| 28 মার্চ 2024
Categories
ধারাবাহিক

ভাষার উপনিবেশ বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস (পর্ব-৩)

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

বাংলা ভাষার উদ্ভব, উনিশ শতকে কলিকাতার সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিতদের দ্বারা সংস্কৃতায়িত বাংলার সৃষ্টি, বাঙালির সংস্কৃতি ইত্যাদি নিয়ে গত দুইশ বছর ধরে পরতে পরতে লেখা হয়েছে মিথ্যা আর ভুল তথ্যভিত্তিক বানোয়াট ইতিহাস। দুইশ বছর  ধরে আমরা  অইসব ভুল বা বানানো ইতিহাস মেনে নিয়ে এর ভিত্তিতেই পুনরায় আমাদের ভাষা আর সংস্কৃতির বয়ান রচনা করে গেছি। আর এভাবে বাংলা ভাষা পরিণত হয়েছে সংস্কৃতের উপনিবেশে। এই প্রথমবারের মত বানানো ইতিহাসের স্তর খুঁড়ে বাংলা ভাষার উদ্ভব ও বাঙালি সংস্কৃতির রদবদলের আদত ইতিহাস উদঘাটনের চেষ্টা চালিয়েছেন উত্তর উপনিবেশী তাত্ত্বিক ফয়েজ আলম তার “ভাষার উপনিবেশ: বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস”বইয়ে।

ফয়েজ আলম ঐতিহাসিক ও ভাষাতাত্ত্বিক তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে দেখিয়েছেন ‘বাংলা ভাষা সংস্কৃতের কন্যা’ এটি সচেতন চেষ্টায় তৈরি একটি মিথ্যা বয়ান, যে মিথ্যা রচনার পিছনে কাজ করেছে ধর্মীয় আবেগ ও উপনিবেশি প্রশাসকদের প্রশ্রয়। আসলে সংস্কৃত এবং বাংলা দুটো ভাষাই এসেছে স্থানীয় ভাষা থেকে (যাকে প্রাকৃত ভাষা বলা হয়ে থাকে)। প্রাচীনকালে ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে (বর্তমান পাকিস্তানের অংশ বিশেষসহ) প্রচলিত স্থানীয় ভাষাকে কিছু নিয়মে বেঁধে দেন পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডির বাসিন্দা পাণিনি নামের এক পন্ডিত; সেটিই পরে ধর্মচর্চা আর ধর্মীয় লেখাজোকায় কাজে লাগানো হয় আর সংস্কৃত ভাষা নাম পায়। এটি কখনো কোনো মানবগোষ্ঠির মুখের ভাষা ছিলো না। একই সময়ে আমাদের দেশে প্রচলিত স্থানীয় ভাষা মানুষের মুখে মুখে স্বাভাবিক রদবদলের নানা ধাপ পার হয়ে ৬৫০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি বাংলা ভাষার আদি রূপ নেয় । সংস্কৃতের সাথে বাংলার কোনো সরাসরি সম্পর্কই নাই। অথচ দুইশ বছর ধরে ভাষার ইতিহাসে আর পাঠ্য বইপুস্তকে বাংলা ভাষাকে সংস্কৃতের মা বানিয়ে রাখা হয়েছে। এরকম অনেক বানোয়াট ধারণা ভেঙ্গে দিয়েছেন ফয়েজ আলম ভাষার উপনিবেশ বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস এই ধারাবাহিকে  আজ থাকছে পর্ব- ৩।


 

প্রাকৃত হতে সংস্কৃতের উদ্ভব এবং ‘সংস্কৃতশব্দে উনিশ শতকীয় ধর্মীয় রাজনৈতিক আবেগ

আরেকটি প্রশ্ন এখানে তোলা জরুরী। সেটি হলো পাণিনীই প্রথম পরিশোধিত বা সংস্কারকৃত অর্থে সংস্কৃত কথাটি ব্যবহার করেন তার অষ্টাধ্যায়ী গ্রন্থে। কিন্তু ভাষা বোঝাতে তিনি শুধু ‘বাক’ বা ভাষা শব্দটি ব্যবহার করেন। আর নির্দিষ্ট  ভাষা বোঝাতে সংস্কৃত শব্দের ব্যবহার আরো অনেক পরে, খুব সম্ভবত ১২ শতকে লিখিত রামায়নের সুন্দরকান্ডে। অথচ সুকুমার সেন ও পরেশচন্দ্র মজুমদার খ্রি. পূ. বারো শতকে অর্থাৎ আরো প্রায় আড়াই হাজার বছরের পুরোনো ভাষাকে ‘কথ্য সংস্কৃত’ নামে অভিহিত করতে চান কেন? যে ভাষাকে বেদের নামানুসারে বৈদিক ভাষা নামে উল্লেখ করা হয় ভাষাতাত্ত্বিক আলোচনায় তাকে সংস্কৃত নাম দেয়ার দরকার কোথায়? এ প্রয়োজন অনেকটাই ধর্মীয় আবেগের তাড়না মেটানোর সাথে জড়িত। বিষয়টি একটু বিস্তৃতভাবে বলা দরকার।

পাণিনী উদীচী অঞ্চলের প্রাকৃত ভাষাকে নিয়মকানুনের মধ্যে এনে ভাষার নতুন ছাঁচ তৈরি করেন। পরে এ ভাষাতেই প্রথমে ধর্মীয় বইপত্র পরে সাহিত্যও রচিত হতে থাকে। পাশাপাশি জনতার ভাষা অর্থাৎ যা সংস্কৃত ভাষার প্রকৃত উৎস সেই প্রাকৃতেও সাহিত্য রচনা হতো। তবে প্রাকৃত জনসাধারনের মুখের ভাষা বলে নিয়ত তা পরিবর্তিত  হচ্ছিলো এবং ক্রমে অপভ্রংশে পরিণতি হয়ে আধুনিক ভারতীয় ভাষায় রূপান্তরের দিকে আগাচ্ছিলো।  কিন্তু সংস্কৃত ধর্মচর্চা ও মন্ত্রপাঠের ভাষা ছিলো বিধায় এর মর্যাদার সাথে জড়িয়ে ছিলো পবিত্রতা, ঐশ্বরিকতা, রহস্যময়তা, মান্যতা, পরিশুদ্ধতা, শাস্তি প্রভৃতি বিষয়। তা ছাড়া এটি কখনো কোনো মানবগোষ্ঠীর মুখের ভাষা হিসাবে ব্যবহৃত হয়নি। সে কারণে এ ভাষা ছিলো পুস্কনির পানির মত টলটলে, কিন্তু স্রোতছাড়া, তাই পরিবর্তনহীন। ১২ শতকে এ ভাষা সংস্কৃত হিসাবে পরিচিত হতে শুরু করলে এর রচনাবলীও সংস্কৃত ভাষার রচনাবলী হিসাবে অভিহিত হয়, যদিও এর আগে লেখা সংস্কৃত সাহিত্যের পান্ডুলিপি বা পান্ডুলিপি রচনার প্রমাণ আমাদের হাতে নাই। সংস্কৃতের ধর্মীয় মর্যাদা ও মান্যতা ইংরেজ উপনিবেশের শুরুতেও একই রকম ছিলো। সংস্কৃতের প্রতি একই শ্রদ্ধাভক্তি পোষণ করতেন উচ্চ মর্যাদার পুরোহিত থেকে শুরু করে সকল উচ্চশ্রেণির হিন্দু । তাছাড়া শাসনকার্যের ভাষা ফারসি হওয়ায় ফারসির প্রতি কিছুটা ক্ষোভ এবং সংস্কৃতের প্রতি বাড়তি মমত্বও থাকার কথা তাদের মনে।

এই পরিস্থিতে ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড ও উইলিয়াম জোনস যখন ভুল আন্দাজ থেকে বলেন, সংস্কৃত হলো সকল ভারতীয় ভাষার মা-বাপ তখন তারা ভারতীয় উচ্চ শ্রেণীর হিন্দুদের ধর্মের ভাষাকেই বিরাট এক মর্যাদায় উন্নীত করেন। ফলে উচ্চ  শ্রেণীর হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষেরা সংস্কৃতের উন্নীত মর্যাদায় গৌরবান্বিত বোধ করে। এবং তাদের ধর্মীয় ভাষা ভারতের সকল ভাষার ‘মা-বাপ’ আখ্যা পাওয়ায় ধর্মীয় আবেগও তৃপ্ত হওয়ার সুযোগ পায়। সুকুমার সেন বা পরেশ বাবু বা তাদের পূর্বপুরুষের কেউই এই স্বাভাবিক ও আপাত নিরীহ আবেগ থেকে মুক্ত থাকতে পারেন নাই। কিন্তু পরবর্তীতে আবিষ্কৃত নমুনা নিয়ে ভাষাতাত্ত্বিকদের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে আস্তে আস্তে প্রাকৃত ভাষার প্রাচীনত্ব সম্পর্কে এমনসব প্রাসঙ্গিক তথ্যাদি উন্মোচিত হতে থাকে যে, ‘সংস্কৃত সকল ভারতীয় ভাষার মা-বাপ’ জাতীয় সরল দাবী টিকিয়ে রাখা মুশকিল হয়ে যায়। কিন্তু সংস্কৃতকে আর্য অভিবাসনের সর্বপ্রাচীন বিন্দু বৈদিক কালের সাথে মিলাতে পারলে এ সমস্যার সমাধান হয়, এবং সংস্কৃত নামের ঐ ভাষা হতেই প্রাকৃতের উদ্ভব দেখানো সহজ হয়। বস্তুত সুকুমার সেন ও পরেশবাবু এ কারণেই বৈদিক কালের ভাষাকে চিহ্নিত করার কাজেও সংস্কৃত শব্দটি নানা প্রতিকী অর্থে নিয়ে এসেছেন, যদিও সে সময় সংস্কৃত শব্দের অস্তিত্বই ছিলো না। এর ফলে সাধারণ ভাষা ব্যবহারকারীরা সংস্কৃত-এর প্রতিকী ব্যবহারের কথা চিন্তা না করেই এ ভাষার প্রাচীনত্ব মেনে নিবেন। বাস্তবে তাই হয়েছে , জনমনে পাণিনীর ‘সংস্কৃত’ ভাষা প্রাকৃতের চেয়ে প্রাচীন ভাষা এবং প্রাকৃতের উৎস হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। আমরা এই ইচ্ছাকৃত জটিলতা উন্মোচনে সুকুমার সেন ও পরেশ বাবুর সূত্র ধরেই আগাতে পারি, তাতেও সত্যে পৌঁছানো ঠেকবে না।

বৈদিক “আর্যদের ভাষা সাধারণের সঙ্গে ব্যবহারে ব্যাকরণের বহর কমাইয়া যথাসম্ভব শব্দার্থের উপর নির্ভর করিয়া প্রাত্যহিক কাজ চালানোর উপযুক্ত রূপ লইতে”হলে এবং বৈদিক ও সংস্কৃত ভাষায় অন্য ভাষা হইতে “গৃহীত শব্দের অপ্রতুলতা নাই” থাকতে হলে সাধারণ মানুষের ভাষার সাথে আর্যদের ভাষার পার্থক্য থাকা প্রয়োজন। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের ভাষা আর্য ভাষা হতে ভিন্ন হতে হবে, যাকে সুকুমার বাবু বলেছেন ‘অন্য ভাষা’। বাস্তবে সেটি ধরে নেয়াই যৌক্তিক। এর সঙ্গে আমরা যুক্ত করবো সুকুমার বাবুর পূর্বোক্ত বক্তব্যের এই অংশটুকু, “অর্বাচীন বৈদিকের মূলে ছিলো অন্য একটি উপভাষা যে উপভাষা ঋগবেদের ভাষার সঙ্গে ঘনিষ্ঠসম্পর্কযুক্ত কিন্তু যাহার মধ্যে আর্যেতর প্রভাব বেশি প্রকট”। সুকুমার বাবু বার বার ‘অন্য ভাষা’, ‘অন্য একটি উপভাষা’ ‘আর্যতের প্রভাব’ এবং এর প্রভাবে বৈদিক ভাষার বদলে যাওয়ার বিষয়ে রেখে ঢেকে  যে ভাষার কথা বলতে চেয়েছেন সেই ভাষা বা সেইসব ‘আর্যতের’ভাষাই আর্য-বসতি স্থাপনের আগের স্থানীয় ভাষাগুলির প্রতি নিশ্চিত নির্দেশ। সুকুমার বাবুদের কথাতেই তার প্রমাণ রয়ে গেছে। 

আর্যরা যখন ভারতে প্রবেশ করে তখন স্থানীয় অধিবাসীরা নিশ্চয়ই কোনো এক ভাষায় কথা বলতো। আর ভারত বিরাট এক দেশ বলে সেই ভাষার আঞ্চলিক রূপভেদও ছিলো। ঐতিহাসিক ও ভাষাতাত্ত্বিকদের মতে ভারতের বেশির ভাগ অঞ্চলে তখন প্রাধান্য ছিলো দ্রাবিড় ভাষাগোষ্ঠীর। তবে পুব অঞ্চলে বিশেষত  বাংলাদেশে (বৃটিশ আমলের মূল বাংলাদেশ, অর্থাৎ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশসহ) অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষাগোষ্ঠীর মুন্ডা, কোল, সাঁওতালি ইত্যাদি ভাষা প্রচলিত ছিলো মনে করা হয়। প্রথম দফায় অভিবাসনকারী আর্যরা উত্তর-পশ্চিম ভারত ও মধ্যভারত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। আর্যদের পরবর্তী ধাপের অভিবাসন প্রক্রিয়ায় স্বভাবতই আগে আসা আর্যরা বাইরের দিকে চাপ দেয়ার কথা। এর ফলে স্থানীয় অধিবাসীরাও প্রান্তের দিকে সরবে। এর মধ্যে আর্যদের ভাষা এক দফা পরিবর্তিত হয়ে গেছে এবং আর্য ও স্থানীয়দের মিশ্রণ শুরু হয়েছে। এই মিশ্রিত গোষ্ঠীটিই ভারতের পুব দিকে সরে আসে। এরই মধ্যে কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে এদের ভাষা, হয়তো সময়ও পার হয়েছে অনেক। বাংলায় প্রবেশের পর ইতিমধ্যে পরিবর্র্তিত ভাষা স্থানীয় অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষার সাথে মিশে প্রাকৃত ভাষার রূপ পরিগ্রহণ করে। এ কারণে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের প্রচলিত ভাষার সাথে পুবের ভাষার কিছুটা  বাড়তি পার্থক্য আছে। আগতদের ভাষার সাথে মিশে স্থানীয় ভাষার প্রাকৃত রূপের বিকাশের এই কথাটিই সুকুমার বাবু  কোমল করে কোথাও বলছেন সংস্কৃত ও বৈদিক ভাষায় অন্য ভাষা হইতে “গৃহীত শব্দের অপ্রতুলতা নাই”, কোথাও বা বলেছেন বৈদিক ভাষা সাধারণের সঙ্গে ব্যবহারে বদলে গিয়ে কথ্য রূপ নেয়, আরেক জায়গায় বলেছেন অন্য একটি উপভাষার কথা যাতে আর্যেতর প্রভাব প্রকট। অর্থাৎ স্বাভাবিক নিয়মেই যে বৈদিক ভাষা ও স্থানীয়দের ভাষার মিশ্রণে প্রাকৃত ভাষার উদ্ভব হয় এই কথাটি স্বীকার না করে ভিন্নভাবে শুধু উল্লেখ করে গেছেন তিনি। আর এজন্য কথা বলতে হয়েছে রেখেঢেকে, ঘুরিয়ে  পেঁচিয়ে। আর পরেশবাবু সংস্কৃত নামের মধ্যে প্রাকৃতকে হজম করে নেয়ার উদ্দেশ্যে বৈদিকের যুগেই বৈদিকের আরেকটি বৈচিত্র পাশাপাশি প্রচলিত ছিলো বলে দাবী করেন এবং তার নাম দেন ‘কথ্যসংস্কৃত’। এর থেকেই প্রাকৃত ভাষাগুলির উদ্ভব প্রমাণের প্রয়াস পেয়েছেন তিনি। আবার দুজন অকুণ্ঠে স্বীকার করে নিয়েছেন যে খ্রি. পূ. পঞ্চম শতকের পরে কোন এক সময়ে পাণিনী একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলের ভাষার উপর ব্যাকরণের রঙ চড়িয়ে ভাষার ‘পরিশুদ্ধ’ বা সংস্কারকৃত’ বা ‘সংস্কৃত’ নমুনা তৈরি করেন। এটিই কালক্রমে সংস্কৃত নাম পায়। দুজনের আলোচনাতেই এরূপ বহু পরস্পর-বিরোধী মত ও যুক্তি-বিশ্লেষণ রয়ে গেছে।

স্থানীয় ভাষা ও বৈদিক ভাষার মিশ্রণের ফলে প্রাকৃত ভাষা বিকশিত হওয়ার সময় স্থানীয় ভাষাগুলির আঞ্চলিক ভিন্নতা অনুযায়ী প্রাকৃতের রূপও ভিন্ন ভিন্ন হয়। পুবের প্রাকৃতের বৈচিত্রও একটু বেশি। পাণিনী নমুনা হিসাবে নিয়েছিলেন উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের এক বা একাধিক প্রাকৃত ভাষা। সুকুমার সেনের মতে:

আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দে বা তাহার কিছুকাল পরে অদ্বিতীয় বৈয়াকরণ পাণিনী তক্ষশীলার নিকটে (বর্তমান লাহোরের কাছে) শালাতুরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। . . . উদীচী বা উত্তর-পশ্চিমা তখন শিষ্টসম্মত মুখ্য ভাষা ছিল, আর পাণিনী এই অঞ্চলেরই অধিবাসী। সুতরাং তাহার ব্যাকরণে এই অঞ্চলের ভাষাই আদর্শরূপে গৃহীত হইয়াছিল।২২ 

এ বিষয়ে শ্রীপরেশচন্দ্র মজুমদারের মত ভিন্ন। তিনি মনে করেন, “সংস্কৃত বা পাণিনীর ‘ভাষা’ যে একটি বিশেষ অঞ্চলের কথ্য ভাষার উপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছিলো, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। আর পূর্বেই বলেছি, এ ভাষাঞ্চল হলো আর্যাবর্তের মধ্যদেশীয় অঞ্চল (বর্তমান দিল্লী ও আশপাশ)।”২৩  উত্তর-পশ্চিমাই হোক আর মধ্যদেশীয়ই হোক, সংস্কৃত একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলে প্রচলিত প্রাকৃতেরই পাণিনীকৃত পরিশুদ্ধ রূপ। সুতরাং সংস্কৃতের উৎস হিসাবে প্রাকৃতের নামই নির্দেশ করা উচিত। ভাষাতাত্ত্বিক রীতিতে প্রাকৃত ভাষাকে মধ্যভারতীয় আর্য ভাষা নামে চিহ্নিত করা হয়। তাই প্রাকৃত হতে সৃষ্ট সংস্কৃত ভাষা মধ্যভারতীয় আর্য ভাষারই অন্তর্ভুক্ত হওয়া স্বাভাবিক। তাই ভারতীয় জীবিত ভাষাগুলির উৎপত্তি বিষয়ক বয়ান হওয়া উচিত এরকম: আর্যভাষীরা ভারতে প্রবেশের পর প্রাচীন ভারতীয় আর্য ও স্থানীয় ভাষা মিশ্রিত ও একে অন্যের প্রভাবে পরিবর্তিত হওয়ায় এর থেকে  আঞ্চলিক ভিন্নতাসমেত বিভিন্ন প্রাকৃত ভাষা বিকশিত হয়; উদিচ্য অঞ্চলের প্রাকৃত ভাষার পাণিনীর নিয়মে আবদ্ধ লেখ্য রূপ হলো সংস্কৃত। আর অন্যান্য আঞ্চলের প্রাকৃত ভাষার মৌখিক রূপ আরো পরিবর্তিত হয়ে অপভ্রংশের মধ্য দিয়ে আধুনিক ভারতীয় ভাষাগুলি বিকশিত হয়। কাজেই প্রাকৃত একদিকে যেমন সংস্কৃতের, অন্যদিকে তেমনি সকল নব্যভারতীয় আর্যভাষারও উৎস।

এখানে আমরা একটি প্রাচীন ভিন্নমত উল্লেখ করতে চাই। অলংকার শাস্ত্রবিদ হিসাবে খ্যাতিমান কাশ্মিরী পন্ডিত রুদ্রট নবম-দশম শতকে রচনা করেন তার কাব্যালঙ্কার গ্রন্থখানি। এগার শতকে এর তাফসির লেখেন শ্বেতাম্বর জৈন ধর্মাচার্য নামি সাধু। তিনি দাবী করেছেন জৈন ধর্মচর্চার ভাষা অর্ধ-মাগধী প্রাকৃতকে ‘পরিশুদ্ধ’নিয়মকানুনে বেঁধে সংস্কৃত ভাষা তৈরি করা হয়। সংস্কৃতের উদ্ভব সম্পর্কে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্য পাণিনীর নিজের। কিন্তু তার সময়ে সংস্কৃত প্রাকৃত ইত্যাদি নামগুলি প্রচলিত না হওয়ার কারণে তিনি শুধু ‘বাক’ বা ভাষা কথাটি উল্লেখ করেছেন। এর পর নামি সাধুর বক্তব্যই সর্বপ্রাচীন। এরও আটশ বছর পর সুকুমার সেন, পরেশচন্দ্র প্রমুখ ভাষাবিজ্ঞানী প্রামাণ্য সূত্র ব্যতিরেকে কেবল ভাষাতাত্ত্বিক অনুমানের উপর নির্ভর করে নামি সাধুর সাক্ষ্য যে বাতিল করে দিলেন তা কতটা যৌক্তিক? ২৪

আরেকটা কথা। সংস্কৃতের প্রাচীনতম লিখিত গ্রন্থের নমুনা হলো রামায়ন, যার সর্বপ্রাচীন পান্ডুলিপি ১১৬২ খ্রিস্টাব্দে লিখিত অর্থাৎ আটশ বছর আগে বলে আন্দাজ করা হয়। কিন্তু প্রাকৃত ভাষার লিখিত নমুনা আরো অন্তত এক হাজার বছরের পুরান। অশোকের অনুশাসন, সুতনুকা ও খারবেল প্রত্নলেখ, পালি ও বৌদ্ধ (মিশ্র) সংস্কৃত প্রভৃতি প্রাকৃতের লিখিত নমুনা প্রায় দু’হাজার বছরেরও বেশি পুরানা। ৮০০ বছরের প্রাচীন লিখিত নমুনা পাওয়া গেছে যে সংস্কৃত ভাষার তাকে দু’হাজার বছরের পুরান নমুনার প্রাকৃত ভাষার চেয়ে প্রাচীন বলে সাব্যস্ত করা হচ্ছে কিভাবে? ফরাশি গবেষক লুই রেনো এ উদ্ভট অবস্থাটাকে  বলেছেন, “Great linguistic paradox of India”। ২৫ 

প্রাকৃত ভাষার উদ্ভব ও বিকাশের বিবরণ দিতে গিয়ে মধ্য ভারতীয় আর্য নামে প্রাকৃতকে চিহ্নিত করে একে তিনটি স্তরে ভাগ করা হয়েছে। এ বিষয়ে ভাষাতাত্ত্বিকদের মতামত কাছাকাছি। স্তর বিভাগ এমন: (১) প্রথম উপস্তর: ৫০০ খ্রিস্টাব্দ পূর্বাব্দ হতে ১০০ খ্রিস্টাব্দ; নমুনা পাওয়া যায় অশোকের অনুশাসনে, অশ্বঘোষের নাটকে এবং ধম্মপদে। পালি (২) দ্বিতীয় উপস্তর: সুকুমার সেনের মতে প্রথম হতে ৬ষ্ঠ শতক পর্যন্ত বিস্তৃত। নিয়া প্রাকৃত, মহারাষ্ট্রী, শৌরসেনী, অর্ধমাগধী, মাগধী, পৈশাচী, অপভ্রংশ ইত্যাদি। শেষ উপস্তর: খিস্ট্রীয় ৬ষ্ঠ হতে দশম পর্যন্ত।


আরো পড়ুন: ভাষার উপনিবেশ বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস (পর্ব-২)


তবে সময়ের প্রসঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেন ড: মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি মনে করেন দ্বিতীয় উপস্তরের বিস্তার ২০০-৪৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। গৌড়ী প্রাকৃত নামে আরেকটি প্রাকৃতের কথাও বলেন তিনি। দন্ডীর (খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতক) কাব্যাদর্শ থেকে গৌড়ী প্রাকৃতের অস্তিত্বের সপক্ষে প্রামাণ্য উদ্ধৃতিও প্রদান করেন। ড: মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে শেষ উপস্তর ৪৫০ খ্রিস্টাব্দ হতে ৬৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিস্তৃত। এ স্তরে অপভ্রংশ ভাষাগুলির বিকাশ। এরপরই গৌড়ীয় অপভ্রংশ থেকে নব্যভারতীয় আর্য বাংলা ভাষার সূচনা। 

প্রাকৃত ভাষার বিভিন্ন আঞ্চলিক রূপের উল্লেখ করেছেন ড: সুনীতিকুমার সেন, সুকুমার সেন, পরেশচন্দ্র মজুমদারসহ অনেক ভারতীয় ভাষাবিজ্ঞানী। কিন্তুকোন অজ্ঞাত কারণ তাদের প্রত্যেকের বিবরণ থেকে গৌড়ী প্রাকৃত নামে পুর্বাঞ্চলে প্রচলিত প্রাকৃত ভাষার নাম বাদ গেছে। ড: মুহম্ম্দ শহীদুল্লাহ দন্ডীর কাব্যদর্শের সূত্রে তার উল্লেখ করেছেন। গৌড়ী প্রাকৃত পরিবর্তিত হয়ে গৌড়ীয় অপভ্রংশের রূপ নেয়। ২৭টি অপভ্রংশের মধ্যে গৌড়ীয় অপভ্রংশের নামও উল্লেখ করেছেন প্রাকৃত বৈয়াকরণ মার্কন্ডেয়। নবম দশকের আলঙ্কারিক রুদ্রট তার কাব্যালঙ্কারে গৌড়ীয় রীতির উল্লেখ করেন যা সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে স্বতন্ত্র প্রাকৃত ভাষারও ঈঙ্গিত করে।  ড: মুহম্মদ শহীদুল্লাহ লিখেছেন কাহ্ন ও সরহের দোহাকোষ এবং প্রাকৃতপিঙ্গলে গৌড়ী অপভ্রংশের কিছু নমুনা পাওয়া যায়।

ভারতীয় ভাষাগুলোর উপর প্রথম সার্ভে পরিচালনাকারী গ্রীয়ারসন পাণিনীর মাধ্যমে প্রাকৃত থেকে সংস্কৃতের উদ্ভব বিষয়ে যা বলেন তার সাথে বেশ মিল আছে সুকুমার বাবু ও পরেশ বাবুর বক্তব্যে, কিছুটা পার্থক্য কেবল কালগত প্রশ্নে। তারা অষ্ট্যাধ্যায়ীর রচনার কাল পঞ্চম শতক বললেও গ্রীয়ারসন মনে করেন পাণিনী ৩০০ খ্রি. পূর্বাব্দে স্থানীয় ভাষার পরিশুদ্ধ নমুনা তৈরি করেন তার ব্যাকরণ গ্রন্থ অষ্টাধ্যায়ীতে। প্রাকৃত ভাষাগুলির ইতিহাস অনেকটাই সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন তিনি। সংস্কৃতের তুলনায় প্রাকৃত ভাষার প্রাচীনত্ব এবং প্রাকৃত ভাষা হতে ভারতের সকল প্রচলিত ভাষাগুলির জন্মের প্রক্রিয়াটা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি লেখেন:

“প্রাচীন ভারতীয় আর্যের, কিংবা বলা যায় প্রাথমিক প্রাকৃতের উপভাষাগুলির দুটো দল ছিলো: মধ্যদেশ বা আর্যাবতের উপভাষাসমূহ আর এর বাইরের দিকের উপভাষা। মধ্যদেশের প্রাকৃত উপভাষা সাহিত্যের ভাষা হয়ে উঠে, এ ভাষাই ৩০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের দিকে (পাণিনীর মাধ্যমে) পরিশোধিত রূপ নিয়ে সাহিত্যিক সংস্কৃতে পরিণত হয়। অন্যান্য প্রাথমিক প্রাকৃত ধ্বনিতত্ত্বের স্বাভাবিক নিয়মে পরিবর্তিত হতে থাকে এবং মুখের ভাষা হওয়ায় দূরূহ যুক্তাক্ষর ও লম্বা সন্ধিস্বরগুলো সহজ হওয়ার মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় স্তরে পৌঁছে . . .।”২৬ 

তিনি মনে করেন এই দ্বিতীয় স্তরের প্রাকৃত সাহিত্যে ব্যবহৃত হতে শুরু করার পর ব্যাকরণের নিয়মে বাঁধা পড়ে বিবর্তনের প্রক্রিয়া হারায়। কিন্তু তার কথ্যরূপ স্বাভাবিক জীবিত ভাষার নিয়মমাফিক পরিবর্তিত হতে হতে অপভ্রংশে পরিণত হয়। অপভ্রংশেরও একটা সাহিত্যিক রূপ নিয়মে বাঁধা পড়ে। আর কথ্য রূপটি স্বাভাবিক ধ্বনিতাত্ত্বিক নিয়মে পরিবর্তিত হয়ে তৃতীয় স্তরের প্রাকৃতের ধাপ পেরিয়ে আধুনিক ভারতীয় আর্য ভাষাগুলির সৃষ্টি করে। বস্তুত গ্রিয়ারসনের বক্তব্যেই ভারতীয় ভাষাগুলোর উদ্ভবের সত্যিকার পথরেখা এবং কালিক সীমানার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।  

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত