| 20 এপ্রিল 2024
Categories
এই দিনে গল্প পুনঃপাঠ সম্পাদকের পছন্দ সাহিত্য

ইরাবতী এইদিনে: শ্যামল গঙ্গ্যোপাধ্যায়ের গল্প রস

আনুমানিক পঠনকাল: 14 মিনিট

ভাদ্র শেষ হয়ে আশ্বিন শুরু। এখন বেলা চারটে সাড়ে চারটে। গত দু’তিন মাস বৃষ্টি দিয়ে দিয়ে আকাশটা একদম ফ্যাকাশে। এখনও সূর্য ডোবেনি। তবে আলো নরম হয়ে আসছে। হাবুল পাল আলে আলে ঘুরে জমিতে ভিজে ভাবটা আছে কিনা দেখছেন। একদম খটখটে শুকনো হয়ে গেলে যাও বা দুটি ধান ফলার কথা—তাও ফলবে না। একটু পরেই তো রোদ মুছে গিয়ে আকাশটাকে অন্ধকার করে তুলবে। বছরের এই সময়টায় আকাশে একখানাও মেঘ আসে না।
সাহেবপুর, রায়পুর, দ্বারিকপোতা, মৌভোগ—পরপর সব মৌজা। আসলে এগুলো হল গিয়ে এক একটা মাঠের নাম। মৌজা ম্যাপে আর লোকের মুখে মুখে এইসব নাম ঘোরে বলে হাবুল পাল প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে জন্মে তক এই নামগুলো শুনে আসছেন। 
আলে দাঁড়িয়েই শেয়ালদা যাবার লোকালের হুড়দুড় করে এসে পড়া টের পেলেন তিনি। ওখান থেকে ট্রেন দেখা যায় না। মাঝখানে কোম্পানি আমলের বাঁধ পিঠ উপুড় করে পড়ে আছে। তারপরে খাল। খাল পেরোলে ইটখোলার কেটে নেওয়া মাটির গর্তে এই বর্ষার জল গলায় গলায়। শেষে হোগলাবন। তারপরেই ট্রেন লাইন। স্টেশন। প্ল্যাটফর্মের মাথায় করোগেটের ঢেউ। ইলেকট্রিক ট্রেনের গম্ভীর ভোঁ। 
বিকেল আর সূর্য ডুবে যাওয়ার মাঝখানে খানিকটা সময় সূর্য থেকে নরম আলো আসে। সেই আলোয় হাবুল পাল ধানের গোছা হাতে নিয়ে থর থর করে কেঁপে উঠলেন। পায়ের নীচে বর্ষকালের নরম আল এখন শুকিয়ে পাথর। নইলে এখন বেঢপ ফুলো ফুলো লম্বা মানুষটা কেঁপে উঠেই পা সমেত নরম আলে খানিক গেথে যেতেন। 
ধানগাছের গোছ তো ভালো। কিন্তু ভেতরে ভেতরে পোকা লেগে ধানের গর্ভথোড় প্রায় সবটাই খেয়ে ফেলেছে। তাই ধানের ছড়া পড়লেও ভেতরে দুধ নেই। দুধ থাকলে এবার সেসব শক্ত হয়ে চাল হয়ে যেত। হাবুল পাল তার আট বিঘের দাগটায় তাকিয়ে বুঝতে পারছেন—শুধু গোছই সার—নয়তো ধান প্রায় সবটাই চিটে। এই মাঠের ধান হলুদ হয়ে পেকে উঠলে তা কাটবার মজুরি পোষাবে না। শুধু হয়রানি। আল ছেড়ে হাবুল পাল কোম্পানি বাঁধে উঠে বসে পড়লেন। কম মেহনত যায়নি এই আটবিঘেয়। সেই সঙ্গে পয়সা। সার, ওষুধ—সব নগদে কেনা। তারপর লোক করে দেবারা নিড়েনিতেও গেছে অনেক। এখন ফল বলতে কিছু খড়। বেশি ফলনের ধানের খড় আবার গরুর মুখে রোচে না। 
কলকাতা থেকে ডাউন লোকালখানা এসে প্রায় পাখির মতো উড়ে পালাল। আরেকটু এগিয়ে আমতলা-বারুইপুর-ঘটকপুকুর বাসরাস্তার ওপর হাবুল পালের বাড়ি। উঠোনে গাই-গরুর জাবনা দেওয়ার চাড়ি বসানো। পেছনে পুকুরের গায়ে হালের বলদের ছাউনি, গোয়াল। বিচি রাখার লাউটি চালের ওপর এখনও তত হলুদ হয়নি।
চাষের শুরুতে এসব মাঠ সারাদিন লোকে লোকে জ্যাস্ত থাকে। আবার ধান পাকলে মাঠ লোকে ভরে যায়। এই সময়টাই সারা তল্লাট শুধু খাঁ খাঁ করে। পরেপ্পর মৌজা ধানচারায় ভরাট হয়ে আছে। বহুদূরে মৌভোগ মৌজার শেষে মৌভোগ গায়ের গাছগাছালির ওপর আকাশ গিয়ে শেষ। আকাশের কিনারায় গাছপালার ভেতর কুড়েঘর, ধানের গোলা।
মাঝে মাঝে তাল গাছ। নিকাশি ভেতর-খালের পাড় ধরে খেজুর গাছ। আর রেলের নামি জায়গা—পঞ্চায়েতের খাসরাস্তার গা ধরে এলোপাথাড়ি নানান গাছ। পাখিদের কাণ্ড । কোথায় কোন ফল খেয়েছে—তার দেনা কোথায় ফলে গেছে—তার কোনও ঠিকঠিকানা নেই। সেই থেকে গাছ। সেই গাছ থেকে আবার ফল। বেশিরভাগই খেজুর গাছ। অনেক গাছের আবার নাম জানে না কেউ। 
রোজ ভোর রাতে উঠে হাবুল পালের মনে হয়—সাহেবপুর, রায়পুর, দ্বারিকপোতা, মৌভোগ—এসব জায়গা ফের বুঝি নতুন করে জন্মাল। রোদ ওঠার আগেকার ফিকে হয়ে আসা অন্ধকারে। এই মাত্র। যে অন্ধকারও গেল—মৌজা মাঠগুলোও জন্মাল। অথচ তিনি তো জানেন—এরা কতকালের মাঠ। কতকালের মৌজা! সেই সমুদ্র সরে গিয়ে ডাঙা জেগে ওঠার সময় থেকে। 
খালের ওপারে ইটখোলার গর্তে জলভর্তি বুকের সামনে একেবারে গা ঘেঁষে বসে থাকা আস্ত একখানা গাছ যেন এইমাত্র উঠে দাঁড়াল। বাবা—? 
খালের ওপার থেকে হাবুল পাল বললেন, কিরে খোকা ? এখনও ওখানে বসে ? উঠে আয়— 
মন বলে বাবা—গলদার মিনগুলো এই দেড়মাসেই ডাগরটিই হয়ে উঠল— 
আত জলে টের পেলি কী করে? অ্যা? ইটখোলার গর্ত সে তো মহা গভীর— 
জানা থাকলি টের পাওয়া যায় বাবা ? জলের ধারে ধারে ডাড়া তুলে রোদ খাচ্ছিল কটা গলদা। এমন বোকা—বলে তার খোকা ওরফে শ্যাম পাল হো-হো করে হেসে উঠল। ভারি গলার সে-হাসি গড়াতে গড়াতে একদম ডিসস্ট্যান্ট সিগনালে। ডাড়া ধরে টানতেই একদম চ্যাংদোলা হয়ে উঠে এল বাবা—একটা গলদা একখানা পঞ্চাশ টাকার নোট বাবা! 
বলিস কিরে? ছেড়ে দিসনি? 
হ্যাঁ বাবা। ছেড়েই দিলাম। এক একটা দু’শো শ’দুশো গ্রাম হয়ে এল বোধহয়—চাই কি চারশো সাড়ে চারশো গ্রামে মুটিয়ে যাবে। 
আমার ইদিকে ধানের দশা শেষ। 
ছাড়ো তো বাবা। ধান ধান করে মরলে। ধান আবার একটা কারোবার নাকি। ভাগ্যিস ইটখোলার গর্তগুলো লিজ নে ছিলাম। এবার বাবা গলদায় গলদায় ভর্তি হয়ে যাবে সব গর্ত-
সব ধান চিটে হয়ে গেল খোকা। মাঠসুদ্ধ শুধুই খড়। 
ধান দিয়ে কী হবে বাবা। মা নেই। দুটো মোটে পেট আমাদের। তাও আমি এবেলা ওবেলা দু’বেলাই রুটি খাই। দেখো বাবা যদি সব কটা ছানা বড় হয়ে ওঠে—তুমি আবার এসব কথা রেলবাজারে গিয়ে গাবিয়ে বেড়িও না। 
নারে খোকা! আমি আর রেলবাজারে যাই কোথায়! এখন তো ডাগরটি হয়ে তুই-ই রেলবাজারে জুতোর দোকানে, পালানের সারের দোকানে বসে গল্প মারিস। কথা বলতে বলতে হাবুল পাল দেখলেন—তিনি তার জোয়ান ছেলে শ্যাম পালকে আর দেখতে পাচ্ছেন না। বাপ বেটা দু’জনেই লম্বা চওড়া। কয়েক বছর আগেও হাবুল পাল চুটিয়ে পঞ্চায়েত করতেন। তখন পঞ্চায়েতে এখনকার মতো অ্যাতো পয়সা ছিল না। সালিশীতে বসতেন। সবাই তার বিচার মেনে নিত। খুব ট্যারা বলে বাদী-বিবাদী কেউই মুখ দেখে বুঝতে পারত না—হাবুলদা কার দিকে। 
রেলস্টেশন দ্বারিকপোতা। ডাকঘর দ্বারিকপোতা। মৌজা দ্বারিকপোতা। লোকজনের বসবাস গ্রাম দ্বারিকপোতায়। ইলেকট্রিকের দুটি তার লেভেল ক্রসিং পার হয়ে এপারে আর আসেনি। অনেক কাল আগে শ্যামের মা বেঁচে থাকতে এদিকে নতুন ধানের পয়লা চলন হয়েছিল হাবুল পালের হাত দিয়ে। বি ডি ও অফিসের গ্রাম সেবকের মারফত। গ্রাম সেবকই প্রথম ও তল্লাটে হাবুল পালকে বোরো ধানের চাষে নামাতে পারেন। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে। তাতেই হাবুল পাল কলা গাছ হতে থাকেন। 
তিনি ঠিক হেলে চাষা নন। নামে সই করতে পারেন। পটাশ, ফসফেট, ল্যাদাপোকার জ্ঞান আছে। কখনও কয়লার দোকান করেছেন হাবুল পাল। কখনও বা শ্যামকে বসিয়ে রেলবাজারে হাবুল পাল কিশলয়ও বেচেছেন। এখন সন্ধের পর খবর শোনেন। একটা কালো ট্রানজিস্টরে। টিভি কেনেননি। বিড়ি টানেন। বুঝে উঠতে পারে না—ঠিক কতদিন বাঁচতে হবে। বুঝতে পারলে তিনি সেইমত ঘরের চাল সারাতেন—আট বিঘের দাগটায় পরিমাণ মতো সই সই ধান দিতেন। এখন সব হিসেব তার কেমন গোলমাল হয়ে যায়। জীবনটা যে কতদূর?—কতখানি ? তা ঠিক বোঝা যায় না। 
ও বাবা শ্যাম ? কোথায় গেলি ? আর যে দেখা যাচ্ছে না— 
হাবুল পালের এসব কথা খাল পেরিয়ে ওপারে পৌছাল না। দূরে ঘটকপুকুরের বাস যায়। ভ্যান রিকশায় আশ্বিনের পয়লা বিয়ের পর পা ঝুলিয়ে বসে। এখন বেলা বড়। তবু ইটখোলার জলভর্তি গর্ত, হোগলা বন, পাটিঘাসের বন ঝোপের আড়ালে পচিশ ছাব্বিশ বছরের শ্যাম পাল হারিয়ে গেল। ছেলেটার কোনও ভয়ডর নেই। বাতিল ইটখোলা আসলে গোখরোর আড়ত। মানুষ যায় না। ওরা ওখানটায় নিজের জায়গা ভেবে চলাফেরা করে। তার ভেতর মানুষ পা দিলে খুব রেগে যায়। নিজের বুদ্ধিতেই শ্যাম কয়লার কারবার করতে করতেই জলে ভরাট গর্তগুলো একটার পর একটা জমা নিল। গলদার মিন ছাড়ল। … 
পড়ন্ত রোদে খালপাড়ে মোটা পাটির ঘাসের ফাঁকে মাটি দেখা যায়। এখানে মাটির গা একদম কালো। খালে নেমে গিয়ে হাবুল পাল দেখেছেন, জলের সঙ্গে গা লাগানো মাটিও কালো। তার ভেতর দিয়ে ওপরকার নানা বনঝোপের শেকড় দাড়ি হয়ে বেরিয়ে। 
হাবুল পালের নীচে হেটো ধুতি। ওপরে ফতুয়া। কিন্তু শ্যাম পালের গায়ে ধুতির ওপর ফুলশার্ট। কবজিতে হাতঘড়ি। হাবুল পাল স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন, খোক গলদার বাড় দেখতে উবু হয়ে জলের ধারে বসে। চাওড়া কাঁধ। মাথাটা ঘন কালো। পায়ের পাম্প সু ভারি লম্বা চওড়া। শরীর উবু হয়ে বসায় তার ওজনে ঘাস মাটিতে ডেবে বসে যাচ্ছে। জলভরাট ইটখোলার গর্তে নীলচে পিঠ নিয়ে এই বুঝি বড় একটা গলদা ভেসে উঠল। চোখের পলক নড়ছে না শ্যাম পালের। 
হাবুল পাল বুঝতে পারে না—তিনবিঘের ভদ্রাসন, দুখানা পুকুর, রেলবাজারে কয়লার দোকান, ধান—তারপর আবার জুটিল গলদা চিংড়ি—এসব কি খোকা সামলাতে পারবে ?
 তিনি বুঝতে পারছেন—যে মাটির ওপর তিনি দাঁড়িয়ে আছেন—তাতে ধান ফেললে চাল হয়—তার জলভর্তি পুকুরে পোনা ছাড়লে রুই কাতলা—ইটখোলার জমা নেওয়া জলে গলদার মিন ফেললে সবুরে চাই-কি তিন চারশো গ্রামের বড় চিংড়ি হয়। এই মাটির গায়ে আপনা আপনি ফলে থাকা ঘাস খেয়ে গরু দুধ দেয়। আবার ল্যাদা পোকা গর্ভ থেকে থোড় খেয়ে ফেললে ধানে দুধ আসে না। চাল হয় না। পুকুরের জলে শ্যাওলা না জন্মালে পোনা বাড়ে না। মাথা মোটা ডিগডিগে কাতলারা ঘুরে বেড়ায়। ইটখোলার জলভরাট গর্তে অঢেল পোকামাকড়—তাই খেয়ে গলদার মিন তিন-চার মাসে গায়ে গতরে মুটিয়ে যায়। আন্দাজে অতখানি জলার জমা নিয়ে শ্যাম বুদ্ধির কাজ করেছে। আমার চেয়েও অনেক তাড়াতাড়ি এই পৃথিবীটা চিনতে শিখেছে। তাই তো মনে হচ্ছে হাবুল পালের। মাথার মাঝখানে পুরনো সিথির জায়গায় ক’গাছা মোটে চুল। বাকিটা ফাকা। ট্যারা চোখ দুটি দূরের দিগন্তে ফিট হয়ে আছে। এই পৃথিরীর ভেতরটা যে শাসে-জলে—যে জানে—সে-ই শাঁস খায়—জল খায়। শ্যাম ঠিক ধরতে পেরেছে। 
আমরা মাহীনগরের পাল। মাহীনগর এখান থেকে আরও তিন ক্রোশ ভেতরে। ধানক্ষেতের ওপর দিয়ে যেতে হয়। আজও কোনও রাস্তা হয়নি। আমার বাবা সেখান থেকে দ্বারিকপোতায় উঠে আসেন। বডড কষ্টে জন খাটতেন। কোনদিন কোনও আমোদ করতে পারেননি বাবা। দ্বারিকপোতা স্টেশনে মাল বয়ে দিতেন ব্যাপারীদের। আমিও বয়েছি ছোটবেলায়। 
এইসব ভাবনা মাথার ভেতর দিয়ে যাতায়াত করছে যখন তখন হাবুল পাল বিড়বিড় করে বলে উঠলেন, পৃথিবীর ভেতরটা যে শাসে-জলে—ভেতরে মানুষের জন্যে এত রস তা আমি তখনই টের পাই—চাষ-আবাদ, গাইগরু, বৃষ্টি দেখে দেখে —বলতে বলতে হাবুল পাল সাহেবপুর, রায়পুর, দ্বারিকপোতা, মৌভোগের ধোপেমাঠের দিকে তাকিয়ে খিক খিক করে হেসে ফেললেন। খুব তৃপ্তিতে। কোনও সাক্ষী না রেখে। যদিও তার এবার ধান হয়নি। তবুও । খালের ওপারেই গলদারা বাড়ছে। সব সময়। 
হাসি গিলে ফেললেন হাবুল পাল। যতদূর চোখ যায়—ততদূর ধান চারার গোছ। বিকেল প্রায় শেষ। এর ভেতর সাহেব ? 
মাথায় হালকা টুপি, কোট প্যান্টালুন—একজন সাহেব মৌজাগুলোর নিকাশী ভেতর খালের উচু পাড়ে ভেসে উঠল। রীতিমতো চমকে গেলেন হাবুল পাল। তিনি কিছুতেই মেলাতে পারছেন না। এখানে সাহেব আসবে কোথেকে? আকাশ থেকে পড়ল নাকি? আর সাহেব এগিয়ে আসছে কেমন? যেন এ তল্লাটের সব জায়গা তার চেনা জানা। নয়তো আমন করে আল ধরে ধরে কেউ এগিয়ে আসতে পারে? 
হাবুল পাল নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাড়িয়ে। ধানক্ষেতের ওপর এতক্ষণ সাহেবের কোমর অব্দি দেখা যাচ্ছিল। এবার সাহেব ক্ষেত ডিঙিয়ে নাবাল জায়গায় পড়লেন। এবার তার পুরোটা দেখা গেল। মাঝারি লম্বা। বয়স কিছু হয়েছে বোধহয়। একটু ঝুঁকে হাঁটছেন। মৌভোগের দিককার মাঠের ভেতর দিয়ে সাহেব কোথেকে আসছেন? এদেশে তো কানও সাহেব নেই। কোনও কুলকিনারা করতে পারলেন না হাবুল পাল।
সাহেব তখন একটা খেজুর গাছের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। খুব মন দিয়ে তিনি গাছটাকে দেখছেন। হাবুল পালের মনে হল—সাহেব গাছটাকে ঘাড় কাত করে যেন চোখ দিয়ে মাপছে। এদিকে সাহেব আসে না সে কতকাল। ইংরেজ চলে যাওয়ার পরেও দু’একজন এসেছে। তবে তারা রেলের, না, অন্য কোনও ব্যবসার তা জানে না হাবুল পাল। একটা গির্জে আছে রেলবাজার ছাড়িয়ে দক্ষিণ পাড়ায়। কঘর বাঙালি খ্রিস্টান থাকেন সেখানে। তা সে বড়দিনের সময় ওখানে বিলিতি পাদ্রি আসতেন আগে। এখন যারা আসেন তারা সবাই এদেশি। আশ্বিন মাসের বিকেলে দ্বারিকপোতায় জলজ্যান্ত সাহেব। তাজ্জব ব্যাপার! দূর থেকে হব যে তারই দিকে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে এগিয়ে আসছে। 
হাবুল পাল একবার তার পেছনে তাকালেন। নাঃ ? তার পেছনে তো ফাঁকা খালপাড়। হাত দশেকের ভেতর এসে পড়ল সাহেব। মাথার ওপর দিয়ে একঝাক পাখি তাদের বাসার দিকে সাঁ সাঁ করে উড়ে গেল। 
নোমোস্কার হাবুলবাবু— 
হাবুল পাল পাল্টা হাত তুলে নমস্কার করতে ভুলে গেলেন। বুঝতে পারছেন—একেবারে লালমুখো গোরা সাহেব নয়। তবে রংটা ফর্সা। ছাইরঙের কোট প্যান্টালুন। জুতো-প্যান্টালুনের পা মাঠের শুকনো ধুলোয় সাদা। 
অনেক কষ্টে হাবুল পালের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, নমস্কার। আপনি আমায় চেনেন? 
আপনি তো হাবুল পাল। বাসরাস্তায় ওই তো আপনার বাড়ি— 
পেছন ফিরে আঙুল দিয়ে ঠিক ভদ্রাসনই দেখাল সাহেব। নারকেল গাছ। বাড়ি। পুকুর। হাবুল পাল তো হতভম্ব। তার মুখে কোনও কথা সরছে না। দেখে বোঝা যায় লোকটা বাঙালি নয়। আবার গোরাও নয়। দিব্যি বাংলা বলছে। আর তার নামও জানে। চেনেও । পুলিসের লোক না তো? যদি কোন ক্ষতিও করে দেয়! 
অবাক হবার কিছু নেই। আমার বেঙ্গলে আছি দুশো বছর। আমরা পারসি। এসব মাঠ-ঘাট আমার সব চেনা। এদিকে আসেন নাকি মাঝেমাঝে ? 
আমি দু’বছর তিন বছর পর পর একবার করে আসি। সব জায়গায় তো সারা জীবনেও পৌছানো যাবে না। একবার এসে আপনার বাড়িটা চিনেছিলাম। আপনাকে দেখিয়ে কে একজন বলেছিল—ওই তো হাবুল পাল। ওটা ওনারই বাড়ি। 
দু’বছর তিন বছর অন্তর একবার আসে। আমাকে দূর থেকে চিনিয়ে দিয়েছিল কে? একবার দেখেই, নাম চেহারা ভোলেনি। নিৰ্ঘাৎ পুলিসের কোনও বড় টিকটিকি। 
আপনার নামটা জানতে পারি কি ?
নিশ্চয়। নিশ্চয়। এতক্ষণে একবার আমার নিজেরাই বলা উচিত ছিল। আমরা পারসি। আমি হলাম গিয়ে—হিড়জিভাই প্রেস্টনজি মরিশাসওয়ালা—আমার ঠাকুর্দার বাবা মরিশাস গিয়েছিলেন। ভাগ্য ফেরাতে। 
কী ? 
অতবড় নাম মনে রাখতে পারবেন না হাবুলবাবু। আমাকে প্রেস্টনজি বলেই মনে রাখবেন। আমরা দুশো বছর কলকাতায় আছি। লালবাজারের পেছনে রাধাবাজারে আমার ঠাকুর্দার ঠাকুর্দার বাবা বাড়ি করেন। মরিশাস থেকে ফিরে—সেই থেকে আমরা মরিশাসওয়ালা। 
তবু একটা সন্দেহের খোঁচ লেগে থাকে হাবুল পালের মনে। সন্ধে হয়ে আসছে। রেল প্ল্যাটফর্মের মাথায় আকাশ লালে লাল। কলকাতায় আরেকখানা ট্রেন গেল। হাবুল পাল জানতে চাইলেন, তা ঘুরে ঘিরে এদিকে আপনাকে আসতে হয় কেন? মরিশাসটা কোন দিকে ? 
মরিশাস অনেক দূরে একটা দ্বীপ। এখন একটা দেশ হাবুলবাবু। ঘুবে-ফিরেই আসি আমি হাবুলবাবু। দুপুরবেলা তো এই রোদে ঘোরা যায় না। বিশেষ করে এই সময়ে। শীতকাল হলে আলাদা কথা। তখন দুপুরে ঘুরতেই মজা। 
এসব কথায় আরও ঘাবড়ে গেলেন হাবুল পাল। এই মাঠেঘাটে বনবাদাড়ে ঘুরতে কোনও মজা আছে নাকি! আশ শ্যাওড়ার জঙ্গল। উলু ঘাসের বন। তিনি প্রেস্টনজির মুখে তাকিয়ে থাকলেন। কথাটি না বলে। 
হিড়জিভাই প্রেস্টনজি মরিশাসওয়ালা হাবুল পালকে কিছুটা আশ্বস্ত করতে চাইলেন। – তিনি বুঝতে পারছেন—হাবুলবাবু সন্ধের মুখে কোনও থই পাচ্ছেন না। অবিশ্যি এখনও আলো আছে। একটা বাতাস দিল।
 প্রেস্টনজি বললেন, এই তো আজ দুপুরে কলকাতা থেকে মোটরে বেরলাম। সিধে বারুইপুর থেকে ঘটকপুকুরের রাস্তা ধরে আড়ংঘাটায় এসে নেমেছি এই ঘণ্টা দুই আগে। 
তারপর?—বেশ অবাকই হয়েছেন হাবুল পাল। কলকাতা থেকে মোটরে এলে তো দ্বারিকপোতায় সিধে আসা যায়। তা না করে দ্বারিকপোতা পেরিয়ে আড়ংঘাটা গিয়ে নামা কেন ? বিশেষ করে দ্বারিকপোতা যখন আসতেই হবে? তিনি কিছু বুঝতে পারছেন না। প্রেস্টনজির সবটাই যেন ধাধা। মাথার টুপিটা খুলে তিনি বা হাতে নিয়েছেন। কাচাপাকা চুল। তার চেয়ে প্রেস্টনজি বছর পাঁচ দশের বড়ই হবেন। এই বয়সে এমন আবোল-তাবোল ঘোরা কেন ? পাগল নয়তো ? 
প্রেস্টনজি বললেন, আড়ংঘাটায় গাড়িটা রেখে ড্রাইভারকে বললাম, দ্বারিকপোতায় গিয়ে অপেক্ষা করো স্টেশনের কাছে। তারপর এই ঘণ্টা দুইয়ে মাঠঘাটের ভেতর দিয়ে সাত আট মাইল তো হেঁটেছি। – 
হাবুল পাল প্রেস্টনজিকে একদম বুঝতে পারলেন না। দ্বারিকপোতার খালপাড়ে এই বিকেলবেলায় একজন পারসি সাহেব। কোট প্যান্টালুন গায়ে। হাতে টুপি। বয়স হয়েছে। পরিষ্কার বাংলায় কথা বলছেন। তারপর পড়তি দুপুর থেকে সন্ধে অব্দি বনবাদাড় ভেঙে হাঁটাই বা কেন? লোকটা এখানে কেন? এখানেই বা দু’তিন বছর হাবুল পালের ঘাবড়ে যাওয়া মুখ অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে। সন্ধের আবছা আলো থেকে তা ডাঙায় তোলার মতো করে প্রেস্টনজি বললেন, বড়সড় ঝড় হলেও আমি ঝড়ের পরদিন ভোর ভোর এসব জায়গায় ঘুরে যাই। 
দুপুরবেলা মাঠ ভেঙে হাঁটা? তারপর আবার বড়সড় ঝড় হলে প্রেস্টনজির এদিকে ঘুরে যাওয়া ? ঝড়ের সঙ্গে কিসের সম্বন্ধ ? ওঃ! আর পারা যাচ্ছে না। এখন যদি শ্যাম পাশে থাকত। সে আর আবার কোথায় সেঁধোল? হাবুল পাল শান্ত গলায় বললে, বাংলাটা ভাল শিখেছেন— বাঃ! আমরা তো বাঙালিই। বলতে পারেন পারসি বাঙালি। দুশো বছরে বিলকুল
বাঙালি হয়ে গেছি। আমার পড়াশুনো পোলক স্ট্রিটে এক বাঙালি স্কুলে। আমার ঠাকুর্দার ফিজিসিয়ান ছিলেন ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়— 
কোন বিধান রায়?
বাঃ! চিফ মিনিস্টার—মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। জানেন তো। 
জানি। আপনারা তাহলে বড়লোক খুব!—ভয়ে ভয়েই বলে ফেলেন হাবুল পাল। 
না না। বিধানবাবু সবাইকেই তো দেখতেন। আমরা সাধারণ লোক হাবুলবাবু। 
ঠাকুর্দার বাবা কলকাতায় ছটা তাড়িখানা খোলেন। সেই সুবাদেই এখানে ঘুরে যাওয়া আমাদের। আমার বাবাও আমারই মতো ঘুরে যেতেন। ছোটবেলায় কয়লার ইঞ্জিনে কাঠের ট্রেনে তা পঞ্চাশ বছর আগে বাবার হাত ধরে আমি প্রথম এদেশে আসি। সেই থেকে এদিকে ঘুরে ঘুরে আসছি। আসছিই— 
দেখুন প্রেস্টনজি সাহেব। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। চলুন। আমার বাড়ির বারান্দার বসে আপনি এক পেয়ালা চা খাবেন। অনেক পথ হেটেছেন। 
তা হেঁটেছি। চলুন— 
ঘটকপুকুর-দ্বারিকপোতার রাস্তায় কেরোসিন কুপি বুলিয়ে সাইকেল ভ্যান। যেসব হেলে বলদ গোহাটায় বিক্রি হয়নি—তারা সার দিয়ে ঘরে ফিরছে এখন। এদের চাপা গলা—ঠেলাঠেলি করে দল বেঁধে হাঁটার শব্দই আলাদা। হাবুল পাল চেনেন। ঘরে ফিরলে এদের বড় হেনস্থা। 
প্রেস্টনজি মাটির দাওয়ায় কাঠের জলচৌকিতে বসলেন। হাবুল পাল কেরোসিন পড়ে আছে। আকাশ থেকে জ্যোৎস্নাগোলা আলো। হাবুল পাল জানতে চাইলেন, ছ ছটা তাড়িখানা? বলেন কি? দেখাশুনো করাও তো কঠিন ছিল আপনার ঠাকুর্দার বাবার পক্ষে—অত লোক তাড়ি খেয়ে মাতলামি জুড়ে দিলে— 
নাঃ ! বলছেন কি? লোকজনই চালায়। মাস মাইনে পায় তারা। একসময় কলকাতায় আশিটা তাড়িখানা গজিয়ে ওঠে। তার ভেতর আরও তিনখানা ছিল আমার ঠাকুর্দারই—বেনামায়। 
চায়ের জল ভুগ ভুগ করে ফুটছে। তার ভেতরেই হিড়জিভাই প্রেস্টনজি মরিশাসওয়ালা ফের কথা বলে উঠলেন, আগে নাকি আমাদের নামের শেষে লেখা হোত নওরোজি। ঠাকুর্দার ঠাকুর্দার বাবা মরিশাসে যান নতুন ব্যবসা করতে। ফিরে এলেন কলকাতায়। একদম দেনদার হয়ে। তখনই খুব সম্ভব পাওনাদারদের হাত থেকে বাঁচতে নওরোজি থেকে মরিশাসওয়ালা হয়ে যান তিনি রাতারাতি— 
হাবুল পাল চা ছাকছেন আর মনে মনে ছবি একে নিচ্ছেন। কলকাতায় লালবাজারের পেছনে দুশো বছরের বাস। বিধান ডাক্তার দেখতেন ওনার ঠাকুর্দাকে। ছ’ ছ’খানা তাড়িখানা চালান। তাছাড়া তিনখানা বেনামায় —ভাবতে ভাবতে চায়ের পেয়ালা এগিয়ে দিয়ে হাবুল পাল জানতে চান, এত তাড়ি? 
আগে তো আরও বেশি লাগত। এখন সবটাই দ্বারিকপোতা থেকে যায়। 
ভোরবেলার ট্রেনে কামরা বোঝাই দিয়ে পিপে পিপে তাড়ি—
ওসবই কি আপনাদের যায় ? না না হাবুলবাবু। কলকাতায় তো আরও অনেক তাড়িখানা আছে। তাদের পিপের।
সঙ্গে আমাদের পিপেগুলোও যায়। এই তো এবার শীত পড়লে কিছু গাছ কাটা হবে। খেজুর তাড়ি শুরু হয়ে যাবে। গরম ভোর চলবে তালের তাড়ি— – 
হাবুল পালের চা খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। এত তাড়ি ? কত গাছ তাহলে ? 
সে-ই সব গাছই তো ঘুরে ঘুরে দেখতে বেরই। মানুষের বসানো গাছ আর কটা হাবুলবাবু? পাখিরা খেজুর খেয়ে খেয়ে ইচ্ছেমতো দানা ফেলেছে—তাতে যেখানে সেখানে গাছ জন্মেছে। সেইসব গাছ আমাদের জমা নেওয়া। 
জমা নেওয়া ? বলেন কি। 
– হ্যাঁ। ঠিকই বলছি। ঠাকুর্দার বাবার স্কুলের বন্ধু ছিলেন কেলভিন সাহেব। পরে তিনি গোটা চব্বিশ পরগনার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিষ্ট্রেট হন। কেলভিনই ঠাকুর্দার বাবাকে শ’তিনেক খেজুর গাছ—আশিটা তালগাছ পাইয়ে দেন—সদর আলিপুরে নিয়ে গিয়ে। 
তিনশো ? বলেন কি? . 
হ্যাঁ। আরও আশিটা তালগাছ। সবই বনে বাদাড়ে। ঠাকুর্দার বাবা ঘুরে ঘুরে গাছগুলো সনাক্ত করান। 
অ্যাতো গাছ সনাক্ত করা ? 
হ্যাঁ। মাঠে মাঠে ঘুরতে হয়েছে অনেক। সে-আমলে নাকি সব গাছে তিনি দাগ দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। 
কী বলছেন প্রেস্টনজি! 
ঠিকই বলছি হাবুলবাবু। মৌজার পর মৌজা পায়ে হেঁটে হেঁটে সনাক্ত করা খুবই কঠিন কাজ। পাখিদের তো মাথার ঠিক নেই কোনও। ফল খেয়ে যেখানে সেখানে দানা ফেলাই ওদের স্বভাব। ইউনিয়ন বোর্ডের খাতায় গাছের পাশে নাম উঠে গেল—হুরমুশজি প্রেস্টনজি মরিশাসওয়ালা— 
হ্যারিকেন ধরাতে ধরাতে হাবুল পাল জানতে চাইলেন, তিনি কে? বাঃ! এই তো বললাম—আমার ঠাকুর্দার বাবা—। ওকি—হ্যারিকেন ধরাচ্ছেন কেন ? ধরাব না ? – 
না। এই তো বেশ আছি। হাওয়া দিচ্ছে। চাদের আলো এ দেশের কত কত মৌজায় যে ঘুরলাম সারাটা জীবন। খেজুর গাছের সুবাদে। তালগাছের সুবাদে। 
– বলুন প্রেস্টনজি—পাখিদের সুবাদে। 
হ্যাঁ হ্যাঁ। ঠিকই বলেছেন হাবুলবাবু। দ্বারিকপোতা তো রেল স্টেশনের গায়ে। ভাবুন তো কোথায় সেই চন্দনেশ্বর। পশ্চিম কণিকা। খয়রামারি। নীলগঞ্জ। 
ওরে বাবা! এসব নাম তো আমি কোনওদিনই শুনিনি। সে সব জায়গা কোন দেশে? 
হাবুল পালের একথায় কিছু গৰ্বই হল হিড়জিভাই প্রেস্টনজি মরিশাসওয়ালার। তিনি একগাল হেসে বললেন, তবে? সবই এই চব্বিশ পরগনায়। কত মজা সারা দুনিয়ায়। কত রস। কত মানুষ। কত গাছ। ঠাকুর্দার বাবার আমলের গাছগুলোর বয়স হয়ে গেছে। তারা একে একে ছুটি নিল। 
ছুটি নিল? 
হ্যাঁ। সবাইকে আমি দেখিনি। মাটির ভেতরে শেকড় চালান করে দিয়ে ওপরে রস দিতে দিতে তারা তো একদিন বুড়ো হবেই হাবুলবাবু। 
তা তো নিশ্চয়। খুবই ন্যায্য কথা।
ঠাকুর্দার বাবার ডাইরিতে যেসব মৌজায় যেসব গাছের কথা পেয়েছি—সরেজমিনে তাদের অনেককেই খুঁজে পাইনি। 
কেন ? 
বুড়ো হয়ে ক্ষয়ে গিয়ে ভেতরে মরে গিয়ে—ঘুণ ধরে কবেই তারা একে একে সাফ হয়ে গেছে। একদম গোড়া থেকে। জুলানির জন্য বুড়ো গাছ কেটে নিয়ে গেছে লোকে। রস দেয় না। ফল দেয় না। কী কাজে লাগবে আর, বলুন ? খেজুর গাছ—তাল গাছ তো আর মেহগনি গাছ নয়। যে শুধু দাড়িয়ে থাকলেই—বিউটি—শোভা!
 তা তো বটেই।-কথাটা বলে নিজেই হাবুল পাল নিজের ভিতরে একটুংখানি কাঁপে উঠলেন।
প্রেস্টনজি খোলা বারান্দায় জলচৌকির পাশে খালি পেয়ালাটি রেখে আবছা চাদের আলোয় হো-হো শব্দ করে বিটকেলের মতো একটা পারসি হাসি হাসলেন। অবিশ্যি আমাদের বাবার আমলে জমা নেওয়া সব কটা গাছের সঙ্গেই আমার দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে। তারা কেউ কেউ এখন ছুটি নিচ্ছে। আমি নতুন গাছ বেশি জমা নিতে পারিনি। আর গাছগুলো দেখাশুনো করতে গিয়ে কত লোকের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হল। নীলগঞ্জের গোহাটার হাটবাবু ভরত সর্দারের সঙ্গে আপনার কখনও আলাপ হয়েছে? 
নীলগঞ্জে আমি যাই-নি কোনওদিন। কোথায় নীলগঞ্জ তা-ই জানি না। তা কোথেকে ভরত সর্দারের সঙ্গে আলাপ হবে! 
মানুষ ছিলেন বটে একজন ভরত সর্দার। নীলগঞ্জে বিরাট গোহাটা। দুপুরবেলা তেঁতুলগাছের মাঝের ছায়ায় হাট বাসে। গোরু মোষ তো আসতই। দুধের। হালের। তাছাড়াও আশ্চর্যের ব্যাপার—আমি নিজের চোখে দেখেছি—আশিটা পর্যন্ত রামছাগল বিক্রি হয়ে যেতে এসেছে। ভরত সর্দারের থেলো হুঁকোর নারকেলটি এই অ্যাতো বড় ছিল। 
প্রেস্টনজি দুহাতের থাবা বড় করে উঁচুতে ধরে আছেন। থেলো হুঁকোর নারকেল চালের বাতায় কখন এই আধো-অন্ধকারে গুজে রেখে দিয়েছেন। গলায় শক্ত করে বাধা লাল কাপড়ের টুকুরোটাও খোলা সারা। 
অনেকক্ষণ তো বেরিয়েছেন। দুটো ভাত রাধি? 
ভাত ? তা অনেকদিন খাওয়া হয় না। এবেলা পাউরুটি। ওবেলাও পাউরুটি। 
বেশ তো প্রেস্টনজি—বিরহী চাল তুলে রাখা আছে। লালচে মতো। ভাত খুব মিষ্টি হয়। গত সনের চাষের গোটা মসুর ডাল রয়েছে। সেদ্ধ বসাই? দুটি ডাল-ভাত খেয়ে যান। বাড়ির কাগজি নেবু আর র্কাচালঙ্কা ছিড়ে আনছি— 
অনেকদিন পরে হয়ে যাক ভাত ! তা আপনার ওয়াইফ—স্ত্রী—তিনি এই গরমে আবার— 
ও বস্তুটি অনেকদিন হল নেই। তিনি মরে গেছেন। 
এবার প্রেস্টনজি মরিশাসওয়ালা জলচৌকিতে না বসে মাটিতেই বসলেন। দাওয়ার বাইরে পা ঝুলিয়ে। আমার ওয়াইফও অনেকদিন হল নেই। জানেন—বড় ঝড়ের পরদিন সকালে কতবার খয়রামারির ওদিকটায় ছুটে গেছি হাবুলবাবু। জানি তো এলোপাথাড়ি ঝোড়ো হাওয়া খয়রামারি, গলতামারি পিপুলপাতির ওপর দিয়ে সমুদ্রের দিকে ছুটে যায়। –
ঝড়ের আবার পথ আছে নাকি প্রেস্টনজি? 
আছে না? ঠাকুর্দার ডাইরিতে ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যায় যেসব জায়গার ওপর দিয়ে—যে যে রাস্তা দিয়ে–অনেকদিন ধরে দেখা-জানা খবর তিনি একটু একটু করে লিখে রেখে গেছেন তার ছেলের জন্যে—মানে আমার ঠাকুর্দার জন্যে। ঠাকুর্দার বাবা তো তার তাজা বয়সে চব্বিশ পরগনার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট কেলভিনের সঙ্গে ওঠাবসা করতেন—একসঙ্গে লঞ্চে ঘুরেছেন সুন্দরবনের নদীতে নদীতে—শুনেছি শিকারেও যেতেন ক্লাসফ্রেন্ড কেলভিনের সঙ্গে। 
কালবৈশাখী তো বটেই—এই তো দুগ্গাপুজোর কিছু আগে আরেকটা ঝড় আমাদের ইদিকে ঝাপিয়ে পড়ে। ফি বছর—এই তো সময় হয়ে এল। 
তা পড়ে। খয়রামারির ওদিককার গেরস্থ চাষীরা খুব ভাল নারকেল চাষী। সবাই দিঘির পাড় ধরে নারকেল সুপারি বসায়। আর ঝড়ে মাথাভারি নারকেল গাছ আধখানা হয়ে দু’চারটে ভেঙে পড়বেই। পড়লে আমি গিয়ে মাথাগুলো কিনে ফেলি। 
দিয়ে হাবুল পাল জানতে চান, কেন? কেন? 
চুলোর ভেতর শুকনো চালা দাউ দাউ করে জুলে উঠল। সে আগুনের আলোয় ট্যারাচোখো হাবুল পালের মুখখানি আবার স্পষ্ট দেখতে পেল মরিশাসওয়ালা। হাবুল পালও প্রেস্টনজির মুখখানি পরিষ্কার দেখতে পেলেন। দুখান মুখই জায়গায় জায়গায় ভাঙা। মুখ দুখানির সেইসব ভাঙা ভাঙা জায়গার ওপর দিয়ে পয়সা কামানোর মেহনতের ঝক্কি আর তার চাকার দাগ ফেলে গেছে। সংসারের ঝড় ঝাপটার দাগদাগালি দুখানি মুখেই চেপে বসেছে। 
প্রেস্টনজি বলল, নারকেল গাছের মাথাই তো আসল হাবুলবাবু। মাটির ভেতর শেকড় চালান করে সব রস মাথায় টেনে তোলে গাছগুলো। পাতালের জল শরীর দিয়ে ওপরে উঠে কী করে যে ডাব বানায় ! 
আমরা ওকে বলি মাথি। সবুজ খোল দিয়ে গাছ তার মাথি ঢেকে রাখে। ভেতরটা সাদা। কচকচি। বেশি খেলে মাথা ঘুরে উঠবেই— – 
ঠিক ধরেছেন। ওখান থেকেই ডাব বেরোয়। চারপাশ দিয়ে ডেগো ছাড়ে নারকেল গাছ। 
ডেগো কথাটা জানেন দেখছি। – 
জানবো না? বাঃ! গাছ, গাছের রস নিয়ে ক পুরুষের কারবার আমাদের। তা ঝড়ে পড়া নারকেল গাছের ওই মাথিটা আমি স্পটে নগদ টাকায় কিনে ফেলি। খুবই দামী জিনিস তো। 
মাথি কেনেন ? 
হ্যাঁ। মাথি থেকে একরকমের মদ হয়। খুব দামী মদ। আমাদের পারসিদের নওরোজ পরবে সবাইকে ওটা থেকে দিতে পারা—সে এক মস্ত গর্বের ব্যাপার হাবুলবাবু। 
আপনার কটি ছেলেমেয়ে ? 
একটি ছেলে। সে এদেশে থাকে না। 
কোথায়? বিলেতে ? 
– না হাবুলবাবু। সে ফ্যামিলির তাড়িখানার কারবারে আসেনি। সে ফিরে গেছে যেখান থেকে আমরা আটশো বছর আগে ইন্ডিয়ায় এসেছিলাম—সেখানে।
মানে ? এ কি কথা বলছেন প্রেস্টনজি? আপনার পরে এসব দেখবে কে? কোন দেশে গিয়ে সে বসে আছে? 
ওই যে বললাম, যেখান থেকে আমরা আটশো বছর আগে তাড়া খেয়ে ইন্ডিয়ায় এসেছিলাম—সেই ইস্পাহানে। 
ওসব দেশ কোথায় আমি জানি না প্রেস্টনজি। আটশো বছর আগের কথা জানব কী করে? 
একটু হাসলেন প্রেস্টনজি। এখন যাকে বলে ইরান—সে দেশের গায়ে কৃষ্ণসাগর নামে একটা খুব বড় জলকর আছে। ইংরাজিতে বলে ব্ল্যাক সি। 
হবে। 
সেই কৃষ্ণসাগরের একরকমের মাছের ডিমের কারবার করে আমার ছেলে। 
অত দূরদেশে গিয়ে মাছের ডিমের কারবার ? সুখে থাকতে ভূতে কিলোয়! 
কি বললেন? 
নাঃ! কিছু না বলে চুলোর ভেতর কখানা চালা গুজে দিলেন হাবুল পাল। অনেক পয়সার কারবার। কৃষ্ণসাগরে বিদেশিরা বেড়াতে গিয়ে ওই ডিম খুব আদরআহ্লাদ করে খায়। তাতেই পয়সা। ইউরোপ আমেরিকার সাহেবমেমেরা ওই ডিমের জন্য একেবারে ছুটোছুটি করে। আমার ছেলেটা দুনিয়ার এত জায়গা থাকতে ব্ল্যাক সি-র মাছের ডিমেই রস পেল। 
সে তো বিদেশিরা চিংড়ির জন্যেও ছুটোছুটি করে প্রেস্টনজি। তা তো করেই। সারা দুনিয়াই করে। জাপানীদের বড্ড টান হাবুলবাবু এই চিংড়িতে। 
সেই চিংড়িতেই ঝুঁকেছে আমার ছেলে। নয়তো দেখুন না, রেলবাজারে পোজিশন মতো জায়গায় আমার কয়লার ডিপো। এই খালের গায়ে চাষের জমি। তবু— 
দু’জনের মুখেই কথা ফুরিয়ে আসে। বিরহী চাল এবার মিষ্টি একটা সুগন্ধ ছড়িয়ে ভুগ ভুগ করে ফুটতে লাগল। আলোগোলা অন্ধকারে গা জুড়োনো বাতাস। হাবুল পাল ছাড়ো তো বাবা! দুটো মোটে তো পেট আমাদের। 
আমার ছেলেও চিঠি লিখেছে হাবুলবাবু। 
কী লিখেছে ? 
মাঠে ঘাটে গাছ দেখে দেখে বনবাদাড় ভেঙে ঘুরে ঘুরে কী লাভ বাবা! আমার কাছে ব্ল্যাক সি-এর পাড়ে এসে থাকো। সুন্দর জায়গা। আমার বাড়ির সামনে ফলের বাগান—কত ভালো ভালো কথা। আমি ভাবি আমাদের বংশের প্রথম মরিশাসওয়ালা মরিশাসে কী রস পেয়েছিলেন তার প্রথম যৌবনে। 
এক হাতা ভাত তুলে দেখলেন হাবুল পাল। দেখতে দেখতে বললেন, চিংড়ির তো মড়ক লাগে। বড় সুখী মাছ— 
সে তো আপনার ধানেও পোকা লাগে। কোনও কোনও বছর জিরেন কাটের পর কোনও কোনও গাছ যে শুকিয়ে যায় হাবুলবাবু। একবার তো ব্ল্যাক সি-তে আমার ছেলের সেই মাছ এলই না। 
এবারই আমার ধানে পোকা লেগেছে প্রেস্টনজি। সব ধান বরবাদ। 
দেখবেন আবার সামনের বছর ধানে মাঠ ভরে যাবে হাবুলবাবু।
চিন্তা হয় ছেলের জন্য। দামী মাছ। চুরি যেতে পারে। কেউ বিষ দিয়ে দিতে পারে। তাহলেই তো গেল সব। 
চুরি কার না যায়! আমার জমা নেওয়া জোয়ান বয়সী তাজা খেজুর গাছে গজাল মেরে হিং ঢুকিয়ে গাছ মেরে দেয় না? 
গাছ মেরে দেয় ? 
তবে কী? ফাঁকা মাঠে অত গাছ—কে পাহারা দেবে বলুন ? না, পাহারা দেওয়া যায়! ওঃ ! বডড খিদে পেয়ে যাচ্ছে। আপনার এই বিরহী না কী এক চাল বললেন—এর ভাত আমি কোনওদিন খাইনি। 
খেয়ে দেখুন। গতবার দেড় বিঘেয় বিরহী ধান দিয়েছিলাম। তারই চাল। 
ভাত বসানো থেকে ডালসেদ্ধ হওয়া অবধি এই সময়টুকুর ভেতর আরও দুখানি ট্রেন শেয়ালদায় গেল। দুখানি ট্রেন শেয়ালদা থেকে এল। এই সময়টায় কলকাতার ডেলি প্যাসেঞ্জারবাবুরা ঘরে ফেরেন। শেয়ালদায় কোলে মার্কেটে গন্ত করতে যায় একই লাইনের আনাজ ব্যাপারীরা। ফেরে সেই লাস্ট ট্রেনে। 
নিন, এবার গায়ের জামাটা খুলুন। প্যান্টালুন পরে খেতে বসতে পারবেন তো? 
খুব পারব। 
ভাতের গরাস মুখে তুলে হিড়জিভাই প্রেস্টনজি মরিশাসওয়ালা বললেন, আহা! কী মিষ্টি। এমন তো খাইনি কখনও। – 
হাবুল পাল বললেন, আর দু’হাত ভাত—একটু ডাল দিই বরং। নেবু-নঙ্কা পাশেই আছে। দেখেছেন তো। আঃ। হেরিকেনটা বড্ড জ্বালাচ্ছে। যদি আরেকটু আলো দিত।
(শারদীয় বর্তমান ১৪০৪)

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত