেল। শত হলেও বয়স্ক মানুষ। দীর্ঘ সময় গলা ফাটিয়েও একে বাগে আনা মুশকিল। কেউ কেউ থাকেন, না-মানা টাইপ। তারা কিছুতেই কিছু মানতে চান না। তার রজদ্দা ওই ক্যাটেগরির। 

       কেউ কেউ আছেন, মেনে নেন না হয়ত, কিন্তু মানিয়ে নেন। অর্থাৎ কিছুক্ষণ ঘোঁত ঘোঁত করেন, তারপর চুপ। গোমড়া মুখ। স্পিকটি নট। বাধ্য হয়ে মানছেন বোঝাই যায়। কেউ আবার যুক্তি তর্ক নিয়ে এগোন। কাজেই তাদের সঙ্গে কথা বলে আনন্দ। সব পক্ষের মতামত শুনে ধীরেসুস্থে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছন।

       এল সি অফিসে বিকেলের দিকে কাজের কথার চেয়ে হই হই বেশি হয়। রজতদা, যাকে সকলে শর্টকাট করে রজদ্দা বলে, তাঁর গলাই ওই সময় শোনা যায় বেশি। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি পৌঁছলে কী হবে, গলার জোরে আর দাপটে একডজন কুড়ির ঝাঁককে চুপ করিয়ে দিতে পারেন।   

       শুভ্রাংশু কলেজের কালচারাল সেক্রেটারি। সম্প্রতি সে একটি দেওয়াল পত্রিকা শুরু করেছে কলেজে। নাম দেওয়া হয়েছে ‘স্পন্দন’। তলায় একটা হার্টবিটের গ্রাফিক্স হাতে আঁকা। সংগঠন এসব চাইছে। আরও ছেলেমেয়েদের নিয়ে এসো। ইনভলভ করো। এক ছাতার তলায় আনো। মাসে মাসে একটা দেওয়াল পত্রিকা দিয়ে শুরু হোক। এর পরে না হয় বছরে এক-দু’বার ছাপা পত্রিকার কথা ভাবা যাবে। আগে ছিল। কবে কীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে, কারও মনে নেই। সিনিয়ররাও এড়িয়ে যান। ওই কংরেসি গুণ্ডা, নকশাল আমল ইত্যাদি বলে গুলিয়ে দেওয়া হয়।

দেওয়াল পত্রিকা নিয়ে খুব তোড়জোর চলছে। জুলাই মাসে নতুন সেশন। ভর্তি নিয়ে হইচই শুরু হয়ে যাবে। তার আগেই ম্যাগাজিনটা রেডি হয়ে যায় যেন। নতুন ছেলেমেয়েরা এসে একটা উদ্যোগ দেখবে। ফ্রেশার্স ওয়েলকাম উপলক্ষে আবার কিছু লেখা পাওয়া যাবে। কে কে লিখবে, কে কী লিখবে, কে আঁকবে সব নিয়ে তুমুল গজল্লা চলছিল কয়েকদিন ধরে। কার হাতের লেখা ভালো সেটা খুঁজতেই গেল কয়েকদিন। ভালো হাতের লেখা আর ভালো লেখার হাত তো একসঙ্গে পাওয়া যায় না। অথচ কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের লিখতে বললেই এই বয়সে ধুপধাপ করে লেখা জমা পড়তে থাকে।

কয়েকদিন ক্লাস রিপ্রেজেন্টেটিভরা ক্লাসরুমে একটু মুখে মুখে জানিয়েছিল। ইউনিয়ন রুমের বাইরে একটা বড়সড় লেটারবক্সের মতো বাক্স রাখা হয়েছিল। ওপরে লেবেল লাগানো ‘স্পন্দন’। লেখা জমা নেওয়ার জন্য রাখা। দিন কয়েকের মধ্যে সেটা উপচে পড়ছে। ছেলেমেয়েরা ঠাসাঠাসি করে কাগজ গুঁজে দিয়ে যাচ্ছে। যারা ওই বাক্সে ঠেসে কাগজ ঢোকাতে পারছে না, জায়গা পাচ্ছে না, তাদের নিয়ে ঝামেলার শেষ নেই। তারা কেউ উত্তেজিত হয়ে, কেউ কাঁচুমাচু মুখে ইউনিয়ন রুমে ঢুকে শুভ্রাংশুকে খুঁজছে। শুভ্রাংশুর জামার পকেটে প্রতিদিন গোছা গোছা কবিতা। হ্যাঁ। কবিতাই বেশি। ছোট বড় মাঝারি, দুঃখের সুখের বর্ষার শীতের বিরহের প্রেমের প্রতিবাদের… শুধু কবিতা।

       শুভ্রাংশু সময় পেলেই বসে বসে আজকাল কবিতা পড়ে। অন্যের কবিতা। নানান নাম। সেকেণ্ড ইয়ারের বাংলা অনার্স থেকে প্রায় সবাই দিয়েছে। সায়েন্সের পাস কোর্সে বায়ো সায়েন্সে লেখকের পরিমাণ বেশি। জীবন বিজ্ঞানে জীবন সাহিত্যের সঙ্গে একেবারে জড়িয়েমড়িয়ে আছে। শুভ্রাংশু কিছু বাতিল করে, ছিঁড়ে ফেলে দিতে মায়া লাগে। সাইকেলে করে বাড়ি ফেরার সময় আলতো করে উড়িয়ে দিয়ে যায় বাড়ির পাশের বন্ধ কারখানায়। কিছু ফাইলে গুছিয়ে রাখে। ফাইলের ওপর লেখা ‘মনোনীত’। সব পড়তে ইচ্ছেও করে না। সব পড়াও যায় না। অসুবিধে হয়। ক্লান্ত লাগে। আর তাছাড়া প্রায় সমবয়সী বা এক-দু’বছরের ছোটদের কবিতা পড়ে মনোনয়ন করাটাও খুব মুশকিল।


আরো পড়ুন: কদমতলি (পর্ব-১৯) । শ্যামলী আচার্য


       কফি হাউসে নিয়মিত যাওয়া আসা শুরু করেছে সে। টুকটাক আলাপ হয়েছে লিটল ম্যাগাজিনে লেখালেখি করা মানুষজনের সঙ্গে। বেশ কয়েকজন সম্পাদকের সঙ্গে আজকাল আড্ডা হয়। প্রত্যেকেই যথেষ্ট বয়স্ক। এদের অনেকের মধ্যেই শুভ্রাংশু বয়সে একেবারে কাঁচা। সে শুধু শোনে। অনেক কিছু শোনে। তারাই বলেন, লিটল ম্যাগাজিন কী, লিটল ম্যাগাজিন কেন। লিটল ম্যাগাজিন একটা আন্দোলনের নাম। একটা সংগঠিত উত্তেজনা। কিছু আবেগের বহিঃপ্রকাশ। অনেকটা পরীক্ষানিরীক্ষা। প্রচুর নতুন লেখার সুযোগ। ছক ভাঙার সাহস। ফর্ম বদলানোর চেষ্টা। সপ্তাহে একদিন অন্তত কফি হাউসে না গেলে তার আজকাল ভালো লাগে না। কত রকম আলোর খোঁজ পায় সে। কড়া কালো ইনফিউশনের গ্লাসে মিলেমিশে যায় স্বপ্ন।

       সত্যি কথা বলতে কি, এল সি তে বসে পার্টির ক্লাস না করে তার কফি হাউসে এসে আড্ডা মারতে ভালো লাগছে আজকাল।

দেওয়াল পত্রিকার জন্য জমা দেওয়া কবিতার গোছা হাতে নিয়ে একদিন বলেই ফেলল জয়দীপকে। “কী করি বল তো? এত কবিতা!”

জয়দীপ হেসে ফেলল, “এত কবি কেন?”

শুভ্রাংশু হাসতে হাসতেই তাকায়। “এ’ও এক কবিরই কথা।”

       “কত বিরক্ত হলে একজন কবি এমন বলতে পারে বল তো?,” জয়দীপ চোখ নাচায়, “বেছে আর কী হবে শুভ্রাংশু, লটারি করে ফেল বরং।”

       “মানে?”  

       “মানে আর কী, যেটা হাতে উঠে আসবে, সেটাই সাঁটিয়ে দে। বাকিদের বলবি, মনোনয়ন চলছে। দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। ওয়েট করো। সময়মতো সব বেরোবে। পরের সংখ্যায়…”

       “ধুত্তেরি। সকালে কলেজে ঢোকা ইস্তক লোকে হাতে কাগজ গুঁজে দিয়ে যাচ্ছে। শালা, চিনি না, জানি না…”

       “মেয়েরাও দিচ্ছে? দ্যাখ কোনও লাভ লেটার এল কীনা,” জয়দীপ হাসতে থাকে।

       “তুমি আর হাওয়া দিও না তো জয়দীপ,” শুভ্রাংশু রেগে গেলে সকলকে ‘তুমি’ বলে, “একে মরছি নিজের জ্বালায়, লাভ লেটার। ফুঃ।”

       “ইকিরে! তুই লাভ লেটারকে দুচ্ছাই করছিস! কী কাণ্ড! নাঃ তোকে কাল্টিভেট করতে হচ্ছে।”

       “আরে দূর দূর, লাভ বলে কিছু নেই। সব লস, সব ক্ষতি।”  

       শুভ্রাংশু-র ভুরু কুঁচকোনো। জয়দীপ ওর ব্যথা বুঝতে পারে। মনে পড়ে যায়। মাস ছয়েক আগেই বেচারা প্রেমে পড়েছিল। নীরব প্রেম। সোচ্চার নয়। দূর হতে তোমারেই দেখেছি আর মুগ্ধ ও চোখে টাইপের প্রেম। ফোঁস ফোঁস করে খানিক দীর্ঘশ্বাস ফেলে গুচ্ছের সিগারেট-বিড়ি পুড়িয়েও শুভ্রাংশু সাহস করে রঞ্জনাকে কিচ্ছু বলতে পারেনি।

       রঞ্জনা ফার্স্ট ইয়ার। কমার্স। শুভ্রাংশু ইতিহাস। আর্টস। অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। একই বিল্ডিঙে ক্লাস। দেখাসাক্ষাৎ হয়। শুভ্রাংশু ইউনিয়নের কালচারাল ইত্যাদি পোস্ট মুখের সামনে ঝুলিয়ে গম্ভীর হয়ে ঘোরাফেরা করে। আর বিকেল হলেই লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস।

       রঞ্জনা আজ তাকায়নি। রঞ্জনা আজ পাত্তা দিল না। রঞ্জনা আজ অন্যদিকে মুখ করে গল্প করছিল। ওর বাঁ গালের ওপর রোদ্দুর পড়ে কী অসম্ভব ভালো দেখাচ্ছিল। রঞ্জনার চিবুকের খাঁজটা কী সুন্দর। রঞ্জনা শুধু ওর দিকে একবার তাকালেই গ্রীষ্মের দুপুরে বিলের জলে সাঁতার কাটার কথা মনে পড়ে। শান্ত স্নিগ্ধ। আরাম আর আরাম। 

       সব বন্ধুরা এবার অতিষ্ঠ।

       ওরে তুই এবার কিছু বল। সকলেই শুভ্রাংশুকে ঠেলছে। আচ্ছা, তুই না বলতে পারিস, আমরা তবে গিয়ে বলি।

কমার্স সেকশনের কতজনকে উত্তম ডেকেডুকে নিয়ে এল ইউনিয়ন রুমে। প্রত্যেকের সঙ্গে আলাপ পরিচয় বাড়ানো দরকার। কাকে কখন কীসে লাগে। ক্যান্টিনে রোজ হল্লার মধ্যে রঞ্জনাকে দেখা যেতে লাগল টুকটাক। তবু শুভ্রাংশুর মুখ বন্ধ। কিচ্ছু বলে না। ওকে খোঁচালেই বলে, “সব কিছুর একটা সময় আছে। যখন তখন যা খুশি তাই করা যায় না। এটা একটা গোটা জীবনের ডিসিশান…” একটা এই, একটা সেই জাতীয় হ্যানাত্যানা অজুহাত করে কাটিয়ে দিল বেশ কয়েক মাস। 

শুভ্রাংশু সমস্ত সম্ভাবনাকে কড়া হাতে সামলাতে সামলাতে হঠাতই একদিন খবরটা পাওয়া গেল। ক্লাসে রঞ্জনা জানিয়ে দিয়েছে, পার্ট ওয়ানের পরেই ওর বিয়ে। সব ঠিকঠাক। পাত্র ব্যবসায়ী। পাত্রের বাবা আর ওর বাবা ছেলেবেলার বন্ধু। সেই কোন ছোটবেলা থেকেই তারা নিজেদের ছেলে-মেয়ের বিয়েথা ঠিক করে নিশ্চিন্তে আছেন। তারা সাবালক হলেই চার হাত এক করে দিয়ে নিশ্চিন্তে তীর্থধর্ম করবেন। দুই পরিবার মিলেই অপেক্ষা করছেন সেই শুভ মুহূর্তের।

শুভ্রাংশু চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল একদম। এমনিই শান্ত। আরও যেন গুটিয়ে নিয়েছিল নিজেকে। গম্ভীর মুখে হাঁটা চলা করত। কমার্সের ডিপার্টমেন্টের দিকে পারতপক্ষে ঘেঁষত না। প্রচণ্ড মন দিয়ে ক্লাস নোটস টুকল ক’দিন। এল সি’তে গিয়ে বসে থাকত বিকেল হলেই। এদিক ওদিক লেখা পাঠাতে শুরু করল।

‘স্পন্দন’-এর কাজ আসাতে বেঁচে গেছে শুভ্রাংশু। কিছুটা সময় তো কাটছে।

একটার পর একটা ভাঁজ করা কাগজ খুলে খুলে দেখছিল শুভ্রাংশু। একটা হাতের লেখায় চোখ আটকে গেল। মুক্তোর মতো উপমাটা বড্ড একপেশে। ছাপার অক্ষর একদম। সাদা কাগজে একছাঁদে ফেলা কতগুলো ছবি যেন।

নাম লেখা আছে শ্রীপর্ণা সেনগুপ্ত। বায়োসায়েন্স পাস। রোল নম্বর বাহান্ন।

কিছুতেই মুখটা মনে করতে পারল না শুভ্রাংশু। উত্তমকে জিগ্যেস করতে হবে।

         

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত