| 20 এপ্রিল 2024
Categories
গীতরঙ্গ

প্রবন্ধ: আমরা সবাই ধৃতরাষ্ট্র । সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

রুডিয়ার্ড কিপলিং তাঁর ‘The Ballad Of East And West’-এ লিখলেন ‘Oh. East is East, and West is West, and never the twain shall meet’ পূর্ব আর পশ্চিমের মিলন সম্ভব নয়। অর্থাৎ প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের ধর্ম, সংস্কৃতি, জীবনযাত্রার সব ধরন, ধারণ, ভাষা, গাত্রবর্ণ বিলকুল আলাদা। এতে আমাদের কলকাতার কি যায় আসে? একটু একটু আসে। আমাদের কলকাতার উত্তর আর দক্ষিণ, মাঝখানে ধর্মতলা। উত্তর উত্তর থেকে এসে, দক্ষিণ দক্ষিণ থেকে এসে ধর্মতলায় মুখোমুখি। অতীতে মুসলমান আমলে জেলায় জেলায় যা হওয়ার হয়েছে। হিন্দু, মুসলমান, বেদ, কোরান, মোল্লা, কাজি, মহামহোপাধ্যায়, আরবি, ফার্সি, টোল, টুলোপণ্ডিত, মক্তব, ইমাম, গাজি। কলকাতা তার জলা, জঙ্গল, শেয়াল, বাঘ, কুমির, সাপ, কাপালিক ইত্যাদি নিয়ে অপেক্ষায় ছিল। কবে হঠাৎ এসে পড়বে ইওরোপের বাণিজ্যপোত। নেমে আসবে বন্দুকধারী। আসবে রাইটার, ফ্যাক্‌টার। নতুন এক ধরনের জমিদার ইংরেজদের পাশাপাশি জাঁকিয়ে বসবে। ল্যান্ডলর্ড নয়, বেনিয়া। ইংরেজরাও বেনিয়া। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তাদেরই তৈরি মুৎসুদ্দি, বেনিয়ান, জগৎ শেঠ, উমিচাঁদ, রাজবল্লভ, নবগোপাল, শেঠ, বসাক, লাহা, মল্লিক, ঘোষ, বোস, মিত্তির। কিছুটা অঞ্চল সুতানুটি, কলকাতা, গোবিন্দপুর। কিলকিলা থেকে কলকাতা? নাকি প্রশ্নোত্তর? সায়েব জিজ্ঞেস করলে, এই ঘাস ‘কব কাটা?’ উত্তর ‘কাল কাটা’। ‘ক্যালকাটা’, ‘কালকুত্তা’।

খুব পুরোনো, হাজার হাজার বছর আগের কথা নয়। খুব প্রাচীন সভ্যতার বিকাশ ঘটে শক্ত জমিতে। নবদ্বীপ, শান্তিপুর, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ। শাক্ত, বৈষ্ণব। কৃষ্ণচন্দ্র, রামপ্রসাদ। মুর্শিদাবাদে নবাব, বর্ধমানে রাজা। পূর্ববঙ্গ আর এক ব্যাপার। ওদিকে যাচ্ছি না। জ্ঞান হলো। একটা নাম, ঠিকানা পেলুম। না গ্রাম, না শহর, একটা জায়গা। মাইল সাতেক দূরে ইংল্যান্ড। রাজভবন, রাইটার্স, হাইকোর্ট, সায়েবপাড়া, ফোর্ট, ময়দান, অপর নাম গড়ের মাঠ, ল্যাঞ্জে, গোটাকতক দিশি বাজার। সেরা বাজার বড়বাজার। সেখানে জগৎ শেঠদের যাবতীয় কেরামতি। পোস্তা, গঙ্গা, বজরা, ভিস্তি। মাল নামছে, মাল উঠছে। কেউ খেটে মরছে, কেউ খেয়ে। একটু হড়কে উত্তরে কিছুটা নামলেই বিখ্যাত নিমতলা। চিতা জ্বলছে, কলকে ফাটছে। এ-গলি সে-গলিতে ঢুকলেই হাত ধরে টানাটান। রমণীয় রমণীদের এলাকা। পুরো খেমটা নয়, আড়খেমটা—

এস জাদু আমার বাড়ি তোমায় দিব ভালোবাসা।

যে আশায় এসেছ জাদু , পূর্ণ হবে মন আশা।।

আমার নাম হীরে মালিনী, কোড়ে রাঁড়ি না কো স্বামী

ভালোবাসেন রাজনন্দিনী, করি রাজবাটিতে যাওয়া আসা।।

ইনি বিদ্যাসুন্দরের মালিনী। মালা গাঁথেন। অজ্ঞাত এক গীতিকারের লেখায় চিৎপুরের চিত্র—

কলিকাতার বেশ্যাদের লীলা অতি চমৎকার

মায়া বোঝে সাধ্য কার।

হাঠখোলায় আছে যারা বলি তাদের ধারা

কাপড় পরে রাস্তার ধারে নেয় বাহার তারা

আবার ধোপাপাড়া যেমন তেমন দরমাহাটায় চলাভাব।

যেতে নাথের বাগানে ভয় লাগে মনে,

চাইলে পরে তাদের পাশে হাত ধরে টানে,

কেউ বা দিনান্তরে পায় না খেতে, খোঁপা বাঁধার কি বাহার।

এদের কথা এত কেন? কারণ, উত্তর কলকাতার জীবন ও সংস্কৃতির কাঠামোটা বড়ো অদ্ভুত। ‘কসমোপলিট্যান’। কেউ ছিল না, সবাই এসেছে ভাগ্যের সম্বন্ধে। ভাগীরথীর ভাগ নিতে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্মসাহিত্য পরের কথা। আগে পেট। তারপর বঙ্কিম, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্র, মাইকেল, কেশব, শিবনাথ, তর্কালংকার, ন্যায়চঞ্চু, মহামহোপাধ্যায়। এই খেমটা গানের স্থান নাম কলকাতার চরিত্র প্রকাশ করছে। সে কলকাতা উত্তর কলকাতা, সুতানুটি। এলাকার নামগুলি লক্ষ করি হাঠখোলা, ধোপাপাড়া, দরমাহাটা, নাথের বাগান, জোড়াবাগান, মালাপাড়া, মনসাতলার গলি, রামবাগান, রুপোগাছি, সোনাগাছি, মেছোবাজার। ‘জোড়াবাগানে গেলে মিষ্টি কথা বোলে আগে ভোলায়, শেষকালেতে দেয় ফাঁসি গলে’। সব কেড়েকুড়ে নিয়ে কপনি পরিয়ে ছেড়ে দেয়। মালাপাড়া আর এক ভয়ংকর জায়গা। প্রাণ হাতে যেতে হয়।

‘কত খেলা খেলে তারা দিনে রেতেতে

কেউ মেখে খড়ি, হয়গো ছুঁড়ি, আলতা গালে দেয় আবার।’

‘মেছোবাজারের ধরণ কামরূপ কামিখ্যের মতন… আবার সোনাগাছি— যারা থাকে সব কশাই।’

কেন এমন? ওই যে যেমন অতীত, বর্তমানও তো সেরকমই হবে। ‘ডাঙায় বাঘ-শুয়োর, জলে কুমীর কামট বাতাসে মারী বীজ, ঝোপ জঙ্গল খানাখন্দে ভরা সুতানুটি-গোবিন্দপুর-কলকাতা’। ‘আইন-ই-আকবরী’-তে আছে ইংরেজরা গ্রাম তিনটি ইজারা নিয়ে ‘বন কেটে বসত করল, কুঁড়ে ঘর ভেঙে অট্টালিকা বানালো, চারিদিক থেকে ব্যবসায়ী, উমেদাররা এসে জড়ো হতে লাগল।’ তিনটি গ্রাম একত্রিত হয়ে হলো ‘কলকাতা’। পরিচয়? বাণিজ্যনগরী। শেঠ, দে, দাঁ, বসাক, অস্তিত্বরক্ষার লড়াই। সরস্বতী শুকিয়েছে। সপ্তগ্রামের লক্ষ্মী ইংরেজের কলকাতায়। ধর্ম হলো, অর্থ আর কাম। মোক্ষ মানে মৃত্যু। ইংরেজরা অতশত ভাবেনি। ভেবেছিল ‘বেগুন খেত’। যথেচ্ছ মুনাফা শিকারের প্রধান ঘাঁটি। তা আর হলো কই! দেশীয় মানুষরা এই সাদা মানুষদের পছন্দ করে ফেলল। বণিকের হাতে তুলে দিলো রাজদণ্ড। আদুরে গোপাল নন্দদুলাল। পরো বুট, চাপাও হ্যাট, চলো সেরেস্তায়। ইংরেজের ম্যাজিক হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট, রাইটার্স, ফোর্ট, কাছারি, হগ মার্কেট, রেস কোর্স, ট্যাভার্ন এটা কি কালচার! কলকাতা কি বারাণসী! তীর্থস্থান! Oh no! never.

ঠিক তা নয়। বাঙালিদের কিছু কিছু ফিরিঙ্গি হলেও বাঙালি বাঙালিই থেকেছে, থাকবে। এইবার একটি পরিসংখ্যানের দিকে তাকাই। ১৮৩৭ সালে কলকাতার জনসংখ্যা। পুলিস অধিকর্তা ক্যাপ্টেন বার্চ-এর সেনসাস। এই গণনায় নারী এবং পুরুষ উভয়কেই ধরা হয়েছে:

ইংলন্ডজাত— ৩১৩৮

ইন্ডিয়ান— ৪৭৪৬

পর্তুগিজ— ৩১৮১

ফরাসি— ১৬০

চীনা— ৩৬২

আরমানি— ৬৩৬

য়িহুদি— ৩৬০

পশ্চিমা মুসলমান— ১৬৬৭৭

বাঙালি মুসলমান— ৪৫৬৭

পশ্চিমা হিন্দু— ১৭৩৩৩

বাঙালি হিন্দু— ১২৩৩১৮

মোগল— ৫২৭

পারসি— ৪০

আরব— ৩৫১

মগ— ৬৮৩

মান্দ্রাজি— ৫৫

বাঙালি খ্রিস্টান— ৪৯

নীচজাতি— ১৯০৮৪

এইবার ঘরবাড়ির সংখ্যা

পাকাবাড়ি— ১৪৬২৩

খোলার ঘর— ২০৩০৪

খোড়ো ঘর— ৩০৫৬৭

এই পরিসংখ্যান তুলে ধরার উদ্দেশ্য এর থেকে বোঝা যাবে কলকাতা তখন কতটা ফাঁকা। আর বিভিন্ন ধর্ম ও জাতির মানুষের সহ অবস্থান। সকলের কোলকাতা। বিভিন্ন ভাষা, সাজপোশাক, আহার, উৎসব।

উত্তর কলকাতার কোন জায়গাটিকে বলব ‘কেন্দ্র’? অবশ্যই সেই সময়ে। স্থানটি হবে চিৎপুর। সেই চিৎপুরের চিত্র এঁকে রেখে গেছেন হুতোমবাবু। তারই একটু অংশ, অসাধারণ সেই বাণী-চিত্র। ‘শহরে (কালীপ্রসন্ন সিংহ শহর বলেছেন, গ্রাম নয়) সন্ধ্যাসূচক কাঁসর ঘণ্টার শব্দ থামল। সকল পথের সমুদয় আলো জ্বালা হয়েছে। ‘বেলফুল’! ‘বরফ’! ‘মালাই’! চিৎকার শুনা যাচ্ছে। আবগারীর আইন অনুসারে মদের দোকানের সদর দরজা বন্ধ হয়েছে অথচ খদ্দের ফিরছে না। ক্রমে অন্ধকার গাঢাকা হয়ে এল। এ সময় ইংরাজি জুতো, শান্তিপুরে ডুরে উড়ুনি আর সিমলের  ধুতির কল্যাণে রাস্তায় ছোটলোক ভদ্দরলোক আর চেনবার যো নাই।’

এই একটা ড্রেস কোড। হুতোম লিখেছেন ‘পীল ইয়ার ছোকরারা উড়তে শিখেচে।’ পরিবেশটা কী রকম? ‘সৌখিন কুঠিওয়ালা মুখে হাতে জল দিয়ে জলযোগ করে সেতারটি নিয়ে বসেছেন। পাশের ঘরে ছোট ছোট ছেলেরা চিৎকার করে বিদ্দেসাগরের বর্ণপরিচয় পড়ছে। স্যাকরারা দুর্গাপ্রদীপ (বড়প্রদীপ) সামনে নিয়ে রাংঝাল দিবার উপক্রম করছে। রাস্তার ধারের দুই একখানা কাপড়, কাঠকাটরা ও বাসনের দোকান বন্ধ হয়েচে। বোকোড়ের দোকানদার, পোদ্দার ও সোনার বেনেরা তহবিল মিলিয়ে কৈফিয়ত কাটচে। শোভাবাজারে মেচুনিরা প্রদীপ হাতে করে ওঁচা পচা ও লোনা ইলিশ নিয়ে ক্রেতাদের ‘ও গামচা কাঁদে ভালো মাছ নিবি?’ ‘ও খেংরাগুঁপো মিন্‌সে, চার আনা দিবি’ বলে আদর কচ্চে মধ্যে মধ্যে দুই একজন রসিকতা জানাবার জন্যে খেঁচুনি ঘেঁটিয়ে বাপান্ত খাচ্চেন। রেস্তহীন গুলিখোর, গেঁজেল ও মাতালরা লাঠি হাতে করে কানা সেজে ‘অন্ধ ব্রাহ্মণকে কিছু দান করো দাতাগণ’ বলে ভিক্ষা করে মৌতাতের সম্বল কচ্চে।’

উত্তর কলকাতা এক গুলজার নগর। তখন দক্ষিণ কলকাতার জন্ম হয়নি। কলকাতা অবশ্যই প্রাচীন, কিন্তু এর ভূগোল? বহু আগে এই স্থানটিকে বলা হতো কালীক্ষেত্র। বিস্তার? বেহুলা (বেহালা) থেকে দক্ষিণেশ্বর পর্যন্ত বিস্তৃত। কালী থেকেই কলকাতা। বল্লাল সেনের আমলে সব ঠিকঠাক ছিল। তারপরে সুন্দরবন তেড়ে এলো। তারপর আবার কলকাতার পুনর্জন্ম হলো। এইসব নানা মতে আমাদের প্রয়োজন নেই। কলকাতা ইংরেজ ভারতের রাজধানী। প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র। আর এই কলকাতার উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম নেই। আছে কেন্দ্র। যত না স্থায়ী বাসিন্দা, তার চেয়ে বেশি বহিরাগত। হুতোম লিখছেন, ‘অনেক পাড়াগেঁয়ে জমিদার ও রাজারা মধ্যে মধ্যে কলিকাতায় পদার্পণ করিয়া থাকেন। নেজামত আদালতে নম্বরওয়ারী ও মোফেরেষ্কার তদবির কত্তে হলে ভবানীপুরেই বাসার ঠিকানা হয়। কলকাতার হাওয়া পাড়াগাঁয়ের পক্ষে বড়ো গরম।’

ভবানীপুর সেই সময় কলকাতা নয়। দক্ষিণ কলকাতার সীমানায় কলকাতা অপেক্ষা শান্ত, শীতল স্থান। বহিরাগত জমিদাররা এসে থাকেন। হুতোম লিখছেন, ‘পাড়াগেঁয়ে দুই একজন জমিদার প্রায় বারো মাস এখানেই কাটান। দুকুরব্যালা ফেটিং গাড়ি চড়া (ঘোড়ার গাড়ি—ফিটন), পাঁচালি বা চণ্ডীর গানের ছেলেদের মতন চেহারা। মাথায় ক্রেপের চাদর জড়ান, জন দশ-বারো মোসাহেব সঙ্গে বাইজানের ভেড়ুয়ার মতো পোশাক, গলায় মুক্তার মালা দেখলেই চেনা যায় যে, ইনি একজন বনগাঁর শিয়ালরাজা, বুদ্ধিতে কাশ্মীরী গাধার বেহদ্দ বিদ্যার মূর্তিমন মা! বিসর্জন, বারোইয়ারি, খ্যামটা নাচ আর ঝুমুরের প্রধান ভক্ত মধ্যে মধ্যে খুনী মামলার গ্রেপ্তারি ও মহাজনের ডিক্রীর দরুণ গা ঢাকা দেন।’

তবু উত্তরের পাল্লা দক্ষিণের চেয়ে ভারী। সিমুলিয়া অঞ্চলটিকে ঘিরেই ‘রেনেসাঁ’ বা নবজাগরণ। পরপর কিছু নাম বললেই বোঝা যাবে যেখানে অন্ধকার সেইখানেই আলো। প্রথমেই রাজা রামমোহন। ক্রম না মেনেই পরপর বলে যাই শোভাবাজারে রাজা নবকৃষ্ণ দেব বাহাদুর, রাধাকান্ত দেব, দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর। এই ঠাকুর পরিবার যেন এক গ্যালাক্সি। দেবেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথের রবির কিরণ। এলাকা ধরে সাজালে কেমন হয়

জোড়াসাঁকোয় রবীন্দ্রনাথ, সিমুলিয়ায় স্বামী বিবেকানন্দ, শোভাবাজারে নবকৃষ্ণ, রাধাকান্ত দেব, মানিকতলায় রামমোহন, বাদুড়বাগানে বিদ্যাসাগর, সার্কুলারে কেশবচন্দ্র (আমহার্স্ট), বিডন রোডে ছাতুবাবু, লাটুবাবু, বাগবাজারে গিরিশ, বলরাম, সার্কুলারে জগদীশচন্দ্র, জানবাজারে রাসমণি, চিৎপুরে সিংহ কালীপ্রসন্ন, জোড়াবাগানে খেলাৎ ঘোষ। মানিকতলায় শ্রীঅরবিন্দ, সাংবাদিক গিরিশ ঘোষ, জয়নারায়ণ তর্কপঞ্চানন, মাইকেল মধুসূদন, গৌরদাস বসাক, অক্রুর দত্ত, দানবীর মতিলাল শীল, রাজেন্দ্র মল্লিক, যদুলাল মল্লিক, রামদুলাল দেরকার, রামকমল সেন, দুর্গাচরণ লাহা, দ্বারকানাথ মিত্র। নামাবলী তৈরি না করে দুটো বিষয় বলি। একটি হলো ফ্যানি পার্কসের অভিজ্ঞতা। শীতের কলকাতায় তিনি মোহিত। গ্রীষ্মের কলকাতা যেন গরম উনান পালাই পালাই। মশার উৎপাত। এই কলকাতার মানুষ সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য ভালোয় মন্দয় মেশানো ‘সকলে না হইলেও, এ দেশের লোকেদের কাহাকে কাহাকে দেখিতে অতীব সুন্দর। তবে নিষ্প্রাণ ও অলস। আহার ও নিদ্রাই এই দেশের ব্যক্তিগণের জীবনের প্রধান কাজ’।

সব বদলাবে। ডিরোজিও, ডাফ, রামমোহন, দেবেন্দ্র, কেশব, শিবনাথ, বিজয়, বৈষ্ণব, শাক্ত, ব্রাহ্ম, পরমহংস শ্রীরামকৃষ্ণ, গিরিশ, নরেন্দ্র, নিবেদিতা। উত্তর কলকাতার বাজারি, যৌনতা সমাকীর্ণ, লোচ্চা সংস্কৃিত ঠেলা খেতে খেতে চিৎপুর। পাথুরিয়াঘাটার অলিতে গলিতে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবে, থাকতে বাধ্য। উত্তর আর দক্ষিণের মাঝে সায়েবপাড়া। টগবগে আধুনিক জীবনের মডেল বেরোবে সেই কেন্দ্র থেকে।

তাহলে উত্তর বনাম দক্ষিণ। ঘটি বনাম বাঙাল। ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, ইলিশ-চিংড়ি, শুকসারির দ্বন্দ্ব, কবির লড়াই, অ্যান্টনি, গুরু ঠাকুর এসব অতীত। উত্তরে লুঙ্গি গামছা। অঙ্গে সরিষার তৈল, শিরে উগ্রগন্ধী তিল তৈল, বাঁদিপোতার জ্যালজ্যালে গামছা। ধুতি ও ফতুয়া, লুঙ্গি, নাসিকা ঋর্তন, তাম্বুল চর্বণ, গলির গলি তস্য গলি। আদুর নর্দমা, আস্তাকুঁড়, কিনু গোয়ালার গলি, উদোম মানবশিশু, ঘরে ঘরে বিধবা, পোয়াতি, কোলে একটা পেটে একটা, পথে দুটো, উত্তর কলকাতার এই অতীত গৌরবচিত্র যাঁরা অদৃশ্য করে দিয়ে গেছেন তাঁরা এই উত্তরেরই মানুষ। দক্ষিণের অহংকার ছিল এই আমরা শিক্ষিত, আমরা উচ্চ পদাধিকারী, আমাদের চুল ফুরফুরে, তেল মাখি না, সাবান মাখি, পাজামা পাঞ্জাবি পরতে শিখেছি। প্যান্টুল বুট পরে আপিস যাই। বউকে বলি মিসেস। ছাতাকে বলি প্যারাসোল। চশমাকে স্পেক্ট। পোয়াতি বলি না, বলি এক্সপেকটিং। জল খাবার খাই না, ব্রেকফাস্ট করি। ঘুমোই না রেস্ট করি। হরিনাম করি না। আমলাদের ভজনা করি। আর সমর সেন যেমন লিখেছেন অপরের গবাক্ষের দিকে চোরা চাহনি চালান করি— ‘A’ দৃশ্য যদি চোখে পড়ে।

দেশবিভাগ এ দেশের সর্বনাশ। দক্ষিণে এলেন তাঁরা, যাঁদের সঙ্গতি ছিল। মৎস্যাহারী পূর্ববঙ্গের মানুষ মেধাবী। সঙ্গে এনেছেন ঘৃণা-বিদ্বেষ। সেই কারণেই এলগিন রোডের নেতাজি সুভাষ, ভবানীপুরের বাংলার বাঘ আশুতোষ, শ্যামাপ্রসাদ, ফাইটার সাংবাদিক হরিশ চন্দ্র। ভারত সেবাশ্রমের স্বামী প্রণবানন্দ, কবি জীবনানন্দ তেমন আলোচনার বিষয় নয়। একটা অহংকার। ইস্ট বার্লিন, ওয়েস্ট বার্লিন। আমাদের গল্‌ফ, ড্রেস কোডে মোড়া আমাদের ক্লাব। আমাদের পান, ভোজন, অ্যাডাল্ট প্রেম, পাইপ, সিগার, কন্টিনেন্ট ট্যুর, নিজের কথাই মহাকাব্য।

সময় অপেক্ষা করেছিল। এখন সব গেছে। ফ্ল্যাট কালচারে ফ্ল্যাট। বড়বাজারের গ্রিপে কলকাতার জমি জিরেত। পরিবার ভ্যানিশ। পুত্র-কন্যা বিদেশে। সল্টলেকের পর রাজারহাট শান্ত পারিবারিক জীবনে ‘I.T.’-র দাড়া ঢুকিয়ে দিয়েছে। স্বামী একখানে, স্ত্রী একখানে। সন্তানাদি ‘হেডএক’। কন্যা মাকে কামড়ে দিয়েছে—কাউনেসেলিং। কঙ্কাল নিয়ে শুয়ে আছে প্রযুক্তিবিদ। বাইরে হায়না প্রোমোটারের শীতল নিঃশ্বাস। নতুন শহরে সিন্ডিকেট লড়াই। দিশি বারে সেই হুতোমের চিৎপুরের ঘাগি,  লোচ্চারা মেয়েদের নাচাচ্ছে। দেশ বিভাগের পর মেয়েদের জীবন নিয়ে যে-সব নেকড়েরা খেলা করেছিল তাদের বংশবৃদ্ধি হয়েছে।

উত্তর আর দক্ষিণ—আমরা সবাই ধৃতরাষ্ট্র! জীবন নেই আছে অন্ধ অস্তিত্ব। চোখ নেই। মোবাইলের জন্যে দুটো কানই খোলা আছে।

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত