| 29 মার্চ 2024
Categories
সঙ্গীত

ইরাবতী সঙ্গীত: শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ইতিহাস এবং চর্চা । বিনয় দত্ত

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

১.
শাস্ত্রীয় সঙ্গীত হচ্ছে শাস্ত্রের নিয়মাদি মেনে চলা সঙ্গীত। সঙ্গীতকে যে সব নির্দিষ্ট নিয়মের ভেতর দিয়ে চলতে হয় সেই নিয়মগুলো শাস্ত্রে উল্লেখ রয়েছে। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ইতিহাস অনেক পুরানো। বৈদিক যুগ থেকে এই সঙ্গীতের চর্চা চললেও প্রায় দুই হাজার বছর আগে থেকে মন্দিরে সুরের মাধ্যমে স্তোত্র পাঠ করা হত। বৈষ্ণবরা এই স্তোত্র পাঠ করতেন। ধারণা করা হয়, সেই স্তোত্রের সুর থেকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বিকাশ। এই শাস্ত্রীয় সঙ্গীত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, রাগ সঙ্গীত, ধ্রুপদি সঙ্গীত বা শুদ্ধ সঙ্গীত নামে পরিচিত।
একাদশ শতাব্দীতে চালুক্যরা এই অঞ্চলে অভিযানে আসে। চালুক্য সাম্রাজ্য ছিল দক্ষিণ ভারতের প্রাচীন সাম্রাজ্য। এই সম্রাজ্য ষষ্ঠ থেকে বার শতক পর্যন্ত শাসন করেছে। ‘দ্বিতীয় পুলকেশ’ ছিলেন চালুক্য সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ রাজা। তাঁর সময়ে প্রশাসনিক দক্ষতা ও বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রসারে এই সাম্রাজ্যের যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছিল।
সেই সময় চালুক্য সাম্রাজ্যের সাথে বহু কর্ণাটকী পরিবারও এ অঞ্চলে আসেন এবং বসতি স্থাপন করেন। সেন রাজারা কর্ণাটকী পরিবারেরই বংশধর। সেন বংশের হাতে রাজত্ব যাওয়ার পর উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের বেশ প্রসার ঘটে। কারণ তাঁরা ছিলেন সঙ্গীত অনুরাগী। এই অঞ্চলের শেষ হিন্দু রাজা লক্ষণ সেনের সভাকবি ছিলেন ‘জয়দেব’। তাঁর রচিত ‘গীতগোবিন্দ’ একটি প্রাচীন কাব্যগ্রন্থ। গীত গোবিন্দের পদগুলো ছিল প্রবন্ধ শ্রেণীর সঙ্গীত।
১২০১ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর বাংলায় আগমন ঘটে। লক্ষ্মণ সেন পালিয়ে যাওয়ার পরে বাংলায় মুসলমান শাসন ব্যবস্থার সূত্রপাত ঘটে, তখন এই অঞ্চলে সঙ্গীতের ক্ষেত্রে এক নতুন ধারার সৃষ্টি হয়। সেই নতুন ধারা এই অঞ্চলে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বিকাশে ভূমিকা পালন করেছে।
উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত এই ভারত উপমহাদেশে দুটি ভাগে বিভক্ত। হিন্দুস্তানি সঙ্গীত আর কর্ণাটকী সঙ্গীত। হিন্দুস্তানি সঙ্গীত উত্তর ভারতে প্রচলিত যা বাংলাদেশের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত নামেও প্রচলিত এবং কর্ণাটকী সঙ্গীত মহীশূর, অন্ধ্র, মাদ্রাজ ও কর্ণাটক অঞ্চলে প্রচলিত। দুটি পদ্ধতিই বর্তমানে আপন ও স্বকীয়তা নিয়ে অনুশীলিত হচ্ছে।

ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত দুইভাবে পরিবেশিত হয়। কণ্ঠসঙ্গীত এবং যন্ত্রসঙ্গীতের মাধ্যমে। সরোদ, সেতার, সুরবাহার, বীণা, সারোঙ্গী, বাঁশি, বেহালা, সন্তুর, তবলা, পাখোয়াজ, মৃদঙ্গ, তানপুরা, এস্রাজ ইত্যাদি যন্ত্রের মাধ্যমে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত পরিবেশিত হয়। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত বিভিন্ন রাগের মাধ্যমে প্রকাশ পায়।
রাগ শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো মনোরঞ্জন। যে সুরের দোলা মনকে আন্দোলিত করে তাকেই রাগ হিসেবে অভিহিত করা হয়। সাতটি স্বরের চলনে মাধুর্যতা তৈরি করাই হচ্ছে রাগ। ভারতীয় উচ্চাঙ্গ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে সময় ও কাল নির্ভর প্রায় ছয় হাজার রাগ রয়েছে।
এদেশে ছয়টি ঋতু আছে। এ ছয়টি ঋতুকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন রাগ তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে দীপক, মেঘ, ভৈরব, মালকৌশ, শ্রী ও হিন্দোল অন্যতম। রাগের গঠন ও প্রকৃতি অনুযায়ী শাস্ত্রে রাগ পরিবেশনের সময় ও কাল উল্লেখ রয়েছে। যেমন সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা ও রাত। আবার প্রহর অনুযায়ীও ভাগ রয়েছে যেমন প্রথম প্রহর, দ্বিতীয় প্রহর, তৃতীয় কিংবা শেষ প্রহর। আর এই প্রহর অনুযায়ী রাগ পরিবেশন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে নিয়ে গেছে অন্য এক উচ্চতায়। তারই ধারাবাহিকতায় সুরসম্রাট তানসেন কিংবা আলাউদ্দিন খাঁ সঙ্গীতের আধুনিক রূপায়ণ ঘটিয়েছেন।

২.
সঙ্গীত গুরুমুখী বিদ্যা এ কথা সর্বজন স্বীকৃত। তবে সঙ্গীতগুরু সবাই হতে পারেন না। এর জন্য বিশেষ সঙ্গীতগুণ থাকা বাঞ্ছনীয়। একজন শিক্ষার্থী তার বিচক্ষণতা দিয়ে সঙ্গীতগুরুকে জেনে-বুঝে নির্বাচন করেন। প্রায় দুই হাজার বছর আগে থেকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শুরু হলেও বাংলাদেশে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত অত্যন্ত ধীর গতিতে এগিয়েছে। গুটিকয়েক সংগঠন আর অল্প কয়েকজন সঙ্গীতগুরু ছাড়া এদেশে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত তেমন প্রসার লাভ করেনি। বাংলাদেশে যেসব সঙ্গীতগুরু আছেন তাঁদের মধ্যে পণ্ডিত বারীণ মজুমদার, ওস্তাদ মুনশি রইস উদ্দিন, ওস্তাদ আজিজুল ইসলাম, ওস্তাদ আলি আকবর খান, ওস্তাদ নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী ও ওস্তাদ সঞ্জীব দে সহ কয়েকজন গুণীওস্তাদ বা পণ্ডিতদের নাম শোনা যায়।

এঁদের মধ্যে বাংলাদেশে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের প্রচার ও প্রসারের ব্যাপারে পণ্ডিত বারীণ মজুমদারের অবদান অনস্বীকার্য। দেশ ভাগের পর তিনি পাবনায় এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। এরপর থেকেই তিনি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের প্রসারের লক্ষ্যে একটানা কাজ করে গিয়েছেন। ১৯৬৩ সালের ১০ নভেম্বর কাকরাইলের একটি বাসায় ১৬জন শিক্ষক এবং ১১জন ছাত্রছাত্রীর সহায়তায় দেশের প্রথম ‘কলেজ অব মিউজিক’ এর কার্যক্রম শুরু করেন। ১৯৬৮ সালে তিনি ডিগ্রি ক্লাসের সিলেবাস তৈরি করে সংগীত মহাবিদ্যালয়কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজে পরিণত করেন এবং ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিষয়ক পরীক্ষা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০ সালে সংগীত কলেজের তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশে ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটে সংগীত সম্মেলনের আয়োজন করেন। এই সম্মেলনে নাজকোত-সালামত, আমানত-ফতেহ, মেহেদী হাসান, আসাদ আলী খানসহ বহু গুণী শিল্পী অংশগ্রহণ করেন। ধারণা করা হয়, এটিই প্রথম বাংলাদেশে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সবচেয়ে বড় আয়োজন। ১৯৭৩ সালে শিক্ষা কমিশনের অধীন প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের সিলেবাস প্রণয়ন করেন এবং এই কমিটির চেয়ারম্যানেরও দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ‘সংগীত কলি’ ও ‘সুর লহরী’ নামে দুটি পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত চর্চা ও প্রসারের ক্ষেত্রে বারীণ মজুমদার বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম। ২০০১ সালের ৩ অক্টোবর তাঁর মৃত্যুর পর উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সকল প্রসার থেমে যায়।
গুটিকয়েক যে কয়েকটি সংগঠন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চর্চা করে তাদের মধ্যে ঢাকার ছায়ানট সঙ্গীত বিদ্যায়তন, চট্টগ্রামের সদারঙ্গ, নারায়ণগঞ্জের লক্ষাপার, রাজশাহীর হিন্দোল সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, যশোরের ওস্তাদ মোশাররফ হোসেন স্মরণে উচ্চাঙ্গসঙ্গীত সম্মেলন এবং ঢাকায় বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব শুদ্ধ সঙ্গীত প্রচার এবং প্রসারে অনন্য ভূমিকা রেখেছে। এরমধ্যে বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব সবচেয়ে বড় পরিসরে ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বেশ সুনামের সাথে এই উৎসব আয়োজন করেছে। এতে বিভিন্ন দেশের প্রথিতযশা শিল্পী ও পণ্ডিতরা নিজেদের মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন।
বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা শহরে তুলনামূলক সল্প পরিসরে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের চর্চা করা হলেও বেঙ্গল ফাউন্ডেশন এইক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। উচ্চাঙ্গসংগীতের প্রচার ও প্রসারের উদ্দেশ্যে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন ‘বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়’ প্রতিষ্ঠা করে। এই প্রতিষ্ঠানে ধ্রুপদে তালিম দেন পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকর, সরোদে পণ্ডিত তেজেন্দ্র নারায়ণ মজুমদার, সেতারে পণ্ডিত কুশল দাস, খেয়ালে পণ্ডিত উলহাস কশলকর, তবলাতে পণ্ডিত সুরেশ তলওয়ালকরসহ অন্যান্য সংগীতগুরুরা নিয়মিত কর্মশালার মাধ্যমে শিক্ষাদান করেন। সংগীত প্রতিভা অন্বেষণ, মৌলিক জ্ঞান ও শাস্ত্রীয়সংগীতে দক্ষ শিক্ষার্থী গড়ে তোলার লক্ষ্যে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন এই উদ্যোগ নেয়।

৩.
বাংলাদেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সভ্যতা বেশ প্রাচীন। সংস্কৃতির অগ্রগতির পাশাপাশি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন চড়াই উৎড়াইয়ের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গীতের বিকাশ ঘটেছে। এই বিকাশ লাভ আরো সুদূর প্রসারী হতে পারতো, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চর্চায় গুটিকয়েক সংগঠনের নাম না হয়ে আরো অনেক সংগঠন থাকতে পারতো, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে বাংলাদেশে আরো অনেক গুণী সঙ্গীতজ্ঞ, সঙ্গীতগুরুর প্রসার ঘটতে পারতো, কিন্তু হয়নি।
এর কারণ সঠিক সময়ে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে যেসব উদ্যোগ তা নেয়া হয়নি। এই সঙ্গীত বোঝার মতো ভালো দর্শকও তৈরি হয়নি। যারা এই সঙ্গীত চর্চা করতেন তাদেরও ভালো চোখে দেখা হয়নি। ফলে বাংলাদেশে যেভাবে এই সঙ্গীতের প্রসার ঘটার কথা ছিল তা হয়নি।
যে সঙ্গীতের বয়স দুই হাজার বছরেরও বেশি তা নিশ্চয় এমনিতেই মানুষ আঁকড়ে ধরেনি, নিশ্চয় এর মধ্যে এমন শুদ্ধতা ছিল যার কারণে তা যুগের পর যুগ ধরে সঙ্গীত পিপাষুদের মধ্যে বীজ বুনে যাচ্ছে। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সঙ্গীতপ্রেমিদের মূল শিকড়ে নিয়ে যায়, সঙ্গীত অনুরাগীদের প্রাণের কাছে নিয়ে যায়, মানুষের মধ্যে শুদ্ধতা জাগায়, মানবিক মূল্যবোধকে বিকশিত করে, প্রথিতযশা গুণীজনদের কাছাকাছি এসে মানুষ পরম শুদ্ধতার সীমারেখায় পৌঁছায়, গুণী সঙ্গীতজ্ঞদের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা উপঘটনায় মানুষ প্রভাবিত হতে পারে। এককথায় এই সঙ্গীত একদিকে যেমন শুদ্ধ দর্শক তৈরি করে, মানুষের অশান্ত মনকে শান্ত করে তেমনি গুণী সঙ্গীতজ্ঞ ও সঙ্গীতগুরু তৈরি করে। তাই উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের অনেক বেশি মাত্রায় প্রসার এবং চর্চা হওয়া উচিত।

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত